আরাভানি।। অপর্না গাঙ্গুলি
সেদিন আরাভানের বিয়ের দিন ছিল l কত জাঁকজমক হই হুল্লোড় চারিদিকে l গৌরী হিজড়ার মহল্লার লোকজন ভয়ানক উচ্ছসিত l সবথেকে ভালো সিলিক শাড়ি তাদের গুরুমার থেকে এনেছে পরবে বলে l বারো বারো গাছা কাঁচের চুড়ি পরেছে দুই হাত ভরে l কাল সব মেহন্দি হয়ে গেছে হাতে পায়ে, বয়স্কদের চুলেও l রেশমা বিন্দিওয়ালির থেকে চকাচান বিন্দি নিয়েছে সবাই, এক সে বড়কর এক l এ এক মিলনের উত্সব, ঝিকাঝিল্লি পরব এদের l গৌরী দু হাত ভরে টাকা দিয়েছে মেয়েদের l এবারে সংসদে একটা সিট্এর জন্যে লড়বে গৌরী l স্থানীয় পার্টির দাদারা খুব উস্কেছে ওকে, ‘তোর জায়গা এবার পাক্কা গৌরী l এবারে তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা বেড়েছে l রূপান্তরকামী একজন পুলিশ হয়েছে, একজন ছক্কা হয়েছে টি দূরদর্শনের ঘোষিকা আর একজন তো একেবারে কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে বসেছে l’ এসব গৌরী হিজড়ার গর্বের, গৌরবের বিষয় বই কি l স্বীকৃতি মিলছে তবে ওদেরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে l তাই খুশিতে ডগমগ হয়ে মহল্লার মেয়েদের সে ‘সৌ’ ‘সৌ’ টাকা করে দিয়েই ফেলেছে l নাচা গানার বরাত থাকবে তো আবার মিলবে l এই তো দু দিন বাদেই মিনিস্টার সাহাবের ছেলের বৌমার গোদ ভরাই l যাবে সাত আটজন মিলে l সারাদিন ঢোলক, ঝুমরু, নাচা গানা, খানা পিনা, মৌজ মস্তি আর বখশিশ l তার উপর সে গুরু মা বলে কথা l এরাই তো সবাই দেখবে ওকে বুড়াপে মে l বলি, ওদের তো আর নিজের ছেলেপেলে নেই কো l এরাই সম্বল l
খুশিতে হাতে চটাচট তালি মারে গৌরী আম্মা l বলি কি, তোরা তৈরী হলি, আমাদের যেতে হবে এবারে l কম দূর তো না l ছুটে আসে সায়রা, নিশা, হাসিনা l এরা সব আগে স্বপন, রতন, নয়ন, গণেশ ইত্যাদি ছিল l সবাই যে প্রকৃত অর্থে হিজড়া হয়েই জন্মেছিল তা নয় l রূপান্তরকামী হবার সুবাদে অস্ত্রপোচার, ইনজেকশনের পর এই সব নাম এদের l তবে কী এদের, ঠমক চমক, লাস্য, ভ্রু ভঙ্গী, রাজহংসী চলন ! অপ্সরা কিন্নরী কে এরা হারিয়ে দেবে এদের লাস্যে, শারীরিক বিভঙ্গে l তবে অনেকেরই মুখ খুললেই বিপদ l কন্ঠস্বর এখনো বিদ্রুপ করে এদের l রাস্তার লোকেরা টিটকিরি দিতে ভোলে না l অন্তরের কষ্ট লুকিয়ে রাখে সায়রা গৌরীরা l নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি যদি বা কম নেই l কি করবে, ওরাও তো মানুষ, বাঁচবার রসদ চাই, প্রাণশক্তি চাই তো l এক অদ্ভুত সাঙ্কেতিক ভাষায় গৌরীর তথাকথিত ‘আরাভানি’রা কথা বলে l সে ভাষার নাম হিজড়া ফার্সী বা কোটি l
সব্বাই সুন্দর সেজেছে l ওদের দেখাচ্ছে যেন এক রাশ রঙিন প্রজাপতি l গৌরী আম্মা সবার দিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলকে l তারও সাজ শৃঙ্গার শেষ l উঁচু করে চূড়া করে চুল বেঁধেছে, প্রশস্ত কপাল l বয়সে চুলে উঠে গিয়েছে অনেকটা l কপাল জুড়ে লাল বড় সিঁদুর টিপটি, চোখে কাজল, টানা চোখ দুটি ঘোলাটে হয়ে এসেছে বয়সের সাথে সাথে l আর জবাফুলের মত লাল দেখাচ্ছে আজ, কেন কে জানে l পান খাওয়া ফাঁক ফাঁক দাঁতে মধুর হাসি লেগে আছে l সবার দিকে তাকিয়ে প্রছন্ন স্নেহের হাসি হাসলো গৌরী আর তারপরই খোঁজ পড়ল l ‘আরে নীল পরী কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো ?’ সব্বাই একসাথেই প্রায় বলে উঠলো, ‘নীল পরী যাবে না বলেছে আম্মা, ওর তবিয়ত ঠিক সা নাহীন l’
‘অ মা একী অলুক্ষুনে কথা, আরাভানের পরব আর নীল পরী যাবে না সেখানে ! তাও কি হয়? কোথায় সে ?’
