আবার এসো ফিরে/ রামেশ্বর দত্ত

পাড়া প্রতিবেশীর যে কোনোও প্রয়োজনে তিনি রয়েছেনগ্রামের গরীব দুঃখীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেন, কারোও খ্যাদাভাবে দিন কাটছে কিনা। সাহায্য করেন। সাহায্য প্রার্থীর ঘরে চাল বাড়ন্ত, মাসীমা, দু কুনকে চাল ধার দেবেন, বলে, গ্রহীতা এসে দাঁড়াল। ভগবতীদেবী ভাঁড়ার থেকে চাল বের করে  এনে দিলেন । কাউকে গাছের কলাটা মুলোটা; আবার সেরকম হলে, নিজের সংসারের কষ্ট মেনে নিয়েও দুচার পয়সা সাহায্য করেন অতি দরিদ্রদের।

এ ছাড়াও তিনি হচ্ছেন রত্নগর্ভা মহিলা। ঈশ্বর, দীনু, শম্ভুর মতো কৃতি সন্তানদের জননী তিনিতাঁর প্রায় সব ছেলেরাই কলিকাতা শহরে থেকে পড়াশোনা করে   বিদ্যাসাগর, ন্যায়রত্ন, কেউবা তর্কালঙ্কার উপাধি লাভ করেছে। বীরসিংহ গ্রামে আর কোনও মায়ের এতগুলো কৃতি সন্তান নেই।

এরপর… 

আজকের আসরে হাজির দীনময়ী। ভগবতীদেবীর বড় মেয়ে মনোমোহিনী যে কিনা শ্বশুর বাড়ি থেকে মায়ের কাছে এসে রয়েছে দিন কয়েকের  জন্যে, সেও হাজির । তার মতোই মেজ, সেজ মেয়ে, মানে দিগম্বরী, মন্দাকিনীও যখন মায়ের কাছে এসে থাকে, তখন তারাও এতে যোগ দেয়।

আরোও জনা দশ পাড়াতুত মহিলাদের নিয়ে দুপুরের আসর জমেছে।  গোল হয়ে ভগবতীদেবীকে ঘিরে বসেছে  সকলে। সবার মাঝে দীনময়ীর সই, মানে সেই ঠোঁটকাটা বেহায়া, অন্নপূর্ণাও রয়েছে। কোলে তার দেড় বছরের ছেলে। ঈশ্বরচন্দ্রের কথায়, বিয়ের সাত মাসের মাথায় যাকে  জন্ম দিয়েছে। এ শুধু একলা ঈশ্বরচন্দ্রের কথাই নয়। এই নিয়ে একসময় নানান কানাঘুষোও হয়েছে মহিলা মহলে। তারা বলত,  বিয়ের ফুল ফোটবার আগেই ও মেয়ে তার ভাবী বরের সঙ্গে লটরপটর চালিয়েছিল। ভাব ভালবাসা ছিল আগে থাকতে।  লুকিয়েচুরিয়ে প্রেমপর্ব চলত। অবৈধ শরীরক্রিয়াও হয়েছিল। ফসল পেটে ধরেছে। বাপ তাই লোকটাকে ধরে সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে নিজ সুপুত্রীর দোষ চাপা দিয়েছে। অন্নপূর্ণার কানেও এ কথা পৌঁছিয়েছে। তবে সে তা স্বীকার করেনি। বারবারই হাওয়ায় হাত ভাসিয়ে তা উড়িয়ে দিয়ে গেছে। এজন্যে মেয়েরা ওকে নিয়ে মজা করে। বলে, তুই তো সূর্য পূজো করতিস। সূর্যর তেজে তোর ছেলে হয়েছে, না রে?…

দুপুরের  আসরে এধরণের আচাল বেচাল কথা চলতেই থাকে। অবশ্যই বয়স্কাদের কান এড়িয়ে। তবে আজকের আসরে প্রথম প্রসঙ্গই উঠল রান্না নিয়ে। কার বাড়িতে কী রান্না হয়েছে?

একজন জানাল, সে আজ  সোনামুগের ডাল রেঁধেছে।

-কী দিয়ে সোনামুগের ডাল রাঁধলি রে মান্তা?

ভগবতীদেবী  মোক্ষম জায়গায় ধরেছেন তাঁর সইয়ের মেয়ে মান্তাকে। সই এক বছর হল গত হয়েছে। সংসারের ভার এখন মান্তার ওপরে। বাড়ির একটাই বউ সে।

মান্তা বুঝল মাসী তাকে পরীক্ষা করছে। সে বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠল, কেন গো মাসী? তুমি বুঝি জানতে চাও, সোনামুগের ডালে আমি হলুদ  বাঁটা দিয়েছি কি না? ওটি আমার জানা আছে, মাসী। ওই ডালে হলুদ দিতে নেই।

-নামাবার আগে দুধ দিয়েছিলিস? এক ছটাক দুধ?

মান্তা যে তা করেনি, যেন তা জেনেশুনেই ভগবতীদেবী প্রশ্নটা করলেন। আর ঠিক তাই। মুখ ছোট করে সে উত্তর দিল, না মাসী। সেটা তো জানা ছিল না। তবে জানিয়ে ভালই করলে। এবার থেকে সোনামুগের ডাল রাঁধলে দুধ দিয়ে নেড়ে নামাবখন।

-তুই কী রেঁধে বেড়ে শ্বশুর শাউরিকে খাওয়ালি রে, অন্নপূর্ণা?

অন্নপূর্ণাকে নিয়ে পড়লেন ভগবতীদেবী। অন্নপূর্ণার নামে যে একটা কিছু রটনা রয়েছে, তা তাঁর কানেও রয়েছে। তবে  বয়োজ্যেষ্ঠা হয়ে তিনি তা মনে মনেই রাখেন। এমনিতে মেয়েটা দীনময়ীকে আপন করে  দেখে বলে ভগবতীদেবী অন্নপূর্ণাকে স্নেহ করেন। তাই ওর বিষয়টাকে তিনি বয়সের দোষ বলে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলেন।

অন্নপূর্ণা ছেলেকে বুকের দুধ দিচ্ছিল। ভগবতীদেবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, মাসী, আজ আমি মোচার ঘণ্ট রেঁধেছি। বেশ করে  গরম মশলা দিয়ে রান্না করেছিলুম। তাইতে বাড়িতে সক্কলে পাত চেটেপুটে খেয়েছে। আর ছিল, কৈ মাছের ঝোল। ফুলকপি দিয়ে।

-কৈ মাছের ঝোলে আলু দিতে পেরেছিলি?

