প্রবন্ধ।। গৃহত্যাগী, গৃহকাতর।। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় এর জন্ম সিউড়িতে
১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ ।
হিন্দু স্কুল এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র। হীরেন্দ্রনাথ স্বর্ণপদক নিয়ে তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এম.এ পাস করেন। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ‘আনন্দমেলা’-র পত্রিকায় দীর্ঘ কয়েক দশক সম্পাদক ছিলেন। লোকসংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, বিদেশী সাহিত্যপাঠ নানা বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ এবং জ্ঞান। মূলত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই তিনি সেসব সম্বন্ধে লেখালেখি করেন। গল্প-কবিতা-উপন্যাস রচনায় সর্বদাই তিনি গতানুগতিক রাস্তার বদলে পরীক্ষা নিরীক্ষার পথের দিকেই এগিয়ে গিয়েছেন। প্রবন্ধ-উপন্যাস-কবিতা-গল্পগ্রন্থ মিলিয়ে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশ। তাঁর বিবিধ বিষয়ে প্রকাশিত লেখা সংকলিত করলে আরও এমনই অনেক বই প্রস্তুত হতে পারে।
চিনুয়া আচেবে, ইসমাইল কাদারে, আইজাক আসিমভের নানা লেখা প্রথম বাংলায় অনুবাদের কৃতিত্ব তাঁর। তৈরি করেছেন তিনটি পুরস্কৃত তথ্যচিত্র—‘এ ডলস হাউস’, ‘ক্যালকাটা জিরো মাইল’, ‘চিলড্রেন অফ উমং লাইজ’ ।
প্রয়াণ : ২৪ অক্টোবর ২০১৬
তারই একটি প্রবন্ধ আজ ‘তৃতীয়পক্ষে’র পাতায় পাঠকদের জন্য…
‘না, কক্ষনাে বিয়ে কোরাে না। নিজেকে যেদিন বলতে পারবে জীবনে যে সব কাজ আমি করতে পারতাম সেগুলাে করতে পেরেছি, সেদিন বিয়ে কোরাে। এটাই আমার উপদেশ। …বুড়াে বয়সে যখন তােমার কিছুই করার থাকবে না, বিয়ে করবে ঠিক তখনই। না হলে তােমার জীবনের মহৎ ও ভালাে দিকগুলাে একেবারেই নষ্ট হয়ে যাবে।…’
লিও টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ উপন্যাসে প্রিন্স অ্যান্ড্রু এই উপদেশ দিয়েছেন পিয়েরকে। টলস্টয়ের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে যাঁরা খোঁজখবর রাখেন তাঁরা জানেন, প্রিন্স অ্যান্ড্রু ও পিয়ের এই দুটি চরিত্রই লেখক তার নিজের আদলে এঁকেছেন। অন্তত আলমার মডের এই ধারণা। সেই আলমার মড, যিনি ছিলেন টলস্টয়ের খুব কাছের মানুষ। টলস্টয়ের জীবনীকার এবং তাঁর রচনার নির্ভরযােগ্য অনুবাদক হিসেবে টলস্টয়ের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে আছে।
১৮৬২ সালে টলস্টয় আঠারাে বছরের মেয়ে সােফিয়া আন্দ্রিভনার প্রেমে পড়েন। টলস্টয়ের বয়স তখন ৩৪। এর বছর ছয়েক আগে তিনি সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্টের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, চাষির ছেলেদের পড়ানাের জন্য স্কুল খুলেছেন ইয়সেনায়া পলিয়ানায়।
সােফিয়াকে বিয়ের পর প্রথম পনেরাে বছর টলস্টয়ের বেশ সুখশান্তিতে কেটেছিল। বিয়ের পর তাঁর প্রথম উপন্যাসই ওই ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পিস’। এটি লিখতে তার ছ’বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল। প্রথমে ভেবেছিলেন, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এক পারিবারিক উপন্যাস লিখবেন। কিন্তু আস্তে আস্তে সমস্ত পরিকল্পনা বদলে গেল। ইতিহাস হয়ে দাঁড়াল ইতিহাসের দর্শন। উপন্যাসটি হয়ে উঠল ‘এপিক। এ রকম একটি উপন্যাস লেখার যন্ত্রণাময় মুহূর্তগুলােতে সােফিয়া যতটা পারেন সঙ্গ দিয়েছিলেন। তবু ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পিস’-এ প্রিন্স অ্যান্ড্রু বিয়ের বিরুদ্ধে কেন এমন সােচ্চার হয়ে উঠলেন ?
