গল্প।। রুবেল ও কাহাকাসানের আলো ।। শানু চৌধুরী
রুবেল তার পাঁচ বছরের জন্মদিনে বাবার কাছে একটা কৃষ্ণচূড়ার চারা কিনে দেওয়ার বায়না ধরলে, তার বাবা তাকে বলেছিল- “ অপেক্ষা…”
পাঁচ বছরের ছেলের এই আবদার হাসানকে বেশ কিছুটা অবাক করে তুলেছিল। কিন্তু ; রাহু নদীর হাওয়া গায়ে এসে লাগতেই হামিদা ছেলেকে বলল- “ না”। “ তুমি কি জানো না, আমাদের উঠোনগুলো সব ছিঁড়ে গেছে। গাছ লাগাবার আর কোনো জায়গা নেই। আমাদের এই সুড়ঙ্গের দেশে আমরা কেমন ঠাসাঠাসি করে বেঁচে আছি, তুমি কি জানো না?” এ কথা বলবার পরেও হামিদা নিজের মনকে অস্বীকার করাতে পারে না যে, মানুষের মনের জলেই গাছ বাঁচে, গাছ বড় হয়। এসব ভাবনার পর হামিদা হাসান আর রুবেলকে খেতে ডাকে। রুবেল আসনপিঁড়ি করে বসতে গেলেই হামিদার মুখ থেকে যে কথা বেরিয়ে আসে তা হল-“ মনটাকে বড় রাখবি বাবা। মনের জোরেই মানুষ সমস্ত গাছদের বাঁচাতে পারে।“ এ কথার ঠিক পরেই পুরস্কার হিসেবে হামিদা তার ছেলের পকেটে তেঁতুলের বীজ ভরে দেয়। সেই তেঁতুল বীজ আজও জল হাওয়া পায় রুবেলের হাতের। এই তেঁতুল বীজ ভরে দেওয়ার পর রুবেল অনেক গাছ পুঁতল… আর তার বাবা কথামতো একটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল এনে দিল তাকে। সে ভাবল, অপেক্ষা বুঝি শেষ হল তার। তার মা আপত্তি জানালেও তার বাবা শোনেনি সে কথা। কারণ , হাসান চেয়েছিল তার ছেলে ভালবাসুক তার মতই গাছ মানুষকে।
রুবেলের সংসারে প্রতিদিন সবাই একেকটা নাটকের চরিত্র হয়। সেই চরিত্রগুলো প্রতিটা ছিদ্র দিয়ে বয়ে নিয়ে চলে তাদের। ক্ষণিকের আলো জ্বলা-নেভার মতো তারা বদলে যায়।
রুবেলের চোখদুটো খোলা। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে মেঘ চায়, যাতে তার গাছেরা জল পায়। এমন সময় তৃষ্ণায় মুখ বেঁকে যায় , হাসানের। ক্লান্ত, নির্ভীক উটের মতো ঠেলে উঠতে থাকে তার গলা। হামিদা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, জলের অবয়বকে জল ভেবে মুখে ঢেলে দিতে চায়। রুবেল দূরে দাঁড়িয়ে ভাবে, তার বাবাই কি এক দীর্ঘ গাছ? যে জলের অপেক্ষায় গভীর থেকে গভীর ঠেলে তুলছে তার নিশ্বাসের শেকড়?
রুবেল চুপচাপ বসে, বাবার তেষ্টা দেখে যাচ্ছে আর ভাবছে, তেঁতুলের পাতাগুলো বোধহয় শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। প্রসব যন্ত্রণার মতো তার মা ছুটোছুটি করছে,এই দুর্যোগের দিনে। মাটিতে ফাটল ধরেছে। হাঁ হয়ে আছে মুখ। পাশের বহুতল হাঁ করে আছে। ঝুলে আছে তাদের বারান্দা। রুবেল ভাবে তেঁতুল চারা, কৃষ্ণচূড়া সবাই রাগ করেছে তার ওপর, এই ভেবে সে গাছের মুখে শেষ জল দিতে থাকে… আর গাছগুলো এক সময় হিম হয়ে এলে… সেই হিম আলো করে বেরিয়ে আসে আবু বেনের মতো এক সাধক। রুবেল চমকে ওঠে। আবু বেনের চোখে পবিত্র আলোর রেখা দেখে। সেই মুহূর্তে সে স্থির করতে পারে না তার চোখ খোলা রাখা উচিত কি না! আবু বেনের পবিত্র আলোর রেখায় সে এক কুমারী বীজ দেখতে পায়, যে বীজ রক্তের দলা হয়ে পড়ে আছে এক না জানা ঠিকানায়। সমস্ত ইঙ্গিতে সে সেই বীজকে নিজের আত্মীয় বলে জানতে পারে আর তার চোখ পাথর হয়ে যায়। সেই পাথুরে চোখ। অপলক। তাকিয়ে থাকে কেবল হাসান আর হামিদার দিকে। রুবেলের চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরে। হাসান আর হামিদার চোখে জড়িয়ে যায় সেই অপরাধের গুল্মলতা, যাদের শিকড়ের টান আজ বুঝতে পারে। এরপর আবু বেন ছেয়ে থাকে আকাশের দিকে নীরব ভঙ্গিমায়… আর ঠিক তখনই যেন সেই নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙ্গে পরার ইঙ্গিত বয়ে আনে দমকা বাতাস। হাসান আর হামিদা ঠোঁটে বিপন্ন হাসি নিয়ে বলাবলি করে- “ মানুষ ভুল করলে শাস্তি পাবে এটাই তো স্বাভাবিক।