এক পানি-পাঁড়ে ও একটি ডেথ সার্টিফিকেট।। আবেশ কুমার দাস

সিনেমা নিয়ে একটু-আধটু চর্চা করা বাঙালিমাত্রেই ওয়াকিবহাল ঋত্বিক ঘটকের সেই ‘কুখ্যাত’ উক্তিটি বিষয়ে। আসলে শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের শক্তি যে অতিক্রম করে যায় পূর্বসূরি সব ক’টি মাধ্যমকেই তারই পরোক্ষ স্বীকৃক্তি ছিল মন্তব্যটি। আর কে না জানে শক্তি সবক্ষেত্রেই বয়ে আনে কিছু বাড়তি দায়িত্বের বোঝা। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জবানিতে বিশুদ্ধ বাংলা সংলাপ বসাতে দু’বার ভাবতে হয়নি বঙ্কিমচন্দ্রকে। পর্তুগিজ ভ্যাগান্বেষী অ্যালভারেজের বেলাতেও একই পথে হাঁটতে পেরেছেন বিভূতিভূষণ। যদিও এই আওরঙ্গজেব বা অ্যালভারেজের মতো লোকগুলির সঙ্গে সম্ভবত বাংলা ভাষার একটি শব্দেরও আজীবনে পরিচয় ঘটেনি। এখানে ‘সম্ভবত’ শব্দটি সংযুক্ত করলাম এই কারণেই কেননা অধীনস্থ কোনও বাঙালি মনসবদারের কাছ থেকে আওরঙ্গজেব বা শঙ্করের কাছ থেকে অ্যালভারেজ হয়তো দু’-একটি বাংলা শব্দ শিখে থাকতেও পারেন নিছক কৌতূহলের বশেই। কিন্তু তাহলেও স্রেফ তার ভিত্তিতে ‘রাজসিংহ’ বা ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের অত সংলাপ উগরে যাওয়া যায় না। কিন্তু বড়জোর ‘লোকটি যা বলছিল তার বাংলা করলে দাঁড়ায়’ কথা ক’টি লিখে দিলেই এসব ক্ষেত্রে দায় মিটে যায় সাহিত্যিকের। কিন্তু স্রেফ টার্গেট অডিয়েন্সের (‘অডিয়েন্স’ অর্থে এখানে পাঠক, দর্শক এবং শ্রোতা সবাইকেই বিবেচনা করতে হবে) অভিজ্ঞতার চরিত্রটুকু ‘পড়া’ থেকে ‘দেখা-শোনা’য় বদলে যেতেই আর এত সহজে ছাড় পাওয়ার পথ থাকে না সিরিয়াস চলচ্চিত্রনির্মাতার।

আজকের পরিণত সিনে-দর্শক বরং খেয়াল রাখবেন এমনকি শ্রেণিভেদে বক্তাচরিত্রের সংলাপের ‘অ্যাকসেন্ট’ বা উচ্চারণরীতির তারতম্যের দিকেও। সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র উপসংহারে মেঘ সরে যাওয়া ম্যালের প্রেক্ষাপটে সহসা দু’ কলি গুনগুনিয়ে ওঠা সেই নেপালি কিশোরটির গানের কথাগুলির শব্দার্থ অবশ্যই বোধগম্য হয় না হাতিবাগান-ভবানীপুরের সাধারণ বাঙালি দর্শকের। কিন্তু উক্ত পটভূমিতে ওই নেপালি সুরটুকুর ব্যবহারই আখেরে বাস্তবানুগ। মামুলি বাংলা ছবির ফরমুলায় একটি রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহারই বরং উক্ত পরিস্থিতিতে হয়ে দাঁড়াত চরম আরোপিত। গানের কথা না বুঝলেও ওয়ার্ডসওয়ার্থ সাহেবের আদলে ‘দ্য সলিটারি রিপার’-এর সুরে কল্পনাপ্রবণ হতে এক্ষেত্রে বাধা ছিল না আপামর বাঙালি দর্শকের।