প্রিন্স অ্যান্ড্রর অনেক কথাই তাে টলস্টয়ের নিজের কথা বলে ধরে নেওয়া হয়। জীবনে মানুষের যা চাওয়া-পাওয়ার থাকে তা কি স্ত্রীর পক্ষে মেটানাে সম্ভব নয়? প্রেমিকা ও স্ত্রীর মধ্যে একটা তফাত থাকেই? অথচ টলস্টয় তাে সােফিয়াকে ভালােবেসেই বিয়ে করেছিলেন। সােফিয়া কেমন মেয়ে তা তিনি জানতেন। তা হলে কেন প্রিন্স অ্যান্ড্রু পিয়েরকে বলেছিলেন, মেয়েটি ঠিক কেমন তা সবটা না জেনে বিয়ে করলে মারাত্মক ভুলের ফঁদে পড়বে, সে ভুলের মাশুল দিতে পারবে না?
সাংসারিক টানাপােড়েনে তবে কি ভালােবাসা চাপা পড়ে যায় ? দৈনন্দিন সমস্যা ও তিক্ততাই তখন বড় হয়ে ওঠে? টলস্টয়ের জীবন সম্পর্কে কথাটা বােধহয় প্রযােজ্য নয়। জীবন ও সাহিত্যের মধ্যে কোনও ভেদ রাখেননি বলেই তিনি এত বড় লেখক হতে পেরেছিলেন। সাহিত্যের জন্য কোনও অতিকল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি তাকে। যুদ্ধ নিয়ে লিখতে গিয়ে সামরিক বাহিনীর একদা লেফটেনান্ট টলস্টয় বােরােদিনাের যুদ্ধক্ষেত্র দেখতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন বারাে বছরের শ্যালক স্টেপানকে। রক্তাক্ত যুদ্ধের সাক্ষী সেই বােরােদিনাের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে টলস্টয় খুঁটিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যুদ্ধটা কীভাবে হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানই ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-কে কালজয়ী সাহিত্য করে তুলেছে।
এমনকী, এর জন্য তাকে গৃহসুখও ত্যাগ করতে হয়েছিল। এবং এই ত্যাগ তাঁকে কখনও বিলাপমুখর করেনি। বরং টলস্টয়ের ব্যক্তিগত ভাবাদর্শের মূল্য দিতে হয়েছিল সােফিয়াকে। টলস্টয় চলে যাওয়ার পর সােফিয়া প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। তার শরীর ও মন ভেঙে পড়েছিল। সেই দুঃখের দিনগুলাের কথাই তিনি লিখে গিয়েছেন তার ডায়েরিতে। টলস্টয়ের লেখক-খ্যাতির আড়ালে সােফিয়ার সেই ডায়েরিটি চাপা পড়ে গেছে, টলস্টয়ের ব্যক্তিগত আদর্শ ও জীবনবােধের কাছে যেমন চাপা পড়ে গিয়েছিল সােফিয়ার ভালােবাসা।
১৮৮১ সাল নাগাদ টলস্টয়ের জীবনে আসে এক বিরাট পরিবর্তন। সমার প্রদেশে তার ছিল প্রায় ৬০ হাজার পাউন্ড মূল্যের বিষয়সম্পত্তি। বই থেকেও ভালাে আয়ের রাস্তা খােলা ছিল। ১৮৮৩ সালের ২৩ মে তিনি তার সব বিষয়সম্পত্তি দেখাশােনার ভার দেন সসাফিয়াকে। স্ত্রীকে পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ দিয়ে টলস্টয় ঠিক করেন, তিনি আর টাকার জন্য লিখবেন না। লিখবেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। নিজের হাতে এমনকী জমিও চাষ করেছেন টলস্টয়। এভাবে জীবনের মূল্যে তিনি তার অমর গল্প উপন্যাসগুলাে লিখে গিয়েছেন। গৃহত্যাগী হয়েও বাইরের পৃথিবীকে করে তুলেছিলেন নিজের বাড়ি।