স্মৃতি হাতড়ে গৌরী আম্মা অচানক ফিরে গেল সেই ভোরে যেদিন, বাড়ির কাছের বাসস্টপে চায়ের দুকানটায় গৌরী চা খেতে গিয়েছিল l তখন রামাপ্পা ওঠেনি ঘুম থেকে l রামাপ্পা তার নাগর, তৃতীয় লিঙ্গ কিন্তু সে পুরুষ হয়ে থাকতেই পছন্দ করত l গৌরীর পুরুষ l ঢোলক বাজাত ওর দলে l ওই উঠে চা করে খাওয়াত রোজ গৌরী কে l বাস স্টপে একটি সুকোমল চেহারার ছোট্ট ছেলেকে কাঁদতে দেখে গৌরী l ওর মাতৃহৃদয় স্নেহার্দ্র হয় l
কে রে তুই?
আমি স্বপন l
কে স্বপন, ঘর কোথায় ? এখেনে বসে কাঁদছিস কেনই বা l
আমার ঘর অনেক দূর, মেয়ে হতে চাই বলে বাপ মা তাড়িয়ে দিল l
হায় হায় মেঘ না চাইতেই জল, স্বপন কে চা বিস্কুট খাইয়ে বুকে তুলে নেয় গৌরী l
ওরে আজ থেকে তুই আমার মেয়ে, আমি তোর মা আর রামাপ্পা তোর বাবা l
তোকে একটা ভালো নাম দিলাম, নীল পরী l
সেই থেকে শুরু ওই নীল পরীর জীবন বৃত্তান্ত গৌরী আম্মার আশ্রমে l
মনে আছে, কি ভাবে নীল পরীর লিঙ্গছেদ বা ‘নির্বান’ করেছিল গৌরী আম্মা l
২১ দিন কত যত্নে রাখা হয়েছিল নীল পরী কে l খাবার অসুধ, যতক্ষণ
না ক্ষত শুকিয়ে যায় l আর কি কান্না নীল পরীর l বুক দিয়ে আগলিয়ে ছিল তাকে গৌরী l
জন্ম হলো নীল পরী হিজড়ার l
আর এখন কি না সে এত বড় হয়ে উঠেছে! এত বড় যে গৌরীকে অমান্য করে এক ফুটা
পয়সার মরদের জন্য l
কি কুক্ষণে ওকে অটো ডাকতে পাঠাত গৌরী l নীল পরী জুটে গেল সেই অটোওয়ালা
লড়কার সাথে l জওয়ান মরদ, তা ওই নপুংসক, থিরুনাঙ্গাই ওকে দেখে এক্কেবারে ভুলেই গেল l
ভুলে গেল বলে ভুলে গেল ! কস্তুরীর সুঘ্রান পাওয়া হরিনী যেমন প্রেমোন্মাদে দাপিয়ে বেড়ায় ইতিউতি,
সব ভুলে, এও যেন তাই l আরে বাপ, আমাদেরও তো মরদ ছিল, ভাবে গৌরী, তা বলে আমরা এমন
পাগলপন করেছি কি? আমরা তো সব ধান্দা, কামাই ছেড়ে ছুড়ে মরদ নিয়ে পড়ে থাকিনি বাপ l
গৌরী হাতে জোর জোর তালি বজায় আর উষ্মা প্রদর্শন করে l বুড়ো বাপ্পা ওকে শান্ত করে, জল এনে দেয় l
তা সত্যি সংসার বটে নীল পরীর l এক টেরে একটা ছোট ঘরকে সে এমন গুছিয়ে রেখেছে, বলার নয় l সর্বত্র লক্ষী বিরাজ করে l ওর অন্তরের নারী সত্বার পূর্ণরূপ দেখা যায় এই ঘরে ঢুকলেই l
গৌরীর ধান্দা ওকে ঘিরেই চলে l খুব ভালো নাচা গানা জানে পরী l ব্যবহার খুব ভালো, চট করে রেগে ওঠেনা গৌরীর মত l খদ্দের যদি বলে আজ না পরে এসো, ঠিক পরের বার, তার পরের বার গিয়ে টাকা যোগাড় করে আনে l আর সে যদি এইভাবে ক্ষেপে যায় তাহলে চলে কি করে l ওর না হয় অটো ওয়ালার পয়সায় চলে যাবে l বেচারী গৌরী আর তার দল কি ভুখা মরবে?