          একটু ভাবা যাক, পর্দায় কতটা অবাস্তব লাগতে পারত নেপালি কিশোরটির লিপে ওই প্রেক্ষাপটে একটি বাংলা গানের ব্যবহার। এখানেই বাড়তি দায়িত্ব একজন সৎ চলচ্চিত্রকারের। সাহিত্যের কাহিনিকে আশ্রয় করলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি বরাবর তাঁকে বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে হবে হয়তো এমনকি মূল কাহিনিকারকেও অতিক্রম করে। এই যুক্তি থেকেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনির প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করেও নিছক উপযুক্ত লোকেশনের অভাববোধে আর শুটিং-এ উদ্যোগী হননি সত্যজিৎ রায় (যে কাহিনি অবলম্বনে পরবর্তীকালে ‘নিশিযাপন’ ছবিটি নির্মাণ করেন সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ রায়)। এবং অবিকল এই যুক্তি থেকেই প্রয়াত কথাসাহিত্যিক দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল বাংলা ছোটগল্প ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-কে গল্পকারপুত্র নবীন চলচ্চিত্রপ্রণেতা রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় রুপোলি পর্দায় চিত্রিত করলেন আপাদমস্তক কুরমালি ভাষায়। রামপুরহাট (বাস্তবের রামপুরহাট নয়, পুরুলিয়ার পাহাড়নিসর্গের প্রেক্ষাপটে এ এক অন্যতর কাল্পনিক জনপদ) গ্রামীণ হাসপাতালের দেওয়ালে স্বভাবতই সরকারি ভাষা বাংলায় লিখিত কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির নির্দেশাবলী পর্দায় এলেও ছবির চরিত্ররা সারাক্ষণই কথাবার্তা বলেছে কুরমালি ভাষায়। আসলে ঝাড়খণ্ড-পুরুলিয়া সংলগ্ন যে অঞ্চলের পটভূমিকায় ঘটমানতা এই ছবির কাহিনির, উক্ত অঞ্চলের কথ্যভাষা এটিই। এবং চলচ্চিত্রশিল্পের বাস্তবানুগতার প্রতি এই বাড়তি বিশ্বস্ততা বজায় করতে গিয়েই নিঃশব্দে আরও বড় একটি কৃতি ঘটিয়ে ফেলেছেন রাজাদিত্য। ২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নির্মিত কুরমালি ভাষার প্রথম কাহিনিচিত্র। প্রসঙ্গত সদ্যসমাপ্ত ২০১৮ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রদর্শিত হয়েছে ছবিটি।

তবে চলচ্চিত্রশিল্পের অনুপুঙ্খ বাস্তবানুগতার যে প্রশ্নটি থেকে আপাদমস্তক কুরমালি ভাষায় ছবিটির উপস্থাপনা—সূক্ষ্ম বিচারে হুবহু সেই প্রশ্নেই রাজাদিত্যর বিপক্ষেও যাবে বিশেষ কয়েকটি দৃশ্যের নির্মাণ। যথেষ্টই বাংলা-ঘেঁষা কথ্যভাষা এই কুরমালি। সাবটাইটেল না দেখেও বুঝতে অসুবিধা হয় না ছবির বৃহদংশের ঘটনাপরম্পরাকে। দীর্ঘকাল পুরুলিয়াবাসের অভ্যাস থেকে সরকারি বাঙালি অফিসারদের তাই অবলীলায় বুঝে নেওয়ার কথা দেহাতি চরিত্রদের সংলাপ। আবার তাঁদের কথ্য বাংলাকে বুঝে নিতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয় স্থানীয় ভূমিপুত্রদের। বাস্তব সেটাই বলে। সেক্ষেত্রে হাসপাতাল বা থানার দৃশ্যগুলিতে সুপার (চরিত্রায়নে সুদিন অধিকারী) বা ইন্সপেক্টরের (চরিত্রায়নে রাজু রায়) জবানিতে নিখাদ বাংলা সংলাপ কৃত্রিম তো নয়ই, বরং বেশ বাস্তবগ্রাহ্যই হতে পারত (মনে রাখতে হবে চেহারা-চরিত্রে উক্ত সরকারি আধিকারিকদের নিখাদ মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তানই মনে হয়েছে)। এবং বাংলা ভাষার উপর চলতে থাকা ইংলিশ বা হিন্দির আধিপত্যের অনুরূপেই অন্যান্য প্রান্তিক ভাষাগুলির উপরে চলতে থাকা কলকাত্তাইয়া বাংলারও আধিপত্য তথা জেনোসাইডের বাস্তব ছবিটিও সেক্ষেত্রে নিঃশব্দেই তুলে ধরা হত পর্দায়। বরং তাতে ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র পাতাবাড়ি গ্রামের প্রান্তিক রমণী সাবিত্রীর (চরিত্রায়নে দীপমালা সেনগুপ্ত) প্রতি হাসপাতালের সুপার বা পুলিশের ইন্সপেক্টরের অতি নির্দয় আচরণের ব্যঞ্জনাটুকুই আরও জোরালো মাত্রা পেয়ে যেত। ইতিহাস সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হতে গিয়েই সম্ভবত এত বড় সুযোগটি হেলায় হারিয়েছেন রাজাদিত্য।

