উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
চিঠির বান্ডিলটা হাতে ধরে দীনময়ী তখন কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তাড়াতাড়ি সেগুলো বিছানার তোষকের তলায় চালান করে দিয়ে গায়ে কাপড় জড়িয়ে নিলেন। তারপর নিজেও কয়েকটা লেখা পাতা এনে ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো আপনার জন্যেই। দেখুন পড়ে, কত কথা লেখা আছে।
আর তিনি দাঁড়ালেন না সেখানে। ঘর ছেড়ে দালানে এসে বাইরের দিকে উকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করলেন, কেউ কোথাও দেখছে কিনা। দিনমানে ঘরের দরজা আব্জিয়ে তিনি এখন কী লজ্জায় না পড়েছেন। তবে ভেবেছিলেন এক। হয়ে দাঁড়াল অন্য। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবলেন, এ মানুষটার ওপর কী রাগ করব ?
এরপর…
গ্রামে মেয়েদের ইশকুল খোলা হচ্ছে আর ঠাকুরদাসের মনে উদ্বেগ, এর খরচ খরচাও কি ছেলের ওপর বর্তাচ্ছে? কৈ, কারোও কাছে তো সাহায্য চাইল না ঈশ্বর! অথচ খরচ করে চলেছে। এখন না হয়, প্রাথমিক খরচ। এরপর সেখানে শিক্ষক রাখতে হবে। মাসে মাসে তাদের মাইনে দেওয়া, ছোট মেয়েরা যদি পড়ে তাদের দেখাশোনা করবার জন্যে ঝি রাখা, মেয়েদের বই খাতা, পেন্সিলের জোগান দেওয়া, মানে সব মিলিয়ে তো খরচের বহর অনেক।
প্রথমদিন ছেলের মুখে প্রস্তাবটা শুনে মাঠে দাঁড়িয়ে এসবেরই উত্তর জানতে চাইছিলেন ঠাকুরদাস। তা আর জেনে ওঠা হয়নি। ছেলেও তাঁকে আর কিছু জানায়নি। তবে, এখন তা জানতেই হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্রকে ডেকে নিয়ে বসলেন। প্রশ্ন করতে থাকলেন একটার পর একটা। তিনিও ঠাকুরদাসের কথার উত্তর দিয়ে যেতে থাকলেন। জানালেন, এখন প্রথম অবস্থায় তার খরচ হচ্ছে, তিনশত টাকার মতো। এরপরে মাসে মাসে ত্রিশ টাকা খরচ হবে। আর তা তিনি কলিকাতা থেকেই পাঠিয়ে দেবেন। বরং ঠাকুরদাস যাতে ওই ইশকুলের দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন, তাতে তাঁর পক্ষে বিশেষ সুবিধে হবে।
-ইশকুল কার নামে করছ, ঈশ্বরচন্দ্র?
প্রশ্ন রাখলেন ঠাকুরদাস। ঈশ্বরচন্দ্র অক্লেশে উত্তর দিলেন, কেন মায়ের নামে?
-তোমার মায়ের অনুমতি নিয়েছ?
-অবশ্যই বাবা। মা কোনও আপত্তি করেননি। বরং খুশিই হয়েছেন।
ঠাকুরদাস কিছু বললেন না। উল্টে প্রশ্ন করলেন, কলিকাতার মেয়েদের স্কুলের খরচও কি তুমিই করছ?
-না বাবা। আমি তো ছোটলাটের কথা মতো ওই ইশকুল চালু করিয়েছি। এখনও পর্যন্ত খরচ খরচা দপ্তর থেকেই যায়্…
ঈশ্বরচন্দ্রের কথা শেষ হল না। তার আগেই ঠাকুরদাস বলে উঠলেন, তুমি কি নিশ্চিত, এ ব্যবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হবে?
-কেন? আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন বাবা? এ তো সামাজিক কাজ। দেশের সরকারেরই দায়িত্ব এ কাজের!