আর সােফিয়া? তার মা ছিলেন টলস্টয়ের আবাল্য বন্ধু। মস্কোর এক নামকরা ডাক্তারের মেয়ে সােফিয়া পেয়েছিলেন বাবার মেধা ও মায়ের রূপলাবণ্য। তার মতাে মেয়ের প্রেমে-পড়ার যথেষ্টই কারণ ছিল টলস্টয়ের। তাঁদের সন্তানসংখ্যা তেরাে। টলস্টয় যে সােফিয়াকে খুব ভালােবাসতেন, তাঁর প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন তার প্রমাণ, সােফিয়াকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি তার জাগতিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সব ব্যবস্থাই করে গিয়েছিলেন।
‘দা রাশিয়ান মেসেঞ্জার পত্রিকায় ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পিস’ বেরােনাের আগে পর্যন্ত সাহিত্যসমালােচকরা টলস্টয়কে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ প্রথম খণ্ড বেরােনাের পর এমনকী তুর্গেনেভও বলেছিলেন এটা যথার্থ নিকৃষ্ট, বিরক্তিকর ও অসফল রচনা। পরে অবশ্য তিনি মত বদলেছিলেন। তাঁকে মত বদলাতে হয়েছিল।
টলস্টয়ের প্রতি রুশ সাহিত্য-সমাজের বৈরিতার কারণ আর কিছুই নয়। তারা টলস্টয়ের স্বাতন্ত্রকে সহ্য করতে পারতেন না। টলস্টয় সর্বদাই সাহিত্য-জগতের রাজনীতি, গােষ্ঠীচর্চা ও অক্ষমের ঈর্ষা থেকে নিজেকে দূরে রাখতেন। সােফিয়া ও ছেলেমেয়েরাই ছিল তার অবলম্বন। সমালােচকদের নিন্দা ও পরশ্রীকাতরতার মুখে সােফিয়া দিয়েছিলেন টলস্টয়কে সত্যিকার আশ্রয়। তার গভীর মমতা ছিল টলস্টয়ের জন্য। শিল্পী-জীবনের অনিশ্চয়তা, অতৃপ্তি ও যন্ত্রণাকে তিনি মূল্য দিতেন। কিন্তু তার প্রেমের মূল্য টলস্টয়কে দিতে হলে আমরা হয়তাে অতিসাধারণ মাপের একজন লেখককে পেতাম, যাঁকে নিয়ে রাশিয়ার ও বিশ্বসাহিত্যের গর্ব করার কিছু থাকত না।
ঘরছাড়া কালজয়ী আর এক লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। ১৮৯৯-এর ২১ জুলাই আমেরিকার শিকাগাে, ইলিনয়-এর শহরতলি ওকপার্কে তার জন্ম। বাবা ডাক্তার। মা ধর্মচর্চা, গান-বাজনা, ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। বাবা পছন্দ করতেন মাছ ধরা ও শিকার। মায়ের চেয়ে বাবার প্রভাবই বেশি পড়েছিল আর্নেস্টের ওপর। স্কুলে বক্সিং লড়তেন, ফুটবল খেলতেন আর্নেস্ট। কিন্তু তার থেকেও বেশি চাইতেন লিখতে, বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াতে। টলস্টয়ের সঙ্গে তার মিল খোঁজা নিরর্থক। মিল বােধহয় এখানেই যে, দু’জনেই। বহির্বিশ্বকে নিজেদের বাড়ি করে তুলেছিলেন, গৃহত্যাগী হয়েও মনে মনে তারা দুজনেই হয়তাে ছিলেন গৃহকাতর।
গ্রাজুয়েট হয়ে হেমিংওয়ে চলে গেলেন কানসাস সিটিতে। সেই যে বেরিয়ে পড়লেন পাকাপাকিভাবে, বাড়িফেরা আর তার হয়ে ওঠেনি। বাবার দামাল চরিত্রের উত্তরাধিকারী হেমিংওয়ে মনেপ্রাণে ছিলেন রােমান্টিক। বীরত্ব ও মহত্ত্বকে খুব সম্মান করতেন। যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাকে নেয়নি। কানসাসের ‘সিটি স্টার’ পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতার চাকরি নেন। এর জন্য তাঁকে বয়স একবছর বেশি দেখাতে হয়েছিল। উদ্দেশ্য যেখানে মহৎ সেখানে সামান্য এই মিথ্যাচারণে পিছপা হননি হেমিংওয়ে। বাধাবন্ধহীন জীবনকে তিনি এই ছন্দেই গড়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভুল করেছিলেন তাঁর জীবনীকাররা। সিটি স্টার’ থেকে তথ্য নিয়ে তারা কেউ কেউ ১৮৯৮ কে হেমিংওয়ের জন্ম-সাল বলে উল্লেখ করেছেন।
