উপন্যাস। আবার এসো ফিরে। রামেশ্বর দত্ত

সেদিনের যাত্রাপালা বসল দুপুরে । কৃষ্ণ-অর্জুন-দ্রৌপদি উপাখ্যান। দিনের আলো থাকতে থাকতে তা শেষ হয়ে গেল। এরপর শুরু হল দেবীবরণ। সঙ্গে মহিলাদের সিঁদুরখেলা। মাথা মুখে সিঁদুর মেখে এক একজন মহিলা হয়ে উঠলেন মা চণ্ডী। শেষে ঠাকুর ভাসানের পালা।  বাড়ির ঠাকুর আর গ্রামের ঠাকুর দুই পাশাপাশি চললমা দুর্গা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে কাঁধে চড়ে এসেছিলেন আবার কাঁধে চেপেই  চললেনএসেছিলেন নিরাভরণে। গেলেন, ফুল মালা, ধুপ ধুনো, আতসবাজির ঝলক দেখতে দেখতে। সঙ্গে বাজনদারদের তাল, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ…সঙ্গে উদোম নাচ ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে।  সব শেষে ফিরে এসে মিষ্টিমুখ।

এরপর…

একাদশী, দ্বাদশী করে তিনটে দিন কাটবার পরেই লক্ষ্মী পূজোর আগে দীনময়ীর পাকাসাধের দিন উপস্থিত হল। পঞ্চামৃত, কাঁচাসাধ, পাকাসাধ অতি প্রাচীন ক্রিয়া। এর আগে, বাকি দুই ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। পাকাসাধের দিন উনুনের পোড়া মাটি খেতে হল গর্ভিণীকে। এ ব্যাতীত সপ্ত ব্যাঞ্জন রেঁধে বেড়ে পাত সাজিয়ে পাঁচ এঁয়োকে সামনে বসিয়ে রেখে দীনময়ীর সাধ ভক্ষণ সমাপ্ত হল। পরে বাড়ি শুদ্ধু মহিলা সহ গ্রামের প্রায় গণ্ডা কয়েক মহিলার সেদিন ভোজের নেমন্তন্ন। তারাও কব্জি ভরে মাছ তরকারী, ভাত, ডাল,দই, পায়েস ভরপেট খেয়ে গর্ভবতীকে পুত্রজন্ম দেবার আশীর্বাদ জানিয়ে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র সহ অন্যান্য পুরুষেরা , মায় ঠাকুরদাস পর্যন্ত সেদিন ঘরের খাওয়া খেতে পারলেন না। এটাই নাকি নিয়ম। তাদের জন্যে বামুন আলাদা করে উনুন পেতে রান্না করেছিল। বাইরের চাতালে বসে পুরুষরা খাওয়া দাওয়া সারলেন।

পাঁচদিনের মাথায় দীনময়ী প্রসব করলেন। জন্ম দিলেন পুত্র সন্তানের। তাকে প্রসব করাল ও পাড়ার যশোদা দাই। বুড়ির বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। ভগবতীদেবীর সব কটা সন্তান যশোদা দাইয়ের হাতেই বিয়োনো। তবু সেই দাই দীনময়ীর নাড়ি কাটতে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যখন দেখল প্রসূতি প্রায় জ্ঞান হারাবার অবস্থায়। পাড়ার মতিমাসী তাড়াতাড়ি রসুন পুড়িয়ে দীনময়ীর মুখে ঠুসে দিতে একটু পরে তাঁর ধাত ফিরল। মতিমাসী জানান দিল, বয়সে প্রথম সন্তান বিয়োনর সময় পোয়াতির এ অবস্থা হয়।

মতিমাসী বাচ্ছার মুখ দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ বার করিয়ে বাইরে এসে খবর দিল, ওগো, তোমাদের ঘরে নারায়ণ এয়েছে। উলু দাও। শাঁখ বাজাও।

ঠাকুরঘর থেকে  শঙ্খ এল। জোড়া শাঁখ। শাঁখে ফুঁ পড়ল। দিনদুপুরে শাঁখের মাঙ্গলিক শব্দে বাড়ি মাথায় উঠল।

মহিলাদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল, কে আগে দেখবে ছেলের মুখ। সকলের হাতেই কিছু কিছু না কিছু উপহার। প্রথম মুখ দেখার উপহার। এসব দেখে ঠাকুরদাস মেয়েদের ঈষৎ বকাঝকা দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তখন গর্বে বুক ফুলিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মনে মনে হাসছেন। নিজের মনেই বলছেন, পুত্রের নামকরণ তো হয়েই গেল। মাঝে রীতি মেনে ভগবতীদেবী তেল আর মাসকলাই বিতরণ করলেন উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে। বাড়িময় আনন্দের বন্যা বইতে থাকল।

                                (১৩)

  আশ্বিনের শেষ সপ্তাহে ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় ফিরলেন। পূজোর ছুটির পর কলেজ খুলে গেছে। তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন। সদ্য ঘর ফেরত মনে দুর্গাপূজোর রেশ তখনও পুরোমাত্রায় বজায় রয়েছে। এমনই সময়ে একদিন এক সংবাদবাহক এসে তাঁকে জানাল, বাচস্পতি মশায়ের মৃত্যু হয়েছে।

-কোন বাচস্পতি মশায়? সংবাদদাতাকে প্রশ্ন করলেন তিনি।

উত্তর এলো, শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতি, আপনার পাঠ্যকালের অধ্যাপক।

ঈশ্বরচন্দ্র মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্বগোক্তি করলেন, রাম রাম… মেয়েটা বিধবা হয়ে গেল!

জানতে চাইলেন, ওরা মেয়েটাকে সতী করেনি তো!

-না। তা করেনি। তবে…

ভদ্রলোক আরও কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও আর কথা বাড়ালেন না। বাচস্পতি মশায়ের মৃত্যুশোকটা তখন তাঁর কাছে অনেক পিছনে পড়ে গেছে। যদিবা তিনি ছিলেন তাঁর অধ্যাপক। তবু, অধ্যাপককে ছাড়িয়ে তিনি দেখছেন অভাগিনী দশ বছরের মেয়েটাকে আর শোক করছেন।

আগন্তুককে বিদায় দিয়ে ভাবতে বসলেন পুরনো দিনের কথা। নিজের মনেই বারবার উচ্চাচরণ করতে থাকলেন, কত করে সেদিন নিষেধ করেছিলাম বাচস্পতি মশাইকে, এই বয়সে আপনার আর বিয়ে করা ঠিক হবে না। আমার কথা শুনলেনই না। কারণ দেখালেন, তিনি বিপত্নীক, বৃদ্ধ হয়েছেন। তারপর বললেন,  আমি তোমার শিক্ষক এবং তোমাকে নিজের ছেলের মতো স্নেহ করি বলে তুমি আমার দেখভাল করো; কিন্তু এভাবে তো দিন চলে না। আমি স্থবিরপ্রাপ্ত হয়েছি। নিজের স্নান, আহার, শৌচ, প্রস্রাবের জন্যে লোকের সহায়তার প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু বিষয়ে তুমি আমাকে সাহায্য করো ঠিকই, তবে আমার অভিপ্রায়, এক সুস্বভাব, বয়স্থা, সুন্দরী কন্যার দার পরিগ্রহ করে নিজের বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিই।  প্রত্যুত্তরে বলেছিলাম, এই বয়সেও আপনি সুন্দরী কন্যা খুঁজছেন, মাস্টারমশাই! তাছাড়া দেশে আজকের দিনে কোন বয়স্থা কন্যাকে আপনি পাবেন যিনি অনূঢ়া রয়েছেন?

