উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

 দীর্ঘ সময় ধরে মন্ত্র উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান চলেছে। ঈশ্বরচন্দ্র এক মনে ভক্তিভরে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন। ঘরে অনেকেই উপবিষ্ট হয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখছে। সেখানে ভাইরা যেমন রয়েছে, রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি ও তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা।  

  একসময় তাঁর কাজ সুসম্পন্ন হল। আসন ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি। ভাইদের ডাক পড়ল। পুরোহিতের নির্দেশে তাঁরা একে একে কাজ সারছে। সেও অনেক লম্বা

সময় ধরে চলেছে।

এরপর … 

পর্ব-২৪ 

   ঈশ্বরচন্দ্র এসে বসেছেন নিরিবিলিতে। নানান ভাবনা মনে এসে ভিড় করছে। ডেকে নিলেন বন্ধু রাজনারায়ণকে। পাশে বসালেন। কথা শুরু করলেন তাঁর সঙ্গে।

বললেন, জানো তো ভাই, আজকাল লেখাজোখার কাজেও মন বসছে না, অথচ হাতে কত কাজ। তাই মনস্থির করে ফেলেছি, এবার সত্যিই কোনও নিভৃত স্থানে চলে যাব। প্রকৃতিকে আঁকড়ে বাঁচব।  কোনও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ থাকবে না।

রাজনারায়ণ শুনে আর আশ্চর্য হলেন। প্রশ্ন করলেন, এত বৈরাগ্য কেন হে ঈশ্বর?

-তুমি আমাকে এই প্রশ্ন করছ? তুমি তো আমার সবকিছুরই খবর রাখো বলে জানি।

-না, সব খবর রাখলেও, এক্ষণে তোমার কথা হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে আমার।  খুলে বলো তো সবটুকু…

-আজকের দিনেই কি তা শুনবে?

-আপত্তি না থাকলে বলো। আমি শুনতে প্রস্তুত।

-ভাই, সবাইকে তো দেখলাম। কার জন্যে কী করতে বাকি রেখেছি বলো। নিজের ভাইদের আচরণে আমি ক্ষুব্ধ। তারা সব স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করছে। দীনু, যাকে আমি আমার উপযুক্ত ভাই বলেই মনে করি, সেও আমার নামে মামলা করল মিথ্যে অজুহাত দিয়ে?

-হ্যাঁ। সেটা আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা! যাকে তুমিই কিনা ছোটলাটকে বলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি করে দিলে, বরিশালে বহালি হল, তার এই মতিগতি ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। মনে খুবই ধাক্কা লাগে। তুমিও ভেঙ্গে পড়েছিলে জানি। তবে তুমি ঠিকই করেছ। দীনুকে রেহা করনি। তাই হয়ত সম্মানের সঙ্গে সেই মামলা সে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

-শুধু এখানেই তো আমার কষ্টের শেষ হয়নি। একমাত্র সন্তানের ওপর বাবার কত আশা থাকে। অথচ নারায়ণের দুর্ব্যবহার অসহনীয় হওয়ায় তাকেও ত্যাজ্য পুত্র করতে হল। সন্তানের জন্যে স্ত্রীর কাছে অপ্রিয় হয়ে গেলাম। তার সঙ্গেও মনোমালিন্য।

প্রিয়বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ঘটনাটা দেখলে? একসময়ের আমার অভিন্ন বন্ধু, সে আমাকে দোষারোপ করে বিচ্ছেদ ঘটাল। অমন প্রাণের অধিক সংস্কৃত প্রেসটা বেচতে হল। এরপরেও সে বলে বেরিয়েছে, আমার বেতালপঞ্চবিংশিতি বই লেখায় সে দিনরাত এক করে দিয়ে খেটেছে।যা কিনা আদৌ সত্য নয়। তবু আমি ওনার মেয়ে কুন্দমালার জন্যে বই বিক্রয়ের থেকে অর্থ ধার্য করেছি।

এরপরেও রয়েছেন তারানাথ বাচস্পতি। সেও কতখানি অকৃতজ্ঞ হল। কতখানি কায়িক কষ্ট স্বীকার করে একদিনে পদব্রজে অম্বিকা-কালনায় গেলাম; বাড়ি বয়ে ডেকে এনে সংস্কৃত কলেজে কাজ দিলাম, সেও বিচ্ছেদ ঘটাল,…সব, সব বৃথা হয়ে গেল!

