গুচ্ছ কবিতা।। বিভাস সাহা

 ডুয়েল

দশটি বসন্ত আগে আমার জন্মের ঠিক আগে মাকে বাজি রেখে বাবা আর মায়ের প্রেমিক ডুয়েল লড়েছিল। কিন্তু বেইমান ছাড়া কারো হাতে বন্দুক বশ মানে না, তাই বাবার বুলেট গিয়ে লেগেছিল দেওয়ালে, ঐ কুলুঙ্গির মাথায়। মায়ের অন্তরে তখন এক নিষ্ঠুর আনন্দ শিহরন, সাত মাসের ভ্রূণ আমি কেঁপে উঠেছিলাম।

মায়ের প্রেমিক তখন বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে, একটা বুলেট বিষ ঢালার জন্যে তৈরি। তখন শুধু অপেক্ষা … … তখন প্রতিটি মুহূর্ত অনন্ত প্রহরের মত দীর্ঘ …। প্রতিটি নিঃশ্বাস মৃত্যুর কাছে হাত পাতা।  হঠাৎ মায়ের প্রেমিক বন্দুক নামায়, তারপর “আজ থাক, আর এক দিন আসবো” — এই  বলে রাজপুত্রের মত ঘোড়ায় চেপে পাহাড় পেরিয়ে দূরে জামরুলের অরণ্যে হারিয়ে যায়।

আরেক দিন সে আসবে – এই আতঙ্কে বাবার বিকেলগুলো তামাটে হয়ে যেত। নিশুতি রাতের মৈথুনে একটা বুলেট এসে তাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিত। বাঁচা ও মরার মধ্যে ছিল শুধু একটা তেঁতুল কাঠের দরজা। এমন দুঃস্বপ্নের রাতে বাবা একদিন জলে ঝাঁপ দিয়ে খালাসিদ্বীপের চোরাবালি পার হয়ে জাহাজ ও সমুদ্রের কাছে পৌঁছে যায়। আর পাহাড় থেকে নেমে এসে মায়ের প্রেমিক ছাউনি ফেলে আমাদের ঘরের সামনেই। দেখলাম তার কপালে রয়েছে আমারই মত এক অশুভ জড়ুল।

আমি জানি, মায়ের এক একদিনের ব্যভিচার বাবার এক এক মাসের আয়ু কিনে বাড়ি ফেরে। শুধু বাবা যদি জানতো ! কবে যে বাবা ফিরবে, মায়ের জন্যে নিয়ে আসবে ময়ূরকন্ঠি  শাড়ি, আর আমার জন্যে একটা লাইফ জ্যাকেট।

সন্ধেতারা

সন্ধেতারার আকাশে ঈশ্বরের শেষ করুণা যখন জলরঙের মত ছেয়ে থাকে, বোষ্টমদের অন্ধ মেয়েটি তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালে, শাঁখ বাজায়। আলোহীন তার অনন্ত অন্ধকারের পৃথিবীতে আগুনের কোন স্মৃতি নেই, সে শুধু দয়া আর লোভ এই দুটি রং চিনতে শিখেছে।

 

এমনই অন্ধকারের রাতে মেয়েটি শুয়ে শুয়ে ভেবেছিল একটা কবিতার কথা। পাপড়ির মত ব্রেল হরফগুলি তার আঙুলে তখনো লেগে। তাদের মলিন শিরায় এক ঝরনার স্মৃতি ছিল। দুপুর দহনে বকুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ডাকপিওনকে সে যখন জল দিয়েছিল, তখন কি সে নিজেই ঝরনা হয়ে যায়নি?  সেই পুরুষ আঙুল থেকে চুঁইয়ে  পড়া শিশিরবিন্দু ছুঁয়ে সে কি কেঁপে ওঠেনি? সারারাত সে এই সব ভেবেছিল।

ভালোবাসা আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে তাকে স্পর্শ করে গেছে। সে এখন মৃত্যুর কপালে হাত রেখে বলতে পারে, আমিও তোমার মত ছায়াময়, অনন্ত, অলৌকিক।

ফেরা

আশ্চর্য আগুনের কাছে  নিঃস্ব হয়ে  দিন ফেরে গোধূলির কাছে ।

নীলিমার মসলিনে কে সেজেছে আজ, অবেলায় ভাঙনের গান !