সাবিত্রীর স্বামী রামলখন (চরিত্রায়নে রাজাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং) ঝাড়খণ্ডের হেসালং স্টেশনে কর্মরত জনৈক পানি-পাঁড়ে। এই একটি চরিত্রের উপস্থিতিই ইঙ্গিত দেয় কাহিনির ঘটনাকাল সেই অর্থে সাম্প্রতিক নয়। বিগত শতকের সাতের দশকে রচিত মূল ছোটগল্পের সমকালে ভারতীয় রেলব্যবস্থায় চালু ছিল এই বিশেষ পদটি। যেসব প্রত্যন্ত স্টেশনে সারাদিনে চার-পাঁচটির বেশি ট্রেন থামত না পানীয় জলের সুবিধা খুব সুলভ ছিল না সেসব স্টেশন চত্বরে। সম্ভবত বয়স্ক রেলযাত্রীদের কথা চিন্তা করেই নিয়োগ করা হত এই পাঁড়েদের। এক্সপ্রেস গাড়ি এসে থামলে পানীয় জলের বালতি হাতে এরা ছুটে যেত কামরা থেকে কামরায়। ছবি দেখে এও মনে হয়েছে কোনও একটি নির্দিষ্ট স্টেশনেই শুধু নয়, অনেকটা আধুনিক হকারদের আদলেই রামলখনদের ডিউটি ছিল রেলপথের বিস্তৃত এক রুটে। এক সন্ধ্যায় ডিউটি সেরে নিজের ঘরে ফিরল না রামলখন। দাদু (চরিত্রায়নে প্রদীপ ভট্টাচার্য) ও শিবুকে (চরিত্রায়নে গৌতম দাসাণ্ডি) সঙ্গে নিয়ে পরদিন সকালে স্বামীর খোঁজে হেসালং স্টেশনে এল সাবিত্রী। ইতিমধ্যে স্টেশনমাস্টারের (চরিত্রায়নে মানব মুখোপাধ্যায়) কাছে খবর এসেছিল দূর রামপুরহাটে কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের রেলে কাটা পড়ার। মৃতদেহটি দেখে আসতে সাবিত্রীদের রামপুরহাট হাসপাতালের মর্গে যেতে বললেন তিনি। এবং যেহেতু রামলখন ছিল রেলের কর্মচারী তাই সাবিত্রীকে যাত্রার পূর্বাহ্নে মনে করিয়ে দিলেন মৃতদেহটি রামলখনের হলে যেন তারা হাসপাতাল থেকে তার ডেথ সার্টিফিকেটটি সংগ্রহ করে নেয়। এই ডেথ সার্টিফিকেটের সূত্রেই এরপর প্রশাসনের দরজায় দরজায় শুরু হবে সাবিত্রীদের হয়রানি। এবং ছবির উপসংহারে রামলখনের ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া না গেলেও দর্শকের চোখের সামনে যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধের ডেথ সার্টিফিকেটটি ঠিকই রুজু হয়ে যায়।

এমন আপাদমস্তক গদ্যময় স্টোরিলাইনকে আশ্রয় করেও পর্দায় যা নির্মাণ করেন রাজাদিত্য তাতে কবিতার অনুষঙ্গ কিন্তু যথেষ্টই। এবং নেপথ্য অনুঘটক হিসেবে এক্ষেত্রে একটি উপাদান যদি হয় ক্যামেরার নয়নাভিরাম ব্যবহার, অন্যটি তবে অবশ্যই তাঁর ঋদ্ধ সাহিত্যবোধের ইন্ধন। এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলার আগে মূল গল্পের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।