বাচস্পতি মশায় মাষ্টারমশাই হলেও কিছুটা ব্যঙ্গ মিশ্রিত কথাই সেদিন বলেছিলাম।  মাস্টারমশাই শোনেননি সে কথা। তাঁকে ওই কাজে নিবৃত করবার জন্যে এও বলেছিলাম, আপনার আর বেশি দিন বাঁচবার সম্ভাবনা নেই। তাই বিয়ে করে একটা নিরাপরাধ বালিকাকে চিরদুঃখী করবেন না। বিয়ে তো দূরে থাকুক, ওই চিন্তাতেও আপনাকে পাপ স্পর্শ করবে। কথা শুনে তিনি  টিপ্পনী কেটেছিলেন, তুমি কি লাটুবাবুর থেকেও বেশি বোঝ? চুপ করে গিয়েছিলাম। পরে জানতে পারি, সেই লাটুবাবু, ছাতুবাবু, আর নাড়াইলের জমিদার রামরতন রায় মিলে মেয়েটার সঙ্গে ওনার  বিয়ে দিয়েছে। বারাসতের গরীব ব্রাহ্মণের পরমাসুন্দরী মেয়ে। দশ বছর বয়স। খবরটা শুনে বুঝেছিলাম, এ মেয়ের কপাল পুড়ল। আর ঠিক তাই হল! ক’টা বছর ঘুরতে না ঘুরতে বুড়ো মরল, মেয়েটা বিধবা হল। এখন কোথায় তার স্থান হবে? বাপের কাছে? সেও না হয় হল। কিন্তু তাই বলে তার যৌবনটা? সেটাও তো মাটিতে মিশল। বাকি জীবনটা তার কাটবে কেমন করে? বিধবার তো বিয়েও হবে না । তাহলে,  যৌবনটাকে নিয়ে লোভী পুরুষের দল কুকুর বেড়ালের মতো ছিঁড়ে খাবে? পুরুষ জাতকে তো আর  চিনতে বাকি নেই? বিধবাকে বিয়ে করতে সমাজে বাধার পাহাড়। তা কি শাস্ত্রে বলা আছে? নাকি এ বলা আছে, অল্প বয়স্থা বিধবা রমণীকে পেলে শুধু উপভোগ করো? হাড় বজ্জাত, ওই বাচস্পতি মশায়টা একটা নারীর জীবন শেষ করে দিয়ে গেল! বিয়ে  করেছেন, করেছেন। তারপরে একদিন আমায় বলেন কিনা, তোমার জননীকে একবার দেখতে যাবে না? কলেজ থেকে বুড়ো আমায় টানতে টানতে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন।  গুরুমশাইয়ের পত্নী, গুরুপত্নী। তাঁকে দেখতে যাচ্ছি। বিনা প্রণামীতে কি দর্শন হয়? পকেটে নেই একটাও টাকা। কলেজ দারোয়ানের কাছ থেকে দুটো টাকা ধার নিয়ে গেলাম । মা জননীর পায়ে টাকাটা দিয়ে প্রণাম করেই ফিরে আসার সংকল্প করলাম । করেছিও তাই।… না, তা হবে না। বললেন, তোমার মাকে দেখে যাও। দাসীকে ডাকলেন। বললেন, নতুন বউয়ের ঘোমটা খুলে বাবুকে ওর মুখ দেখাও। তাই করল সে। মেয়ের মুখ দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিললাম । হা ভগবান, করে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসছি, বাচস্পতি অনুরোধ করলেন,  জল মিষ্টি খেয়ে যাও । রাগে দুঃখে, সেদিনই তাঁকে জবাব দিয়ে এসেছিলাম, আপনার ভিটায় আর কখনও জলস্পর্শ করব না…

পুরনো দিনের কথা ভাবছেন আর চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়ছে। এই নয় যে, মাষ্টার মশায়ের মৃত্যুর কারণে তাঁর কান্না; তিনি অশ্রু সংবরণে অপারগ হচ্ছেন, নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে। তবে কি, সত্যিই বিধবা রমণীদের জন্যে কেউ চিন্তা করবে না? রাজা রামমোহন বিধবাদের বাঁচবার অধিকার দিয়ে গেছেন, কিন্তু সমাজে সেই অসহায়, নাবালিকা; শুধু নাবালিকাই বা কেন, সাবালক রমণী, যাঁরা স্বেচ্ছায় পুনর্বিবাহ করতে চায়, তাদের জন্যে কি তিনি নিজে কিছু করে যাবেন না?

নাহ। চেষ্টা করতেই হবে। তাতে যা আপদ বিপদ, বাধা আসুক না কেন। তিনি ভাবতে থাকেন, বিধবাদের সমাজে পুনপ্রতিষ্ঠা করবার জন্যে আমরণ লড়াই করে যাবেন।

দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ঈশ্বরচন্দ্রের হাত পা, বুকের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। কোমল মুখে  আমআঁটির কঠোরতা ফুটে উঠল। খাট ছেড়ে উঠে পড়লেন। চেয়ার টেনে নিলেন। টেবিলে গিয়ে বসলেন। কাগজ বের করলেন। দোয়াত থেকে খাগের কলমটা তুলে হাতে নিলেন। লিখতে বসলেন।

বিধবা বিবাহ নিয়ে যত শিগগীর সম্ভব একটা পুস্তক রচনা করে তা প্রকাশ করতে হবে। প্রচারের জন্যে পাশে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা রয়েছে। সময়ে সেখানেও লেখা প্রকাশের জন্যে পাঠাবেন। বিধবা বিবাহের জন্যে সরকার বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই হবে এখন তাঁর কাজ। এই নিয়ে সমাজকে সচেতন করতে হবে।

দিনরাত এক করে ঈশ্বরচন্দ্র বই লিখে চলেছেন। একদিকে কলেজে অধ্যাপনার কাজ। অন্যদিকে বই লেখার তাড়া। এরই তরাসে অর্ধেক দিন দুপুরের খাওয়া হয়ে উঠছে না। রাতের খাওয়ার বিষয়েও তথৈবচ। সুহৃদ রাজকুমার মশায় ঈশ্বরের এই অবস্থা দেখে একদিন বললেন, মশায়, এভাবে চললে তো আপনি অতি শীঘ্র অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এভাবে অনাহারে থাকাটা কি যুক্তিযুক্ত হচ্ছে?

-কী করি বলুন?