ভগবতীদেবীর প্রশ্নে অন্নপূর্ণা অবাক। আলু! ও বস্তুটাকে তো এখনও চোখেই দেখা হয়নি। শুধু নাম শুনেছে। আর জেনেছে, সে নাকি ভারী সোয়াদের আনাজ। একবার যে খেয়েছে, সে বারবার খাবে। ঝালে, ঝোলে, শাকে, অম্বলে, সবতেই ও সবজীর কদর। তাই শুধু কী সোয়াদ? রান্না তরকারীর পরিমাণ বাড়ানোতেও তার মহিমা। সবই শোনা কথা। এখন ভগবতীদেবীর মুখে আলুর কথা শুনে অন্নপূর্ণা বলে উঠল, মাসী, এ সবজী তোমার বাড়িতে হলেও, আমাদের কাছে তা স্বপ্ন।

-কেন রে! তোর বর কিনে আনতে পারে না?

-বেশ কথা বললে, মাসী। কিনবেটা কোথা থেকে? তারা কি আর কলিকাতায় যায়? নাকি, সে সবজী এই গ্রামে পাওয়া যায়? তোমার বাড়ির মানুষরা কলিকাতায় থাকে। নিত্যি তাদের সেখানে যাওয়া আসা আছে। সাহেব সুবোদের সবজী কিনে আনে। তোমরা খাও। তাই বলে আমরা…!

-তা ঠিক বলেছিস রে তুই ।

 ভগবতীদেবীর দয়ার শরীর। মন গলে গেছে অন্নপূর্ণার কথায়। বললেন, ও জিনিষ এখনও এদেশেই হয় না। ঈশ্বর কলিকাতা থেকে কিছু বয়ে আনে বলেই না আমাদের খাওয়া হয়। সে তো বলে, আলু আসে বাইরের দেশ থেকে কাঠের জাহাজে চেপে। দুর্মূল্য বস্তু।… তা যাক। আজ যাবার সময়ে বরং হাতে করে গোটা কয়েক আলু নিয়ে যাস। খেয়ে দেখিসখন। কী সোয়াদের সবজী!

-ও ঈশ্বরদা বুঝি কলিকাতা থেকে এয়েছেন…, অন্নপূর্ণার কথায় রসের আভাষ। সঙ্গে দীনময়ীর গায়ে চমটি কাটা।  ফিসফিস করে সে উচ্চারণ করল, কি লো সই, রাত রঙিন হচ্ছে তো?

অন্নপূর্ণার কথার ইঙ্গিত বুঝে দীনময়ী গোল্লা গোল্লা চোখে তাকান। ঈশারায় জানান দেন, বাচালতা করবি না। শাশুড়ি রয়েছে …

এমন একটা ছোট্ট রসালো ঘটনা মুহূর্তে ঘটে গেল। ভগবতীদেবীর চোখের আড়ালে। উনি তখন অন্নপূর্ণার কথার উত্তর দিচ্ছেন। বলে চলেছেন, তা না হলে, আর কে আনবে? দীনুর এসব দিকে মন নেই। শম্ভু অন্য সবজী কিছু কিছু নিয়ে আসে বটে। তবে ঈশ্বরের তো ওঠাবসা রয়েছে সাহেবসুবোদের সঙ্গে। কী নাম যেন বলে বাবা,… হগবাজার, না কী, তা সেই  বাজারে গিয়ে আলু কিনে আনে।  সাহেবদের বাজার। সেখানে নাকি জ্যান্ত সব পশুপাখি, মুরগি, এসবও পাওয়া যায়। কেটে, তার মাংস বিক্রি হয়। কলিকাতা শহরের ধরনধারণই আলাদা…,

শেষের বাক্যিটা ভগবতীদেবী সগোক্তির মতো করেন। এদিকে মাসী শুধু অন্নপূর্ণাকে ওই নতুন সবজী খাওয়াবে জেনে অন্যেরা বলে ওঠে, ও, মাসী বুঝি শুধু অন্নপূর্ণাকেই নতুন সবজী দেবে? আমরা কী দোষ করলুম গো, মাসী?

ওদের গলায় আবদারের সুর।

-তোরাও নিয়ে যাস। সকলে কয়েকটা করে নিয়ে যাস। অনেকই তো এনেছে। এবার তোরাও তোদের বরকে বলবি, কলিকাতায় গিয়ে আলু কিনে আনতে। ঈশ্বর না হয় বাজারের খোঁজটা দিয়ে দেবে।

সকলের উদ্দেশ্যে ভগবতীদেবী কথাটা ছুঁড়ে দেন।  বয়স্কা একজন বলে উঠলেন, তা যা বলেছ, দিদি। আমার বাড়ির পুরুষরা আবার ওই রাজ্যি পথ হেঁটে গিয়ে কলিকাতা থেকে নতুন সবজী কিনে আনছে? সবাই কি আর তোমার ছেলেদের মতো?

-সত্যি দীনময়ী, তুই একটা বর পেয়েছিস!

বাক্যটা নিচু স্বরে উড়ে এলো অন্য একজনের মুখ থেকে। মেয়েটিকে দীনময়ী দিদি বলে। সাদা থান কাপড় পরে । স্বামী এক বছর আগে মারা গেছে। বুড়ো ঢরঢরে বর ছিল। বিয়ে হয়ে মাত্র চার বছর ঘর করতে পেরেছিল দীনময়ীর এই সৌদামিনী দিদি।

কথাবার্তা চলতেই থাকে। শীতকালের দুপুরের রোদ নিজের মনে গড়িয়ে দালানের এপার থেকে ওপারে চলে যেতে বসেছে। সৌদামিনীর দু বছরের ছেলেটা খেলে বাড়াচ্ছে দালানে। সঙ্গী পেয়েছে পূর্ণিমার মেয়েকে। দুজনে প্রায় সমবয়সী। খুব মিল দুটোতে। এই দৌড়চ্ছে, তো এই খেলনাবাটি বার করে  সংসার সাজাচ্ছে। আবার মতে অমিল হলে ঝগড়াও করছে। তবে শিশুর মায়েদের সেদিকে মন দেবার দরকার হয় না।  এই নিয়ে পূর্ণিমা একদিন মেয়েকে একটা চড় মেরেছিল। ভগবতীদেবীর সে কী রাগ! পূর্ণিমাকে বলেই দিয়েছিলেন, অতই যদি শাসন করতে হয়, তো মেয়েকে নিয়ে আসিস কেন রে? আমার সামনে বাচ্ছাদের গায়ে হাত তুলবি, আমি বাপু তা সহ্য করতে পারব না।

তারপর থেকে এ বাড়িতে আসলে বাচ্ছাদের পোয়া বারো, আর ছেলেমেয়ের মায়েদেরও তাই। সব মায়েরাই এই সময়টা নিজেদের পেটেরটির কথা ভুলে দুপুরের খোস গল্পে মেতে থাকে। হাসি-ঠাট্টা, রঙ্গ-রস, কাজ-অকাজের কথায় মেতে ওঠে। ছোটরা বড়দের, একে অন্যের সঙ্গসুখে দিনের একটা সময় কাটায়। গ্রাম্য জীবনে এটার মূল্যই বা কম কী?