শুখা মরশুমে এই একটা কষ্ট ছিল রামলখনের। বৃষ্টি বাদলে তারপর বনস্থলি ঘুরে দেখে আসত, ছোট চারাগাছগুলো বেঁচে আছে তো? ধুঁধুল লতা শুকিয়ে যায়নি তো? ঘুরে ঘুরে দেখত রামলখন। তারপর যখন দেখত ধুঁধুল লতায় কচি ফল জেগে উঠেছে, বাঁশ গাছের কোঁড়াগুলো বেড়ে উঠেছে গায়ে গতরে, সে স্বস্তি পেত। ঈশ্বর যদি কেউ থাকেন তা হলে পেশায় তিনি পানি পাঁড়ে। আকাশ তাঁর বড় বালতি।

ছবির প্রয়োজনে মূল কাহিনির অল্পবিস্তর অ্যাডাপটেশন আজকের দিনে আর নতুন কোনও কথা নয়। নিউ থিয়েটার্সের ‘দুই পুরুষ’-এর আমলে যেহেতু আর থমকে নেই সময়। কিন্তু এটাও ঘটনা, এই তথাকথিত অ্যাডাপটেশনকে অজুহাত করেই মাঝেমধ্যেই প্রায় বলাৎকারের সমতুল পর্যায়ের অত্যাচারও ঘটছে মূল সাহিত্যের উপর। সুখের কথা, মূল কাহিনির পরিণতিকে পর্দায় অতিক্রম করেও জীবনের প্রথম ছবিতেই কাহিনির মূলসুরের প্রতি যথেষ্টই আনুগত্যের পরিচয় রেখেছেন রাজাদিত্য। যেটুকু তাঁর নিজস্ব অদলবদল তার সঙ্গে মূল কাহিনির অন্তর্লীন সাযুজ্যের প্রশ্নে রসিক দর্শকের অবলীলায় মনে পড়বে তপন সিংহকে।

          ফিরে আসি পুরনো কথায়। আদপে ফ্ল্যাশব্যাকে পর্দায় আসা রামলখনের চরিত্রটুকুই ছবির অন্তর্লীন কাব্যময়তার মূল। এই কাব্যময়তা কিন্তু চরিত্রে এসকেপিস্ট নয়। মূল স্টোরিলাইনে পদে পদে সমাজের তুলনামূলক উঁচুতলার হাতে নিম্নশ্রেণির যে বঞ্চনা, যে হয়রানি, যে অপমান তাকে কিছুতেই আড়াল করে বালিতে মুখ গুঁজে কিন্তু থাকে না এই কাব্যময়তা। বরং সেই বঞ্চনাময় জীবনকে নির্বাহ করতে করতেই একদিন সেই জীবনের যাবতীয় ক্ষুদ্রতার অনেক ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার নিরাসক্ত উদাসীনতার ভারতীয় দর্শনই তার চরিত্রগত। এই ছবিতে তাই সাবিত্রীর সূত্রে ভারতীয় পুরাণের ইচ্ছাপূরণের গল্প নেই। কিন্তু রামলখনের সূত্রে ভারতীয় দর্শনের মহিমা অবশ্যই আছে। অতি সাধারণ জীবিকার জনৈক দেহাতি মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরকে অবলীলায় মনে করতে পারছে নিজের মতোই এক পানি-পাঁড়ে হিসেবে। নিজেরই সহকর্মী। পলায়নবাদী মনোবৃত্তি কোনওদিনই হদিস দেবে না এই উপলব্ধির। যে কোনও অভিনেতার পক্ষেই খুব বড় চ্যালেঞ্জ এমন একটি চরিত্রের রূপায়ণ। নিঃসন্দেহে সুদীর্ঘকাল দূর ফিনিশ দেশে থিয়েটারে অভিনয়ের অভিজ্ঞতাই এক্ষেত্রে রাজাদিত্যকে সাহায্য করেছে এমন একটি কঠিন চরিত্রকে সহজে উত্তীর্ণ করতে। ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলিতে পর্দায় আসা রামলখনের চরিত্রে তাঁর অভিনয় এই ছবির অন্যতম সম্পদ। অভিনয়ের কথায় প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, স্টেশনমাস্টারের অল্পক্ষণের চরিত্রে মানব মুখোপাধ্যায় ও বেশ কিছু দৃশ্যে সাবিত্রীর চরিত্রে দীপমালা সেনগুপ্তর অভিনয়ে থিয়েটারি আবেগের ছোঁয়া যথেষ্টই। অভিনেতারা সেই অর্থে বড় বা ছোটপর্দারও পরিচিত মুখ নন। যদিও সেটা অবশ্যিক নয়।

