উপন্যাস। আবার এসো ফিরে। রামেশ্বর দত্ত

এ জেলার বাকি জায়গা ব্রিটিশরাজের অধীন। উত্তরপাড়া, কোন্ননগর , শ্রীরামপুর, শেওড়াফুলি, চুঁচুড়া । সেখানে বর্ণ হিন্দুদের বাস। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগরের নাম তাঁদের অজানা নয়। তবু সেখানে মেয়েদের ইশকুলের কথায় বিশেষ সাড়া পাচ্ছেন না।  অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিও মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। মেয়েদের পড়াবার কথায় বেঁকে বসছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের তখন মনে পড়ল বেথুন সাহেবের কথা। মেয়েদের ইশকুল চালু করবার জন্যে প্রথমাবস্থায় তিনি কী করেছিলেন। মদনমোহনের দুই মেয়ে ভুবনমালা আর কুন্দমালাকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। নিজের করে। একই পথ ধরে তিনিও এগোলেন।

ঘটনার সূত্রপাত শ্রীরামপুর থেকে। শ্রীরামপুর মিশনারিদের জায়গা। সাধারণ গৃহস্থদের মাঝে তাদের অবস্থান।  গৃহস্থ বাড়িতে যাতায়াত অবাধ না হলেও লোক ইংরেজ পাদ্রীদের কথা শোনে। এক পাদ্রীর সঙ্গে ভাব জমালেন। তাঁকে নিয়ে একদিন এক গৃহস্থ বাড়িতে গেলেন।

তারপর… 

ছোট চালাঘরের বাড়ি। সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। গাছ গাছালি লাগানো। তাতে সবজীর ফলন। পাদ্রীকে দেখে গৃহকর্তা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন। মাঝ বয়স্ক। এক মাথা টাক। পরণে ধুতি ফতুয়া। মাথায় খুব একটা লম্বা নয়। পাঁচ ফুটের মতো হবে। ভদ্রলোকের তিন সন্তান। তিনটেই মেয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র আগেই দূত মারফৎ খবর নিয়ে নিয়েছিলেন, গৃহকর্তার আর্থিক দূরাবস্থার কারণে এখনই তিনি মেয়েদের বিয়ে দিতে যাচ্ছেন। বড় মেয়ের বয়স বারো। মেঝ, ছোটজন, দশ এবং নয়। খবরটা শুনেই তিনি হায় হায় করে উঠেছিলেন। এখন ভদ্রলোককে সামনে পেয়ে প্রশ্নটা করলেন।

-আজ্ঞে হ্যাঁ। উত্তর দিল গৃহকর্তা।

-এখনই মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে লেখাপড়া করিয়ে বিয়ে দেবেন? এই বয়সে বিয়ে দিয়ে ওদের তো জলে ফেলে দিচ্ছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন। সঙ্গের পাদ্রীকেও তাতে সায় দেবার ইশারা করলেন।

ভদ্রলোক কিছু না বলে চট করে সেখান থেকে সরে গেলেন। বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্র ঘাবড়ে গেছেন। লোকটা আবার কী না কী ভাবল তাঁদেরকে। অপেক্ষা করছেন। বাইরে দাঁড়িয়ে। একসময় ভিতর থেকে উকি দিল একটা মেয়ে। বোঝা গেল না, সে বড়, মেঝ, না ছোটটা? হাতের ইশারায় পাদ্রী মেয়েটাকে বাইরে আসবার কথা জানাল। পায়ে পায়ে সে বেরিয়ে এলো। বড় মেয়েটাই হবে। বলল, বাবা আমাকে পাঠাল।

-তাই? ঈশ্বরচন্দ্রের মনে কৌতূহল জাগল।

মেয়েটার চেহারা শীর্ণ। মাথায় লম্বা হয়ে উঠেছে। কিন্তু গায়ে সেরকম মাস নেই। করুণ মুখ।

-তোমার নাম কী? ঈশ্বরচন্দ্র জানতে চাইলেন। মেয়েটা নাম বলল। সুমনা।

-পদবী?

-দাস।

পাদ্রী জানাল,  ওরা খৃষ্টান। নিয়মিত গির্জায় আসে।

-সুমনা, তুমি এখনই বিয়ে করবে, না কি আরও বড় হয়ে বিয়ে করবে? ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করলেন।

-বড় হয়ে বিয়ে করব।

-তাহলে এখন কী করবে?

-বাবা বলছিল, আপনারা এসেছেন আমাদের পড়াবার জন্যে।

-তাই তো। এখানে ইশকুল খুললে তুমি পড়তে আসবে?

