প্লাস্টিক দূষণ এবং আমাদের পৃথিবী।। ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী
প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান আধুনিক পৃথিবীর এক জটিল সমস্যা যা স্থলভাগ থেকে জলভাগ সবক্ষেত্রেই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। নিয়মিত প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলছে উত্তোরত্তর। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক দূষণের কারণে মানুষও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা জানা যায় থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত ক্ষরণের জন্য প্লাস্টিক দূষণ পরোক্ষভাবে দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সঠিকভাবে হয়না। সেগুলোই পরিবেশ থেকে বর্জ্যের আকার নেয়। লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক নদীর স্রোতে ভেসে মহাসাগরে সংরক্ষিত হয়, যা সেখানে বসবাসকারী উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রের বড় বড় বলয়ের মধ্যে আটকে পড়ে এবং তা সামুদ্রিক দূষণে সৃষ্ট বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে নেয় যা সামুদ্রিক প্রাণীরা খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করলে তাদের শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
প্লাস্টিক পচনশীল পদার্থ নয়। তাই জলেও এর কোন বিনাশ সম্ভব নয়। কিন্তু সমুদ্রের জল লবণাক্ত হওয়ায় এবং সূর্যের আলো ও উত্তাপ সহ নানাবিধ কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য ভেঙে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। আবার কিছু প্লাস্টিক সামুদ্রিক স্রোতের কারণে অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে। ফলে প্লাস্টিক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণায় পরিণত হয় যা বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যধিক ক্ষতিকর।
এই প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে জমার কারণে সৃষ্টি হয়েছে গার্বেজ প্যাচের। গার্বেজ অর্থাৎ ‘আবর্জনা’ এবং প্যাচ অর্থাৎ ‘একত্রিত স্থান’। বিপুল পরিমাণ আবর্জনা একটি জায়গায় জমা হয়ে সৃষ্টি হয় এই গার্বেজ প্যাচের। বিশ্বের মহাসাগর গুলোতে এরকম অনেক গার্বেজ প্যাচের অস্তিত্ব রয়েছে। এর প্রভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জলজ প্রাণীর মৃত্যু ঘটে চলেছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার জানাচ্ছে, প্লাস্টিকের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা প্রাণীগুলির শতকরা ১৭ টি প্রজাতি প্লাস্টিক সেবন করে কিংবা প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষে জড়িয়ে পড়ে মারা যাওয়ার কারণে বিলুপ্ত হতে চলেছে। শুধুমাত্র প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে।
এই সম্পর্কে ইউনাটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের একটি নতুন প্রতিবেদনে বিপদের আভাস দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মহাসাগরে প্লাস্টিকের পরিমাণ প্রায় ৭৫ থেকে ১৯৯ মিলিয়ন টন বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ছাড়া জলজ বাস্তুতন্ত্রের প্লাস্টিক বর্জ্য নির্গমণ ২০৪০ সালের মধ্যে প্রায় তিনগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূল্যায়ন অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্লাস্টিক দূষণের কারণে পৃথিবীর উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে এবং এটি নিষ্ক্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ব্যবসার কারণে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অভাবে জলজ বাস্তুতন্ত্রে জমা হওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ২০১৬ সাল থেকে বছরে ৯ থেকে ১৪ মিলিয়ন টন থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২০৪০ সালের মধ্যে বছরে প্রায় ২৩ থেকে ৩৭ মিলিয়ন টন হতে পারে।
এখনও পর্যন্ত উৎপন্ন সাত বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে আনুমানিক ১০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে, ১৪ শতাংশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং বাকি ৭৬ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশে আবর্জনার মধ্যে চলে গেছে। শুধুমাত্র বাছাই এবং প্রক্রিয়াকরণের সময় প্লাস্টিক প্যাকেজিং বর্জ্যের বার্ষিক ক্ষতি আনুমানিক ৮০-১২০ বিলিয়ন ডলার।