লো বাজেটের ছবির স্বার্থে থিয়েটারের অভিনেতাদের ব্যবহার বাংলার অনেক বরেণ্য চলচ্চিত্রপ্রণেতাই করে দেখিয়েছেন। কিন্তু অভিনেতাদের ভেতর থেকে রুপোলি পর্দার উপযোগী বাস্তবানুগ অভিনয় আদায় করে নেওয়ার দায়িত্ব চলচ্চিত্রকারের। অভিনেতা ও চলচ্চিত্রনির্মাতা উভয়কেই বুঝতে হবে থিয়েটার ও সিনেমা সমপর্যায়ের মাধ্যম নয়। যদিও সেই একই ‘দেখা-শোনা’র অভিজ্ঞতাটি উভয় মাধ্যমেই ঘটছে অডিয়েন্সের। কিন্তু সিনেমার হাজারো যান্ত্রিক অনুষঙ্গ যেহেতু থিয়েটারে অনুপস্থিত, সুতরাং সিনেমার স্বাভাবিক বাস্তবানুগ অভিনয় থিয়েটার দর্শকের মনে হবে মিনমিনে। দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ রাখতে তাই মুহুর্মুহু কণ্ঠস্বরের গমক, এক্সপ্রেশনের লাউডনেস অভিনয়ে আনতেই হবে থিয়েটারের অভিনেতাকে। কিন্তু বড়পর্দায় লাইট ক্যামেরার সাহচর্যে যখন সিনেমার কাহিনি এগোবে অবিকল বাস্তবের ঢঙে তখন আবার অভিনয়ের এক্সপ্রেশনে এক স্কেল উপরের থিয়েটারি আবেগের আতিশয্য আর সইবে না ছবির দর্শকের। থিয়েটারটা তাই থিয়েটারই, সিনেমাটাও সিনেমাই। তাছাড়াও ডেথ সার্টিফিকেট তথা মৃত্যুর কথায় রৌদ্রস্নাত হেসালং-এর প্লাটফর্ম থেকে ক্যামেরার আচমকা গোধূলির আকাশে দু’-একটি নীড়ে ফেরা পাখির দিকে ফোকাস হওয়ার ট্রিটমেন্টটুকুও হালের চলচ্চিত্র ভাষার সাপেক্ষে বেশ তামাদি। এই ছবির প্রোটাগনিস্ট হিসেবে সাবিত্রীকেই উপস্থাপিত করা হলেও আমার মতে রামলখনের চরিত্রটুকুই আখেরে ধরে রাখে কাহিনির সূত্র।

          রামলখনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নেপথ্যে নিঃশব্দ অবদান আসলে তার পারিপার্শ্বিকের। নগরসভ্যতা নির্মাণ ঘটাতে পারত না এমন একটি চরিত্রের। রামলখনকে উপলব্ধি করতে হলে আগে বুঝতে হবে তার পরিবেশের ভূমিরূপকে। তার আশপাশের পৃথিবীটায় হয়তো নগরসভ্যতার থাবা নেই, কিন্তু খুব বেশি সবুজের সমারোহও নেই। চরিত্রগত ভাবেই সেই পৃথিবীটা অতি রুখাশুখা, ঊষর। আর সেই ঊষরতাকেই সহ্য হয় না রামলখনের। বিশ্বপ্রকৃতিকে সে সবুজে সবুজ করে দিতে চায় বালতি বালতি জলে। ঘটনাচক্রে তার স্বজনদেরই দৈনন্দিনের জলটুকুও মাঝেমধ্যেই সংগ্রহ করতে হয় মাটি খুঁড়ে। ভূমিরূপের এই বিশেষ বাস্তবতাই দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের রামলখনকেই নয় কেবল, রাজাদিত্যর ছবির রামলখনকেও কল্পনা করায় ঈশ্বরকে এক পানি-পাঁড়ে হিসেবে। পুরুলিয়ার আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-পাহাড়-প্রান্তরকে তাই উঠে আসতেই হত পর্দায় স্রেফ প্রেক্ষাপট হিসেবেই নয়, বরং স্বয়ং এক মৌন চরিত্রের ভূমিকায়। নচেৎ পায়ের তলায় মাটি পেত না খোদ রামলখনের চরিত্রটিই। ক্যামেরার অতএব বাড়তি গুরুত্বই ছিল এই ছবির চিত্রনাট্যে। ছবির সূচনা ঘটে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ঘুরে ঘুরে আড়েবহরে বিস্তীর্ণ দিগন্তরেখার বিপুল রুক্ষ্মতাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। মাটি থেকে উঁচু হয়ে উঠে যাওয়া টিলার ফুটিফাটা ভূমিরূপের অনুপুঙ্খতাকে ধরে রাখতে এগিয়ে-পিছিয়ে কখনও ক্লোজে কখনও মিড-লঙে শট নেয় ক্যামেরা।