ঠাকুরদাসের প্রশ্নে অবাক হলেও সাধাসিধে উত্তর দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর বিশ্বাস, ছোটলাটের কথা কেউ ফেলবে না। তবে, ঠাকুরদাসের প্রশ্নে মনে সন্দেহের একটা কাঁটা জেগে রইল।
কথা আর এগুলো না। এখানেই শেষ হয়ে গেল। পরের কয়েকটা দিন ইশকুল খোলার তদারকিতে কাটল। ইশকুলে ছাত্রী ভর্তির অগ্রগতি চলছিল ঢিমা তালে। এক দুজন করে আসছিল। নিজেই তিনি বেরলেন গ্রামে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে বার্তা পৌঁছিয়ে দিতে থাকলেন। সেখানে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। কোনও বাড়ির অভিভাবক প্রশ্ন করছেন, মেয়ে পড়াশোনা করে করবেটা কী? দুদিন পরেই তো বিয়ে হয়ে অন্যের ঘরে চলে যাবে।
সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিচ্ছেন, বাল্যবিবাহ দেবেন না। মেয়ে বয়স্থা না হওয়া পর্যন্ত তাকে নিজের কাছে রাখুন। পড়াশোনা করলে সেই মেয়ে মা হবে যখন, নিজের সন্তানকে সে নিজে পড়াতে পারবে।
-তোমার এ কথার যুক্তি আছে মানি। তবে বাবা, আমার বাড়িতে যে বয়স্থা মেয়েরা রয়েছে, তাদেরকে এখন বাইরে বের করলে, পরে ওদের বিয়ে-থা দেওয়ার জন্যে ছেলে পাওয়া যাবে না।… তুমি এখন এসো। আমাকে ভেবে দেখতে দাও।
নিরাশ হয়ে ফিরলেন ঈশ্বরচন্দ্র। অথচ তিনি জানেন, ওই বাড়িতে তিনটি মেয়ে রয়েছে, যার মধ্যে একটি খুবই ছোট। পরের দিন আবার গেলেন চন্ডিমোহন মশায়ের বাড়ি। অনুরোধ করলেন, মশায়, আপনার ছোট মেয়েটিকে তো ইশকুলে পাঠাতে পারেন।
ভদ্রলোক কী চিন্তাভাবনা করে রাজী হয়ে গেলেন। ঈশ্বরের হাতে তুলে দিলেন বালিকা কন্যাকে। বললেন, দ্যাখো, ওকে ইশকুল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারো কিনা।
ঈশ্বরচন্দ্রের মনে পড়ে গেল, বেথুন সাহেবের কথা। হাত ধরলেন চার বছরের মেয়েটির। নাম, সুখলতা। নিজেই তাকে ইশকুলে নিয়ে গেলেন। খাতায় নাম তুলে শিশু ক্লাসে বসিয়ে দিলেন।হাতে দিলেন নিজের লেখা বর্ণপরিচয় বই। ছবিওয়ালা বই পেয়ে সুখলতার কী আনন্দ! হাতে পাথরের স্লেট আর খড়ি পেয়ে মেয়ে স্লেটে আঁকিবুঁকি কাটতে শুরু করল। আনন্দ ধরে না ঈশ্বরচন্দ্রের। ফেরার পথে ইশকুলের ঝিকে সঙ্গে দিয়ে বাড়ি পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। সুখলতার কপালে চুমা দিয়ে আদর জানিয়ে বলে দিলেন, কাল আবার আসবে। লজেঞ্চুস পাবে।
পরের দিন সুখলতা তো এলোই, সঙ্গে সুখলতার বড় বোন, বছর দশ বয়স, আর মেজ জনের বয়স সাত, তারাও ইশকুলে এসে হাজির। ঈশ্বরচন্দ্রের আনন্দ সেদিন দেখে কে? সকলকে একই ক্লাসে বসিয়ে এক বই থেকে পড়া করাতে শুরু করলেন নস্যি নেওয়া সাত টাকা মাস মাইনের পণ্ডিত তিনকড়ি ভট্টাচায্যি।
ছেলের দেখাদেখি ঠাকুরদাসও লোকের বাড়ি বাড়ি যাওয়া শুরু করে দিলেন। সকলেই যে এক কথায় বাড়ির মেয়েকে ইশকুলে পাঠাচ্ছে, তা নয়। তবে কেউই হাল ছাড়তে রাজী নয়। শম্ভুচন্দ্র গ্রামে এসে আছে। তিনিও লেগে পড়লেন এ কাজে। এবার একদিন নিজের তিন বছরের ভাইজী, হেমলতাকে হাত ধরে ইশকুলে নিয়ে আসলেন শম্ভুচন্দ্র। ঈশ্বরচন্দ্র হাসলেন। ভাইকে বললেন, কাজটা ভালই করেছিস, শম্ভু। দাতব্য তো ঘর থেকেই শুরু করতে হয়। তবে, ওর মাকে বলে এনেছিস তো?
শম্ভুচন্দ্র উত্তর দিলেন, বউদিই নিজে হেমলতাকে সাজগোজ করিয়ে দিয়েছে, দাদা। আসার সময় বউদি আমাকে বললেন, যার বাবা নিজে ঘুরে ঘুরে ইশকুলের ছাত্রী জোগাড় করছে, তাঁর বাড়ির মেয়ে ঘরে বসে থাকবে, তা কি হয়?