-আমি যাব। আমার বোনদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব।

-বাঃ! ঈশ্বরচন্দ্র পাদ্রীর দিকে তাকালেন। উৎসাহ পেয়েছেন। হাত বাড়িয়ে সুমনাকে কোলে তুলে নিতে গেলেন। মেয়েটা জড়োসড়ো মেরে গেল। পাদ্রী  ইশারায় না, করলেন। সরে এসে বললেন, বাবাকে নিয়ে এসো। তোমার বোনদেরকেও ডাকো।

মেয়েটি ভিতরে গিয়ে বাবা এবং দুজন বোনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো। ঈশ্বরচন্দ্র গৃহকর্তার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার নামটা জানা হোল না।

-বিশ্বম্ভর দাস। আমার মেয়েদের নাম সুমনা, কামিনী আর পূর্ণা, বলে গৃহকর্তা নিজের মেয়েদের দেখিয়ে চিনিয়ে দিলেন।

-বিশ্বম্ভর বাবু। আজ থেকে আপনার তিন কন্যা আমার কন্যা হল। ওদের ভার আমি তুলে নিলাম। ওরা এখানের ইশকুলে গিয়ে পড়বে। বড় হলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা আমিই করব।

বিশ্বম্ভর দাস এগিয়ে এসে ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রণাম করতে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

পাদ্রীর উদ্যোগে জায়গা ঠিক হল। গির্জার পাশের জমিতে মেয়েদের ইশকুল খুলল। সেখানের প্রথম ছাত্রী হল, দাস মশাইয়ের তিন মেয়ে।

খবর রটে গেল, স্বয়ং ইশকুল কর্তা এসে মেয়েদেকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ইশকুল চালু করেছে। সেখানে পড়াবার দায়িত্ব নিলেন পাদ্রী। ভদ্রলোক ইংরেজ। কিন্তু বহুকাল এদেশে থাকার সুবাদে বাংলা ভাষা শিক্ষা করেছেন। অন্যান্য বিষয়েও পড়াশোনা রয়েছে। শিক্ষকতার প্রাথমিক দিকটা উনিই সামলে দিলেন। পরে শিক্ষক নিযুক্ত করা হল এক ইংরেজ মহিলাকে। পাদ্রীই তাঁকে ঠিক করেছেন। সরকার থেকে শিক্ষিকার বেতন আসবে।

 

কলিকাতায় ফিরলেন ঈশ্বরচন্দ্র। স্কুল পরিদর্শকের কাজে ক্ষান্ত দিলেন কিছু দিনের জন্যে। কলেজেও কাজ রয়েছে। এতদিন কলেজ সামলাচ্ছিলেন সহঅধক্ষ্য। প্রায় একমাস কালের অনুপস্থিতির পর কলেজে ফিরেছেন তিনি। সব বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। সংস্কৃত কলেজের বাড়ির কিছু সংস্কারের প্রয়োজন। অর্থ ঢালতে হবে। অথচ তার জোগান নেই। সোজা চলে গেলেন ছোটলাটের কাছে। সঙ্গে বছরের আয় ব্যায়ের হিসেব। ছোটলাট মিঃ হ্যালিডে বসেই রয়েছেন তাঁর প্রিয় পাত্র ভিদ্যাসাগর মশাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। তাঁকে শুনলেন। ঈশ্বরচন্দ্র হাতে ধরা খাতাপত্র হ্যাডিরের দিকে এগিয়ে দিলেন। ।

-ও আর আমি কী দেখব, ভিদ্যাসাগর মশাই? হ্যালিডে বলে উঠলেন।

-মিঃ হ্যালিডে। আমি অর্থ চাইতে এসেছি। হিসেব দেখানো আমার কর্তব্য। সে আপনি দেখুন আর না দেখুন। তবে কলেজের সংস্কারের কাজটা করা কিন্তু বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে।

-কাজের এস্টিমেট করিয়েছেন কিছু?

-অবশ্যই। কলেজে অতিরিক্ত ঘর দরকার। দুখানা। আগামী বছর নতুন বিষয় শুরু হতে যাচ্ছে। ছাত্র বসাতে পারব না। খরচ পড়বে আট হাজার টাকা। এছাড়াও কলেজে একটা ক্যান্টিনের ব্যবস্থা এবার করতেই হয়। না হলে ছাত্ররা কতদিন আর বাইরে বাইরে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে এসে ক্লাস করবে?