-বিধবা বিবাহ চালু করার ব্যাপারে কতজনের বিরূপ কটাক্ষ। জানো তো, সকলকে সন্তুষ্ট করবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছি; কিন্তু অবশেষে বুঝতে পারলাম, সে বিষয়ে কোনও অংশে আমি কৃতকার্য্য হতে পারিনি। কথায় আছে, যে সকলকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করে সে কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারে না- এই কথাটাই আমি বাবাকেও লিখে জানিয়েছিলাম।

তাই এখন মনস্থির করে ফেলেছি। এবার এমন স্থানে চলে যাব, যা সভ্য সমাজ বর্জিত হলেও ক্ষতি নেই। মানুষ যদিও বা সেখানে থাকে, তারা যেন প্রকৃতির সন্তান হয়। নাই বা থাক তাদের মাঝে লেখাপড়ার চল।  না হোক শহুরে হালচালে অভ্যস্ত, এমন স্থানই হবে আমার বাকি জীবনের শান্তির নীড়।

সেরকম জায়গার খোঁজ খবর করতে শুরু করেছি আজকাল। জীবনের পঞ্চাশটা বছর কাটল বীরসিংহ গ্রাম আর কলিকাতাবাসে। এর বাইরে আর কোথায়ই বা গেলাম? শুধু কাশী। তার আগে একাধবার এদিক ওদিক , মানে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, আর ভিন রাজ্যের বাইরে কানপুরে । সেসব স্থানগুলোয় মনের মতো নির্জন স্থান পাননি।   পশ্চিমে রয়েছে দেওঘর। স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে উৎকৃষ্ট স্থান। বন্ধু রাজনারায়ণ বসু সেখানে তাঁর কাছে গিয়ে আবাস স্থাপনের কথা জানিয়েছিলেন। তাতে আমার খুব একটা মত নেই। এক তো, দেওঘর বাঙালিদের তীর্থস্থান। সবসময়েই ভিড় লেগে রয়েছে; উপরন্তু সেখানে বাসা নিতে গেলে যা টাকা খরচ করতে হবে, আপাততঃ তা আমার সাধ্যের বাইরে।

এই মুহূর্তে এসব কথা না চিন্তা করে আমি পারছি না। মাকে মনে রেখেই আমার চিন্তা চলছে। শ্রাদ্ধাধি বাহ্যিক অনুষ্ঠান। অন্তর থেকে আমি মাকে ছাড়তে পারছি না। মা চলে গেলেও নাড়ির টান চিরদিনই অনুভব করব…

একটানা কথা বলতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র হাঁপাচ্ছিলেন। বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। কথার মাঝে বারবার উদাস হয়ে যাচ্ছিলেন। রাজনারায়ণের তা গোচরে আসছিল। এমনিসময়ে শম্ভুচন্দ্র এসে সংবাদ দিল, দাদা, আমাদের কাজ শেষ হয়েছে। পুরোহিত মশাই এবার তোমাকে চাইছে। পিণ্ডদান পর্ব সমাধা করবেন।

ঈশ্বরচন্দ্র উঠে গেলেন। আসনে বসলেন। পিণ্ডদান পর্ব শুরু হল। তখন আর তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

একদিকে মুখে মন্ত্র উচ্চারণ করছেন আর মায়ের কথা মনে ভেসে উঠছে। ভাবছেন, এত দুঃখ সবই কি তাঁর ভাগ্যেই লেখা ছিল? দুঃখই কি তবে তাঁর শেষ জীবনের সম্বল হবে? অশ্রু সংবরণ করে পিণ্ডদান সম্পন্ন করলেন। ভগবতীদেবীর পটে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে উঠে দাঁড়ালেন।

 

শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে শেষে আবার রাজনারায়নকে নিয়ে বসলেন। আজ যেন তাঁকে কথায় পেয়েছে। বন্ধুকে অনুরোধ করে বসিয়ে গিয়েছিলেন। এবার দুজনে গিয়ে বসলেন বাইরের বারান্দায়। ঈশ্বরচন্দ্র হুঁকো আনালেন। দুখানা। হুঁকোর মাথায় কল্কিতে টীকা জ্বলছে। সেবন শুরু হল। সঙ্গে কথা,  বুঝলে রাজনারায়ণ, দুচার দিনের মধ্যেই কলিকাতা ছেড়ে নিভৃত কোনও জায়গায় চলে যাব।

রাজনারায়ণ জানতে চাইলেন, স্থান ঠিক হয়েছে?

-দেখি, যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাবো। আর ভালো লাগছে না।

-বলি, ওরকম নিরুদ্দেশের উদ্দেশে যাত্রা না করে চলে যাও কর্মাটাঁড়ে।

-বলছ? জায়গাটা তোমার দেখা?

-দেখা বলেই বলছি। তুমি যেমন প্রকৃতি খুঁজছ, তা পাবে সেখানে। আমি আগে গিয়েছি। মনোরম পরিবেশ। এক আদি সমাজ রয়েছে। সাঁওতাল অধ্যুষিত জায়গা। সাঁওতালরা বড্ড সদাসিদে মানুষ।

-কতদূর হবে?

-কলিকাতা থেকে দু’শ মাইলের মতো দূরে হবে।  জামতারা আর মধুপুরের মধ্যবর্তী  অঞ্চল।

-কোন জেলায় পড়ছে কর্মাটাঁড়?

-সাঁওতাল পরগনায় । আগে ছিল বীরভূমে।১৮৫৬ তে বীরভূম জেলাকে ভেঙে জঙ্গলমহল নামে নতুন জেলা হয়েছে।

হুঁকোয় গুড়গুড় আওয়াজ উঠছে। ঈশ্বরচন্দ্র ঈশানকে ডেকে আদেশ করলেন, শাস্ত্রী মশাইকে চা জল দিতে। বলে দিলেন, এটা তোর ওপর দায়িত্ব দিলাম।

-নিশ্চিত থাকো, দাদা।

ঈশানচন্দ্র  চলে গেল। আবার কথা শুরু হল দুজনের। পুরনো প্রসঙ্গে এসে পড়ল। রাজনারায়ণ বাবু বললেন,  ঈশ্বর, তুমি জানো বোধ হয় সাঁওতাল বিদ্রোহর কথা।

-জানি কিছুটা। তবে জানার কি আর শেষ আছে? বলো দেখি সে ইতিহাস। সময়টা কাটুক। মনটা বড্ড বিক্ষিপ্ত।

-তবে শোনো, সে বিদ্রোহ ছিল বীরভূম জেলার জঙ্গলমহলের সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক চাষি, খেতমজুতদের। তাদের জমির খাজনার অপ্রত্যাশিত বৃদ্ধি ও মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু-কানহু, চাঁদ-ভৈরব,-সাঁওতালী নেতারা। তাদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা নিজেদের অভিযোগের সুবিচার পাবার আশায় মিছিল করে। মিছিল আসবে কলিকাতায় । বড়লাটের কাছে নালিশ জানাবে। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আসছে।

এ স্পর্ধা ব্রিটিশ রাজের পছন্দ হল না। এমনিতেই ব্রিটিশ সাঁওতালদের ওপরে ক্ষিপ্ত ছিল। বীরত্বের সঙ্গে তাদের সব লড়াইকেই দমন করেছে। নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। এখানেও ঠিক তাই করল। গর্জে উঠল সরকারের গোরা সৈনদের বন্দুক।  বিনা প্ররোচনায় এলোপাথাড়ি গুলি চালতে শুরু করল।  ছত্রভঙ্গ হল মিছিল। মারা পড়ল অসংখ্য নিরীহ আন্দোলনকারী। সৈন্যদল মৃতদেহ নিয়ে গিয়ে ফেললে স্থানীয় একটা পুকুরে। একদিকে পুকুর, অন্যদিকে ময়ূরাক্ষী; দুইয়ের জল মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠল। বাকি দেহ গণকবর দিল। কেঁন্দুয়ার গভীর জঙ্গলে। শেয়াল কুকুরের খাদ্য হল।