“ মিলিয়ে যাওয়ার আগাম বার্তা পেয়ে তাদের দুজনের মন হাল্কা হয়ে যায়… আর কৃষ্ণচূড়াও যেন আরও লাল হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার বেশ কিছু বছর পর রুবেল ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে আর সেই নিশ্চিহ্ন, ফাঁকা জায়গায় বসে থাকে। সে মনে করে আজও সেই তেঁতুল, সেই কৃষ্ণচূড়া তার সঙ্গ দিচ্ছে… আসলে কেউ কোথাও নেই। এক ফাঁকা মরুভূমির ওপর রুবেল একা। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে এক সুপ্ত সুন্দর ভঙ্গিমায় সে গাছে জল দিয়ে চলেছে… সে ভাবে তার বাবার পাপের কথা। সে ভাবে মায়ের জ্বালা। সে ভাবে সেই রক্তের বীজের কথা… ভাবে আলোর কথা। এই সময় এক নির্লিপ্ত হাত তার পিঠে ছোঁয়া দিয়ে যায়। সে ভাবে তার পরিবার তাকে বলছে- “ রুবেল এবার তুইও বেরিয়ে আয় এ ঘর ছেড়ে।“ সব গাছের চারা তছনছ হয়ে গেছে আমাদের মতো মানুষের কারণে। তুই আর কত ভাববি? আমাদের নদীর পারের বহুতল ভেঙ্গেই তো শেষ হল সব। মিলেমিশে গেল তোর বাপ-মা আর সখের গাছ। সব লেপটে গেল ইমারতের চাপায়।“ এই ডাক রুবেলকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে। মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভয় তো মৃত্যুই। এই ভয়ে সে সারা মাটির ফাটলের বুকে লিখে চলে- “ কৃষ্ণচূড়া আর তেঁতুল আমার বাবা-মা’র নাম” সারা মাটি জুড়ে লেখার পর এক কাঁপা কাঁপা হাতে সে গোলাপ জলের সুগন্ধি ছড়িয়ে দেয় মাটির বুকে আর ধীরে ধীরে বলে- “ আমার ভীষণ ভয় করছে।“ মনে হচ্ছে আমার মা-বাপ , আমার গাছেরা আমাকে টানছে।“ সে এক ছুটে পালাতে চাইলে তার সামনে এসে পড়ে আবার সেই আলো ভরা আয়না। সে নিজেকে দেখতে পায়,বহুকাল বাদে। আর ঠিক তখনই বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় চারিদিক এবং রুবেলের সর্বাঙ্গ।
অনন্ত বৃষ্টি। বৃষ্টির জলে রুবেল ডুবে যাচ্ছে আর মরুভূমিতে গজিয়ে উঠছে গাছপালা। সে দেখছে তাকে বুকে আগলে নিয়ে চলে যাচ্ছে সব গাছ এক স্বপ্নলোকে। সব গাছ কাঁদছে। রুবেল তখন বুঝতে পারে মানুষকে থামতে জানতে হয়। রুবেল বিড়বিড় করে বলছে- “ নয়টি উজ্জ্বল গম্বুজের পাশে আমাদের পৃথিবীটা আসলে জলে ভাসমান একটা পোস্তদানার মতো। কিন্তু নিজেকে যখন আমরা সেই পোস্তদানার সাথে তুলনা করি তখন নিজেদেরই আবার হাস্যকর রকম ক্ষুদ্র বলেই প্রতীয়মান হয়।“ এইভাবেই সে মিলিয়ে যেতে থাকে। এই শাবেস্তারি উচ্চারণ করতে করতে রুবেল আরও আরও গভীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। মাটির ভিতর আরও গভীর… গভীরে তলিয়ে যেতে থাকে। এ যেন এক প্রাকৃতিক কবর খুঁড়ে দিচ্ছে কেউ… তার কষ্টের পথকে শান্তির বানিয়ে দিচ্ছে কেউ। সমস্ত কাহকাসান তার গায়ের ওপর পরছে। আলো পড়ছে তার বুকে। ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে অকাল বৃষ্টিতে রুবেল। একি সেই আবু বেনের আলো? সেই ফারিস্তার বর্ণময় আলো? যার পথ ধরে রুবেল চলে যাচ্ছে তার তেঁতুল, কৃষ্ণচূড়া, বাপ-মা আর সেই রক্তের বীজের কাছে?