-ক্যান্টিন খুলছেন। ছেলেরা আবার সেখানেই বসে থাকবে না তো? ক্লাস কামাই করবে।

-চিন্তাটা আপনার অমূলক নয়। তবে, কলেজ ছাত্রদের কিছু তো স্বাধীনতা দিতেই হয়। ক্যন্টিন, কমনরুম, এসব জায়গায় বসে তারা শুধু আড্ডাই দেবে না। নানান বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মত বিনিময় করতে পারে। যা একান্ত দরকার।

-হুঁ, আপনার দৃষ্টি স্বচ্ছ। সবকিছুর মধ্যে আপনি ভালই দেখেন। এ ব্যাপারটার জানেন তো, ইংল্যান্ডে খুব চল আছে। তাতে উপকারই হয় ছাত্রদের। আপনি এখানেও সেই চল আনতে চাইছেন, ভিদ্যাসাগর মশাই।

-এখন আর এদেশ ওদেশ করে ভাবা নেই। ভালোটা সব দেশেই চলুক। এদেশের ছাত্ররাও কিছুতে কম যাচ্ছে না এখন।

হ্যালিডে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলেন। হাত বাড়িয়ে নোট শীটখানা নিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে। কোনও কিছু না পড়েই কাগজে দস্তাখত করলেন। ফেরত দেবার সময় বললেন, কাজের অগ্রগতি নিয়ে আমাকে একটু ওয়াকিবাহাল করে রাখবেন। বড়লাট জানতে চাইলে আমাকে রিপোর্ট দিতে হবে তো।

-বিলক্ষণ। মাসে মাসে কাজের অগ্রগতি দেবার কথা জানিয়ে দিচ্ছি। সহ অধ্যক্ষই বিষয়টা দেখবেন।

-আপনি?

-আমি এবার বেরব। নদীয়ায় যাব। সেখান থেকে মেদিনীপুরে। আমার গ্রামেও একটা বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করব  মনস্থির করে ফেলেছি।

-কাজটা আপনাকে দেওয়া সার্থক হয়েছে, এটুকু আমি মনে করি।

কথার মাঝে কফি এসেছিল। দুজনের জন্যে। তা শেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

 

কলিকাতা থেকে নদীয়ায় যাওয়া স্থির করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। নদীয়া , মানে নবদ্বীপে প্রভু চৈতন্যদেবের জন্মস্থান দর্শনে অবিরত তীর্থযাত্রীর আনাগোনা রয়েছে। বেশিরভাগই যায় জল পথে। গঙ্গার উজান বেয়ে। আর রয়েছে সড়ক পথ। গরুর গাড়ি চেপে যাওয়া। তাতে সময় বেশি লাগে। জল পথে  সময় নেয় দেড় থেকে দুদিন। ঈশ্বরচন্দ্র চললেন জল পথে। দেড় দিনে নবদ্বীপের ঘাটে গিয়ে উঠলেন।

গঙ্গাতীরে এক কুঠিতে স্থান নিলেন। খবর গেল রাজবাড়িতে। রাজা কৃষচন্দ্রের বংশধর, সতীশচন্দ্র এখন রাজ্যপাট চালাচ্ছেন। কৃষ্ণগঞ্জে। মাথার ওপরে রয়েছে বৃটিশ শাসক। তাহলেও নদীয়া জেলায় রাজাদের আধিপত্য যথেষ্ঠ। অনেকটা  বর্ধমান জেলার মতো। তবে পণ্ডিত আর কুল পাঠাশালায় ভরা।  সংস্কৃত ভাষায় পড়াশোনা চলে। নদীয়ার শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় গত হয়েছেন প্রায় আশি বছর আগে। তবে তিনি যে সাহিত্য সংস্কৃতি চালু করে গেছেন, তা আজো বিদ্যমান। বর্তমান রাজা তাই বহন করে চলেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র ডাক পেলেন সতীশচন্দ্রের কাছ থেকে। রাজবাটীতে পৌঁছলেন। সাদরে অভ্যর্থনা হল। বিদ্বান বিদ্বজ্জনের মর্যাদা দেন। আগমনের অভিপ্রায় জানালেন তিনি। সামান্যতম দেরী করলেন না অনুমতি দিতে। একটাই প্রশ্ন রাখলেন, বিদ্যাদান কি সংস্কৃতে হবে?

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, বালিকারা সংস্কৃত ভাষা চর্চা করবে। তবে বিদ্যাদান হবে বাংলা ভাষায়।

তিনটে ইশকুল স্থাপনের জায়গা স্থির হয়ে গেল। কাজে লেগে পড়লেন স্থানীয় লোকজন। রাজার নির্দেশে কাজ শুরু হল। অর্থের জোগান আসল সরকারের তহবিল থেকে। কাজ কিছুদূর এগোতে ঈশ্বরচন্দ্র নদীয়া ছাড়লেন। তার আগে অবশ্য ছাত্রী জোগাড়ের জন্যে কিছু ঘোরাঘুরি করলেন। সঙ্গে রাজার দেওয়া লোকও ছিল। এক লপ্তে বিশ বাইশ জন ছাত্রীকে পেয়ে গেল তিনটে ইশকুল।