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন। পরে কথা যোগ করলেন, এখন বাড়িতে গিয়ে যে রান্নাবান্না করে খেয়ে আসব, তাতে সময় তো যাবে। সেটুকু সময়ও আমি অপচয় করতে রাজী নয়, রাজকুমার।

-এই যদি অবস্থা, আপনার আপত্তি না থাকলে দুপুরে আমার বাড়িতেই খেয়ে নিন। আমি তো বাড়ি যাই রোজ।  আপনিও আমার সঙ্গে চলে আসুন।

বেশ গুরুত্ব দিয়ে রাজকুমার মশায় কথাটা বললেন। বন্ধুর এ প্রস্তাবে ঈশ্বরচন্দ্র বাধ সাধলেন না। দুপরের খাওয়া ওনার বাড়িতেই চলতে থাকল। তিনি কাজ করেন অনেক দেরী পর্যন্ত। কলেজে বসেই তাঁর কাজ। বিকেলেও কিছু জলখাবারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তার ব্যবস্থা হয়ে গেল অন্য সুহৃদ শ্যামবাবুর দ্বারা। তাঁর বাড়ি থেকে বিকেলের জলখাবার আসতে লাগল।

নিশ্চিন্ত মনে ঈশ্বরচন্দ্র কলেজ লাইব্রেরীর এ বই সে বই  পড়ছেন লিখছেন। পড়ার মধ্যে রয়েছে নানান শাস্ত্রের বই। খুঁজে তাকে পেতেই হবে, শাস্ত্রে কোথায় লেখা রয়েছে, বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ। শাস্ত্রে যদি তা না থাকে, তাহলে এ নিয়ম মানুষের মন গড়া। যেমন কিনা ছিল সতীদাহের কারণ। পুরাকাল থেকেই এ সমাজ পুরুষ শাসিত। তারাই নিজেদের স্বার্থের জন্যে এই নিয়ম করেছে? শাস্ত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে, তাঁদের মন গড়া নিয়ম ভুল। একে বাতিল করতে হবে। দরকার পড়লে সরকার থেকে নিয়ম করে তা করাতে হবে। যেমন কিনা হয়েছে সতীদাহ রদ করার ক্ষেত্রে।

তিনি লিখে চলেছেন। সঙ্গে পড়া। দিনের পর দিন। কিন্তু অভীষ্ট বস্তুকে  কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে মন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সেরকমই একদিন নিজের  কলেজের লাইব্রেরীতে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করলেন। কিছু না পেয়ে শেষে বেশ মন খারপ নিয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে ধরলেন।

অনেকটা রাত হয়ে গেছে। পথ প্রায় জনমানব শূন্য। ইতস্তত এক দুজন লোক চলাচল করছে। পথের ধারের অনেক বাড়ির আলোও নিভে গেছে। গৃহস্থজনেরা শুয়ে পড়েছে। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। গাছে গাছে পাখির দল ঝিমুচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্র পথ চলছেন রাস্তার বাতির আলো দেখে। বাতিগুলো সন্ধ্যের পর থেকে ঠায় একলা দাঁড়িয়ে পথকে আলো দিয়ে চলেছে।

তিনি অনেক দূর চলে এসেছেন। হঠাৎ তাঁর যেন দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল।  তাই তো!  পেয়েছি, পেয়েছি, করে, চেঁচিয়ে উঠলেন? আর্কিমিডিসের সুত্র খুঁজে পাওয়ার মতো উইরেকা, উইরেকা’র পরিবর্তে  চিৎকার, পেয়েছি। পেয়েছি…

গাছে গাছে ঘুমন্ত পাখিরা জেগে উঠল। পথের ধারের গৃহস্থ বাড়ির মানুষেরও হয়তো নিদ্রাভঙ্গ হল।  অথচ তাঁর সেসবে খেয়ালে নেই। নিমেষে পিছন ফিরে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ভাগ্যিস শহরের পথ তখন নির্জন হয়ে গিয়েছিল। তা না হলে, ওই চিৎকার আর উন্মাদের মতো পিছন ফিরে উল্টোদিকে হাঁটা দেখে মানুষ নির্ঘাত তাঁকে উন্মাদ বলেই মনে করত।

প্রায় দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এলেন কলেজে। । দারোয়ানকে ডাকলেন। গেট খোলালেন। সোজা লাইব্রেরীতে গিয়ে ঢুকলেন। যে বইয়ে তিনি তাঁর উদ্দিষ্ট বস্তুটি লক্ষ্য করেছিলেন, সেই পরাশর সংহিতা বার করে আবার পড়তে বসলেন। বার বার পড়ছেন। বইয়ের পাতায় একই জায়গা নজর ঘোরাঘুরি করছে। তিনটে শ্লোকের ওপর।

‘নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।’

পরের শ্লোক

‘মৃতে ভরতরি যা নারী ব্রহ্মচর্যে ব্যবস্থিতা।

সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ।।’

শেষ শ্লোক

‘তিস্রঃ কোট্যাহর্ষকোটী ন যোনি লোমানি মানবে।

তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গং  ভর্তারং যানুগচ্ছতি।।’

প্রথম শ্লোকেই তাঁর জিজ্ঞাসার উত্তর পেয়ে গেলেন। বই বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন। কলেজ গেটে তালা পড়ল। বাড়ি ফিরে চললেন। রাত গভীর হয়ে গেছে। নির্জন রাস্তা। গৃহস্থের বাড়ির বাতি সব নিভে গেছে। লোকজন শুয়ে পড়েছে। পথ চলেছেন আর মনে মনে আওড়াচ্ছেন, কী লিখবেন।

বিষয় মনে বসে গেছে। লেখায় দেরী হল না। দুদিনের মধ্যে লেখা শেষ করে ফেললেন। শ্লোক এবং সঙ্গে তার ব্যাখ্যা, যুক্তি, জিজ্ঞাসার উত্তর। স্তবকে স্তবকে সাজিয়ে লিখে ফেললেন, বিধবাবিবাহ কেন শাস্ত্র সিদ্ধ। ব্যাখ্যা দিলেন,  যদি তাই হয়, তাহলে, বাংলা তথা ভারতের অগণিত হিন্দু  বিধবা নারীকে দুর্বিষহ জীবন নিয়ে কেন বাঁচতে হবে? কেন তাদের বাকি জীবন কাশী, বৃন্দাবন, মথুরায় বাস করতে হবে? মুন্ডিত মস্তকে রাধা বিনোদের চরণে নিজেদের উৎসর্গ করে তিলে তিলে যৌবনকে পদদলিত করতে হবে?  বৈধব্য কৈ পুরুষদের তো বইতে হয় না? বইতে হয় না বলেই, তারা বোঝে না, কী ভীষণ জ্বালা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে নৈরাশ্যের রাজ্যে নারীদের দিনাতিপাত করতে হয়। কেন কখনও সখনও তাদের ব্যাভিচারিণী হতে হয়। সমাজে কেন তারা মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না? চাইলে পুনর্বিবাহ করে সুস্থ সফল ভাবে সংসার জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না, কেন?