আন্তরিকভাবে চাইলে পৃথিবীতে কোনও কিছুই বােধহয় না-পাওয়া থাকে না। হেমিংওয়েও যুদ্ধে যেতে পেরেছিলেন। তবে রেড ক্রশের অনারারি লেফটেন্যান্ট হিসেবে। যুদ্ধে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারেরও কাজ করেছেন কিছুদিন। ইতালির সৈন্যদের খাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে ১৯১৮-র ৮ জুলাই গুরুতর আহত হয়েছিলেন। হাঁটুতেই সেবার বারােবার অপারেশন করতে হয়েছিল। শরীর কেটে ছিড়ে বের করতে হয়েছিল ২২৭টি ছররা। ডাক্তাররা প্রথমে ভেবেছিলেন ছেলেটি মারা গেছে। মিলানের সেই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতেই এক নার্সের প্রেমে পড়েন হেমিংওয়ে। মেয়েটি তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছিল।
এরপরও অবশ্য একাধিক মেয়ের প্রেমে পড়েছেন হেমিংওয়ে। বিয়েও করেন চারবার। প্রথম বিয়ে হাডলে রিচার্ডসনের সঙ্গে। তাদের এক ছেলে। বিয়ে বেশিদিন টেকেনি, ডাইভাের্স হয়ে যায়। পরের দু’টি বিয়েও স্থায়ী হয়নি। এর মধ্যে তৃতীয় স্ত্রী ছিলেন মার্থা জেলহন, ঔপন্যাসিকা। কিন্তু নিজে ঔপন্যাসিকা হয়েও ঔপন্যাসিক হেমিংওয়েকে বােঝেননি মার্থা।
আশ্চর্য জীবন এই হেমিংওয়ের। ১৯৪৮-এ তাঁর চতুর্থ ও শেষ বিয়ে মিনেসােটার মেরি ওয়েলশের সঙ্গে। মেরির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। সেবছরই ইংল্যান্ডে এক সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন হেমিংওয়ে। মাথায় সাতান্নটি সেলাই দিতে হয়েছিল। একজন মানুষের পক্ষে শরীরে যত আঘাত নেওয়া সম্ভব তা বােধহয় হেমিংওয়ে নিয়েছিলেন। মাথার খুলি ফেটেছিল একবার।‘ব্রেন কনকাশন’ হয়েছে অন্তত বারােবার। গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন তিনবার। আফ্রিকার জঙ্গলে দু’দিনে দু’বার বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন। চোখ প্রায় নষ্ট হতে বসেছিল। বাঁচারও আশা ছিল না। সংবাদপত্রে তার মৃত্যুর খবরও বেরিয়ে গিয়েছিল। সুস্থ হয়ে ওই খবর পড়ে হাে হাে করে হেসে উঠেছিলেন হেমিংওয়ে। এভাবে কতবার যে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। কিন্তু কখনও ভয় পাননি। সুস্থ হয়েই বেরিয়ে পড়েছেন নতুন অভিযানে। স্পেনের বুলফাইট কিংবা কিউবার অশান্ত দরিয়ায় ইউ বোেট ধ্বংস করার সর্বনাশা খেলা—এসবই জীবনকে গভীরভাবে আলিঙ্গনের উপলক্ষ বলে তিনি মনে করতেন।
প্রথম থেকে মৃত্যুই ছিল হেমিংওয়ের লেখার অন্যতম প্রধান বিষয়। ১৯২৪-এ প্যারিসে প্রকাশিত তার গল্পগ্রন্থ ‘ইন আওয়ার টাইম’এর কথাই ধরা যাক। গির্জায় প্রার্থনা করা হয়—“গিভ পিস ইন আওয়ার টাইম ও লর্ড’। শান্তি দাও। কিংবা ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি। যা আমরা এলিয়েটের কবিতাতেও পেয়েছি। কিন্তু হেমিংওয়ের ‘ইন আওয়ার টাইম’-এর গল্পগুলােয় কোথাও শান্তি নেই। বইটির প্রথম গল্পের নাম ‘ইন্ডিয়ান ক্যাম্প। মূল