এই সব মনে করলে তুষের আগুনের মত গৌরী আম্মার রাগ ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে l
এদিকে নীল পরীর হয়েছে জ্বালা l বারো বছর সে ঘর করে সঞ্জীব অটোওয়ালার সাথে l সংসার বন্ধুজন সঞ্জীবকে ত্যাগ দিয়েছে l তবু নীল পরীকে ছেড়ে যায়নি সঞ্জীব l তবু কেন মাঝে মাঝে নীল পরী ভারী সন্দেহ করে সঞ্জীবকে l ওই বুঝি কোনো মেয়ের সাথে ভেগে গেল সে, ওই বুঝি কোনো নতুন হিজড়ার প্রেমে পড়ল সঞ্জীব l কাল অমনি এক ঘটনা l সঞ্জীবের ফোনে অচেনা নম্বর থেকে আসতে দেখে তুলকালাম করলে নীল পরী l মারতে মারতে রাগে অন্ধ হয়ে শেষে বের করে দিলে ঘর থেকে l লোকটা, না খাওয়া দাওয়া, চলে গেল কোথায় অত রাতে আর এখন দুপুর বারোটা বেজে গেলেও আর এলো না l তখন নীল পরীর টনক নড়ল l এর পর সে আরাভানের পরবে যাবে কি করে?
খুঁজতে বেরোবে লোকটাকে ? আগে আগে যতবার বের করে দিয়েছে ওকে, ঠিক এসেছে ভোরবেলাতে l এসেই পায়ে ধরে বলেছে ‘ভুল হয়ে গেছে পরী, এবারটা মাপ করে দে, জমিয়ে আদা মেরে এক কাপ চা কর দিকি, খেয়ে কাজে বেরই l’ আর আজ এত বেলা হয়ে গেল এলো না সে l
তবু কান্নাকাটি করতে করতেই গৌরী আম্মা নিয়ে চলল নীল পরীকে ; সাজিয়ে দিল নিজের হাতে l ভারী ভালো দেখতে লাগছে তাকে l সবাই একমত l ঝিকিয়ে উঠেছে ওর নথনিয়া, সঞ্জীবের দেওয়া l সেদিন সঞ্জীবকেও একটা রোদ চশমা কিনে দিয়েছিল নীল পরী, সালমান খানের মত l কি দেখাচ্ছিল সঞ্জীবকে, আবার আনমনা হলো নীল পরী l ‘কি সুহাগী লাগছে তোকে পরী, ও সঞ্জীব ঠিক ফিরে আসবে দেখিস l কাল যখন ফিরবি, তোর কাছে আবার এসে চা চাইবে দেখিস l’ তাই যেন হয় গো, বিড়বিড়ায় নীল পরী l
আরাভানের পরবে অনেক নাচা গানা হলো l আরাভান হিজড়াদের দেবতা l তাঁর উপর পার্বতীর অভিশাপ ছিল যে সে যদি কাউকে বিবাহ করে তবে পরের দিন সেই মেয়ে বিধবা হবেই l এদিকে আরাভানের মা বাপ নিরুপায় হয়ে প্রার্থনা করলেন পুত্রবধুর জন্যে, যাকে বিবাহ করতে পারে আরাভান l পুত্রের বিবাহ হবে না এই কথা মেনে নিতে পারছিলেন না তারা l এমন সময় কৃষ্ণ মেয়ে সেজে এসে বিবাহ করলেন অরাভানকে l তার থেকেই জন্ম হিজরাদের, অর্ধ নারীশ্বর বা পুরুষ প্রকৃতির মিলন