ঈশ্বরচন্দ্র মুচকি হাসলেন আবার। মনে মনে দীনময়ীর কথার তারিফ না করে পারলেন না। নিজের স্ত্রীর অক্ষর জ্ঞানের বাইরে পড়ালেখা হয়নি বলে তার মনে আফসোস রয়েছে। এবার মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে দীনময়ীকেও বিদ্যাশিক্ষা দেবেন, মনস্থির করে ফেললেন।
পরেরদিন ঈশ্বরচন্দ্র নিজের স্ত্রীকে অধিক বিদ্যে দানের ব্যবস্থা পাকা করে তার হাতে বাংলা ব্যাকারণ বই সহ, অন্যান্য আরোও কিছু বই তুলে দিলেন। ঠাকুরঘরের বাইরে দীনময়ীকে বসালেন। দীনময়ী এখন গর্ভাবস্থায়। ঠাকুরঘরে বসা বারণ। নিজে বসলেন ভিতরে। ঠাকুরের সামনে। সরস্বতী বন্দনা মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকলেন। বার কয়েক নিজে আওড়ালেন।
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে,
ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।
দীনময়ীর কানে তা বাজতে থাকল। ধীরে ধীরে মুখে বসতে থাকল সংস্কৃত মন্ত্র। গলায় কাপড় দিয়ে দীনময়ী মা সরস্বতীকে প্রণাম করলেন। সঙ্গে ভগবতীদেবীকে প্রণাম করতে গেলেন। ভগবতীদেবী হা হা করে উঠলেন, একি করছ বউমা? ঠাকুরের সামনে প্রণাম করতে নেই।
মুখ টিপে হেসে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, মায়ের কাছ থেকে আচার বিচারগুলো শিখে মনে রেখ, দীনময়ী। মা আমার সাক্ষাৎ দেবী।
ঘাড় কাত করে দীনময়ী স্বামীর কথায় সায় দিয়ে উঠে গেলেন। মায়ে পোয়ে আলাপ চলতে থাকল। ভগবতীদেবী বললেন, বাবা, এ ইচ্ছে, আমার বহুকালের। তোমার বাপ ঠাকুরদার গ্রামে তুমি যে মেয়েদের ইশকুল গড়ে দিলে, শুধু গ্রামই বা বলি কেন, দেশে তুমি যে কাজ করলে, এর জন্যেই একদিন সারা দেশ তোমাকে মনে রাখবে। দেখবে মানুষ যুগ যুগ পরেও তোমার নাম করবে…
-আমি তোর কাছে চিরঋণী, মা। তোর গর্ভে আমার জন্ম দিয়েছিলি বলেই আজ আমি যা করছি, তা সবই তোর। ঘরে ঘরে তোর মতো মা বিরাজ করুক…
ঈশ্বরচন্দ্র দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামল।
স্নেহের মতো কান্নাও অতি ভীষণ বস্তু। একজনের কান্না অপরজনের চোখেও জল এনে দেয়। চোখ ভিজে উঠেছে ভগবতীদেবীর। ঈশ্বরের মাথা নিজের বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরলেন। তিনিও কাঁদতে শুরু করলেন। চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে বাড়ির অন্যান্যরা তখন চোখের জলে আগল দিচ্ছে। দীনময়ী আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। হেমলতাকে বুকে ধরে ওপরে নিজের ঘরের দিকে দৌড়তে শুরু করেছেন। নারায়ণ গিয়ে বসে পড়ল ভগবতীদেবীর কোলের মধ্যে। ভগবতীদেবীর মুখ ঝাঁকিয়ে নারায়ণ জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, মা, মা তুই কাঁদছিস কেন? বাবা কাঁদছে কেন?…
রাতে দুই সন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে মিঁয়া বিবি বসেছে, চিঠির ঝাঁপি খুলে। ঈশ্বরচন্দ্র পড়ছেন দীনময়ীর লেখা চিঠির গোছা; দীনময়ী ঠিক তার উল্টোটা। চিঠি বহু আগের আগের লেখা। অথচ তা স্থবির হয়ে এতদিন যার যার নিজের কাছে রেখে দেওয়া ছিল। এখন সেগুলো গরম ভাতে গাওয়া ঘিয়ের মতো সুবাস ছড়াচ্ছে। হাসাহাসি চলছে দুজনের মধ্যে। চিঠির বক্তব্য সবই জানা, কিন্তু অজানার মোড়কে তা উপস্থাপিত হচ্ছে। ঈশ্বরচন্দ্র বেছে নিলেন দীনময়ীর একখানা চিঠি। পড়তে শুরু করতেই, দীনময়ী তা স্বামীর হাত থেকে চিলের মতো ছোঁ মেরে কেড়ে নিতে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও বাচ্ছা ছেলে হয়ে তা লুকিয়ে নিলেন ফতুয়ার পকেটে।
-আপনি কিন্তু এসব চিঠি আমার সামনে পড়বেন না। কপট রাগ দেখালেন দীনময়ী।
-আমাকে চিঠি লিখলে, আর আমি পড়ব না?