          প্রকৃতির এই বাঙ্ময়তাই যেন অর্থবহতার চরমে পৌঁছয় যখন ছবির উপসংহারে বৃষ্টি আসে আকাশ ভেঙে। পানি-পাঁড়ের মৃত্যুতে এ যেন আকাশের কান্না। এই অংশে রাগসংগীতের ব্যবহারটুকুও যথাযথ। তবে সূক্ষ্মতর বিচারে একেবারে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয় ছবির উপসংহার। যখন হাসপাতালের দালাল হিতেন বনওয়ারির (চরিত্রায়নে ভূপেন পাণ্ডে) হাত ছাড়িয়ে ছুট লাগায় দিশাহারা সাবিত্রী, তারপরেই বৃষ্টি আসে অঝোর ধারায়, ধারাস্নানে ভিজতে থাকে পুরুলিয়ার রুক্ষ্ম ভূগোল— দূরদর্শনের পর্দায় সেই মুহূর্তেই ভেসে ওঠে এক রকেট উৎক্ষেপণের চলচ্ছবি। ডিডি ন্যাশনালের মতো চ্যানেলে যে ভারতীয় রকেট উৎক্ষেপণের সংবাদ এবং সংশ্লিষ্ট ছবিই সম্প্রচারিত হবে এটুকু ধরে নেওয়াই যায়। চলচ্চিত্রকারের দিতে চাওয়া বার্তাটুকু এক্ষেত্রে বেশ স্পষ্টই। প্রযুক্তির শিখরে উঠছি আমরা, উঠছে দেশ। অবশ্যই উন্নত সভ্যতার নিদর্শন বিজ্ঞানচর্চার এই অগ্রগতি। কিন্তু সেই সমাজেই মানবিকতার ধারণাটি থেকে যাচ্ছে সেই আদিম স্তরেই। কবে মানবতার শিখরে আরোহণের কথা ভাবব আমরা? কিন্তু এই বার্তাটুকু দিতে গিয়ে একটু বেশি উৎসাহী হয়ে পড়লেন না তো চলচ্চিত্রকার? হেরফের হয়ে গেল না তো সময়সূচকের ইন্টারপোলেশনে? দেশীয় মহাকাশযানে নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহকে ভারতবর্ষ প্রথম মহাকাশে পাঠিয়েছিল ১৯৮০ সালে। সেই সময়কাল অবধি ভারতীয় রেলব্যবস্থায় কি চালু ছিল পানি-পাঁড়ের পদটি? সাধারণ দর্শক এতটা তলিয়ে বিচার না করলেও অভিজ্ঞ চলচ্চিত্র সমালোচকের নজর কিন্তু এড়াবে না এক্ষেত্রে। এবং একেবারে সাধারণ দর্শকের জন্য ব্লকবাস্টার ছবি হিসেবে নিশ্চয় ‘ডেথ সার্টিফিকেট’-এর নির্মাণ ঘটাতে চাননি রাজাদিত্য।

 

ফিচার ফিল্ম : ডেথ সার্টিফিকেট

মূল গল্প : দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
চিত্রনাট্য , সংলাপ , পরিচালনা : রাজাদিত্য ব্যানার্জী
অভিনয়ের : প্রদীপ ভট্টাচার্য্য , রাজাদিত্য ব্যানার্জী , দীপমালা সেনগুপ্ত
সংগীত : মহিনের ঘোড়াগুলির প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় ও ব্যাকবেঞ্চার্স
প্রযোজনা । ব্যাকবেঞ্চার্স  ফিল্মস

২০১৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ চলচ্চিত্রের আলোচনা

২০১৮ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত ও প্রশংসিত

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page