নদীয়া থেকে সরাসরি মেদিনীপুরের পথ নেই। ঈশ্বরচন্দ্র তাই কলিকাতায় ফিরলেন। দিন কয়েক বিশ্রাম নিয়ে চললেন মেদিনীপুর।

মেদিনীপুর তাঁর নিজের জেলা। আয়তনে বেশ বড়। জেলার বহু স্থান তাঁর নখদর্পণে। প্রথমেই পৌঁছলেন চন্দ্রকোনা। সুপরিচিত রাজীবলোচন রায় চন্দ্রকোনার জমিদার। এককালের বর্ধমানের মহারাজার দেওয়ান। চন্দ্রকোনার জাড়ায় মহারাজের দান করা কয়েকশ বিঘা জমিতে তার জমিদারী গড়েন রাজীবলোচনের পিতা মদনমোহন রায়। পরে মদনমোহনের মৃত্যু হলে রাজীবলোচন বর্ধমান রাজার দেওয়ান নিযুক্ত হন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে জাড়ায় ফিরে এসে জমিদারীর কাজে মন দেন।

ইতিপূর্বে ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে রাজীবলোচনের যোগাযোগ হয়েছে। তাতেই তাঁর কাছে আসা। ঈশ্বরচন্দ্রের বিশ্বাস, নদীয়ার মতো মেদিনীপুরও পড়াশোনায় অনেক এগিয়ে। তাই সেখানে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। ছাত্রীও পাওয়া যাবে। হলটাও ঠিক তাই। সহায়তা রাজীবলোচনের। ঈশ্বরচন্দ্র গড়লেন তিনটে ইশকুল। প্রথম ছাত্রীই পাওয়া গেল জমিদার বাড়ি থেকে। জমিদার, জমিদার ভাইয়ের দুই দুই নাতনী করে চারজনকে। সেই দেখাদেখি অনেক বাড়ির মেয়েদের ইশকুলে পাঠানো শুরু হল। খুশিতে ডগমগ ঈশ্বরচন্দ্রের মন এবার টানল নিজের গ্রাম বীরসিংহ।

 

বীরসিংহে চলেছেন। মনে বাসনা, এক কাজে দু কাজ হবে। কতদিন হয় ছেলেমেয়ের মুখ দেখেন না। তাদের সঙ্গ পাওয়া তো দূরের ব্যাপার। পুত্র নারায়ণের পর এক মেয়ের জন্ম দিয়েছেন দীনময়ী। নাম রাখা হয়েছে হেমলতা। ভগবতীদেবীর দেওয়া নাম। তাও প্রায় দু বছর  হতে চলল। মেয়ের টুসটুসে মুখটা তাঁর খুব মনে পড়ছে। দীর্ঘ সময়ের পরে পরে মেয়েকে দেখে মনের আশ মেটে না। সবসময়েই তাঁর মনে হয়, ছুটে চলে যান। মেয়েকে কোলে নিয়ে খুব আদর দেন। নারায়ণ তো অনেকটা বড় হয়ে গেছে। সে এখন তার ঠাকুমার কোল ধরে থাকে। বাবাকে কাছে পায় না বলে, বাবার ওপর তার টান তেমন জোরালো নয়। কথায় আছে, ছেলের টান মায়ের দিকে; মেয়ে টানে বাবাকে। তা এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। ‘হেমলতা, হেমলতা’ করে, তিনি এখন প্রায় হেদিয়ে পড়েন। কলিকাতায় কাজের সময় মেয়ের কথা ভুলে থাকেন। আর কাজ না থাকলেই মেয়েকে উদ্দেশ্য করে মেয়ের মায়ের কাছে চিঠি লেখেন। সে চিঠি যে সবসময় পাঠান, তাও নয়। কিন্তু ওই লিখে নিজের মনে আনন্দ পান। একটার পর একটা চিঠি জড়ো হতে থাকে।

এরকম সময়েই  যখন সুযোগ এল গ্রামে ইশকুল খোলার, আর দেরী করেননি। । বেরিয়ে পড়েছেন। সঙ্গে চিঠির গোছা নিয়ে এসেছেন। দীনময়ী দেখলে খুশি হবে।

গ্রামে ভোর ভোর পৌঁছলেন। এবার আর হেঁটে আসেননি। পাল্কি ভাড়া নিয়ে গ্রামে এসেছেন। ভোররাতে দামোদর পেরিয়েছেন। পাল্কীতে করে ভোরের শোভা দেখতে দেখতে বাড়ি যাচ্ছেন আর দেখছেন মাঠে মাঠে লাঙ্গল চাষ হচ্ছে। বোরো ধানের চাষ শুরু হতে চলেছে। শুকনো মাঠে লাঙ্গল দিয়ে মাটি ওলট পালট করানো হচ্ছে। এরপর প্রথম চোটের বৃষ্টি নামলে মাঠ কাদা করা হবে। বর্ষার জল আকাশ চুঁইয়ে ঝরলে ধানচারা পোঁতা হবে । তারপর অপেক্ষা। কৃষকের ছুটি। তাও কিছু দিনের জন্যে। ঈশ্বরচন্দ্র যাচ্ছেন আর ভাবছেন।

