প্রয়াত হাঁদা-ভোঁদা-বাঁটুল স্রষ্টা ‘পদ্মশ্রী’ নারায়ণ দেবনাথ
তৃতীয়পক্ষ ওয়েব- বাংলা কমিকসের দুনিয়ায় ইন্দ্রপতন। প্রয়াত নারায়ণ দেবনাথ। ২৫ দিনের লড়াই হল শেষ! আজ মিন্টো পার্কের একটি নার্সিংহোমে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে প্রয়াত হন তিনি। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন ৯৭ পার করা শিল্পী-সাহিত্যিক। হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টের স্রষ্টাকে সুস্থ করতে কোনও ত্রুটি রাখেননি চিকিৎসকরা। কিন্তু বয়সের কারণে কিছুটা জটিলতা তৈরি হচ্ছিলই। আপামর বাঙালি হারাল তাদের প্রিয় বাঁটুল-স্রষ্টাকে।
হাওড়ার শিবপুরের স্বর্ণকার পরিবারে জন্ম নারায়ণ দেবনাথের। ছেলেবেলা থেকেই বাড়িতে দেখেছেন বাবা-কাকাকে সোনার উপর আল্পনা ফুটিয়ে তুলতে। সেইসব দেখে আপন মনে তাঁদের কাগজে তিনিও ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন গয়নার নানা নকশা। হয়ত তিনিও হতেন এক ভাল গয়নার কারিগর। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হঠাৎই খেয়াল চাপে তিনি আঁকবেন। ভর্তি হয়ে গেলেন আর্ট কলেজে। পাঁচ বছরের ডিগ্রি কোর্সের শেষ বছর খেয়াল খুশিতে ছেড়ে দেন আঁকা শেখার ক্লাস। কাজ শুরু করেন একটি প্রিন্টিং প্রেসে। সেখান থেকেই দেব সাহিত্য কুটিরের হাত ধরে প্রবেশ করেন বাংলার প্রকাশনা এবং কার্টুন জগতে। তবে শুধু কি কার্টুন! অগুনতি বইয়ের প্রচ্ছদেও বেরিয়েছে তার রং-তুলি থেকে।
১৯৫০-এ শুকতারায় হাঁদা ভোঁদার নামে একটি কমিকস বের হতো অনিয়মিত ভাবে। সেই কমিকসে ‘ছবি ও কথা’র জায়গায় থাকত একটি বোলতার ছবি। ওই বোলতাটি আসলে তখনকার দিনের প্রখ্যাত শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিগনেচার। ১৯৬২ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের উদ্যোগে নারায়ণবাবু হাঁদা ভোঁদাকে পরিমার্জন ও সংশোধন করে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। ২০১২ সালে ৫০ বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল হাঁদা ভোঁদার। নারায়ণবাবুর সময় থেকে হিসেব করলে হাঁদা ভোঁদার বর্তমান বয়স ৫৯ বছর। অন্যদিকে ১৯৬৫ সালে আত্মপ্রকাশ করা বাঁটুল ২০২১ সালে ৫৬ বছরে পা রেখেছে। নন্টে ফন্টেও ১৯৬৯ সালে শুরু হয়ে চলতি বছরে পা রেখেছে ৫২ বছরে।
এরপর মনোরঞ্জনের হাজারও সম্ভার এসে দখল করেছে শিশু মন। কিন্তু হাঁদা ভোঁদার দুষ্টুমি বা বাঁটুলের অতিমানবিক জনপ্রিয়তায় থাবা বসাতে পারেনি এতটুকুও। হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল ছাড়াও নারায়ণবাবুর তৈরি মুখ্য কমিক চরিত্রগুলি হল নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়, ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ, ডানপিঠে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, কৌশিক রায়, পেটুক মাস্টার বটুকলাল, শুঁটকি আর মুটকি।
শরীরে বয়স থাবা বসালেও মনে কিন্তু জং ধরেনি তাঁর। কেউ দেখা করতে গেলে খুশি হতেন, মন ভাল থাকলে মেতে উঠতেন গল্পে। দীর্ঘদিন শিশুমনের পাশাপাশি বড়দের মন দখল করে থাকলেও, বাংলার সাহিত্য জগতের অনেকেই সাহিত্যিক হিসেবে তাকে মান্যতা দিতে চাননি। ২০১৩-তে তাঁর ঝুলিতে আসে সাহিত্য অকাদেমির মতো পুরস্কার। এমনকী দেশের অন্যতম সেরা পুরস্কার পদ্মশ্রীও পান জীবনের শেষ প্রান্তে।
শরীরে বার্ধ্যকের কারণে কলম থেমেছে বহু আগেই। এবার তাঁর মনও থেমে গেল। থেমে গেলেন তিনিও। হাঁদাভোঁদা বাঁটুলের সেঞ্চুরি করা হল না আর। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৩ রানে আউট হয়ে যেতে হল পদ্মশ্রী নারায়ণ দেবনাথকে। তবে তিনি তো অপরাজিত মানুষের মনে। শিশু মন হোক কি পরিণত মানুষের মন, সেখানে একের পর এক সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরি করে অপরাজিত থেকে যাবেন তিনি।