বই  ছেপে বেরলে সমালোচনার মুখে পড়বে , এ তিনি ভালো মতো জানেন। তবে, তিনি দমলেন না।  এমনিতেই লোকে তাঁকে উপহাস করে বলে, ঈশ্বরচন্দ্র নারীজাতির প্রতি দুর্বল। এখন তা বেড়ে গেল শতগুণ। তিনি জানেন, সকলের মন, হৃদয় এক নয়। নারী দেখলে কোনও কোনও পুরুষের মন উচাটন হয়। অথচ নারী তাঁর কাছে মাতৃরূপ। তা সে বালিকাই হোক, আর বয়স্থা মহিলা। তাদের দুঃখে তাঁর মন সব সময় কাঁদে। রমণীর প্রতি কত অনাচারই তিনি দেখেছেন। এক তো, ওই শিক্ষক বাচস্পতি মশায়ের বালিকা বিধবা বধূ। তারপরেও আছে,  তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা এক তর্করত্ন মশায়, তিনি তিন তিনজন বালিকা পত্নী নিয়ে বাস করছেন, যেখানে মশায়ের নিজের কন্যা বিধবা হয়ে বাবার কাছে ফিরে এসে বৈধব্য বয়ে চলেছে। কোথাও বা, বাল্যবিধবা সহোদরার ভরণপোষণকে শিকেয় তুলে ভাইরা সুখে পত্নীদের নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিধবারা বালিকা অথবা কিশোরী। গরীব ঘরের সন্তান। অর্থাভাবে তাদের কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা, ঘাটে যাবার আগে কোনও পুরুষকে ধরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে।

   সমালোচনার মোকাবিলা করবেন। উত্তর দেবেন পত্রিকার মাধ্যমে। কেন, কেন ওই অনাচার? কেন বাল্য বিবাহ? লোকে হয়তো তার দিকেই আঙুল তুলবে, আপনি নিজেও তো পাঁচ বছরের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। তখন?

উত্তর ঠিক করা রয়েছে, তখন তিনি কিছু বুড়িয়ে যাননি। চোদ্দো বছরে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। পাঁচ  বছরের কন্যা হলেও, তাঁকে যথাসময়ে যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে ঘরে এনেছেন।

ঝোড়ো বাতাসের মতো প্রশ্ন ধেয়ে আসবে, নিজের ঘর দিয়েই এ প্রথা চালু করছেন না কেন?

উত্তর হবে, পরিস্থিতি আসলে অবশ্যই তা করা হবে। ছেলে আমার এখনও বিবাহের বয়সে আসেনি।

বই প্রকাশ হলে নিজের পরিবার জনরোষের আগুন থেকে বাইরে থাকবে না, তাও তিনি নিশ্চিত। গ্রামে বাস কঠিন হয়ে পড়বে। বাবার যজমানি ক্রিয়াকর্ম ব্যাহত হবে। হতে পারে, যে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রাম মাথায় করে রাখে, সেখানে লোকে তাকে নানান কথা শোনাবে। অপমানও করতে পারে। পারিবারিক পরিস্থিতি বিষময় হয়ে উঠবে। তবে সে ভয়ে কি তিনি পিছিয়ে আসবেন? নাহ। স্থির করলেন, বাবা- মায়ের অনুমতি নিয়েই তিনি বই প্রকাশ করবেন।

বীরসিংহ গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন । নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপিখানা সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন। সযত্নে তা কাঁধের ঝোলার ভিতর রাখা। দুইদিনে পথশ্রমে গৃহে পৌঁছালেন। মুখ চোখে কিছুটা আতঙ্কের আভাষ। যদি কিনা, ঠাকুরদাস বিষটায় অনুমতি না দেন? তাহলে কি তিনি এই মহৎ কর্ম থেকে পিছিয়ে আসবেন? এটা এখন সত্যিই তাঁর কাছে মহৎ কর্ম। মরণ বাঁচনের সমস্যা না হলেও, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়। কী ভীষণ মনকষ্টে যে তিনি রয়েছেন, তার একমাত্র সাক্ষী তিনি নিজে। কাউকে একথা বলে বোঝানোর উপায় নেই। বুঝতেন হয়ত একজন। তিনি হচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে এখন তিনিও নিজের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত পরিবার নিয়ে ভীষণ নাড়াঝামটা খাচ্ছেন।

বাড়ি পৌঁছলেন। সেইদিনই বিষয়টা ঠাকুরদাসের কাছে পাড়লেন না। প্রথমে দুটো দিন গেল নিজের সদ্যজাত সন্তানকে আদর ভালবাসা দিতে। বংশের প্রথম নাতি নারায়ণ। বাড়িময় তার আদর। ভগবতীদেবী নাতীকে কিছুতেই কাছ ছাড়া করেন না। সারাদিন শুধু ‘নারায়ণ, নারায়ণ’ করে  কোলে আঁকড়ে রেখে দেন। রাতটুকু আর মায়ের স্তন্যপানের সময়টুকু দীনময়ী সন্তানকে কাছে পান। বাকি সময় তাঁর কাটে সংসারের কাজে কাজে। এমনকি স্বামী এসেছেন, তাতেও সময় দিয়ে তাঁর যত্ন আত্তি করতে পারছেন না। বাড়িতে ঠাকুর চাকর থাকা সত্বেও সব ভার এখন ভগবতীদেবী একমাত্র পুত্রবধূর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আগের মত রাতেই ঈশ্বরচন্দ্রের মুখোমুখি হলেন দীনময়ী।

এবার আর দীনময়ীর অভিমান নেই। বরং স্বামীর প্রতি তার প্রেম ভালাবাসা উপচে পড়ছিল। পাশে খোকাকে শুইয়ে রেখে কত রাত পর্যন্ত দুজনের গল্প হল। শরীরে শরীর ঠেকিয়ে ভালবাসা জানানো হল। পরস্পরের ইচ্ছা থাকলেও পূর্ণ মিলন সম্ভব হল না। কারণ দীনময়ীর মাতৃদেশ এখনও মিলনের উপযুক্ত নয়। আরও কিছুদিন সময় লাগবে। পরেরবারের জন্যে তুলে রেখে দিন, বলে দীনময়ী স্বামীর আবেগ উচ্ছ্বাসকে স্থিমিত করে দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও বুঝলেন। নিজেকে সংযত করে রাখলেন। প্রশ্ন করলেন, ভবিষ্যতে আর সন্তান চাও না, দীনময়ী? লজ্জায় মুখ লুকোলেন তিনি। পরে আবেশ জড়ানো গলায় বললেন, এবার একটা মেয়ে চাই।

-যা চাওয়া যায়, তাই কি আর পাওয়া যায়? এ তো ওপরওয়ালার হাত। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করলেন।

-না গো না। আমি জানি, মন চাইলেই, তা হয়।

সরলমনা দীনময়ীকে কে বোঝাবে এ সবই নারী পুরুষের শরীরের ব্যাপার। ঈশ্বরচন্দ্র যার কিছুটা জানেন। নিজে কোনও এক সময় এই নিয়ে কিছু বইপত্র পড়েছেন। তবে, আজ আর তিনি তা ভাঙলেন না। স্ত্রীর ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে দীনময়ীর কথা মেনে নিলেন। কে জানত, পরবর্তী সন্তান তাঁদের মেয়েই হবে। তাও একটা দুটো নয়, পরপর চার জন । মাত্র দেড় দু বছরের অন্তর রেখে।