নিজেদের জমির কাছাকাছি আসতে মাঠে ঠাকুরদাসকে  দেখতে পেলেন।  তিনি মুনিষ পরিচালনায় ব্যস্ত। বিঘে কয়েক জমি ঠাকুরদাস পরিবারের। বাড়ির ছেলেরা সকলে কলিকাতা শহরে থাকার কারণে জমিতে মুনিষ লাগিয়ে চাষ হয়। কয়েক কাহন ধান ওঠে। তাই দিয়ে সমবছরের ঘরের অন্নের সংস্থান হয়ে যায়। কিছু বাইরেও বিক্রিবাটা করেন ঠাকুরদাস।

মাঠে ঠাকুরদাসের পোশাক খাটো ধুতি। গা উদোম। গরমে সব চাষিরাই তাঁরই মতো পোশাকে মাঠে  নামে। রোদ এড়াবার জন্যে মাথায় গামছা ফেট্টি করে বেঁধে নেয়। দূর থেকে তিনি বাবাকে চিনতে পারলেন।  পাল্কি থামিয়ে নামলেন। কয়েকটা মাঠ পেরিয়ে নিজেদের জমিতে পৌঁছলেন। ঠাকুরদাস নিচু হয়ে জমির কাজ করছেন। ডাকলেন। চোখ তুলে দেখলেন ঠাকুরদাস। ছেলেকে এত সকালে দেখে আশ্চর্য হলেন। প্রশ্ন করলেন, তুমি! এখন কি কলিকাতা থেকেই আসছ?

ঈশ্বরচন্দ্র জমিতে নামলেন। প্রণাম সারলেন বাবাকে। উত্তর দিলেন, না বাবা। আমি আসছি চন্দ্রকোনা থেকে। সেখানে মেয়েদের ইশকুল খুলিয়ে এখানে আসছি। পাল্কি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম। মাঠে আপনাকে দেখে নেমে এলাম।

-ভালই করেছ। মেয়েদের বিদ্যালয় খুলছ।

-এবার আমাদের গ্রামেও মেয়েদের ইশকুল চালু করবো, বাবা। আমাদের ঘরের মেয়েও তো বড় হচ্ছে।

ঠাকুরদাস হাসতে থাকেন।

কথা বলতে বলতে জমি থেকে উঠে আলের ওপর এসে দাঁড়ালেন দুজনে । ঈশ্বরচন্দ্র কুশল সংবাদ জানালেন। নিজের এবং কলিকাতায় থাকা ভাইদের। ঠাকুরদাস নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। পরে ছেলের কাছে জানতে চাইলেন,  গ্রামের মেয়েরা ইশকুলে পড়বে, তবে…, বলে তিনি কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন হোঁচট খেয়ে থেমে গেলেন।

-বাব। কি কিছু বলতে চাইছেন?    ঈশ্বরচন্দ্রের প্রশ্ন।

-বলতে তো চাই অনেককিছু; কিন্তু জানো তো ঈশ্বর, মেয়েদের ইশকুল যে বসাবে, তাতে গ্রামের মেয়েরা কি সেখানে যাবে? আর তা ছাড়াও, জানতে চাই, এর দায় দায়িত্ব কি সবটাই তোমার একলার হবে? মানে, আমি কী বলতে চাইছি, বুঝতে পারছ তো?

ঈশ্বরচন্দ্র যেন কিছু বুঝেছেন, আবার বুঝছেনও না। ভাবনা এল, বাবাও কি তাহলে তার উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে না? নাকি, নারীশিক্ষার বিষয়ে বাবা এখনও সন্দিহান? অথচ ইনিই তো দুবছর আগে গ্রামে ছেলেদের ইশকুল বসবার জন্যে নিজেই গ্রামের মানুষজনের সামনে কথা দিয়েছিলেন, যতদিন না, সেখানে ইশকুল গড়া হচ্ছে, ততদিন তিনি তার ইষ্টদেবতাকে স্মরণে আনবেন না। আর আজ তিনিই…