ঈশ্বরচন্দ্র একটু সরে গিয়ে বুক পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে পড়তে শুরু করে দিলেন দাঁড়ি, কমা বিহীন চিঠিটা। সম্বোধনটুকু বাদ রেখে শুরু করেছেন চিঠির মধ্যভাগ থেকে-
‘চোখ বুঁজে এখন ভাবছি আপনি আমার মুখ ছুঁয়ে আমায় সুখ দিচ্ছেন শরীরে কী অনুভূতিই যে হচ্ছে তা লিখে বোঝাতে পারব না…’,
পড়া হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলেন, লিখে না হয়, না বোঝাতে পেরেছ; কিন্তু এখন তো এই আমি তোমার সামনে রয়েছি। বুঝিয়ে দাও না…
-ঈশ, আপনি না…,
দীনময়ী মুখে হাত চাপা দিলেন। হাত বাড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর আড়াল সরিয়ে মুখে চুম্বন রেখা টানলেন। ফের পড়া শুরু করলেন।… আবার এক জায়গায় থেমে পড়লেন। সোহাগ আদরের কথা ভুলে এবার অন্য কথা পড়তে শুরু করছেন, ‘নারায়ণকে নিয়ে এখন বেশ চিন্তা হয় ও বড় হয়ে উঠছে তবে বাবাকে সামনে না পেয়ে ছেলের মনে প্রশ্ন জাগে আমার কাছে প্রায়ই জানতে চায় আপনি দূরে থাকেন কেন আমার মনে হয় বাচ্ছার মনে এ প্রশ্ন থাকা উচিত নয় কিন্তু আপনি কি এর কিছু সুরাহা করতে পারবেন না নারায়ণ এখন গ্রামের ইশকুলে যায় অনেকে তাকে আপনার বিষয়ে প্রশ্ন করে সে কারণেই ওর মনে এধরণের প্রশ্ন আসে এবার এসে এর একটা বিহিত করুন…
চিঠি পড়া থামিয়ে দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। দীনময়ীর অবশ্য তা গোচরে এলো না। তিনি তখন স্বামীর চিঠি পড়াতে ব্যাস্ত।-
‘কত রাতে লিখতে লিখতে মনে পড়ে হেমলতার মুখ। মনে হয় ছুটে চলে যাই, হেমলতাকে বুকে ধরে আদর করি। খুব আদর জানাই আমার একমাত্র মেয়েকে…,’
পড়া থামিয়ে দীনময়ী চিঠি থেকে মুখ তুলে ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও, ছেলে বুঝি আপনাকে টানে না? তাই শুধু মেয়ের মুখ মনে পড়ে?
ঈশ্বরচন্দ্রও কি এখন ঠিক একই কথা ভাবছেন? দীনময়ীর চিঠি কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে না? কী বলবেন? স্ত্রীর প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন? চুপ করে রইলেন।
স্বামীকে ওই অবস্থায় দেখে দীনময়ীর মন ভাঙল। তিনি জানতে চাইলেন, তাঁর লেখা চিঠিতে কী, এমন কিছু উনি পড়েছেন যা তাঁকে ভবানায় ফেলল?
আসলে মেয়েদের মন শিউলি ফুলের মতো। ঝরে পড়ে থাকলেও তা সুবাস ছড়ায়। হাতে তুললে হাতকে সুবাসিত করে, পূজোয় দিলে ভগবানের মনে তুষ্টি আনে। অথচ সে নিজে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হয়েই থাকতে ভালবাসে। গাছের সামান্য ঝাঁকুনিতে ঝরে পড়ে।
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, নারায়ণকে তিনি কলিকাতায় নিয়ে যাবেন। সেখানে ইশকুলে পড়াবেন। তবে, আর একটু বড় হোক। এখন গাঁয়ের ইশকুলে পড়ছে, পড়ুক। তুমি ওর জন্যে চিন্তা কোর না, দীনময়ী। নারায়ণ তো আমাদেরই সন্তান।
হাতে ধরা চিঠিটা খাটের ওপর রেখে দিলেন দীনময়ী। বললেন, আমি জানি আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি। ছেলেকে যে আপনি দূরে রাখবেন না, তাতে আমি নিশ্চিত। আচ্ছা, এখন রাখুন চিঠিপত্র পড়া। শুয়ে পড়ুন। কাল তো আবার আপনাকে রওয়ানা দিতে হবে…
দীনময়ীর কথা শেষ হয়েও যেন হল না। আবার বলতে শুরু করলেন, হেমলতাকে আপনি আশীর্বাদ করুন, ও যেন পড়াশোনা করে অনেক বড় হয়। আমার মতো মুখ্যুসুখ্যু হয়ে না থাকে।
ঈশ্বরচন্দ্র চোখ বন্ধ করলেন। পাশে শোয়া ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। মনে মনে আশীর্বাদ জানালেন, বাংলাদেশের আর পাঁচটা মেয়ের থেকে সে যেন আলাদা হয়। হিন্দু ঘরের কুসংস্কার থেকে মনকে যেন অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে শেখে।
পরের দিন ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় ফিরে এলেন। সেখানে তখন তাঁর জন্যে এক বিষময় পরিস্থিতি অপেক্ষা করে রয়েছে।