চরিত্র নিক অ্যাডমিস নামে এক কিশাের। অস্থায়ী এক শিবিরে নিকের বাবা ডাঃ অ্যাডামস এক ভারতীয় মহিলার সন্তানের জন্মের সিজারিয়ান অপারেশন করলেন। অজ্ঞান করার ওষুধ নেই, নেই শল্য চিকিৎসার উপযােগী ছুরি, ফরসেপ। হাতের কাছে পাওয়া গেল একটা ছুরি। তা দিয়েই অপারেশন করলেন ডাঃ অ্যাডামস। অপারেশনের সময় চারজন পুরুষ মেয়েটিকে শক্ত করে ধরে আছে। কিশাের কিও বাবাকে সাহায্য করল। সন্তান জন্মানাের পর ডাঃ অ্যাডামস স্বস্তিতে মেয়েটির স্বামীর দিকে তাকালেন। পঙ্গু স্বামী শুয়েছিল মাথার ওপর একটি বার্থে। অ্যাডামস দেখলেন সেখান থেকে টপটপ করে তপ্ত রক্ত ঝরে পড়ছে। দু’দিন ধরে স্ত্রীর প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ভোতা ক্ষুর দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে নিজের গলা কেটে আত্মঘাতী হয়েছে পঙ্গু স্বামী।
কিশাের নিকের ওপর এই নিষ্ঠুর ও স্থূল মৃত্যুর প্রতিক্রিয়াই গল্পটির বিষয়।
অপারেশনের পর ডাঃ অ্যাডামস নৌকোয় বাড়ি ফিরছেন। দাঁড় টানছেন নিজেই। হাল ধরে বসে আছে কিশাের নিক। সে হঠাৎ প্রশ্ন করল—
বাবা, লােকটা কেন নিজেকে হত্যা করল?
জানি না। সে বােধহয় এসব সহ্য করতে পারছিল না।
অনেকেই কি এভাবে আত্মহত্যা করে ?
খুব বেশি নয়, নিক…।
ভােরবেলা বাবা দাঁড় টানছেন। চারপাশ শান্ত। হাল ধরে বসে থাকতে থাকতে নিকের তখন মনে হল, সে কখনও মরবে না।
কিন্তু যাঁদের নিয়ে নিক ও ডাঃ অ্যাডমসের চরিত্র দুটি এঁকেছিলেন হেমিংওয়ে তাদের জীবনেও ঘটেছিল এই করুণ পরিণতি। হেমিংওয়ে নিশ্চয় সেই পরিণতির আশঙ্কা করেই এই গল্প লেখেননি। কিন্তু অদ্ভুত যােগাযােগ। বাবা ও ছেলে দু’জনই আত্মঘাতী হল। ডাঃ অ্যাডামস চরিত্রে আমরা দেখতে পাই হেমিংওয়ের বাবাকে। রােগজ্বালা সহ্য করতে না পেরে ১৯২৮-এ পিস্তলের গুলিতে তিনি আত্মহত্যা করেন। তার স্ত্রী, অর্থাৎ হেমিংওয়ের মা, যুদ্ধের স্মারক হিসেবে এর কিছুদিন আগে পিস্তলটি তাকে উপহার পাঠিয়েছিলেন।
হেমিংওয়ে ছিলেন শেষ জীবনে অসুস্থ। নানা রােগে ভুগছিলেন। ছিলেন মানসিক অবসাদগ্রস্ত। দু’দফায় পঁচিশবার ইলেকট্রিক শকও নিয়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে খেলায় মৃত্যুই জিতে যায়। ১৯৬১র এক ভােরবেলা সারা পৃথিবী জানল, নােবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেমিংওয়ে মারা গিয়েছেন। হেমিংওয়ে একটি শটগানের নল পরিষ্কার করছিলেন। বন্দুকে ছিল গুলি। হঠাৎই গুলি তার মাথা এফোঁড় ওফোঁড় করে চলে যায়। আত্মহত্যা। অসতর্ক মুহূর্তে নিশ্চয় এটা ঘটেনি।
সাধারণ মানুষ এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পান না। আমেরিকার আর এক লেখক নােবেলজয়ী স্টোবেকও হেমিংওয়ের এ-ধরনের মৃত্যুকে সমর্থন করেননি। তাঁর বক্তব্য হল, মরতে হলে এভাবে মরতে হবে কেন? বন্দুকে গুলি ভরে বিপজ্জনকভাবে নল পরিষ্কার করা উচিত নয়। হেমিংওয়ে ভুল করেছিলেন।
কিন্তু হেমিংওয়ে ছাড়া আর কার পক্ষেই বা এ ভুল করা সম্ভব!
২৬ আগস্ট, ১৯৮৪
© দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়