জল চেনে  শোক ও দুঃখের ভেলা, অনন্তের আনাচে কানাচে

আমাদের ছন্নছাড়া সংসার, জমা করা কত অপমান ।

শীর্ণ সিঁথি কার চেয়ে থাকে দিগন্তের মতো, যে গেছে তারই অপেক্ষায়

‘সাবধানে যেও’ বলেছিল সে… শুধু ওইটুকু বলা যায়।

 

পুরনো কাগজ

পুরনো খবরের কাগজ বই খাতা

সব ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে ঘরটা বেশ খালি খালি করলে,

ওখানে রোদ্দুর ঢুকে ইচ্ছামত খেলা করবে এবার।

কিন্তু একটা জীবন তো চলে গেল

ওসবের মধ্যে আমার ভবিষ্যত  বার্ধক্য লুকিয়ে রেখেছিলাম –

অর্থহীন স্মৃতিচারণ, অপ্রকাশিত কবিতার খাতা

অনাহারের দিনগুলিতে বাজার না করা ফর্দ

আর বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার সময়

মাকে লেখা বাবার একটা নিষ্ঠুর চিঠি ।

প্রেমিকা

আমার দুটি প্রেমিকা আছে

একটি মিথ্যে, একটি সত্যি

মাঝে মাঝেই তারা ঠিকানা বদল করে

আমি ভুল বাড়িতে গিয়ে ফিরে আসি।

 

এই দুই প্রেমিকারও প্রেমিক আছে

আমি তাদের ভয় খাই।

তারা রাত্রে আমার ঘরের সামনে এসে

গুলি ছোঁড়া প্র্যাকটিস করে।

না, না, ভাড়াটে আততায়ীর পকেট পিস্তল নয়

সাবেকি জমিদারদের লম্বা নলওলা বন্দুক

পাখি মারার জন্যে নৃশংস

একবার ট্রিগার টানার পরেই নিষ্ঠুর উল্লাস, পিকনিক —

একটাই গুলি, আমার জন্যে একটাই যথেষ্ট।

 

আমার প্রেমিকারা জানে বন্দুকের ব্যাপারটা

অভয় দিয়ে বলে, এবার পুজোয় বুলেটপ্রুফ জামা কিনে দেব।

আমি অষ্টমীতে সত্যি প্রেমিকার মিথ্যে জামা পরি,

আর নবমীতে মিথ্যে প্রেমিকার সত্যি জামা।

 

ওইসব প্রেমিকদেরও মিথ্যে প্রেমিকা আছে

তাদের সত্যি প্রেমিকেরা একজনকে খুঁজছে।

তারা আমাকে সমবেদনা জানায়,

এবারের শীতটা সাবধানে থাকবেন।

 

ক্রমশ আমার ঘরের সামনে

বন্দুকবাজের সংখ্যা বাড়তে থাকে,

আমি তাদের রিহার্সালে গিয়ে দাঁড়াই

মাঝে মধ্যে হাততালি দিই, বেশ লাগে।

 

ওরা চলে গেলে, হেমন্তের মাঠ থেকে

সত্যি বুলেটগুলো কুড়িয়ে নিই।

আমার তো একটা নয়, অনেকগুলি দরকার।

 

বিভাস সাহার জন্ম ও বড় হওয়া বর্ধমানে, এবং পেশায় তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক। দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে রয়েছেন। পনের বছর হল ইংল্যান্ডে কর্মরত ও অধিবাসী। দীর্ঘ বিরতির পর কবিতা লেখায় ফিরেছেন। দুটি কবিতার বই রয়েছে, —  মাধবীলতার মধুমাস এবং ব্যাকপ্যাকে এনেছি শ্রাবণ

(আলোবাতাস প্রকাশনী ও  দক্ষিণের বারান্দা প্রকাশনী, বর্ধমান)।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page