পরেরদিন ঈশ্বরচন্দ্র ঠাকুরদাসের সামনে নিজের বইয়ের কথাটা পারলেন। বললেন, বাবা, আমি এই পুস্তকখানা রচনা করেছি। এর বিষয় বিধবা বিবাহ। নানান শাস্ত্রাদি থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে আমি এটি লিখেছি। আপনি শুনে যদি মত দেন তাহলে পুস্তক আকারে তা প্রকাশ করতে  পারি। এটা সময়ের চাহিদা, বাবা।

বইয়ের পাণ্ডুলিপির দিকে তাকালেন ঠাকুরদাস। বললেন,যদি আমি এ বিষয়ে মত না দিই, তুমি কি করবে?

  ঈশ্বরচন্দ্রের মনে সংশয়ের উদয় হল। তিনি তো কিছুটা হলেও মাতৃআজ্ঞায় এই বিষয়ে এগিয়েছিলেন। বাঙলার মেয়েরা অল্প বয়সে বিধবা হলে যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তাদের জীবন কাটে, তার একটা বিহিত করার জন্য মা তাকে মন দিতে বলেছিলেন। এই পুস্তক লেখার ক্ষেত্রে সেটা যথেষ্ট প্রেরণা যুগিয়েছে । এখন যদি বাবা পুস্তক প্রকাশে মত না দেন তাহলে একদিকে যেমন মাতৃ ইচ্ছা অপূরণ থেকে যাবে; তেমনই সমস্যার হাল কী করে করবেন তিনি, তা ভেবে উদ্বিগ্ন হলেন।

এটা যে তাঁর অভীষ্ট, তা বোঝাবার জন্যে ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করলেন, তাহলে আমি আপনার জীবদ্দশায় এ গ্রন্থ প্রচার করব না। আপনার দেহত্যাগের পর আমার যা মনে হবে, তাই করব।

-আচ্ছা, আজ থাক। কাল নির্জনে বসে মনোযোগর সঙ্গে আমি সমস্ত শুনব, পরে আমার যা বক্তব্য, বলব।

ঠাকুরদাস সেখান থেকে উঠে গেলেন।  ঈশ্বরচন্দ্র মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। তবে, কেন যেন তাঁর মন বলছিল, বাবা তো তাঁর জেদ জানেন। তিনি যে কঠোর পরিশ্রমী, বিচক্ষণ এক পিতার সন্তান, তাও বাবার ভালো  জানা রয়েছে। সহজে তিনি এ পথ থেকে সরবেন না, এ কথা বাবা ছাড়া বেশি কে জানবে? তাছাড়া তখনই মাতৃ ইচ্ছার কথাটা খোলসা করবেন। এই ভেবে, মন হালকা করে স্থান ত্যাগ করলেন।

পরেরদিন। ঠাকুরদাস বসে রয়েছেন বাড়ির চাতালে। বিকেলের সময়। রোদ পড়ে গেছে। মৃদু বাতাস বইছে। বাড়ির গাছপালা গুলোর মাথা হেলদোল খাচ্ছে হেমন্তের হাওয়ায়। বাতাসে একটু শীত শীত ভাব। ঠাকুরদাসের গায়ে র‍্যাপার জড়ানো। এই সময়টা তিনি এভাবেই চাতালে বসে কাটান।

সামনে দিয়ে বাচ্ছারা হুটোপাটি করে খেলে। তিনি তা দেখে আনন্দ পান। সেখানে রয়েছে বাড়ির ছোটরা। সঙ্গে আশপাশের বাড়ির বাচ্ছারাও এসে যোগ দিয়েছে। এটা তাঁর নিত্যাকার অভ্যেস।

চাকরকে দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ছিলেন নিজের ঘরে। দীনময়ীর সঙ্গে খোস গল্প করছিলেন। বাবার ডাক পেয়ে নিচে নেমে এলেন। বুঝেছেন, বাবা এবার তার নতুন বইয়ের কথা শুনতে চান। হাতে করে পাণ্ডুলিপিখানা নিয়েই নামলেন।  সামনে আসতে তাঁকে বসতে বললেন। ফাঁকা একটা বেতের মোড়া সামনে রাখা ছিল । ঈশ্বরচন্দ্র সেটাতে উপবেশন করলেন।

-হাতে পাণ্ডুলিপিখানা নিয়েই এসেছ  দেখছি। ভালোই হয়েছে। পড়ো। ঠাকুরদাস বললেন।

-আমি পড়ব?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার লেখা তুমিই পড়ো। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি।

ঈশ্বরচন্দ্র পড়া শুরু করলেন।–

নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।

পঞ্চস্বাপৎসু  নারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে।।

অর্থ , স্বামী অনুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব স্থির হলে, সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করলে অথবা পাপী, নীচ হলে, স্ত্রীদের পুনর্বিবাহ শাস্ত্র সম্মত।

মৃতে ভরতরি যা নারী ব্রহ্মচর্যে ব্যবস্থিতা।

সা মৃতা লভতে স্বর্গং যথা তে ব্রহ্মচারিণঃ।।

অর্থ, যে নারী স্বামীর মৃত্যু হলে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে থাকে, সে দেহান্তে ব্রহ্মচারীদের মতো স্বর্গলাভ করে।

তিস্রঃ কোট্যাহর্ষকোটী  ন যোনি লোমানি মানবে।

তাবৎ কালং বসেৎ স্বর্গে  ভর্তারং যানুগচ্ছতি।।

মানে, মানুষের শরীরে যে সাড়ে তিন কোটী লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তারা স্বর্গে একই সঙ্গে বাস করে।

সংস্কৃত শ্লোকে ভরা বইটার আদ্যপান্ত তিনি পড়ে গেলেন। সঙ্গে অর্থও জানালেন। জায়গায় জায়গায় যা ব্যাখ্যা ঠকুরদাস চাইলেন, তাও দিলেন। ঠাকুরদাস প্রশ্ন করলেন, তুমি যা লিখেছ, তা সমস্ত শাস্ত্রমতে লেখা হয়েছে?