কথা উঠল, দিলুর বরের নাকি আজ পাঁচ দিন ধরে সর্দি কাশি হয়েছে, কিছুতে কমছে না। অথচ ব্যাপারটা গ্রাহ্যই করছে না দিলুর বর। কথাটা ভগবীদেবীর কানে যেতে বললেন, দিলু, কামদার অসুখটা এভাবে ফেলে রাখিস না। বুকে সর্দি জমলে তাড়াতাড়ি তা দূর করতে হয়। না হলে, অন্য কোনও রোগে দাঁড়িয়ে যায়।

কামদা দিলুর বরের নাম। সবার নাম ভগবতীদেবীর ঠোঁঠোস্থ। তিনি, কী মেয়ে-বউ, ঝি, কী তাদের বর, শ্বশুরের নাম, সব মনে করে রেখেছেন।

দিলু উত্তর করল, কী বলব মাসী। কারোও কথা শোনে না। কত করে  বলি, কবরেজের কাছে গিয়ে ওষুধ এনে খাও। তা কার কথা, কে শোনে। ওই নিয়ে হাট-মাঠ করে বেড়াচ্ছে। হাল গরু নিয়ে মাঠ চাষ করছে!

-কামদাকে আমার নাম করে বলবি, আমি বলেছি, বুকে পুরনো ঘি মালিশ করতে। তাতে যেমন বাচ্ছাদের সর্দিকাশি দূরে থাকে, বড়দেরও জমা সর্দি নেমে যায়। কুসুম কুসুম গরম জল মাথায় দিয়ে নাইতে বলবি।

-তুমি, বলছ যখন, আমি তা গিয়ে বলব। তোমার কথায় যদি কান দেয়।

এর ওপর দিলুর কথা বাড়াবার সাহস নেই। কিন্তু ভগবতীদেবী তাতেও না ভরসা রেখে আবার বলেন, না হলে, একদিন ওকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আয়। ওর বাপ আমাকে ভয় করে , তো ছেলে…

প্রসঙ্গ শেষের আগে কথা ঘুরে গেল। অন্য কথায় গিয়ে ভগবতীদেবী মনোমোহিনীকে নিয়ে পড়লেন। সে পানের বাটা থেকে পাতা বের করে তাতে চুন ঘষছিল। ঝিনুক চুন। সাদা ফকফকে। ভগবতী দেবী জানতে চাইলেন, হ্যাঁ রে মনো, তোর দেওয়ের চাকরীর কিছু ব্যবস্থা হল?

চুন দোক্তা দেওয়া এক খিলি পান মায়ের হাতে তুলে দিয়ে মনোমোহিনী জবাব দিল, কৈ আর হল, মা? সে তো এখনও ঘরেই বসা।

-তাই তো। ছেলেটা পড়ালেখা করেও কিছু করতে পারছে না।…তোর বড়দাকে ধর না। তুইও রয়েছিস, ঈশ্বর তো এখন এখানে রয়েছে । ওকে বললে ও নিশ্চয়ই একটা কিছুতে লাগিয়ে দেবে।

সবদিকে খেয়াল ভগবতীদেবীর। তবেই না সকলে তাঁকে মানে। কী ছোট, কী বড়। গ্রামে আরও পাঁচটা বাড়ি। সেখানেও একজন করে গিন্নী আছে। তবু বয়স্ক, বুড়ি, এঁয়োতি, পোয়াতি, সন্তানের মা, সকলে ভগবতীদেবীর জন্যে এখানে এসেই ভিড় জমায়।

কথা থামল। অনেকটা সময় সকলে চুপচাপ। বাচ্ছা দুটো দালানময় ছুটোছুটি করছে। ওদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

দিনের ঝাঁ ঝাঁ রোদের তেজ একটু যেন কম হল। শীতের হাওয়া এবার গায়ে লাগছে। ভগবতীদেবী বললেন, মনো, নিচের থেকে আমার গায়ের চাদরখানা  নিয়ে আসবি মা…

মনোমোহিনী উঠে পড়ল । সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। মায়ের ঘরে গিয়ে আলনা থেকে হাতে বোনা সুতোর হাল্কা চাদরখানা এনে ভগবতীদেবীর গায়ে জড়িয়ে দিল।

তিনি তখন পিকদানি খুঁজছেন। মুখে পিক জমে উঠেছিল। দিলু জায়গা ছেড়ে উঠে এসে তাঁকে পিকদানিটা এগিয়ে দিল। এমন সময় সদর দরজায় দেখা গেল ঈশ্বরচন্দ্রকে। তিনি বাড়িতে ঢুকছেন। দালান থেকে সদর দরজা দেখা যায়। ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে সকলে উঠে পড়ল । মায়, দীনময়ীও। বসে রইলেন শুধু ভগবতীদেবী। তিনি জানেন, বাইরে থেকে এসে ছেলে আগে তাঁর কাছেই আসবে।

সদর দরজায় চটিজুতো ছেড়ে ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে গেলেন কলতলায়। পাতকূয়ো থেকে জল তুলে হাত পা ধুলেন। স্নান সকালেই সারা হয়ে গিয়েছিল। ওপরে উঠে এলেন। দালানে মাকে দেখতে পেলেন। বললেন, বেলা যেতে যেতেই শীত শীত করছে না-মা?

-হ্যাঁ বাবা।  উত্তর দিয়ে ভবগবতীদেবী  কথা যোগ করলেন, বেলা যে পড়ে গেল । ভাত খাবি কখন?