যাকে বলে l কিন্তু তা সত্বেও পরের দিনই মৃত্যু হলো আরাভানের l তাই এই উত্সবের প্রথম দিন যেমন আনন্দের, সব হিজড়া সুহাগন সেজে বিয়ে করে আরাভান কে l পরের দিন সবাই সাদা শাড়ি পড়ে, বিধবার বেশে ‘হা আরাভান জো আরাভান’ করে বুকে মেরে, কেঁদে কেটে তার মৃত্যুকে সম্মান জানায় l সব করলো নীল পরী যন্ত্রচালিত পুতুলের মত l সাদা শাড়ি পরবার সময়ে এবার কোনো অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠলো নীল পরীর l ফেরবার সময়ে সারা রাস্তা গৌরী আম্মা, বাপ্পা, আর সবাই তাকে কত্ত যে বোঝালো l কিন্তু গ্রিক ট্র্যাজেডির ‘নেমেসিস’ এর মত একটা কালো মেঘ যেন ঝুলে রইলো নীল পরীর মাথার উপর l ওর অন্তর্লীনা নারীমনটি কি এক অজানা আশঙ্কাতে বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো শুধু l
ডেরায় পৌঁছতে না পৌঁছতে, যা ভেবেছিল ঠিক তাই l পুলিশ, লোকজন ছয়লাপ l সঞ্জীব আত্মঘাতী হয়েছে l লিখে গেছে, নিজের অটোর কাঁচের জানালায় l ‘নীল পরী, আমি কাউকে ভালোবাসিনি, তোকেই শুধু, তোকেই ভালোবেসেছিলাম রে l পরের জন্মে আবার… l’ নীল পরী কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল l তেমন কিছু না পেয়ে ছেড়েও দিয়েছিল l কে যেন বলেছিল অনেক ধার ছিল বাজারে তাই সঞ্জীব ওই রাস্তা দেখেছিল l
পরী মনে মনে জানে, ঠিক কেন l এই প্রথম সেদিন সঞ্জীব, সেই রাতে পরীকে ঠিক ঐভাবে গাল দিয়েছিল l বলেছিল,
‘ছক্কা, ছেনাল ! মেয়েমানুষ সাজার সখ হয়েছে তোর ?
তোর হাতে ভাত খাই, এই না কত …’
থু : l
এক রাশ থু থু এসে পড়েছিল নীল পরীর মুখে l
নীরবে সে সব সহ্য করে ও আবার পথ দেখেছিল সঞ্জীবের l
হয়ত সেইজন্যেই … সঞ্জীব আর মুখ দেখাতে পারেনি নীল পরীকে l
ট্রেনের ধাক্কায় তার মুখ মাথা নাকি ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছিল, ওরা বলে l
অপর্ণা গাঙ্গুলী
ইংরিজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে বি.এড পাশ করা অপর্ণা অতঃপর সিম্বায়োসিস ও এপটেক থেকে যথাক্রমে ম্যানেজমেন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পেশায় কপি এডিটর অপর্ণা বর্তমানে একটি আমেরিকান সংস্থার অনলাইন ইংলিশ ট্রেনার, এডুকেশনাল রিসার্চার ও স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে কর্মরতা।
** প্রকাশিত – রেওয়া পত্রিকা, পুজো সংখ্যা, ২০১৭ l