এভাবেই সাঁওতাল বিদ্রোহ দমন হয়েছিল। সরকার যা চাইছিল, তাই করল এবার। সার্ভে সেটেলমেন্টের কাজে অসুবিধার অজুহাত দেখিয়ে আদত বীরভূম জেলাকে ভেঙে দুটুকরো করে বীরভূম আর জঙ্গলমহল জেলার পত্তন করল।

ঈশ্বরচন্দ্র শুনলেন। বললেন, সত্যি এই ইংরেজ সরকার কী অত্যাচারটাই না করেছে। এতগুলো লোকের মৃত্যু …

-দাদা, এবার যজ্ঞ শুরু হবে। পণ্ডিত মশাই তোমাকে ডাকছেন…, শম্ভুচন্দ্র এসে দাদাকে এত্তেলা দিতে কথা অর্ধসমাপ্ত রেখে তিনি উঠে গেলেন।  কাজের আসনে গিয়ে বসলেন। রাজনারায়ণ গিয়ে ভিড়লেন বাড়ির অন্যান্য পুরুষদের মাঝে।

                               (৩০)

 

ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ি পরিবর্তন করে কাশীপুরে চলে এসেছেন। গঙ্গাতীরে থাকছেন। বাবু হিরালাল শীলের এক বাংলো বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। মাসিক ভাড়া একশ পঞ্চাশ টাকা। কলিকাতা আর ভালো লাগছে না।  ঘরদোর বন্ধ রেখে সত্যিই একদিন কর্মাটাঁড়ে উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন।

তিনি যাচ্ছেন হাওড়া স্টেশন। পায়ে হেঁটে। গঙ্গার তীর ধরে ধরে চলেছেন। পথের এক পাশে ঘরবাড়ি। কিছু পাকা বাড়ি; বেশিরভাগই কাঁচা মাটির দেওয়ালের বাড়ি। কিছু ছিটেবেড়ার বাড়িও রয়েছে। বাড়ির মাথায় খড়বিচুলির ছাউনি।

রাস্তা সোজা নাক বরাবর। হেঁটে গিয়ে উঠলেন বড়বাজারে। এবার গঙ্গা পেরোতে হবে। পথের বাম দিকে বাঁক নিলেন। ডান দিক গেলে ব্রীজ। জলের ওপর ভাসমান পন্টুন ব্রীজ। তা চালু থাকবে, কিনা থাকবে, যদি জাহাজ আসবার সময় হয়, তো ব্রীজ খোলা থাকার কথা; তাই সে অনিশ্চয়তা না রেখে নৌকোয় গঙ্গা পেরোনো মনস্থির করে বাঁদিক ঘুরে আর্মেনিয়ান ঘাটে এসে পৌঁছলেন। এই ঘাট থেকে ফেরী নৌকো চলে। কলিকাতা-হাওড়ার মাঝে চলাচল করে।

গঙ্গায় জোয়ার এসেছে। জলে পাড় ছাপানো। অল্প হেঁটেই নৌকোয় ওঠা সম্ভব হল। আগে থেকেই সেখানে কিছু যাত্রী চেপে বসেছিল।  ঈশ্বরচন্দ্র ওঠাবার পরেও আরও কিছু যাত্রী এলো। নৌকো ছাড়ল। দাঁড় টানা নৌকো। নদী পেরোতে অনেকটা সময় নেওয়ার কথা। তবে জোয়ারের কারণে তা তরতরিয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই হাওড়ার পাড়ে এসে ভিড়ল।

পাড় ছেড়ে ওপরে উঠে আসলেন ঈশ্বরচন্দ্র। আরও অনেকগুলো মানুষ; দেহাতি গোছের তাঁকে অনুসরণ করে ওপরে এসে উঠল।

সামনে চওড়া রাস্তা। রাস্তা ধরে গরুর গাড়ি, ঘোড়ায় টানা বগী গাড়ি, হাতঠেলা অনবরত চলছে। চোখের সামনে হাওড়া স্টেশনের নতুন গড়ে ওঠা বাড়িখানা। ঈশ্বরচন্দ্রের কাছেও এটা নতুন দেখা।

রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, কখন রাস্তা ফাঁকা হয়। পথ পেরিয়ে স্টেশন বাড়িতে গিয়ে ঢুকবেন। মানুষগুলো কিন্তু বারবার চেষ্টা করতে লাগল রাস্তা পেরবার, তবে গাড়ির সামনে পড়ে দৌড়ে আবার ধারে সরে আসছিল। তাদের কান্ড দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের হাসি পাচ্ছিল। ভাবলেন, হতে পারে, এ পথে ওদের প্রথম আসা। স্টেশনের বিশাল বাড়ি দেখে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র শুনেছেন, ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার, জর্জ টার্নবুল পাকা স্টেশনবাড়ির নকশা করে কোম্পানিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মতো বাড়িখানা গড়বার পরে, তা দর্শনীয় বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সারা দেশের মধ্যে এই বাড়িটা গর্বের স্থাপত্য সৃষ্টি করেছে। এখন থেকে প্রায় উনিশ-কুড়ি বছর আগে মানে, ১৮৫৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানি বাংলায় প্রথম ট্রেনের গোড়াপত্তন করে।  প্রথম ট্রেন চলে হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত। তারপর, বর্ধমান। রেলপথ বাড়তে বাড়তে শেষে এখন ট্রেন যাচ্ছে এলাহাবাদ পর্যন্ত। অনেক আগে  স্টেশনবাড়ি ছিল কাঁচা ছাউনিতে। তাঁর তা দেখা ছিল। আর আজ সেই বাড়ি পাকা হয়ে কী বিশাল রূপ নিয়েছে।

তা যাক। গাড়ি ঘোড়ার চলন কাটিয়ে তিনি রাস্তা পেরলেন। পিছু পিছু আরও জনা কুড়ি মানুষ। তারাও চওড়া রাস্তা পার করে স্টেশন বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।

এবার টিকিট কাটার পালা। স্টেশনের ভিতরে একদিকে সার দিয়ে তিনটে খুপরি ঘর। প্রতি ঘরে এক চিলতে করে জানলা। খুপড়ির ভিতর একলা মানুষ, টিকিট আর টাকা নিয়ে বসে রয়েছে।

তিনি একটা খুপরির সামনে গেলেন। ফাঁক গলিয়ে হাত ভিতরে ঢুকিয়ে টাকা বাড়িয়ে দিলেন। গন্তব্যের নাম বললেন। হাতে টিকিট এল।

কর্মাটাঁড় পর্যন্ত টিকিটের দাম এক টাকা চার আনা।   তাঁর দেখাদেখি অন্য লোকগুলোও একইভাবে টিকিট কাটল। তবে তারা কোথাকার টিকিট নিল, তা তাঁর জানার প্রয়োজন ছিল না। তিনি এগিয়ে চললেন প্ল্যাটফর্মের দিকে।

সামনে নিচু প্ল্যাটফর্ম। পাশাপাশি। গা দিয়ে রেলের লাইন। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার মুখে দাঁড়ানো কালো কোটের চেকারকে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলেন, তাঁর গন্তব্যের গাড়ি কোন প্ল্যাটফর্মে। সেইমতো দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো গাড়ির একটা বগিতে উঠে চড়ে বসলেন। কাঠের বগি। ভিতর দিকে বগির গা বরাবর এপাশ ওপাশ করে লম্বা টানা বসবার কাঠের বেঞ্চ। মাঝেও একটা বেঞ্চ রয়েছে। থার্ড ক্লাসের বগি এটা।

গাড়ির সামনের দিকে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের বগী রয়েছে। তাতে কুশন দেওয়া সীট। ফার্স্ট ক্লাস বগি পর্দা আয়না দিয়ে সাজানো। সেখানে বেশিরভাগ সাহেবসুবো, ইংরেজ আমলা আর  দেশীয় রাজারা যায়। সাধারণ মানুষ সেখানে ওঠে না। ওই শ্রেণীর টিকিটের মূল্যও অনেক চড়া।