-এই তো। এবার খাবো, মা। কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। নতুন ইশকুল খোলার ব্যাপার…

কথার মাঝে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। জামাকাপড় বদল করলেন। বেরিয়ে এসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।   সিঁড়ি ভাঙছেন, ভগবতীদেবী দীনময়ীকে ইশারা করলেন, ছেলের খাবার বাড়বার ।  ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে মুখ তুলে বললেন,  গিয়ে খেতে বসো, আমি আসছি।

-নিচে গিয়ে ঠাণ্ডায় কী করবি? এখানেই বস।  ও তো রয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র মাকে রেহায় দিতে চাইলেও ভগবতীদেবী বললেন, না রে, বাবা। এতদিন পড়ে এয়েছ। সামনে বসে তোমাকে না খাওয়ালে কী মনটা ভরে? আমিও মুখে দুটো দোবো। বউটাও তো খায়নি…

-আমার জন্যে তোদেরও খেতে অনেকটা বেলা হয়ে গেল। চল, তাই হোক। আমি খাই। তোরাও বস।

ঈশ্বরচন্দ্র সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন।

তিনি খেতে বসেছেন।। দীনময়ী থালা সাজিয়ে স্বামীকে খেতে দিয়ে নিজে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মাথায় এক হাত ঘোমটা । কাপড়ের আড়াল থেকে স্বামীর খাওয়ার তদারকি করছেন । ভগবতীদেবী ততক্ষণে ওপর থেকে নেমে এসে ছেলের সামনে বসেছেন, খাওয়ার তদ্বির করছেন।

গেলাস থেকে হাতে জল নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র আচমন সারলেন। পাতের চতুর্দিকে জলের ছিটে দিয়ে ভাতে হাত ঠেকালেন। থালা ঘিরে চারটে বাটি। ডাল, তরকারী-দু প্রকারের মাছ। অন্য এক বাটিতে দুধ। তাতে ভাত ডোবানো।

ধীরে সুস্থে খাচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র । ভগবতী দেবী ছেলের সঙ্গে কথা জুড়লেন। জানতে চাইলেন, গ্রামে মেয়েদের ইশকুল বসাবার বিষয়ে সকলে রাজী হল?

-না মা। অনেকেই এর ঘোর বিরোধী। জনে জনে কথা বলে মানাতে হচ্ছে। তুই বোধ হয় জানিস, কলিকাতা শহরেই অমন ছোটলাটের কথায় মেয়েদের ইশকুল খুলতে গিয়ে কত বাধা এসেছিল। সেখানে এই বীরসিংহ গ্রামের মতো জায়গায় মেয়েদের ইশকুল একেবারে সমানে খুলতে দেবে, তা কি ভাবা যায়?

মুখে ভাতের গ্রাস। চিবোতে চিবোতে কথা বলছেন। ভগবতীদেবীর মনে সন্দেহের বান। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, হ্যাঁ রে, তাহলে কি গ্রামের ছেলেমেয়েরা ইশকুলে গিয়ে শিক্ষা নিতে পারবে না?

কথার মাঝে ভগবতীদেবীকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখালো। পাশ থেকে দীনময়ী বললেন, মা, ওনার খাওয়া হলে পরে না হয় সব কথা শুনবেন। অনেকটা তো বেলা হয়ে গেছে…

-তাই, তাই। আমি বরং তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠি। তারপর তোমরাও খেতে বসে যাও।

  ঈশ্বরচন্দ্র হাত চালিয়ে খেয়ে উঠলেন। শেষপাতে কিছুটা ভাত তরকারি রেখে দিলেন স্ত্রীর জন্যে। দীনময়ী ভগবতীদেবীর খাবার বাড়লেন। শাশুড়ির সামনে থালা সাজিয়ে দিয়ে নিজে ঈশ্বরচন্দ্রের পাতে ভাত নিয়ে বসলেন। ঈশ্বরচন্দ্র হাত মুখ ধুয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বিশ্রাম নেবেন এখন। সন্ধ্যের পর আবার তাঁকে বেরতে হবে। ইশকুল স্থাপনের কথা এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে।

সন্ধ্যেবেলা গ্রামে সভা বসল। বারোয়ারী তলায়। চালার ঘর। সামনে বড় চাতাল। পূজো পাব্বনে চাতালে মেরাপ বেঁধে রঙিন কাপড় টাঙ্গিয়ে মণ্ডপ তৈরী হয়। গ্রাম উজাড় করে  লোক পূজো দেখতে আসে। পূজোর আয়োজন হয় বয়স্কদের তত্ত্বাবধানে। ছেলে মেয়েরাও তাতে অংশ নেয়। আজ অবশ্য চাতাল জুড়ে বয়স্কদেরই ভিড়। বহু মানুষ একত্রিত হয়েছে। তাদের মধ্যে আবার দু ভাগের লোক রয়েছে। অনেকে মেয়েদের ইশকুল স্থাপনের পক্ষে। কিন্তু বেশি জনই বিপক্ষে। তাদেরকে মানাবার প্রয়োজন। এ ভার তিনি নিজের ওপর নিয়েছেন। সভার কাজ শুরু হল। ঈশ্বরচন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। সকলে চুপ। তিনি বলতে শুরু করলেন,

-দেখুন মশায়রা, আমার বক্তব্য একটু গভীর প্রকৃতির। নারী শিক্ষার বিষয়ে আমি আপনাদের নানান মন্তব্য শুনেছি। তবে আমি বলতে চাই, বাংলার চিরকালের গৌরব হচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়। তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব ব্যয় করে  বৈদিকধর্ম, উপনিষদের ধর্ম, পরম পূজনীয় ঋষিদের  সাধনা লব্ধ ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারে জীবন ব্যয় করে গেছেন। একথা অনেকেই জানেন। সাধারণ লোকের জ্ঞানবৃদ্ধির জন্যে তিনি হিন্দুর বেদ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করেছেন । তা করতে গিয়ে তিনি সবকিছু খুইয়েছিলেন। শেষে বিলেতে গিয়ে মারাও যান।

আমার কাজ নারী শিক্ষার বিস্তার করা। রাজা রামমোহনের কাজে উৎসাহিত হয়ে আমি তাঁকেই অনুসরণ করছি। বাংলার গভর্নরের নাম আপনারা অবশ্যই জানবেন। তিনি হচ্ছেন জেনারেল হার্ডিঞ্জ। তাঁকে আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আমার কথা শুনে তিনি  কলিকাতা ও বাংলার অন্য জেলায় একশ একটা নতুন বাংলা ইশকুল খুলেছেন। ছোটলাট হচ্ছেন মিঃ হ্যালিডে। তাঁর মুখের কথায় কিছু বালিকা বিদ্যালয়ও শুরু হয়েছে।  সেইসব ইশকুলে ইতিমধ্যে ছেলেমেয়েরা যোগ দিয়েছে। পঠন পাঠন শুরু হয়েছে। চলছে। এভাবেই উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অন্যান্য জেলা। আর সেখানে আমার নিজের গ্রামের জন্যে যদি কিছু না করতে পারি, তাহলে আমার মতো অবোধ আর কে থাকতে পারে?  সুশিক্ষা পাওয়ার জন্যে ইংরেজি ইশকুলেরও প্রয়োজন। আমি আমার বাবা, ঠাকুরদাস মশাইকে বলেছি, বীরসিংহ এবং আশপাশের অন্যান্য গ্রামের বালকদের সুশিক্ষা পাবার জন্যে নিজ নিজ গ্রামে একটা করে  ইংরেজি ইশকুল বসাবার কথা। তিনি আমায় আশীর্বাদ করেছেন। আমার মা, ভগবতীদেবী, যাঁকে আমি দেবী জ্ঞানে পূজো করি, তিনিও এই শুনে অত্যন্ত সুখী। এখন এই অবস্থায় আপনারা যদি আমার সহায় না হন, তাহলে তো এই গ্রামে  বাস করা আমার উচিত হবে না। তাই জিজ্ঞেস করি, ইশকুল বসাবার জন্য আপনারা সকলে একমত কি না আমাকে জানান।