হ্যালিডে সাহেবের বাচনিক আদেশে বাংলার চার জেলা জুড়ে এতগুলো মেয়েদের ইশকুল খুলেছেন। কিন্তু তার লিখিত আদেশ কৈ? ইয়ং সাহেব তাতে বাধ সেজেছেন। ইয়ং শিক্ষা দপ্তরের অধিকর্তা। পুরো নাম, ড্যব্লু গরডন ইয়ং। ইশকুল চালাবার জন্যে অর্থ দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন না তিনি।
চিন্তায় পড়লেন ঈশ্বরচন্দ্র। মনে পড়ছে পুরনো দিনের কথা। ইতিপূর্বেই ওই সাহেবের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়েছে একবার। মুখের ওপর পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে কলেজ অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে চলে এসেছিলেন। এ কি তারই প্রতিশোধ? মিঃ ইয়ং এর ব্যবহার, নিজের পদত্যাগ পত্র, চাকরিতে ইস্তফা…ইত্যাদি বিষয়ে ভাবতে গিয়ে সেই বিশেষ ঘটনার কথা পড়ল। –
সালটা ১৮৫৭। মাত্র কয়েক বছর আগে। কলেজ অধ্যক্ষের পদ সামলাচ্ছেন তখন । একদিন বসে রয়েছেন নিজের ঘরে। কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দারোয়ান এসে খবর দিল, গোরা সৈনিকদের এক অফিসার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। বাইরে অপেক্ষায় রয়েছে।
ঈশ্বরচন্দ্র প্রমাদ গুনলেন। সৈনিক অফিসার! তবে কি কলিকাতায় আবার কোনও গণ্ডগোল বাধল? দারোয়ানকে আজ্ঞা করলেন, অফিসারকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। দারোয়ান বেরিয়ে গেল। অফিসার গেস্ট রুমে বসে অপেক্ষা করছিল। দারোয়ান তাঁকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে গেল। দরজায় ঠক ঠক শব্দ। তিনি বললেন, ইয়েস , কাম ইন। বিশাল চেহারার মানুষটা এলো। ছ ফুটি লম্বা, লালামুখো। পায়ের হান্টার শুয়ের খট খট শব্দ তুলে ঘরে প্রবেশ করল। স্যালুট করল। তিনিও চেয়ার ছেড়ে উঠে বাঙালিয়ানায় অভিবাদন জানালেন। সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসবার অনুরোধ করলেন। অফিসার বসল। বয়স চল্লিশের কোঠায়। গায়ে মিলিটারির উর্দি। মিলিশিয়া রঙের। মাথায় টুপি। উর্দির কাঁধে দুটো স্টার, একটা স্তম্ভ; ইংল্যান্ডের রাজার মুখ বসানো । দুটোই পিতলের। চকচক করছে। জামার ওপর দু কাঁধে লাগানো। বুকের উর্দিতে লাগানো একাধিক মেডেল। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ব্রিটিশ অফিসারের পদ বেশ উঁচু। কর্নেল জাতীয়। ডান হাতে আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত চুরুট নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। সেটা দেখিয়ে অফিসার বললেন, নো অবজেকশন, স্যার?
-ক্যারি ওন। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন। -ইয়েস অফিসার, হাউ ক্যান আই হেল্প য়্যু?
-স্যার, আই নিড ইওর কলেজ বিল্ডিং ফর ফিউ ডেজ, টিল দ্যা কমোশান ইন ক্যালকাটা সাবসাইডস।
প্রমাদ গুনলেন ঈশ্বরচন্দ্র। প্রশ্ন রাখলেন, হোয়াট ফর, ক্যাপ্টেন?
-ফর মাই ব্যাটেলিয়ান । সোলজারস উইল স্টে হিয়ার, স্যার।
-বাট কলেজ?
-প্লীজ, কীপ ইওর কলেজ ক্লোশড ফর দোজ মেনি ডেজেস। লেট দ্যা ল এন্ড অর্ডার বী রেস্টোরড ফার্স্ট ইন দ্যা সিটি। আদারওয়াইজ দেয়ার ইজ ডেঞ্জার ফর দ্যা স্টুন্ডেস অলসো। ইন ফ্যাক্ট, স্টুডেন্টস আর ক্রিয়েটিং মোর ট্রাবল, কমোশন এন্ড ডেস্ট্রাকশন অফ গভরমেন্ট প্রপারটীজ। হোপ, ইউ আর অলসো সীইং…
ঈশ্বরচন্দ্র চুপ করে গেলেন। শহরে, দেশে চলা গণ্ডগোল, ভাঙচূর অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি ব্যাপারগুলো কিছুদিন ধরে তাঁকেও ভাবাচ্ছিল। দুমাস আগে, ৮ই এপ্রিল তারিখে মঙ্গল পাণ্ডে নামের সিপাইকে ফাঁসিতে লটকানোর থেকে যার সূত্রপাত। ইংরেজ সরকারের তৎপরতায় প্রথমদিকে গোলমাল কমেছিল। কিন্তু আগুন জ্বলছিলই । ধিকি ধিকি। মাস দুয়ের মধ্যে তা আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে। শহরে সেনা টহল শুরু হয়েছে।