ঈশ্বরচন্দ্র জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, অবশ্যই তা হয়েছে, বাবা। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

ছেলের এতটাই নিশ্চয়তা আছে জেনে তিনি বললেন, তুমি এ বিষয়ে বিধিমতে চেষ্টা করতে পারো। আমার আপত্তি নেই।

ঈশ্বরচন্দ্র হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মনে পুলক দেখা দিল। সেখান থেকে উঠে ভগবতীদেবীর কাছে গেলেন। মা যে এত শাস্ত্র বিষয় বুঝবে না, তা জেনেই বললেন, মা আমি বিধবা বিবাহ বিষয়ে এই পুস্তকখানা রচনা করেছি। অবশ্যই তা শাস্ত্রের পথ ধরে। কিন্তু তুই তো আর অত শাস্ত্রের বিষয় বুঝবি না, তবে জানবি, এ পুস্তক রচনা তোর আজ্ঞাবহ হয়েই আমি করেছি।

ভগবতীদেবীকে আরও কিছুটা নিঃসন্দেহ করবার জন্য জানালেন, শাস্ত্রে বিধবা বিবাহের বিধি রয়েছে, মা।

করুণার মূর্তি ভগবতীদেবী। তিনি তো জানেন, বিধবা রমণীদের সমাজে কী ভাবে রাখা হয়। নিরন্তর তারা চোখের জলে ভাসতে থাকে; অমঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে তাদের কোনও শুভকাজে থাকতে দেওয়া হয় না, এদের জন্যে তাঁর ছেলে যা করেছে, তা সেই অভাগীদের মঙ্গলই করবে। তিনি বললেন, তোমার মঙ্গল হোক। তবে এক কাজ করো, ওনাকে (ঠাকুরদাস) এখনই এ বিষয়ে বলতে যেও না।

-কেন বলব না, মা?

ঈশ্বরচন্দ্র জানেনে, তিনি কী করেছেন। তাই ভগবতীদেবীকে মন খোলসা করাবার জন্যে এমন প্রশ্ন করলেন।  নিরক্ষর ভগবতীদেবী জানেন, তাঁর স্বামী পণ্ডিত না হলেও, শাস্ত্র বিষয়ে নানান সময়ে নানান আলোচনা সমালোচনা করে থাকেন। তাছাড়াও বহুকাল কলিকাতাবাসের ফলে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা হয়েছে। তাই ছেলেকে সাবধান  করবার উদ্দেশ্যে বললেন, তা হলে, উনি বাধা দিতে পারেন। কারণ তুমি বিধবাবিবাহ প্রতিষ্ঠায় নামলে, ওনার ক্ষতি হবে পারে, এ কথাও আমি ভেবেছি। সমাজে আমাদেরকে একঘরে করে রাখতে পারে, ওনার তাতে যজমানী কাজে বাঁধা আসবে।

হাসতে হাসতে ঈশ্বরচন্দ্র ভগবতীদেবীর কথার জবাব দিলেন, বাবা আগেই এতে মত দিয়েছেন, মা।

-বেশ হয়েছে। তবে আর কি?

ভগবতীদেবীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র খুশি মনে মাকে প্রণাম করলেন। ফিরে গেলেন নিজের ঘরে। হাতে ধরা পাণ্ডুলিপিখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবতে থাকলেন, এ বিষয়ে আর দীনময়ীকে কী বা জানানোর রয়েছে?

আরও দিন দুই বাড়ির সকলের সান্নিধ্যে কাটিয়ে তিনি কলিকাতায় ফিরে এলেন।

 

(১৪)

কলিকাতায় ফিরে তৎপরতার সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র ‘বিধবাদিগের পুনঃসংস্কার’ নাম দিয়ে বই প্রকাশ করলেন। যা মনে করেছিলেন, ঠিক তাই হল। বাঙালি সমাজে সমালোচনার ঝড় উঠেছে । চারিদিকে গেল গেল রব ।

হিন্দু ঘরে বিধবা বিবাহ! আবার তার ওপর লেখা বই? হল কী দেশটার! দেশ সমাজ কি সব রসাতলে যাবে?- এদিকে মুখে এই কথা, আবার লুকিয়ে লুকিয়ে ওই বই কিনে পড়ছে অনেকে। সাধারণের মনে কৌতূহল জাগলেও মুখ ফুটে কেউ বলছে না, বইখানা পড়ব। আসলে বিধবা যদি আবার বিয়েই করল, তাহলে তাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা তো বন্ধ হয়ে যাবে। এমন ধারণা নিয়ে যারা রয়েছে, তাদের কাছেই এই বই লুকিয়ে পড়বার বস্তু। তবে কিছু পণ্ডিত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি যে বইটা মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন না, তা নয়। তাঁরা সকলেই ঈশ্বরচন্দ্রের মতো খোলা মনের মানুষ না হলেও, সমাজ সংসারে কী ঘটছে, সে বিষয় জেনে, থেকে থেকে উতলা হন।

ঈশ্বরচন্দ্রের বইয়ে শাস্ত্রের কথা তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তির পাহাড় খাড়া করা হয়েছে। পণ্ডিতজনেরা এককথায় তা নাকচ করতে পারছেন না। যাঁরা বিদ্বেষবুদ্ধি রহিত হয়ে বইটা পড়ছেন, তাঁরা শুধু বিধবা বিবাহের আবশ্যকতা আছে, সেটা উপলব্ধি করছেন।  আরেঠারে ঈশ্বরচন্দ্রকে সমর্থন জানাচ্ছেন। বই এবং ব্যক্তির উপরে নানান  কটুক্তিপূর্ণ সমালোচনার যে ঝড় উঠছে, তা সামাল দিতে নিজেরা অল্পবিস্তর সুস্থ সমালোচনা করছেন। কিন্তু তাতে স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব।

অল্পদিনের মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রস্তাবের বিপরীতে ঝড়ের গতি প্রবল হয়ে দেখা দিল। ঈশ্বরচন্দ্রের মন ভেঙে গেল।  ভাবলেন, তবে কি সত্যিই বিধবা বিবাহ চালু করা যাবে না? বিদগ্ধ জনেরাও বিরূপ সমালোচনায় মেতেছে! সমাজ কি তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে? মনে সংশয় দেখা দিল। ভীষণ অস্বস্তিতে দিন কাটছে।

তবে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত আহরণ না করা তাঁর ধাতে নেই। তাই সমালোচনার জবাব তাঁকে দিতেই হবে। সব দ্বিধা, জড়তা দূর করে আবার কলম ধরলেন। একই বিষয়ে দ্বিতীয় বই লিখতে শুরু করলেন। এবারের বই, বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা, এতদবিষয়ে প্রস্তাব।

বই তো লিখলেন। কিন্তু এবার তো আর বীরসিংহে গিয়ে বাবাকে বই পড়িয়ে আসা সম্ভব নয়। একবার তিনি মত দিয়েছেন। সেসময় তাঁর চিন্তা কিছু অমূলক ছিল না যে, এই বই প্রকাশ হলে সমাজে ঝড় উঠবে। ঝড় উঠেছে। এখন তাকে সামাল দিতে হবে। আবার নিজ অভীষ্ট সাধনও করতে হবে। কার সাহায্য নেবেন, কার সামনে এবার নিজের মতকে যাচাই করবেন, ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল দেবেন্দ্রনাথের নাম। সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ তিনি। তাঁকেই কেন না, দ্বিতীয় বই পড়ানো যাক?

