রবীন্দ্রনাথের হেমন্তবালা।। স্বপ্নকমল সরকার
ময়মনসিংহের গৌরীপুর এস্টেটের জমিদার ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর বিদুষী মেয়ে হেমন্তবালা দেবীর সঙ্গে তাঁর স্বামী রংপুর ভিতরবঙ্গের জমিদার ব্রজেন্দ্রকান্ত রায়চৌধুরীর বনিবনা হলো না। শিক্ষিতা সুন্দরী সেই রাজবধু একদিন সংসার ত্যাগ করে পুরীর চক্রতীর্থে গুরু কিশোরানন্দ মহারাজের আশ্রমে গিয়ে ঠাঁই নিলেন। বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করলেন। এরই মধ্যে তিনি পড়ে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথের সদ্য দুটি উপন্যাস, ‘যোগাযোগ’ আর ‘শেষের কবিতা’। পাঠমুগ্ধ হেমন্তবালা কখনও ‘খদ্যোৎবালা’ কখনও ‘দক্ষবাংলা’ নামে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন, পরপর আটটি, সবগুলোই ছদ্মনামে। এরপর ৭১ বছরের রবীন্দ্রনাথ আর ৩৭ বছরের হেমন্তবালার পত্রালাপ চলতেই থাকল। সব থেকে বেশি চিঠিপত্র লেখালিখি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই হেমন্তবালা দেবীরই। প্রায় তিনশো। কবি একদিন তাঁকে লিখলেন, “তোমার চিঠি পড়ি, তোমার কথা ভাবি, একটা কথা বারবার মনে আসে।… তোমার চিরাভ্যস্ত ধর্মমত ও আচার থেকে আমি তোমাকে বিচ্ছিন্ন করিনি, বিক্ষিপ্ত করেছি। তাই নিয়ে তোমার নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলছে। অথচ এ দুঃখ কোনদিন তোমাকে দিতে ইচ্ছা করিনি।”
ছদ্মনামে লেখা প্রথমদিকের এক চিঠিতে হেমন্তবালা রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “আমার মনে অনেক অশান্তি জমিয়াছিল, কাহারো কাছে মনের সুখ দুঃখের কথা উদঘাটন করিবার, কাহারো নিকট হইতে একটু সান্ত্বনার বাণী শুনিবার প্রয়োজন ছিল।” রবীন্দ্রনাথ উত্তরে লিখলেন, “আমি বুঝতে পারি, আমাকে লেখা তোমার আন্তরিক প্রয়োজন আছে… আমাকে তুমি দেখোনি, স্পষ্ট করে জানো না। সেও একটা সুযোগ। কেননা তোমার শ্রোতাকে তুমি নিজের মনে গড়ে নিয়েছ।”
হেমন্তবালা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ চিঠিতেই ধর্ম সমাজ লোকায়ত নানা বিশ্বাসের প্রসঙ্গ সুন্দরভাবে এসেছে। এই পত্রগুলি বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ বলে বিবেচিত। একটা উদাহরণ দিই, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “আমার ঠাকুর মন্দিরেও নয়, প্রতিমাতেও নয়, বৈকুন্ঠেও নয়—- আমার ঠাকুর মানুষের মধ্যে—- সেখানে ক্ষুধা-তৃষ্ণা সত্য, পিত্তিও পড়ে, ঘুমেরও দরকার আছে—- যে দেবতা স্বর্গের তাঁর মধ্যে এসব কিছুই সত্য নয় …তোমাদের পূজার বর্ণনা শুনে আমার মনে হয় এ সমস্তই অবরুদ্ধ অতৃপ্ত অসম্পূর্ণ জীবনের আত্মবিড়ম্বনা। আমার মানুষরূপী ভগবানের পূজাকে এত সহজ করে তুলে তাঁকে যারা প্রত্যহ বঞ্চিত করে তারা প্রত্যহ নিজে বঞ্চিত হয়। তাদের দেশের মানুষ একান্ত উপেক্ষিত, সেই উপেক্ষিত মানুষের দৈন্যে ও দুঃখে সে দেশ ভারাক্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে সকল দেশের পিছনে