কথা ঘুরিয়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। জানালেন, পরে এ বিষয় নিয়ে বিস্তারির আলাপ করবেন । কিন্তু তারপরেও প্রসঙ্গটাকে একেবারে বন্ধ না করে বললেন, বাবা, আপনার ভাবনাটা অমূলক নয়। কারণ, শহরে মেয়েদের ইশকুল করতে গিয়েও এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাকে। আর সে বাধা কাটিয়ে উঠে, আজ  বাংলার চারটে জেলা শহরে বেশ কয়েকটা মেয়েদের ইশকুল স্থাপনা করে তবেই আমি নিজের গ্রামের দিকে তাকিয়েছি।…ঠিক আছে। পরে বাড়িতে বসে না হয় এ সম্বন্ধে আরও আলোচনা করা যাবে।

-তাই হবেখন। এখন এত দূর পথ ভেঙে এসেছ, বাড়ি যাও। বিশ্রাম নাও। পরে আমার প্রশ্নের উত্তর জেনে নেব তোমার কাছ থেকে।

ঈশ্বরচন্দ্রকে বিদায় জানিয়ে ঠাকুরদাস মাঠে নেমে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও আল, মাঠ পেরিয়ে পাল্কিতে উঠে বাড়ির পথ ধরলেন।

(১৬)

পরের দিন।

নারায়ণ আর হেমলতা, দুজনকে স্বামীর জিম্মায় দিয়ে দীনময়ী গেছেন ওলাইচন্ডীর পূজো দিতে। গ্রামের ওলাইচন্ডীতলা বাড়ি থেকে এক ক্রোশ দূরে। দীনময়ী আর ভগবতীদেবী, দুজনাই গেছেন। বাড়ির পাল্কি তাদের নিয়ে গেছে। ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ি বসে ছেলে মেয়ের পাহারা দিচ্ছেন। সঙ্গে অবশ্য বাড়ির ঝি, নয়নতারা রয়েছে। তাতেও ঈশ্বরচন্দ্র দুটো শিশুকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছেন।

নারায়ণ এখন পাঁচ বছরের হয়েছে। সে দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধুলো করে।  ঘর থেকে বেরিয়ে দালানে চলে যায়। তাতেই ভয়, দালানে কাঠের ঘেরা রেলিং দিয়ে বাইরে মুখ বের করে না নিচে পড়ে যায়। সেদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। হাতে খেলনা ধরিয়ে কিছুক্ষণ হয়তো চুপ করে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে। কিন্তু তারপরেই উঠে দৌড়। মা, মা কোথায়, করে নিচে নেমে যাবার উদ্যোগ নিচ্ছে সে। সেখানে গিয়ে তাকে আটকাতে হচ্ছে।

আসলে নারায়ণের ঠাকুমা বেশি সময় চোখের আড়ালে থাকলে, সে এরকমটাই করে। ঠকুমাকে সে মা, করে ডাকে। ঠাকুমার সঙ্গেই তো তার দিবারাত্র ওঠাবসা, খাওয়া শোয়া।  সে-ই তার মা। নিজের মা কাছে না থাকলেও নারায়ণের চলে যায়। ঠাকুমাকে মা ডাক সে শিখেছে দীনময়ীর কাছ থেকে। দীনময়ী যেহেতু শাশুড়িকে মা, করে ডাকে, ছেলেও তাই শিখেছে। অন্য সবাইকেও তুই, সম্বোধন করে; এ অভ্যাস ঠিক ঈশ্বরচন্দ্রের মতো। তিনি ভগবতীদেবীকে তুই, সম্বোধনে ডাকেন। একেবারে ছোট বয়স থেকে। অবশ্য অন্যদের তিনি তুমি বা আপনি যাঁর যা প্রাপ্য, তাই সম্বোধন করেন। কিন্তু নারায়ণ , সে তো সকলকেই তুই তোকারই করে। বড় হচ্ছে, এখনও তার এ অভ্যেস  পরিবর্তন করা যাচ্ছে না। দীনময়ী ছেলেকে বকাঝাকা করেন। ঠাকুমা, কাকা পিসীরা বলে, বড় হলে ও শুধরে যাবে।

ঈশ্বরচন্দ্রও এখন থেকে নিজের ছেলের বড় হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কাছে পান না। নাহলে, ছেলেকে নিজের মতো কোমল–কঠোর করে গড়ে তুলতেন। যদিবা নারায়ণ তার ঠাকুরদার হাত ধরে গ্রামের ইশকুলে যায়। ঠকুরদাসই নাতির পড়াশোনা দেখেন। তাঁর বিদ্যে অল্প। কিন্তু ছেলে মানুষ করার অভিজ্ঞতা ঠাকুরদাসের রয়েছে। নজর রাখেন নাতির পড়াশোনার ওপর। ঈশ্বরচন্দ্র তবু বোঝেন, নিজের বাবা কাছে থাকাটা অন্য জিনিষ। এছাড়াও একটা জিনিষ তিনি বুঝতে পারেন না; দীনময়ী কী করে দুটি সন্তানকে সামলায়।