বক্তব্য রাখা শেষ হল। সভা কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চুপ। এধার ওধার থেকে ছোট ছোট করে গুঞ্জন উঠছে। ঈশ্বরচন্দ্রের কানে তা আসছে। ধৈর্য ধরে চুপ করে বসে সব শুনছেন। এমন সময় একজন বয়স্ক ব্যক্তি উঠে দাঁড়ালেন। নাম সুধাময় চক্রবর্তী । ভদ্রলোক বরাবরই ঠাকুরদাসের পরিবারের বিপরীতে কথা বলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁকে কাকাবাবু ডাকলেও, তাঁর ওপরেও তিনি কিছু সদয় নন।  সুধাময় বাবু বলতে শুরু করলেন, তুমি বাপু শহর কলিকাতার কথা টেনে এনে গ্রামের ঘরে ছড়াতে চাইছ। শহর কলিকাতায় বাংলা ইংরিজি ইশকুল হয়েছে বলে কি, এই গ্রামেও ইশকুল হবে?…ক’জন পড়বে? ছেলেপুলেরা মাঠে চাষ দেবে; নাকি ইশকুলে পাঠ নিতে আসবে? …দুদিনেই ইশকুল উঠে যাবে…

-কাকাবাবু, আগে তো ইশকুল বসতে দিন। পরে না হয়, উঠে যাবার কথা ভাববেন।

ঈশ্বরচন্দ্রের জবাবে সভার একদিক থেকে কিছু শ্রোতার মাঝে হাসির রোল উঠল। সুধাময় চক্রবর্তী সেদিকে তাকিয়ে একটু উত্তেজিত হয়েই উচ্চারণ করলেন, আজ হাসছ বটে। যেদিন আমার কথা সত্যি হবে, সেদিন কাঁদবার কুল পাবে না।

-না, না। এমন কথা বলছেন কেন, কাকাবাবু…

-বলব না? ততদিনে তো আমাদের গরীবের ঘরের খেটেখাওয়া ছেলেপুলেরা লায়েক হয়ে যাবে। হাল গরু চলানো ভুলে যাবে। বলি জমি না চষলে ফলন হবে কোথা থেকে? সমবচ্ছরের খাওয়া চলবে কোথা থেকে?

  বেশ নেচেকুঁদে রঙ্গভঙ্গী করে তিনি কথাগুলো বলে বসে পড়লেন। এবার আর ঈশ্বরচন্দ্র কিছু বললেন না। সভার মাঝ থেকে অন্য একজন উঠে জবাব দিতে শুরু করল। মাঝবয়সী লোক। পরণে ফতুয়া ধুতি। হাত নেড়ে বলছে, পড়াশোনা করলেই কি ঘরের ছেলেরা লায়েক হয়ে যায় নাকি? পড়াশোনার সাথে সাথে জ্ঞান বাড়বে। বোধ গম্যির বিকাশ ঘটবে। হতে পারে, কেউ চাষ আবাদ করা ছেড়ে চাকরি করতে যাবে। আবার কেউ লেখাপড়া করেও উন্নত ধরণের চাষে হাত লাগাবে। আসল উদ্দেশ্য তো, নিজেকে গড়ে তোলা। পড়াশোনা করলে, মানুষ ছাগল ভেড়া হয় না। উন্নত মানুষ হয়। এটাই আমাদেরকেও মনে রাখতে হবে…

-ঠিক, ঠিক বলেছ।

মাঝ থেকে অন্য একজন চিৎকার করে কথাটায় সায় জানাল।  সভা আবার চুপ। কিছু সময়য়ের  জন্যে। এবার ঈশ্বরচন্দ্র কিছু বলতে যাবেন, তখনই সভার মধ্যস্থল থেকে একজন তাঁকে উদ্দেশ্য করে  বলে উঠল, ঠাকুরদাস মশায় না হয়, আপনাকে ছোটবয়সে শহরে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। আপনি পড়াশোনা করতে পেরেছেন। সেখানে আমাদের গ্রামের ছেলেরা নাঙ্গল ধরে মাঠ ঘাট চষে, জমিতে ফলন এনে, গরু চরিয়ে বড় হচ্ছে। সংসারে দুটো পয়সা আনছে। কে মশাই চাইবে, তাদেরকে ইশকুলে পাঠিয়ে পড়ালেখা করিয়ে আপনার মতো দ্বিগজ  বানাতে?

আবার বিরুদ্ধমত। তারও সমর্থনে দুচার জন গলা চড়ালো। ঈশ্বরচন্দ্র প্রমাদ গুনলেন। কিন্তু দমলেন না। জানেন, এই চাপান উতরের মধ্যে দিয়েই মানুষ সহমতে আসবে। তার জন্যে তাঁকে আরও অপেক্ষা করতে হতে পারে। তবু লোকটার কথার মান্যতা দিলেন তিনি। যুক্তি সাজালেন। বললেন, আমার বাবার দূরদৃষ্টি ছিল বলে আজ শুধু আমি কেন, আমার ভাইরাও সেখানে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। চাকরী করছে। তবু জানেন নিশ্চয়ই, ওই কলিকাতা শহরে বাস করবার কারণে রোগভোগে আমার ছোট দুই ভায়ের মৃত্যুও হয়েছে। ওলাওঠার প্রকোপ গ্রামে নেই। শহরে ছিল। এখনও আছে। তাই নিয়ে আমরা সেখানে থাকছি। আমার বাবা মাকে সব সহ্য করতে হচ্ছে। সেদিক থেকে এখানে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ভাগ্য তো সুপ্রসন্ন। তারা নিজের ঘরে থেকে পড়াশোনা করবার সুযোগ পাবে।

-ছেলেদের কথা হচ্ছে, হচ্ছে। তাতে আবার মেয়েদের কথা আনছ কেন ঈশ্বরচন্দ্র?