ফাঁসির ঘটনাটা এতটাই আকস্মিক আর বেদনাদায়ক যে মানুষ তা মানতে পারছে না। ২৯ শে মার্চ ১৮৫৭ মঙ্গল পাণ্ডে সহসিপাইদের আহ্বান জানালো বিদ্রোহ করবার। ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে। কোর্টমার্শালে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। আর তার বিচার শেষ হল মাত্র আট দিনের মাথায়, ফাঁসি হল তার দুদিন পরেই! তাও কিনা দোষী সাব্যস্ত হল, নানান অজুহাতে। সে নাকি একজন ইউরোপিয়ানকে গুলি করবার হুমকি দিয়েছে; কর্মরত অবস্থায় নেশাগ্রস্ত ছিল; ব্যারাকপুরের গঙ্গাঘাটে স্টিমারে চেপে ইংরেজ সৈন্যরা আসছিল, তাদেরকে আক্রমণ করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। মানুষ এর কোনটাই বিশ্বাস করেনি। বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। মানুষ মানতে পারছে না।
-অফিসার, আই ফিল ইয়োর নীড। বাট মাই হায়ার অথরিটি ইজ দেয়ার। গিভ মি টু ডেজ টাইম। ঈশ্বরচন্দ্র মিলিটারি অফিসারের কথার জবাব দিলেন।
মুখ কোঁচকাল অফিসারের। -স্যারি প্রিন্সিপ্যাল। আই নীড ইট ফ্রম টু ডে ওনলি। ডোন্ট হ্যাব টাইম ইন মাই হ্যান্ড।
অগত্যা রাজীই হতে হল তাকে। তিনি তো জানেন, ব্রিটিশ মিলিটারিদের ঔদ্ধত্য। কলেজ বন্ধ করে দিলেন। গেটের চাবি হাতে নিয়ে অফিসার চলে গেল।
এই নিয়ে গোল বাধল শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে । ড্যব্লু গরডন ইয়ং শিক্ষাবিভাগের ডাইরেক্টর। মিঃ ইংয়ের কাছে খবর পৌঁছাল, সংস্কৃত কলেজের গেটে তালা পড়ছে। দূত পাঠালেন অধ্যক্ষের কাছে। জরুরী তলব। ঈশ্বরচন্দ্র সেই দিনই দেখা করলেন। ইংয়ের মেজাজ সপ্তমে। প্রথমেই জানতে চাইলেন, কার অনুমতিতে কলেজ গেটে তালা পড়েছে?
-মিলিটারি অফিসার অনুমতি নেবার সময় দেয়নি, স্যার। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন।
-কলেজ বন্ধ করে দিয়ে গেটের চাবি অন্যের হাতে তুলে দেওয়া কি আপনার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে, প্রিন্সিপ্যাল?
-স্যার, এখানে অন্য কেউ আর কেউ নয়। তিনি ছিলেন মিলিটারির কমান্ডিং অফিসার। লেফ্যট্যানেন্ট কর্নেল। আমাকে উনি সময় দেননি উরদ্ধতনের অনুমতি নেবার।
-হোপলেস…
শব্দটার অভিঘাত হল তাঁর মধ্যে। মাথা ঘুরে গেল। ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, আপনি কি আমাকে দোষারোপ করছেন, মিঃ ইংয়?
-তা নয় তো কী! কলেজের সব দায়িত্ব তো আপনার? ছেলেদের পোড়াশোনা বন্ধ থাকলে তার ফল কাকে ভুগতে হবে?
-সেটার থেকেও বড় সত্যি, শহরের গোলমালে কলেজ ছাত্ররা জড়িয়ে পড়লে, তার থেকেও বেশি ক্ষতি হবে না কি? পড়ুয়াদের সুরক্ষা আমার কাছে আগে। চাইলে আপনি আমার কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করতে পারেন। কিন্তু দোষারোপ করা সাজে না। তাই যদি চান, আমি এখানে বসেই আমার ইস্তফা পত্র লিখে জমা দিয়ে যাচ্ছি।
-আপনার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে আপনি কাজ করেছেন।
-ঠিক আছে। এই আমি ফিরে চললাম। শীঘ্রই লোক মারফৎ আমার ইস্তফাপত্র পেয়ে যাবেন।
রাগে গরগর করতে করতে ঘর ছেড়ে সেদিন বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর কলেজ মুখো হননি। ছোটলাট হ্যালিডের কানে সংবাদ পৌঁছেছিল। তিনি অনুরোধ করেছিলেন। ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, এমন কাজ না করতে। কলেজের ক্ষতি হয়ে যাবে।
-না হ্যালিডে সাহেব, আপনারা অন্য অধ্যক্ষ খুঁজে নিন। আমার পক্ষে এ অপমান সহ্য করে ওই কাজে থাকা যাবে না।
জবাব দিয়ে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অপমান সেদিন যেমন তিনি নিজে হয়েছিলেন, তেমনই ওই ইংয়ও হয়েছিল। সেই রাগ কি মিঃ ইংয় এখন মেটাচ্ছেন? বালিকা বিদ্যালয় চালাবার খরচের অনুমোদন না দিয়ে কি তিনি তাঁর অপমানের শোধ তুলেছেন?
নিজস্ব রাগ, প্রতিশোধ নেওয়া এক জিনিষ। আর এক্ষেত্রে এক তো এতগুলো ইশকুলের দৈনিক খরচ চালানো, মাষ্টার মশাইদের মাসের বেতন দেওয়ার মতো নানান সমস্যা রয়েছে। কেমন করে সামলাবেন তিনি? এত বড় আর্থিক দায় কি তাঁর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব? ঠাকুরদাসের কথাটা মনে এলো। তিনি এটারই সংশয় করেছিলেন। যতই হোক, বাবা তিনি। ছেলে যে একদিন এই সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে, তা তিনি আন্দাজ করেছিলেন কি?