এদিকে হেমলতাও দুই পেরিয়ে তিনে পড়তে চলল। সেও চঞ্চল হয়েছে। মেয়ে বলে হয়তো নারায়ণ থেকে কিছুটা কম। তবে শিশু তো শিশুই। অল্প আর বেশি চঞ্চলতায় তাদের আর দোষ কী? হেমলতাও থপ থপ পা ফেলে এদিক ওদিক করে হেঁটে বেড়ায়। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে যায়। যা সে এখনও করছে। ধর ধর, করে তার পিছু নিতে হচ্ছিল ঈশ্বরচন্দ্রকে। ছেলেকে দেখে, মেয়ে কোলে নিয়ে বসে কি আর পড়াশোনা হয়? এই সময়েই ঈশ্বরচন্দ্র পুঁথি খুলে বসেছিলেন। কী? না, ওই যে দীনময়ী বলে গেল, ওলাইচণ্ডীতলা যাচ্ছি, এখন ওই ওলাইচন্ডীর ইতিহাস জানতে হবে তাঁকে।

ঈশ্বরচন্দ্রের গ্রামের বাস অনেক বছরই নেই। কোনও একসময় তিনি শুনেছিলেন, গ্রামে এক নতুন দেবতার উদয় হয়েছে। সে বিষয়ে এতদিন তত খোঁজ নেনেনি। মানে, প্রয়োজন পড়েনি। এটুকু জানতেন, শহরের মতো গ্রামেও ওলাওঠা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা হতে ওই নতুন দেবীর আবির্ভাব। তারপরে আর তা নিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়নি। যা কিনা এখন প্রসঙ্গটা ওঠায়, তাঁকে জানতে হবে, কে এই ওলাইচন্ডী?

বাড়িতে স্তূপীকৃত বইপত্র ঘেঁটে পেয়েছেন একটা বই। সেটাই পড়ছেন। মনোযোগ দিয়ে পড়তে গিয়ে নারায়ণ, হেমলতাকে ঝিয়ের জিম্মায় দিয়ে রেখেছেন। সে বেশ সামলাচ্ছে দুটিকে। আসলে যার যা কাজ। আর ঈশ্বরচন্দ্র পড়ে চলেছেন।-

‘উনিশ শতকে ভারতের আর এক ভয়াবহ মহামারী ছিল কলেরা। যদিও খ্রিষ্টপূর্ব চার শতক থেকে হিন্দু, আরব, চৈনিক, গ্রিক ও রোমান চিকিৎসাশাস্ত্রে কলেরার উল্লেখ পাওয়া গেলেও উনিশ শতকে এই মহামারী চূড়ান্তরূপ নেয় যখন সারা বিশ্বে কলেরায় প্রাণ যায় লক্ষ লক্ষ মানুষের।

‘১৮১৭ সালের মহামারীর পর থেকে কলেরার আচার পালিত হওয়া শুরু হয় বলে মনে করা হয়। আর্নল্ড লিখছেন, “কেবলমাত্র বদ্বীপ বাংলায়, কলেরার নির্দিষ্ট দেবী রূপ ছিল, মুসলিমরা বিশ্বাস করতেন ওলাবিবিতে, হিন্দুরা পূজা করতেন ওলাইচণ্ডীকে।”

পুস্তক আরও জানান দিচ্ছে, ‘১৮১৭ সালের আগে শীতলার চেয়ে এই দেবী কম জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু কলেরার প্রাদুর্ভাব সে মরশুমে ব্যাপক হওয়ায় ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডীর আরাধনার বাড়বৃদ্ধি ঘটে।’

আর্নল্ডের বইয়ে উদ্ধৃত ইউরোপিয় মিশনারিদের রিপোর্ট থেকে মনে হয়, কোনও কম বয়সী মেয়েকে এই দেবী রূপে কল্পনা করা হত। বাংলা ছাড়া রাজস্থানেও এই দেবীর পুজো হত, যেখানে দেবী তাঁর ভক্তদের কলেরা, জন্ডিস, ডায়েরিয়া ও অন্যান্য পেটের রোগ থেকে রক্ষা করতেন।…

এই সময়েই বাড়ির মানুষরা ফিরে আসল । দীনময়ী দেখেন, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ঝি বাড়ির ওঠোনে নেমে খেলা করছে। এবার ওপরে উঠে গিয়ে দেখতে পেলেন স্বামীকে। ঈশ্বরচন্দ্র তখনও বইয়ে মুখ গুঁজে পড়েই চলেছেন।