২০১৯ সালের নেচার রিপোর্ট অনুযায়ী, আফ্রিকান এবং এশিয়ান ওয়াটারশেডগুলি থেকে বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফলে বিশ্বের প্রধান স্থলজ বাস্তুতন্ত্র, জলজ বাস্তুতন্ত্র এবং মহাসাগরগুলিতে লক্ষ লক্ষ টন লিটার প্লাস্টিক বর্জ্য নির্গত হয়। প্ল্যাংকটন, সামুদ্রিক মিঠা জল ফাইটোপ্লাকটন এবং জুপ্লাটনের প্লাস্টিকের ব্যবস্থায় প্রাথমিক উৎপাদনের উপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্ব কার্বন চক্রেরও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র, বিশেষত ম্যানগ্রোভ, সামুদ্রিক ঘাস, প্রবাল এবং লবণাক্ত জলাভূমি কার্বন পৃথকীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা মহাসাগর উপকূলীয় অঞ্চলের যত বেশি ক্ষতি করি, তা বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রণের পক্ষে ততই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্লাস্টিক থেকে নির্গত গ্রীনহাউস গ্যাস যা ২০১৫ সালে ১.৭ গিগাটন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমতুল্য ছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে তা আনুমানিক ৬.৫ গিগাটন বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে।
উদ্বেগের বিষয় হল, মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং বিভিন্ন রকম রাসায়নিক সংযোজনের মাধ্যমে মানুষএবং বন্যপ্রাণী উভয়ের স্বাস্থের পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রের জন্য ও এইগুলো ও খুবি বিষাক্ত এবং বিপজ্জনক হিসাবে পরিচিত।
এই দূষন থেকে সমাধানের উপায় হল, ২০২২ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ পরিষদের পঞ্চম অধিবেশনে যেখানে বিশ্বের সমস্ত দেশ একত্রিত হবে, সেখানে সামুদ্রিক আবর্জনা এবং প্লাস্টিক দূষনের একটি বৈশ্বিক মূল্যায়ন করা যা সবুজ এবং টেকসই বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার মাধ্যমে গড়ে তুলতে সরকারকে সাহায্য করবে।
তবে পরিবেশে প্লাস্টিক দূষণ রোধে শুধুমাত্র সরকারকে নয়, সচেতন হতে হবে সমগ্র মানবজাতিকে। কারণ প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্তমান যুগে যেভাবে বাড়ছে, তাতে সারা বিশ্বের কাছে এটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই সমস্যা কমানোর দায়িত্ব কমবেশি বর্তায় সাধারণ মানুষের উপরেও। এরজন্য প্রয়োজন প্লাস্টিকের কুফল সম্পর্কে প্রচার ও জনচেতনাকে জাগ্রত করা। অন্যথায় ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের পথে। প্লাস্টিক ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ আকাশে বাতাসে জলে মিশে পরিবেশকে করে তুলছে বিষাক্ত। তাই দ্রুত এর প্রতিকার করতে না পারলে প্রাণীকূলের ধ্বংস অনিবার্য।
এইসমস্ত প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে নিগর্ত বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ সমুদ্রের জলে মিশছে এবং সেখান থেকে মাছের মাধ্যমে প্রধানত মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।এইসব বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে ভারী ধাতু ছাড়াও থাকছে ডাইইথাইলক্সি থ্যালেট যা ক্যান্সার সৃষ্টি কারী বিষাক্ত রাসায়নিক আছে।
জাতিসংঘের গ্রিন ইকোনমি প্রতিবেদনে সমুদ্রের খুবই নিদারুন পরিস্থিতির পরিণতি ফুটে উঠেছে। এই জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করা হয়। আমরা জানি, শিল্পায়নের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ছে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের নেতিবাচক বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডে স্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সকলপ্রকার প্রানীরা । এতে সমুদ্রসম্পদ কাঠামোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়ছে। একই কারণে বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এতে সমুদ্র ও উপকূল এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রাণী ও জীবকুলের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পাশাপাশি গোটা জীববৈচিত্র্যই সংকটে পড়ছে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মনে রাখা দরকার, বিভিন্ন ভাবে জলজ প্রানী এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব ফেলছে তাই এই দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের স্বার্থেই। নিজেদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে কোনোভাবেই জীববৈচিত্র্যের খাদ্যচক্র ও নষ্ট করা যাবে না।
ডঃ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী, পরিবেশ বিজ্ঞানী। পরিবেশ ও জৈবপ্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন গবেষণায় যুক্ত।দূষণ প্রতিরোধে বিভিন্ন ও আলোচনা ও কর্মশালা এক পরিচিতি মুখ ।পরিবেশ সচেতনতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্ৰনী ভূমিকায় দেখা যায়।স্বাতীর পরিবেশ বিজ্ঞানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয়।পরিবেশ আন্দোলনের এক পরিচিত মুখ।