ঈশ্বরচন্দ্র আলোচনায় বসলেন ছোটলাট হ্যালিডের সঙ্গে। হ্যালিডেও অপ্রস্তুত। তাঁর আদেশে কাজ হয়েছে। মৌখিক আদেশ। ভুলটা তাঁরও। কেন তিনি আগাম অনুমতি নেননি শিক্ষা দপ্তরের? বললেন, আপনি তো আমার আদেশে কাজ করেছেন ভিদ্যাসাগর মশাই। অতএব আমার নামে কোর্টে নালিশ জানান। কোর্ট ফয়সালা করুক বিষয়টা।
এমন মহামতি মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সুরাহা হবে? ঈশ্বরচন্দ্র ভাবলেন। শুধু ভাবলেনই না; মুখেও কথাটা প্রকাশ করে বললেন, মহান মানুষ আপনি। সমুদ্র মন্থনে যে গরল উঠল, নীলকন্ঠ হয়ে আপনি তা পান করবেন, আর আমি কি বাসুকী হয়ে দেখব?
-হা হা, হা। আপনাদের মাইথলজিক্যাল স্টোরীর উপমা দিয়ে আমাকে উঁচুতে তুলছেন? আর আপনি জেসাস খ্রাইষ্ট হয়ে নিজেকে তীরে বিঁধছেন। ভালোই আপনার মতলব, ভিদ্যাসাগর মশাই।
-সাফ কথা কী জানেন, হ্যালিডে সাহেব। দুরাত্মা যেমন সব দেশে, সব ধর্মে থাকে, ভালো লোকও তেমনই। আমি কখনও কারোও নামে নালিশ করি না, অতএব আপনার নামে কেমন করে অভিযোগ করব? বালিকাদের বিদ্যালয় চালাবার খরচ নিজে ঋণ করে চালাব। শোধও আমি করব।
বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল হ্যালিডের। মানুষটা বলে কি! ঘোর তাঁর এতটাই যে তিনি বলতে বাধ্য হলেন, ভিদ্যাসাগর মশাই আ প নি সুস্থভাবে চিন্তা করে কথা বলছেন?
-চিন্তা শক্তি রহিত হইনি, মিঃ হ্যালিডে । মস্তিক আমার সাফ। আমি যা বলি, তাই করি।
তিনি শুধু একটুকু বলেই ক্ষান্ত হলেন না। জানিয়ে দিলেন, কাজ থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। মানে উভয় কাজ। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ এবং ইশকুল ইন্সপেক্টর।
-আরে, আ প নি একি করছেন!
হ্যালিডে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সামনে ঝুঁকে বললেন, ভালো করে ভাবুন। মাসে পাঁচ শত টাকা! যা দিয়ে আপনি আ প নার ঋণ শোধ করতে পারবেন।
-সাহেব, প্রাণ থাকলে আমি টাকার জন্যে চিন্তা করি না।
পরে মিঃ ইয়ংয়ের উদ্দেশ্যে বিদ্বেষপূর্ণ একটা কথা বলে স্থান ত্যাগ করলেন। পথে নামলেন। চলতে চলতে বাবার জন্যে মন কেমন করে উঠল। তাঁর কথা স্মরণ করছিলেন…
(১৭)
ঈশ্বরচন্দ্র সব চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। হটকারিতার কাজ করলেন কিনা, সময়ই তা বলবে। তবে কী, ইংরেজ এদেশে পা রেখেছিল বণিক হয়ে। এখন বণিকের দণ্ড রাজদণ্ডে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই বলে, দেশের জনগণকে তো আর উপেক্ষা করা যায় না? ভিদ্যাসাগরের মতো মহান পণ্ডিত, সমাজ সংস্কারক ব্যক্তি যদি এভাবে চাকরি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সমাজ ইংরেজদেরই ছি ছি করবে। ইংরেজদের মধ্যে উঁচু মহলেও সংবাদটা চাউড় হয়ে গেল। দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিও তাঁদের মধ্যে পড়েন।
রাজধানী শহর কলিকাতা। সুপ্রিম কোর্ট কলিকাতাতেই অবস্থিত। স্যার জেমস কলবিন প্রধান বিচারপতি। সহৃদয় ব্যক্তি। ঈশ্বরচন্দ্রকে তলব করলেন কলবিন। ঈশ্বরচন্দ্র কোর্টে পৌঁছলেন। খবর গেল কলবিনের কাছে। নিজের এজলাসে ডেকে নিলেন তাঁকে। এজলাসের পিছনের এ্যান্টি চেম্বারে গিয়ে বসলেন দুজনে। নির্বাক হয়ে স্যার কলবিন অনেকটা সময় ধরে ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে চেয়ে রয়েছেন। কোনও কথা বলছেন না। অস্বস্তি হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্রের। দেশের সর্বচ্চো আদালতের চীফ জাস্টিস বলে কথা। নিজেও কোনও কথা শুরু করতে পারছেন না । ঘরের নিস্তব্ধতা ভাঙছে মাথার উপরে বিশাল হাতে টানা পাখার বাতাস কাটার শব্দ।
হঠাৎ গুরু গম্ভীর গলার আওয়াজ, আ প নি কেমন মানুষ ভিদ্যাসাগর মহাশয়?