-আপনি কি যখনই আসেন কাজকে সঙ্গী করে নিয়ে আসেন?   ঈশ্বরের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে দীনময়ী কথাটা বললেন। কথার মধ্যে রুক্ষতার ভাব স্পষ্ট।

-ও , তোমরা এসে গেছ?   ঈশ্বরচন্দ্র চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে কথা বলছেন।

দীনময়ী ঠিক আগের সুরেই বললেন, ছেলেটাকে মেয়েটাকে আপনার জিম্মায় দিয়ে গেলাম। এখন দেখছি, ঝিয়ের হাতে তাদের তুলে দিয়ে নিজে ঘরে বসে বই পড়ছেন! আর সে বাচ্ছাদুটোকে বাড়ির বাইরে উঠোনে নিয়ে গিয়ে খেলতে দিয়েছে? রোদে পুড়ে যাচ্ছে বাইরেটা, সে খেয়াল নেই আপনার?

-সত্যিই তো, বাইরে এত রোদ…,

ঈশ্বরচন্দ্র তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবেন। উদ্দেশ্য নারায়ণ আর হেমলতাকে নিচে থেকে আনবেন। কিন্তু তাঁকে একরকম ধমকের সুরেই দীনময়ী বললেন, থাক। কোথায় যাচ্ছেন?

-আরে, ওদেরকে ওপরে নিয়ে আসি। তুমি তো এসে গেছ।

তিনি ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছেন কি দীনময়ী খনখন করে উঠলেন, আপনার আগে সে কাজ আমি করে এসে ওপরে উঠেছি। ভালই আছেন বেশ।

দীনময়ী বাইরের কাপড় জামা পরিবর্তন করছেন। ঘরে শুধু মাত্র তিনি আর তাঁর স্বামী। যা তিনি কদাচিৎ করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র উঠে ঘরের বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিতে স্বামীর কাছে সরে এসে বললেন, জানেন, আবার আমার মাসের শরীর খারপ হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সে খবর রাখেন?

ঈশ্বরচন্দ্র বুঝেছেন, দীনময়ীর রাগটা এজন্যেই। এখানে এসেছেন দুদিন হয়ে গেলেও স্ত্রীর শরীরের খবর তিনি নেননি। তাতেই দীনময়ীর অভিমান বা রাগ, যাই হোক একটা হয়েছে। তারই প্রকাশ ঘটছে এখন। মাধ্যমটা হয়েছে ছেলেমেয়েকে ঝিয়ের হাতে ছেড়ে রাখার ব্যাপার। বিষয়টাকে লঘু করে দিতে তিনি বলে উঠলেন, বাহ, এবার তাহলে, আবার একজন আসছে?

-হ্যাঁ। আপনার আর কি? আনন্দই তো।

দীনময়ীর ততক্ষণে পোশাক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবার সাজের কাপড়  পাটে পাটে ভাঁজ করতে করতে কথাটা বললেন।

প্রসঙ্গ পাল্টে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এবার অনেক চিঠি এনেছি…,

-চিঠি! মানে?

দীনময়ীর  আশ্চর্য হবারই কথা। চিঠি মানে তো, তা নিশ্চয়ই তাকেই লেখা হবে। তা না হলে, এখন এই অবস্থায় ও কথা বলবেনই বা কেন? প্রশ্ন করলেন, কার চিঠি? আমার?

-হ্যাঁ গো। তোমাকে লেখা, তোমার ছেলেমেয়েকে লেখা চিঠি।

-মস্করা করছেন?

স্বামীর কথায় অবিশ্বাস দেখিয়ে দীনময়ী কথাটা বলে উঠতে ঈশ্বরচন্দ্র তাড়াতাড়ি মুক্ত হয়ে ঘরের আলনায় ঝোলানো ব্যাগ থেকে সত্যি সত্যিই এক গোছা চিঠি বের করে এনে দীনময়ীর হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, এই নাও। বিশ্বাস হচ্ছিল না তো?

চিঠির বান্ডিলটা হাতে ধরে দীনময়ী তখন কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাড়াতাড়ি সেগুলো বিছানার তোষকের তলায় চালান করে দিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিলেন। তারপর নিজেও কয়েকটা লেখা পাতা এনে ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো আপনার জন্যেই। দেখুন পড়ে, কত কথা লেখা আছে।

আর তিনি দাঁড়ালেন না সেখানে। ঘর ছেড়ে দালানে এসে বাইরের দিকে উকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করলেন, কেউ কোথাও দেখছে কিনা। দিনমানে ঘরের দরজা আব্জিয়ে তিনি এখন কী লজ্জায় না পড়েছেন। তবে  ভেবেছিলেন এক। হয়ে দাঁড়াল অন্য। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবলেন, এ মানুষটার ওপর কী রাগ করব ?

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page