বেলা নটায় গাড়ি হাওড়া স্টেশন ছাড়ল। ছ কামরার গাড়ি। গাড়ি টানছে বাষ্পীয়  ইঞ্জিন। ঝিকঝিক আওয়াজ। ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া আকাশে গিয়ে মিশছে। কামরার জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছেন তিনি। মাঠ পুকুর, ধানক্ষেত , ঘরবাড়ি পেরিয়ে গাড়ি ছুটছে।

লিলুয়া, বেলুড় স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল বালি স্টেশনে।  কিছু লোক উঠল, নামল। নির্দিষ্ট সময় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকবার পর আবার চলতে শুরু করল। এরপর অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়ে গাড়ি এলো হুগলী স্টেশনে। ট্রেন আবার দাঁড়ালো। বহু লোক উঠল ওই স্টেশন থেকে।

গাড়ি চলছে। কামরায় নানান বস্তুর বিক্রেতা উঠছে। খাবারই বেশি। কাঁধে মিষ্টির বাঁক, মাথায় পেয়ারা, কলা, শসার ঝুড়ি। অনেকে তা কিনছে, খাচ্ছে। স্টেশন আসলে বিক্রেতা নেমে অন্য কামরায় চলে যাচ্ছে।

এক বিক্রেতা উঠল হাতে বইয়ের গোছা নিয়ে। মুখে তার বাক্যি, পড়ুন ও পড়ান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথমভাগ, দ্বিতীয়ভাগ, বর্ণমালা, বেতালপঞ্চবিংশতি, বাংলার ইতিহাস, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা নামের বিখ্যাত সব বই। জ্ঞান আহরণ করুন। শিশুদের অ, আ, ক, খ শিক্ষা দিন…,

ঈশ্বরচন্দ্র চুপ করে বসে শুনছেন আর  আনন্দ অনুভব করছেন। সার্থক তাঁর লেখা, মনে ভাবছেন। বাঙালির পড়ার অভিমুখ তাঁর দ্বারা কিছুটা নির্দিষ্ট হয়েছে- এ চিন্তা তাঁকে সুখী করছে।

গাড়ি একইভাবে ব্যান্ডেল, পান্ডুয়া, মেমারি হয়ে বর্ধমান, আসানসোল, জামতারা পেরিয়ে একসময় কর্মাটাঁড়ে পৌঁছাল।

বেলা পড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যে নামছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে চতুর্দিক। তিনি নামলেন। ছোট স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের অস্তিত্ব নেই। রেল লাইনের গা ঘেঁসে ঘাসেভরা জমিতে নামতে হল।

ঈশ্বরচন্দ্র হাতের, কাঁধের ব্যাগ সামলে নিয়ে নামলেন। গাড়ি থেকে আর মাত্র তিনজন যাত্রী নামল। উঠল না কেউই। নামা যাত্রীরা স্থানীয় মানুষ। তারা যে যার মতো পথ ধরল। ঈশ্বরচন্দ্র দাঁড়িয়ে রইলেন।

নতুন জায়গা। প্রথমবার আসা। তবু ভালো, একজনের নামধাম জেনে এসেছেন। অভিরাম মণ্ডল। তাকে খবর দিয়েই এসেছেন। মানুষটাকে রাজনারায়ণ বাবু মারফৎ জেনেছিলেন।

অভিরামকে পূর্ণ বয়স্ক লোক বলে জানতেন। তবে স্টেশনের আধা অন্ধাকারে সে যখন সামনে এসে দাঁড়াল, তিনি দেখলেন, অভিরাম একেবারেই যুবক। দুজনের কেউ কারোও পূর্ব পরিচিত নয়। তবু একজন আর একজনকে চিনে নিতে অসুবিধা বোধ করল না। আসলে, স্থানটা সাঁওতাল অধ্যুষিত। খুব কমই শহর নগরের লোক সেখানে থাকে। তাই নির্দিষ্ট আগন্তুকের সাজ পোশাক দেখে অভিরামের তাঁকে চিনে নিতে অসুবিধ হয়নি। তাছাড়াও একজনই তো মানুষ যিনি স্টেশনে নেমে অপেক্ষা করছিলেন। আগের থেকেই খবর এসেছিল, তার জন্যে স্টেশনে একজন এসে অপেক্ষা করবে।

