নতুন বছর এবং তার ইতিহাস
২০২১ সাল তো শেষ হয়েই গেলো, এসে গেলো ২০২২। রাত ১২ টা বাজার পর থেকেই তো সবাই সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাবে, সবাই একসঙ্গে আনন্দ করবে। সারা বিশ্বই তাই করবে, আতশবাজিও ফোটানো হবে অনেক! এই যে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে বর্ষবরণ কীভাবে শুরু হল, জানো? আজ আমরা এই বর্ষবরণের বিস্তারিত জেনে নেই।
বলা হয়, যে সব উৎসব পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো উৎসব হল এই বর্ষবরণ উৎসব। কবে শুরু হল এই উৎসব? এই উৎসব পালন করা শুরু হয় প্রায় ৪ হাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২ হাজার অব্দে। সে সময় মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। বর্তমান ইরাককে প্রাচীনকালে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টা আলাদা আলাদা ভাগ আছে– সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যবিলনীয় সভ্যতা, অ্যাসরীয় সভ্যতা ও ক্যালডীয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যবিলনীয় সভ্যতায়। সেসময় বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালন করা হতো বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখেই পালন করা হতো না। তখন নিউ ইয়ার পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকাল এলে শীতকালের রুক্ষতা ঝেড়ে প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজগোজ করতে শুরু করে, গাছে গাছে নতুন করে পাতা গজাতে থাকে, ফুলের কলিরা ফুটতে শুরু করে, পাখিরা ডানা ঝাপটে গান গাইতে শুরু করে। আর প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকে তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিল। অবশ্য তারা তখন চাঁদ দেখে বছর গণনা করত। তাই উৎসব শুরু হতো চাঁদ দেখে। আমরা যেমন এখন ঈদের চাঁদ দেখি, ওরাও কিন্তু তখন সেভাবেই বর্ষবরণের চাঁদ দেখত। তারপর যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠত, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব। চলত টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের অবশ্য আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিল।
ব্যবিলনীয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন করত রোমানরাও। ওরা আবার এক কাঠি উপরেই ছিল। তৈরি করে ফেলেছিল ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারও অবশ্য ওরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিল। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওদের নববর্ষ ছিলো ১ মার্চ। তবে প্রথম দিকে ওদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা। ছিল না জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরও। ওদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিল না। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে ওরা মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করত। চাঁদ ওঠার সময়কে বল হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলত ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। পরে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের উন্নয়ন করেন। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। ভাবছো, আর ১০ দিন তাহলে গেল কোথায়? আসলে তারা তো তখন চাঁদকে দিয়ে বছরের হিসেব করত। আর আমরা এখন বছরের যে হিসাব করি, সেটা তো সূর্য দিয়ে হিসাব। চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিল। ফলে চাষীরাও পড়লো সমস্যায়। এই সমস্যার সমাধান করলেন হোঞ্চাস হেডাস নামের এক রোমান। তিনি করলেন কি, ফেব্রুয়ারির পরে আরেকটা অতিরিক্ত মাসই ঢুকিয়ে দিলেন। তখন সিজার দেখলেন, অবস্থা তো বড় বেগতিক। পরে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দেখলেন, এত ঝামেলা পাকানোর তো কিছু নেই! চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বছর হয়ে গেলো ৩৬৫ দিনের। তবে অনেকে বলে, তিনি সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়; ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন!
এই ক্যালেন্ডার তৈরি করা নিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে কত রাজ্যের ঝামেলা হয়েছিল। আর তাই সে সময় কবে যে নতুন বছর শুরু হবে, সেটা ঠিকই করা যাচ্ছিল না। একেক সময় একেক জায়গায় একেক দিন নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালিত হত। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ঠিক করা হয়েছিল বর্ষবরণ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে মানাই হচ্ছিল না। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে ঢোকান, তিনি ঠিক করে দেন, জানুয়ারির ১ তারিখ হল বছরের প্রথম দিন। ওইদিনই হবে বর্ষবরণ। কিন্তু সে কথাও মানা হল না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগল। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন– মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেইদিনই হবে। এইবার কাজ হল। বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এল জানুয়ারিতে।
সবার ধারণা রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার শুরু করে গেছে, আমরা এখনও সেইদিনেই বর্ষবরণ উৎসব করছি! আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যদিও আমরা জানুয়ারির ১ তারিখেই উৎসব করছি, দিনটা কিন্তু এক নয়। সিজারের ক্যালেন্ডারেও সমস্যা ছিল। সেই সমস্যা দূর করেন একজন ডাক্তার। নাম তার অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস। কিন্তু ইতিহাসে তার নাম সেভাবে কেউ জানে না। কারণ, ক্যালেন্ডারটির কথা সবাইকে জানান একজন পোপ। সবাই তাকেই চেনে। তিনি পোপ ত্রয়োদশ (১৩তম) গ্রেগরি। পোপ গ্রেগরির নাম অনুসারে ক্যালেন্ডারটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আমরা এটিই ব্যবহার করি। এই ক্যালেন্ডারটি তৈরি করা হয় মাত্র ৪৩২ বছর আগে, ১৫৮২ সালে। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সকল জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে আগে যারা নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো, তারাও এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করতে শুরু করে দিল। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো ১ জানুয়ারির বর্ষবরণ উৎসব। আর এখন তো পুরো পৃথিবী জুড়েই সবাই নিজস্ব বর্ষবরণের পাশাপাশি পালন করে ইংরেজি নববর্ষ, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’। আমরাও পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি প্রতিবছরই ১ জানুয়ারিতেও বর্ষবরণ করি।