হাতে করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে চললেন, দেবেন্দ্রনাথের কাছে। ঈশ্বরচন্দ্রের বড় ভরসার স্থল দেবেন্দ্রনাথ । তাঁর হাতে পাণ্ডুলিপি তুলে দিয়ে অনুরোধ করলেন, এই বই পড়ে অবশ্যই মতামত দিতে হবে আপনাকে। প্রয়োজনে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বইয়ের সারকথা প্রকাশ করতে হবে।

হৃষ্টচিত্তে দেবেন্দ্রনাথ তা গ্রহণ করলেন। সম্মতি দিলেন, অবশ্যই তিনি মত দেবেন এবং প্রয়োজনে পত্রিকায় প্রকাশও করবেন। সেদিন ঈশ্বরচন্দ্র নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরলেন।

বই নিয়ে পড়তে বসলেন দেবেন্দ্রনাথ। পড়ছেন, আর তাঁর গা শিউরে উঠছে। কী ভীষণ তেজস্বী এ লেখা!

এক জায়গায় এসে তিনি পড়ছেন, হা ভারতবর্ষীয় মানবগণ! আর কতকাল তোমরা মোহনিদ্রায় অভিভূত হইয়া প্রমোদশয্যায় শয়ন করিয়া থাকিবে? একবার জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করিয়া দেখ, তোমাদের পুণ্যভূমি ভারতবর্ষ ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রুণহত্যাপাপের স্রোতে উচ্ছলিত হইয়া যাইতেছে। বিধবাদিগের দুরাবস্থা দর্শনে , তোমাদের চিরশুষ্ক নীরস হৃদয়ে করুণা রসের সঞ্চার হওয়া কঠিন এবং ব্যাভিচার দোষের ও ভ্রুণহত্যাপাপের প্রবল স্রোতে দেশ উচ্ছলিত হইতে দেখিয়াও মনে ঘৃণার উদয় হওয়া অসম্ভবিত। তোমরা প্রাণতুল্য কন্যা প্রভৃতিকে অসহ্য বৈধব্যযন্ত্রনানলে দগ্ধ করিতে সম্মত আছো।…

দেবেন্দ্রনাথ পড়ছেন আর তাঁর চোখ দিয়ে হু হু করে জলের ধারা বইছে। এ নয় যে , তিনি দেশের মেয়েদের দুরাবস্থার হালহকিকত জানেন না। তবে, এখন লেখার মধ্যমে তাঁর চোখের সামনে তা চলন্ত ছবির মতো জেগে উঠছে। তিনি করুণারসে আপ্লুত হয়ে পড়ছেন। নিজেকে সামলে আবার পড়তে শুরু করলেন,

  যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই। ধর্ম নাই, ন্যায় অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম আর যেন সে দেশে হতভাগ্য অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে। হা অবলাগণ! তোমরা কী পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ কর, বলিতে পারি না।

চেয়ারে বসে পড়ছিলেন। সেখান থেকে উঠে সটান চলে গেলেন উপাসনা ঘরে। মন স্থির করবার জন্যে। পরের দিন নিজেই ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে চলে গেলেন। সাক্ষাতে দীর্ঘ করমর্দনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে সমর্থন জানালেন। কথা দিয়ে এলেন, তত্ত্ববোধিনী তাঁর পশ্চাতে রয়েছে। শুধু তাই নয়, নিজের সর্ব শক্তি লাগিয়ে এ বিষয়ে সাহায্য করবেন।

পুস্তক প্রকাশ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তারপরেই পত্রিকা সরাসরি জানাল, সমালোচনামুখর জনতা অথবা পণ্ডিতেরা যে বিচার প্রণালী দ্বারা তাঁদের মত সঠিক বলে প্রচার করছে, তা অত্যন্ত দোষাবহ। তাঁরা বিষয়েতে সবিশেষ মনোযোগী না হয়েই অমূলক আপত্তি জানাচ্ছে। দেশাচার ও কুসংস্কার এদেশের বিধবাদের জন্যে যে কতখানি ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাও সম্যক বুঝতে পারছে না তাঁরা।

সব ধরণের চেষ্টা হওয়ায় সমালোচনার ঝড় কিছুসময়ের জন্যে থিতচ্ছে, পরে আবার তা মাথাচারা দিয়ে উঠছে। এর পশ্চাতে আসল উদ্দেশ্যটা তখনও অধরা । চোরাগোপ্তা প্রশ্ন উঠছে, বিধবার বিবাহের পর তার সন্তানেরা যদি বর্তমান দায়ভার অনুসারে পৈতৃক সম্পত্তির স্বত্বাধিকারী না হয়? এমন আশঙ্কা করা একেবারে অমূলক না হলেও, এর কিছু উপমা বাংলা তথা ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অনিয়মিত  বিধবাবিবাহে পাওয়া যাচ্ছিল। তা থেকেই এই আশঙ্কা।

ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ব্যাপকহারে বিধবাবিবাহের রীতি যদি বা চালু করার প্রয়াস নেওয়া যায়, তা সে আইন করেই হোক, বা বিনা বাধায়, জনসাধারণ ওই সংশয়েই তা চালু করতে দেবে না। অতএব, সবার আগে হিন্দু দায়ভাগের সঙ্গতি রক্ষার জন্যে আইন আনাতে হবে।

এগারো দফা প্রস্তাব দিয়ে গভর্নমেন্টকে হিন্দু দায়ভাগের সংগতি রক্ষার জন্যে আবেদন জানালেন। সঙ্গে জুড়ে দিলেন প্রায় এক হাজার মানুষের দস্তাখৎ যাঁরা কিনা এই প্রস্তাবের পক্ষে। তার মাধ্যে কে নেই? রায়বাহাদুর থেকে তর্কালঙ্কার, বাচস্পতি, ন্যায়বাগীশ, বিদ্যারত্ন, সিদ্ধান্তশেখর, বিদ্যাভূষণ তকমাধারী  বিদ্বৎসমাজ, কেউ বাদ নেই। এ করতে কী পরিশ্রম যে গেল ঈশ্বরচন্দ্রের, তা বলবার নয়।

এছাড়াও দিনে দিনে দেখা যেতে থাকল, ব্যক্তিগত উদ্যোগেও আবেদন হচ্ছে। বর্ধমানের মহারাজা, মহতাপ চাঁদ বাহাদুর, নবদ্বীপের অধিপিতি মহারাজ শ্রীশচন্দ্র, ঢাকার জমিদার, ময়মনসিংহের জমিদার ও অন্যান্য ধনী হিন্দুরা পর পর তাঁদের আবেদন রাখলেন আম জনতার কাছে। মানুষ বুঝতে পারল, পৈতৃক সম্পত্তির স্বত্বাধিকারীরের সুরক্ষার বিষয়টা, বিধবাবিবাহের সম্মতিতে এগিয়ে আসতে আর দ্বিধা করল না। হাজারে হাজারে মানুষ সমবেত হয়ে আইন প্রণয়নের জন্যে তুমুল আন্দোলন শুরু করল। অঙ্কুরে যার সৃষ্টি হয়েচ্ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরে, তাই মহীরুহ হয়ে উঠল।

ইংরেজ সরকার এই আইন পাস করবে; কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র জানতে পারলেন, আইন সভায় এই বিষয়ে কী ধরণের আলোচনা হচ্ছে, যা পরে নথিভুক্তও হবে ।  তিনি জানলেন, আলোচনা চলছে, বিধবার বিবাহ হলেও তার জন্যে সবরকম আমোদ আহ্লাদ নিষিদ্ধ। সে গান বাজনা শুনতে যেতে পারবে না। কোনও রকমের উৎসব অনুষ্ঠানে যেখানে অনেক মানুষের সমাগম হবে, সেই আনন্দ অনুষ্ঠানও দেখতে পারবে না। এ কী কথা! তাহলে আর বিবাহ কেন?