অপরিচিত যুবক সামনে এসে নিজের পরিচয় দিল। মাথা হেঁট করে ঈশ্বরচন্দ্রের দুই হাঁটু ছুঁয়ে প্রণাম জানালো। গুরুজনদের প্রণামের জন্যে এখানে এটাই রীতি।

ঈশ্বরচন্দ্রকে অভিরাম আহ্বান জানাল তাকে অনুসরণ করবার জন্যে। ঈশ্বরচন্দ্র জানেন না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁকে। বিনা বাক্যে অভিরমকে অনুসরণ করে বেশ কিছুটা পথ চলে এলেন।

নির্জন জায়গা। নিস্তব্ধ। চোখের সামনে ধূসর মাঠ। চারপাশে ছোটবড় গাছপালা। গাছের মাথায় মাথায় ঘরে ফেরা পাখীর দলের কিচিরমিচির ডাক ধীরে ধীরে স্থিমিত হয়ে আসছে। নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে পাখির দল। পথ চলছেন ঈশ্বরচন্দ্র। কোথাও বা জঙ্গল, আবার কোথাও ছোট ছোট টিলার মতো পাহাড়। অন্ধাকারে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। মাঝ দিয়ে সরু মেঠো পথ। তিনি হাঁটছেন।

অভিরাম মণ্ডল পথপ্রদর্শক। আপন মনে ঈশ্বরচন্দ্র প্রকৃতিকে উপভোগ করতে করতে চলেছেন। স্থান বৈচিত্র আর স্বর্গীয় নির্জনতা তাঁকে আকৃষ্ট করছে। অন্ধকার নামতেই  জোনাকির ঝাঁক বেরিয়ে পড়ল।

এসে পৌঁছলেন এক লোকালয়ে। লোকালয়টা বেশ ছোট। অল্প কয়েক ঘর মানুষের বাস। অভিরাম সেখানেরই একটা বাড়িতে ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে তুলল। জানাল, পাশেই তার নিজের বসতবাটি, ওটাও তাদেরই বাড়ির অংশ।

একখানা ঘর। ছোট একটা বারান্দা। সামনে পাতকুয়ো। পাশে দাঁড়িয়ে স্নানের উপযোগী জায়গা করে রাখা হয়েছে। শৌচকর্ম হবে পার্শ্ববর্তী মাঠে। উন্মুক্ত মাঠে আর পাঁচজনের মতো। ঈশ্বরচন্দ্র তাতেই রাজী।

তিনি ভাবলেন, স্থানটাকে তো আগে চিনতে হবে? তবে, এখন তো কিছুদিন আছেন এখানে। একটা না একটা বাড়ির বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। সকাল হলে নিজে পদব্রজে বেরিয়ে আগে পুরো গ্রামটা পরিদর্শন করে আসবেন।

পরের দিন। ভোর হতেই ঈশ্বরচন্দ্র হাঁটতে বেরিয়ে পড়েছেন। গ্রামের পথ ধরে চলেছেন। অভিরাম তাঁকে একলা ছাড়েনি। নতুন জায়গা! তাছাড়াও, গ্রামের সব খবরাখবর তো তাকেই চালান করতে হবে বাবুকে। সেও সঙ্গ নিয়েছে ঈশ্বরচন্দ্রের।

পথ চলছে আর বকবক করে যাচ্ছে অভিরাম। তার নিজের ভাষা সাঁওতালী নয়; তাহলে কী হবে, জন্মকর্ম তার এখানেই। অন্য আর কোন ভাষা সে আয়ত্ত করবে? তাতেই কথা চালিয়ে যাচ্ছে সে। বলল, বাবু, তু ইখানে বরাবর থাকতে এয়েছিস?

ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, এখন কলিকাতায় যাওয়া আসা করব। তবে পরে বরাবরের জন্যে আমি এখানেই থাকব, অভিরাম।

-তু তো লিখাপড়া করা মানুষ, ইখানে আমরা কেউ লিখাপড়া করি না। তু, থাকতে পারবি, বাবু…

-খুব পারব। আমি ইখানে তুদের লিখাপড়া শিখাবো।

ঈশ্বরচন্দ্রও অভিরামের ভাষা নকল করে কথা বলছেন। যদিবা সাঁওতালী ভাষা তাঁর জানা নেই। তবে, যস্মিন দেশে যদাচার, একথা মনে করে অভিরামের টোনে কথা বলতে শুরু করলেন। অভিরাম তাঁর দিকে চেয়ে অবাক বিস্ময়ে বলল, তু আমাদের ভাষা জানিস?

-শিখে নিব, অভিরাম। তুদের মাঝে থাকতে গেলে, আমায় তুদের ভাষা শিখতেই হবে। কি বলিস?

একগাল হাসি দিল অভিরাম মণ্ডল। পরে বলল, বাবু, ইখানে সাহেব মেমও থাকে বটে। তবে এক সাহেব, সে কিছুদিন আগেই মরে গেল। মেম একলা হয়ে গেল। বলছিল, উদের দেশ, সেই কুথায়, বিলাইতে না কি, সেখানেই ফিরে যাবে। যাবি নাকি, মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা ক্যরতে?

-কুথা থাকে তোর সেই মেমসাহেব?

-হেই, ইশটেশন ধারে। খুব বড় বাংলায় থাকে।

কথাটা শুনে ঈশ্বরচন্দ্র মনে মনে খুশি হলেন। গ্রাম দেখতে দেখতে ফিরলেন স্টেশনের কাছে। মেমের বাংলো বাড়ি স্টেশনের গা ঘেঁযে। ভাবলেন, কালকেই তো এই পথ ধরে গেছেন। তবে, অন্ধকারে চোখে পড়েনি হয়তো।

অভিরাম ঈশ্বরচন্দ্রকে মেম সাহেবর বাড়িতে এনে তুলল। পরিচয় করলেন মেমের সঙ্গে। ভদ্রমহিলা ইংরেজ। বয়স ষাটের ঘরের শেষ দিকে। চেহারায় তার কিছু প্রকাশ ঘটছে। ভদ্রমহিলা সদ্য স্বামীকে হারিয়েছেন। কথায় কথায় সব কিছু জানালেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে তাঁরা কর্মাটাঁড়ে এসে রয়েছেন। তবে এখন একলা হয়ে যাওয়ায়, তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে চান। জমি বাগান সহ বসতবাড়িখানা বিক্রি করে ফিরবেন।

ঈশ্বরচন্দ্র যেন হাতে চাঁদ পেলেন। জিজ্ঞেস করে দরদাম জানলেন।

পাঁচশ টাকা। তিন একর উনিশ শতক জায়গা, বাগান সহ। বাড়ির পরিবেশ মনোরম। কোথাও প্রকৃতি নিরীক্ষণে কোনও প্রতিবন্ধকতা নেই। একলা বসে নির্বিঘ্নে লেখা পড়ার  কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।

ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরোধে মেম তাঁকে সমস্তটাই ঘুরিয়ে দেখালেন। প্রশস্ত জমির একদিকে বাংলো ধরণের বাসস্থান। বেশ পুরানো, ভগ্নপ্রায় অবস্থা। তবে সেখানে রয়েছে চারটে ঘর, দুটো হল ঘর, দুটো বারান্দা।

তিনি বুঝলেন, এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। বসত বাড়িখানা না হয় পুনর্নির্মাণ করে নিলে হবে। তবে হল ঘর, সামনের এতখানি উন্মুক্ত জায়গা, এগুলোকে দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো অনেক কাজ তিনি করতে পারবেন।

বেশি দেরী না করে, হল ঘরে বালকদের জন্যে ইশকুল তো এখনই বসান যায়।… চারটে ঘরের একটা নিজের থাকবার, একটা বইপত্র রাখা, লেখালিখি করবার, অন্যটায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসালয় বসানো, আর একটায় অভিরামকে কাছে এনে ঠাঁই দেওয়া।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page