ফস করে একজন কথাটা বলে উঠল। তাকে লক্ষ্য করে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, জ্যেঠামশাই, মেয়েরা কি ছেলেদের থেকে আলাদা? তাদের পৃথক করে  দেখছেন কেন?

-আলাদা নয় তো কী? পাঁচ-সাত পেরতে না পেরতে যাকে অন্যের হাতে তুলে দিতে হয়, তাঁর জন্যে আবার লেখাপড়া! মেয়ের ফুল ছাড়তে না ছাড়তে বিধবা হয়ে বাপের ঘরে ফিরে আসছে। এসব জেনেও তুমি মেয়েদের কথা কেমন করে বলছ হে? এতকালের সমাজ ব্যবস্থাকে কি তুমিই পালটে দেবে? উত্তর দাও…

   ঈশ্বরচন্দ্রও দমবার পাত্র নন। তিনি জানেন, বাল্যবিবাহ এবং বিধবাবিবাহ, দুই রোধে তিনি কাজ করছেন। শহরে বসে করছেন। তার প্রচার এখনও সেরকম হয়নি। সময় লাগবে। তাই সেকথা এখানে বিশদে শোনানো অমূলক। কেউ বুঝবে না। বিশ্বাস করবে না। তবু আগের বক্তা যখন উত্তর চেয়েছেন, তাঁকে তা দিতে হয়। বললেন, জ্যেঠামশাই, সেখানেই তো আমরা ভুল করছি। নারীশিক্ষা না দিয়ে, উপযুক্ত বয়স হবার আগেই আমরা মেয়েদেরকে সংসার সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছি। ফলে হচ্ছেটা কী? আর যা হচ্ছে, তা তো সচক্ষেই দেখছেন…

-কী কথা বলছ হে, ঈশ্বরচন্দ্র! তুমিই কি পাঁচ বছরের কন্যাকে বিয়ে করে  আনোনি? সে কি অসুখী হয়েছে? হ্যাঁ, তবে এখনও পর্যন্ত তুমি ওই মেয়েকে সন্তান এনে দিতে পারোনি। এটা সত্যি। তা মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে যে এর থেকেও খারাপ কিছু হবে না, তা কি দিব্য দিয়ে বলতে পারো?

সরাসরি আঘাত!  অনেকক্ষণ ধরেই ঈশ্বরচন্দ্র নানান যুক্তি দিয়ে সভাকে মানাবার চেষ্টা করছিলেন। তাতে তাঁর যেমন শক্তিক্ষয় হচ্ছিল, তেমনই মনের ওপর চাপও আসছিল। তবে এখন যেখানে তাঁর নিজের চরিত্রের ওপর আঘাত এসে পড়ল, তিনি আর স্থির রাখতে পারলেন না নিজেকে। মনে কষ্ট পেলেন। সভা ভঙ্গ করবার কথা বললেন। শম্ভুচন্দ্র আর ঈশানচন্দ্র, দুই ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। ভগবতীদেবীর সামনে পৌঁছিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

ভগবতীদেবী বসেছিলেন নিজের ঘরে। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর পায়ের কাছে বসে হাউহাউ করে  কাঁদতে শুরু করলেন।  ভগবতীদেবী অবাক! জানতে চাইলেন, কী হয়েছে।

-মা, আমি হেরে গেলাম।  কান্না জড়নো স্বর।

-ভগবতীদেবী প্রশ্ন রাখলেন, তোমার কথা ওরা মানল না?

-না মা, শুধু তাই নয়। আমার চরিত্র নিয়ে অপমান করতেও ছাড়েনি।

দুচোখে জল। ঈশ্বরচন্দ্র কাঁদছেন। বারবার কপাল চাপড়াচ্ছেন।  বলে চললেন, মা, তোর বীরসিংহ বড় অবুঝ। এখানে নিজের স্বার্থ ছাড়া কেউ কিছু বুঝতে চায় না।

এবার ভগবতীদেবীরও ভাঙবার পালা। হতাশার সুরে ঠাকুরের আশ্রয় নিলেন। বলে উঠলেন, হা ঠাকুর, একী অপমান! ছেলের সঙ্গে তিনিও কান্না জুড়ে দিলেন।

ছুটে এলেন ঠাকুরদাস। পরে পরে শম্ভুচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র, মনোমোহিনী। দীনময়ীও এলেন, তবে নিয়ম মেনে দীনময়ী ঘরের ভিতরে প্রবেশ না করে , দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। একহাত ঘোমটার আড়ালে তাঁর মুখ। স্বামী শাশুড়ির কান্না তাঁর ভিতরেও ছড়িয়ে পড়ল। মন জুড়ে প্রশ্ন, ভগবান তুল্য পতিকে কীসের জন্যে অপমান? কে করল?

স্বল্প শিক্ষিত মহিলা তিনি । একটাই কথা বোঝেন, চরিত্র মানে তো, স্বভাব, সদাচার, সৎ প্রকৃতি। এর কোনটারই তো খামতি নেই তাঁর স্বামীর! তবে কী…?

হাপুস নয়নে ভগবতীদেবী কাঁদলেও, ঠাকুরদাস তো চেনেন ছেলেকে। নিজে হাতে কাছে রেখে তাকে মানুষ করেছেন। এত সহজে ভেঙে পড়ার পুরুষ নয় ও ছেলে ।  বিষয়টার  দ্বিরুক্তি শুনলেন ছেলের মুখে। নিজেকে কঠোর করে  নিলেন। বললেন, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না ঈশ্বর। তুমি কিছু অন্যায় কাজ করছ না । সমাজের ভালোর জন্যে ইশকুল গড়ছ। শহরে ইশকুল গড়েছ। সেখানে তুমি বাধাপ্রাপ্ত হওনি?

নিজেকে শক্ত রাখার জন্যে ঘরময় পায়চারী শুরু করলেন। বলতে থাকলেন, সেখানেও হয়েছ । এখানেও তা হচ্ছে। নিজের ওপর ভরসা রাখো। সমাজকে শুধরোতে গেলে, এ রকম বাধা অনেক আসবে। আমি জানি, ভবিষ্যতেও তোমায় এধরণের অনেক কাজ সমাজের জন্যে করতে হবে। মনকে শক্ত রেখে এগিয়ে যাও।…আমিই না হয়, তোমার হয়ে মানুষকে বোঝাতে বেরব…

ঈশ্বরচন্দ্র বলে ওঠলেন, না, বাবা। আপনি যাবেন না। অপমান শুধু আমাকে করেনি। আপনার  সুপুত্রী পুত্রবধূকেও করেছে। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন, আমার উদ্দেশ্য সফল করে  আমি যেন এর যোগ্য জবাব দিতে পারি।

ঠাকুরদাস দু পা এগিয়ে গিয়ে ছেলের মাথা স্পর্শ করে আশীর্বাদ জানালেন। ভগবতীদেবীকে মৃদু শাসন করে  বললেন, এসময় কোথায় ছেলের মনে বল দেবে, তা না করে  নিজেও ছেলের সঙ্গে ভেউ ভেউ করে  কাঁদছ।

-ওগো, ঈশ্বরের ওপর আমার আশীর্বাদ তো সব সময়ের জন্যে রয়েছে। তবে, যে দোষ ওর ওপর আরোপ করছে, সেটা কি ঠিক?