ঈশ্বরচন্দ্রের মন বিষাদে ভরে গেল। ভাবলেন,  তাহলে বিধবা রমণী পুনর্বিবাহ করে কোন স্বাধীনতা পাবে? শুধু দুবেলা দুমুঠো অন্নের নির্দিষ্ট সংস্থান আর সংসার নামের জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে থেকে নিজের জীবন কাটাবে? তাও হয় নাকি? কেন, বিধবারা কি মানুষ নয়? এব্যবস্থা কি কেউ কখনও মেনে চলতে পারে? তিনি আবার সোচ্চার হলেন । আইন সভার এমন এক বিদ্বেষপূর্ণ অমানবিক আলোচনার বিষয় নিয়ে ফের লিখতে শুরু করলেন। জনমত গড়ে তুললেন।

ছোট লাট হ্যালিডে ডেকে পাঠালেন তাঁকে। দুজনের অতি পরিচিত মুখ। ঈশ্বরচন্দ্র হ্যালিডের দপ্তরে উপস্থিত হলেন। আসুন আসুন, করে খাতির করে বসালেন ঈশ্বরচন্দ্রকে। জল, কফি খাইয়ে আপ্যায়নের খামতি রাখলেন না। একথা সেকথার পরে ঈশ্বরচন্দ্রই প্রশ্ন রাখলেন, মিঃ হ্যালিডে, এসব কী শুনছি? আইনসভার সদস্যারা ইংরেজ বলে, তাঁরা কি হিন্দু ঘরের রমণীদের মানুষ মনে করেন না? আইন পাশ করা হচ্ছে, না হিন্দু ঘরের বিধবাদের হাত পা বেঁধে জলে ফেলে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে! নারী স্বাধীনতায় ইংরেজ এতো হীন মনস্ক নয় বলেই জানতাম।

বেশ উত্তেজনার সঙ্গে কথা বললেন তিনি। কিছুটা আন্দাজ  করছেন, কেন স্বয়ং ছোটলাট তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন। কারণ এসময় শিক্ষা সংক্রান্ত কোনও বিষয় আলোচনার নেই, তা তিনি জানতেন।

-আরে, আরে ভিদ্যাসাগর মশাই। আপনি তো বেশ উত্তেজিত হয়ে রয়েছেন, দেখছি। যে বিষয়টাকে উপলক্ষ্য করে আপনি আবার আপনার কলম ধরেছেন, সেটা তো এখনও আলোচনা স্তরেই আছে, তা তো জানেন?

-সভা আলোচনা করেই তো সিদ্ধান্ত নেয়, মহাশয়। তবে সেই আলোচনা যদি নিম্নমুখী হয়, তবে তার প্রতিবাদ করতেই হয়। এবং যথাসময়ে তা না জানালে, আইনেও ওই আলোচনার ছাপ থেকে যায়। আইন ত্রুটিপূর্ণ হয়। আমরা চাই না, বিধবাবিবাহ আইন কোনও ত্রুটি নিয়ে পাশ হোক। ও আইন বলবৎ হওয়া  যা, না হওয়াও তাই।

-বলেন কী!

-হ্যাঁ। নারী বিধবা হলেই কী তার জীবনের শখ আহ্লাদ কেড়ে নিতে হবে? বাকি জীবন সে শুধু দাসীবৃত্তি করে কাটাবে? সে গান শুনতে পারবে না। নাটক থিয়েটার দেখতে পারবে না। সামাজিক কোনও আনন্দ উৎসবে যেতে পারবে না। এসব কী? বিধবা হলেও সে তো মানুষ। পশু ছাগল তো নয়।

-ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি আপনার মনের কথা বুঝতে পেরেছি…

-এ শুধু আমার মনের কথা নয়। আমি দেশের সব বিধবা নারীর মনের কথা বলছি। এজন্যে প্রতিবাদও হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছেন।

-আপনি জানেন বোধ হয়, সেকারণে ওপরওয়ালার থেকে আমার কাছে আদেশ এসেছে, আপনার সঙ্গে কথা বলবার…

-অতি উত্তম । আপনি তো আমাকে শুনলেন। এই ভাব আপনি ওপরওয়ালার কাছে পৌছিয়ে দিলে আমি  কৃতার্থ হব। আচ্ছা, আর কিছু কী জিজ্ঞাস্য রয়েছে? তা না থাকলে আমাকে অনুমতি করুন। এখন এক সভায় আমাকে যেতে হবে।

-আচ্ছা, আপনি আসুন। আমি নোট তৈরী করে ওপরওয়ালার কাছে পাঠাচ্ছি। কিন্তু আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আজ্ঞাবহ মাত্র।

-ক্ষমতার প্রয়োগ করে আপনি অনেক কিছু করতে পারেন…, আমি উঠছি…

নমস্কার জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দপ্তর ছেড়ে সোজা চললেন গোলদিঘির মাঠে। সেখানেই আজ সভা রয়েছে। বিষয়, সরকার কোনও ত্রুটিপূর্ণ আইন পাশ করলে, তা অমান্য করা হবে।

চাপ সৃষ্টি হল সরকারের ওপর। অবশেষে সভার আলোচনা, আলোচনাই রয়ে গেল। পাশ হল এক পূর্ণাঙ্গ বিল।  গভর্নমেন্টের ব্যবস্থাপক সভায় আইন পাস হল।

১৮৫৬ সাল ২৬ শে জুলাই। হিন্দু বিধবাদের ভালে নতুন করে সিঁদুর ওঠার ব্যবস্থা পাকা হল। জয়ল্লাসে ফেটে পড়ল হিন্দু সমাজের নারীকুল। আর কুচুটে স্বার্থান্বেষী পুরুষদের বুকে জ্বালা  ধরল। নারীদের বিজয় মিছিল বেরল। উদারমনা আইনের স্বপক্ষে থাকা পুরুষরাও তাতে যোগ দিল। সকলে মিলে ঈশ্বরচন্দ্রের গলায় রজনীগন্ধার মালা পরিয়ে মাথায় করে নিয়ে নাচতে নাচতে চলল কলিকাতার রাজপথ ধরে। এই সেই ছাব্বিশ তারিখ। ২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৮২০ ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম। আর তার ঠিক দুমাস বাদ রেখে ছত্রিশ বছর পর ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর অমর কীর্তি সাধন করলেন। উঠে পড়ে লাগলেন, বিলকে কাজে পরিণত করে এক বিধবাবিবাহ সম্পন্ন করবেন।

চলবে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page