পড়ে আছে। এ সব কথা বলে’ তোমাকে ব্যথা দিতে আমার সহজে ইচ্ছা করে না-‘ কিন্তু যেখানে মন্দিরের দেবতা মানুষের দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী, যেখানে দেবতার নামে মানুষ প্রবঞ্চিত সেখানে আমার মন ধৈর্য্য মানে না। গয়াতে যখন বেড়াতে গিয়েছিলেম তখন পশ্চিমের কোন্ এক পুজামুগ্ধা রাণী পান্ডার পা মোহরে ঢেকে দিয়েছিলেন- ক্ষুধিত মানুষের অন্নের থালি থেকে কেড়ে নেয়া অন্নের মূল্যে এই মোহর তৈরি। দেশের লোকের শিক্ষার জন্যে অন্নের জন্যে আরোগ্যের জন্যে এরা কিছু দিতে জানে না, অথচ নিজের অর্থ সামর্থ্য সময় প্রীতি ভক্তি সমস্ত দিচ্ছে সেই বেদীমূলে যেখানে তা নিরর্থক হয়ে যাচ্চে। মানুষের প্রতি মানুষের এত নিরৎসুক, এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশেই নেই, এর প্রধান কারণ এই যে, এ দেশে হতভাগ্য মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে।”
বৈষ্ণবী হেমন্তবালা ইতিমধ্যে নিজের হৃদয়ের সবটুকু অর্ঘ্য রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে বসে আছেন। চিঠিতে অভিমানিনী লিখলেন, “আমার দুর্ভাগ্য যে, আমার পূর্ণ পূজা আপনার চরণে দিতে পারছি না। আপনি কি আমার মন দেখতে পাচ্ছেন না?” হেমন্ত রবীন্দ্রনাথের দেখা পেতে চাইলেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যবস্থাপনাতেই বৈষ্ণবী একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে তাঁর ছয় নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সেই নিভৃত প্রাণের দেবতার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করে এলেন। দুজনের উপহার বিনিময়ও হয়েছিল সেদিন। কবি তাঁকে দিয়েছিলেন গরদের শাড়ি, শ্রীনিকেতনের চামড়ার ব্যাগ, নিজের লেখা বই, নিজের আঁকা ছবি।
১৫জুলাই, ১৯৩১ সালে হেমন্তবালাকে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, “সেদিন তোমাকে দেখে আমি গভীর আনন্দ পেয়েছি।বুদ্ধিতে উজ্জ্বল তোমার মুখশ্রী, ভক্তিতে সরস মধুর তোমার বাণী আমার মনে রইল।” তিনি হেমন্তবালার সব সংকোচ, সংশয় ঘুচিয়ে এক সহজ সম্পর্কের স্পর্শ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে তাঁর হেমন্তবালাকে জানালেন, ‘আমার দুয়ার তোমার জন্য সারাক্ষণ খোলা রইল।” লিখেছিলেন, ”আঁধার নিবিড় হলে আসিও পাশে’! হেমন্তের অনুরোধে কবি তাঁকে ‘নীহারিকা’ নামে একটি কবিতাও লিখে পাঠিয়েছিলেন।দীর্ঘ সেই কবিতায় জানিয়েছিলেন,”কেন অবেলায় ডেকেছ খেলায়—– সারা হয়ে এল দিন।” রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দশ বছরের ‘খেলার সাথী’ ছিলেন এই সংসারত্যাগী রাজকন্যা হেমন্তবালা দেবী। তাঁদের সখ্যতা বেঁচে ছিল কবির শেষের দিনটি পর্যন্ত।বাইশে শ্রাবণ জোড়াসাঁকোর পাথরের ঘরে কবি যখন শেষ নিঃশ্বাসটুকু নিচ্ছেন, তখন ভিড় এড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য গিয়ে নিঃশব্দে হেমন্তবালা শেষ দেখা করে এসেছিলেন তাঁর হৃদয় দেবতার সঙ্গে।