-আজ বাইরের লোকের কথায় তুমি চোখের জল ফেলছ, নিজের কথা ভেবে দেখো। এ বাক্যি তো তোমার মুখেও আসে মাঝে মধ্যে।

ঠাকুরদাস ভগবতীদেবীকে তাঁর নিজের করা ভুল ধরিয়ে দিলেন।  দীনময়ী আজ এ কী শুনছেন! তাঁর বুকের পাষাণ  গলে যাচ্ছে! ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। শ্বশুরের যুক্তি শুনে তিনি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। দৌড়ে ওপরে উঠে গেলেন। নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। খাটে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । বালিশ তুলে মুখে চাপা দিলেন। কাঁদতে শুরু করলেন ।

বউদিকে ছুটে বেরতে দেখে, তাঁর পিছন পিছন মনোমোহিনীও ওপরে চলে এসেছে।  বড়দাদার অনুপস্থিতে সে ঘরে ঢুকল । খাটে উঠে গিয়ে দীনময়ীর পাশে বসে তাকে আশ্বস্ত করল। বলল,   বউদি, কেঁদো না। বাবা তো তোমার পক্ষ হয়েই মাকে ও কথা বলেছেন। সত্যিই তো, বাইরের লোকের কথা শুনে আজ আমরা এতখানি ভেঙে পড়ছি, কিন্তু মা-ই কি এই নিয়ে তোমার ওপর সন্দেহ প্রকাশ করে  কথা শোনায়নি? সবই তো জানি। কিন্তু মুখ ফুটে কথা বলতে পারি না। পাছে মায়ের গায়ে লাগে…। আরে বাবা, সবই তো ওপরওয়ালার ইচ্ছে…

-মনো, তুমি মেয়ে হয়ে যেটা বুঝতে পারো, মা কেন সেটা বুঝবেন না? মা ভাবেন, আমরা কি ইচ্ছে করে  সন্তান আনছি না? কিন্তু এ কলঙ্ক পুরুষের থেকে মেয়েদের গায়েই বেশি করে  লাগে…

বালিশে মুখ চেপেই দীনময়ী কান্না জড়ানো স্বরে কথা বলছেন। খুব সত্যি কথা। এ যেন একলা মেয়েদেরই অপারগতা!

মনমোহিনী বউদির মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এরই মাঝে দীনময়ী কথা জুড়লেন, তোমার দাদাও কি এজন্যে কম মন খারাপ করে থাকে? দেখো মনো, এতদিন আমি এসব নিয়ে কাউকে কিছু বলিনি। মাকেও না। মুখ বুঁজে সব সহ্য করেছি; কিন্তু আজ তোমার দাদা  অপমানে এতখানি ভেঙে পড়েছে, এ জন্যে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।

-বউদি, বাবা সেটা বোঝেন বলেই, মাকে সতর্ক করলেন। দেখবে, এরপর আর এই নিয়ে মা তোমায় কথা শোনাবে না। ভগবানকে ডাকো। দেখবে, ঠিক তিনি তোমার কোলে সন্তান এনে দেবেন।

ইতিমধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র ঘরে ঢুকেছেন।  মুখ নিচু করে মনোমোহিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । বেরবার মুখে ঘরের দরজা আব্জিয়ে   দিয়ে গেল সে ।

  ঈশ্বরচন্দ্র বসলেন দীনময়ীর মাথার কাছে। দুহাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে কাছে টানলেন। পাল্টিয়ে ধরলেন দীনময়ীর শরীরটা। চোখের ওপর স্ত্রীর মুখখানা। মুখ  ভিজে  আমসত্ত্ব হয়ে রয়েছে। মাথার উষ্ণীষ খুললেন। সস্নেহে অশ্রু মুছিয়ে দিলেন। মুখে প্রচ্ছন্ন হাসি খেলল ঈশ্বরচন্দ্রের। স্ত্রীর কপালে ঠোঁট রাখলেন। দীনময়ীর শরীর কেঁপে উঠল। স্বামী সোহাগ উপভোগ করছেন তিনি । দীনময়ীর শরীরে-মনে কাম, সন্তান উৎপাদনের একান্ত আর্তি।

ঘরের দরজায় আগল নেই। দীনময়ীর মন সজাগ হল। সর্তক করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র উঠে গিয়ে দোরের খিল আঁটলেন। ফিরে এলেন। স্ত্রীর শরীর স্পর্শ করলেন । ধীরে ধীরে কাম ক্রীড়ায় রত হলেন। দীর্ঘক্ষণের ক্রিয়া শেষে বর্ষার মেঘের মতো ঘনীভূত হয়ে ওঠা যৌবন রোপণ করলেন দীনময়ীর মাতৃভূমিতে।  আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠলেন তিনি। স্ত্রীর কানে ফিসফিস করে  উচ্চারণ করলেন, দীনময়ী দেখো, আজকের ভালবাসার এ দান বিফলে যাবে না…

(৯)

 

কথায় আছে, দেয়ার ইজ মেনি গ্যাপস বিটুইন দ্যা কাপ এন্ড দ্যা লিপ্স। ঈশ্বরচন্দ্র মনে করেছিলেন ছুটি নিয়ে আর একবার গ্রামে গিয়েই নতুন ইশকুল গড়ে তুলবেন। কিন্তু বিধাতা পুরুষ অলক্ষ্যে হাসলেন। সব কাজ কি আর সাধের সময়েই পূর্ণতা পায়? ছুটির দরখাস্ত যেমনকার তেমন ফাইল বন্দী হয়ে পড়ে রইল কলেজ অধ্যক্ষের কাছে, আর ঈশ্বরচন্দ্র ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অন্য কাজে। কলেজের কোষাধ্যক্ষ বলে কথা। কথায় কথায় ছুটি পাওয়া যায় না। তাই ছুটির বাসনা মনে ধরে রেখে কাজে ডুব দিলেন।

আবার একদিন ময়েট সাহেবের বাঁশি বাজল। ডাক এলো।  ঈশ্বরচন্দ্র ময়েট সাহেবের ডাককে মস্করা করে বলেন, শ্যামের বাঁশি। তিনি জানেন, ময়েট যা চাইবেন, তাতে তাঁর অধস্তন হলেও প্রিয়  ভিদ্যাসাগর বাধ সাধবে না। যদিও বা প্রথমিক ভাবে তা করেনও  আখেরে দুজনের  মতে মিল খাইয়ে ময়েট তা করিয়েই নেবেন তাঁকে দিয়ে। সে মিল কিছু জোলো হবে না।  তেলজলের মেশার মতো নয়। দুধ জমে দই করিয়েই তা সম্ভব করে নেবেন মিঃ ময়েট।

ময়েটের দূত মারফৎ সংবাদ এল সংস্কৃত কলেজ ঈশ্বরচন্দ্রকে ওই কলেজে চায়। দেখা করলেন তিনি । ময়েট সাহেবের আবার সেই স্বর্গ ভোলানো হাসি। চিনি মেশানো কথা, ভিদ্যাসাগর মহাশয়, আ  প নার জন্যে  একটা সুখবর রয়েছে।

-আবার কী সুখবর দেবেন, মিঃ ময়েট?

ঈশ্বরচন্দ্রচন্দ্রে মুখে হাসি।

-আ  পা  নার জন্যে কি খবরের কম রয়েছে?

ঈশ্বরচন্দ্র প্রত্যুত্তর করলেন, মহাশয়, এ তো দেখি, আপনি যাই বলেন, তাহাই আমার কাছে খবর হয়, মানে, বলতে চাই, সুখবর হয়।

-প্রকৃতই সুখবর।

মিঃ ময়েট জোর দিয়ে কথা বলতে থাকেন।  -সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক ও অস্থায়ী অধ্যক্ষের পদ খালি হয়েছে। আ প নি জানেন নিশ্চয়ই, মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয় চাকরীতে ইস্তফা দিয়েছেন।

-বিলক্ষণ জানি। মিঃ ময়েট, আপনিও বোধ হয় জানেন, আমারই আগ্রহে তর্কালঙ্কার মহাশয়  ওই পদ প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং আমরা একত্রে সংস্কৃত ছাপাখানা নামে একটা প্রতিষ্ঠান চালাই। তবে, দিন দুই আগেই আমি জেনেছি, তিনি মুর্শিদাবাদের জজপণ্ডিত হয়ে সেখানে চলে যাচ্ছেন।  কিন্তু তাতে আমার কী করণীয় রয়েছে?

-আ প নাকে ওই পদ গ্রহণ করতে অনুরোধ করছি।

বিস্মিত হলেন ঈশ্বরচন্দ্র। মনের ঘোরে প্রথম বাক্য  ইংরেজিতে উচ্চারণ করলেন, ও মাই গড। পরে যথারীতি নিজ ভাব ধারণ করে বললেন, আমাকে কি আপনি পুনরায় মূষিকের গহ্বরে প্রবেশ করতে বলছেন?

হা হা হা…। ময়েট  হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, আপনি সত্যই রসিক। তবে মহাশয়, আ প নার পুনঃরমূষিক হবার ভয় নেই।

তখন পর্যন্ত ঈশ্বরচন্দ্রের মনের ধন্ধ না  কাটায় বিষয়টিকে তিনি খোলসা করার জন্যে ময়েটকে অনুরোধ জানালেন।

-বুঝিতে পেরেছি…,

ময়েট যেন সত্যিই ঈশ্বরচন্দ্রের মন পড়ে নিতে পেরেছেন। বললেন, আ পনি যদি পূর্ণ কর্তৃত্বের সঙ্গে কাজ না করতে পারেন, তা হলে সেখানে কাজ করবেন না। এই তো? এখন আমি আ প নাকে নিশ্চিত করছি, আ পনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন।

  শ্রোতার মন তবুও ভিন্ন যুক্তি দিতে চায়। ঈশ্বরচন্দ্র প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন,  কিন্তু মহাশয়, আমি তো মার্শাল সাহেবের অধীনে ফোরটউইলিয়াম কলেজে ভালই আছি । আশা করি, সেখানের কাজে আমার কোনও ভুলভ্রান্তি হয়নি…

ঈশ্বরচন্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে ময়েট বলে উঠলেন, -আপনি এরকম ভাবছেন কেন, ভিদ্যাসাগর মহাশয়?

-না, আপনি কি আমায় আবার ওই জজ সাহেবের অধীনে কাজ করতে পাঠাচ্ছেন?

সংশয়টা ঈশ্বরচন্দ্র এবার খোলসা করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু ময়েট যেন তাও বুঝলেন না। প্রশ্ন করলেন, মানে?

-আমি শ্রীযুক্ত রসময় দত্ত মহাশয়ের কথা বলছি।

ঈশ্বরচন্দ্র শিরদাঁড়া সোজা করলেন। বলতে থাকলেন, দেখুন, একবার ওনার সঙ্গে মতবিরোধের কারণে আমি সংস্কৃত কলেজের চাকরী থেকে ইস্তফা দিয়েছি। এখন সেখানে ফিরত যাওয়াকে আমি আমার নৈতিক অবনতি বলে মানব।

-মহাশয়, আপনি সেখানে উচ্চতর পদে যাচ্ছেন।

ভ্রুযুগল কিঞ্চিত উচ্চমুখী করে কথা বললেন ময়েট। ঈশ্বরচন্দ্র তা লক্ষ্য করেই প্রশ্ন করলেন,  এর অর্থ?

-ওই কলেজে আ  প নি সাহিত্যের অধ্যাপক পদে যাবেন। সহকারী অধ্যক্ষের পদও পাবেন। বেতন মাসিক নব্বুই টাকা…,

একটার পর একটা যুক্তি দেখাতে থাকলেন, ময়েট। তবে তাঁকে কথার মাঝ পথে থামিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঈষৎ অধৈর্য  সহকারে বলে ফেললেন, আহ, ময়েট সাহেব। আপনি তো জানেন, আমি অর্থের জন্যে কোথাও মাথা নত করি না। তবু আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আমি কি সেখানে আমার আগের রিপোর্টকে কার্যকর করতে সক্ষম হব?

-অবশ্যই।

প্রবল বাধার মাঝে ময়েট যেন আশার ক্ষীণ রেখা দেখছেন। প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন, এবার সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন সংক্রান্ত রিপোর্ট শিক্ষা পরিষদকে আবার পাঠাবেন। আমার সঙ্গে শিক্ষা দপ্তরের আলাপ অনুযায়ী আমি জানাচ্ছি, ওই রিপোর্ট পুরোটাই গ্রহণ করা হবে।

 

চলবে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page