ঈশ্বরচন্দ্র একটু হাসলেন। এ কথার কী উত্তর দেবেন?
-দেখুন, আ প নি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে আমার বলবার কিছু নেই। তবে আপনার শুরু করা কাজ কি আপনি বিনা চাকরিতে টেনে নিয়ে যেতে পারবেন? নাকি তা সম্ভব?
-স্যার, আমার অভিধানে অসম্ভব বলে কোনও কথা নেই। আমি যে কথা বলি, যেমন করে হোক তা রাখতে চেষ্টা করি। আপনি তো জানেন, আমার পুঁথি বিক্রয়ে নিয়মিত অর্থ আসে। তাতে না হলে, আমি ধারকর্জ করে প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলোকে চালাব। এ বিষয়ে আপনি নিঃসন্দেহ থাকতে পারেন।
ঈশ্বরচন্দ্রের কথায় কলবিন শুধু একবার মাথা ঝাঁকালেন। অর্থাৎ কিনা, বক্তার কথার অর্থ তাঁর কাছে অধরা, তাই কি তিনি বলে উঠলেন, আপনাকে আমি অনুরোধ করব, আপনি ওকালতি পাশ করুন। এ্যডভোকেট, এটর্নি হয়ে কোর্টে কাজ শুরু করুন। আপনার যা মেধা, তাতে ব্যবসা জমাতে বেশি দিন সময় লাগবে না। আর্থিক দিক দিয়ে আপনার সুবিধা হবে।
ঈশ্বরচন্দ্র কলবিনের প্রস্তাবটা মন দিয়ে শুনলেন। জানা নেই, অন্য কারোও এ প্রস্তাব হলে, হয়তো তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ করে দিতেন। তবে খোদ প্রধান বিচারপতি যখন প্রস্তাব দিচ্ছেন, মুখের ওপর না বলাটা সৌজন্যে বাধবে, তাছাড়াও নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে অর্থ তো সত্যিই প্রয়োজন। তা উপার্জনের দিকটা তো কখনও চিন্তায় আসেনি। স্যার কলবিন তাঁর ভালোর জন্যেই বলছেন। তবে কেন না, একটা প্রচেষ্টা নেওয়া? রাজী হয়ে গেলেন। কলবিনই ঠিক করে দিলেন, আদালতের নামী পসারওয়ালা উকিল, দ্বারকানাথ মিত্রকে। ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন, আ পনি যান। ওনার কাছে ওকালতি শিক্ষা করুন। আ প নার যা বিদ্যা অল্প দিনেই আইন বিষয়ে দক্ষ হয়ে পরীক্ষা পাশ করে যাবেন…
কলবিনের কথার দ্বিরুক্তি করলেন না ঈশ্বরচন্দ্র। নমস্কার জানিয়ে ফিরে এলেন। কাজ শুরু করলেন দ্বারকানাথ মিত্রর বাড়িতে। মিত্র মশায়ের চেম্বার তাঁর বাড়িতেই। মধ্য কলিকাতার তালতলায় অঞ্চলে। সেখানে সকাল বিকেল করে যাচ্ছেন। প্রায় রোজ। আইন বিষয়ে কিছু কিছু জানছেন, শিখছেন। বইপত্র নিয়ে পড়াশোনাও করছেন। তবু যেন মন বসছে না এ কাজে। চেম্বারে যতক্ষণ থাকেন, একটা জিনিষ লক্ষ্য করেন, মিত্র মশায়ের আইন ব্যবসায় পসার তো রয়েছেই, আর সে কারণে সবসময় তাকে বকবক করে যেতেই হছে। নিজের বলতে তাঁর কোনও সময়ই নেই। বসে বসে দেখেন আর ভাবেন, এই যদি আইন ব্যবসা হয়, তাহলে তো তার নিজের পড়াশোনা, পুস্তক রচনার কাজ , সব মাথায় উঠবে। স্বমানে সেখান থেকে সরে এলেন। আইন পাশ দেওয়া মাথায় তুলে রাখলেন।
রাজার মেজাজ ঈশ্বরচন্দ্রের। আসলে মেজাজটা আসল। নিজে রাজা নাই বা হলেন। বালিকা বিদ্যালয়ের খরচ টেনে যাচ্ছেন। ইশকুলের নিত্যকার খরচ। মাষ্টার মশাইদের মাস মাইনে। এছাড়াও অন্যান্য খরচ। নিজের কাছে জমানো অর্থ দিয়ে ক’মাস চলল। এরপর শুরু হল দেনা করা। দেনা হচ্ছে তো হোক না। সমাজের কাজ করতে গেলে দেনা হবে, জীবন থাকলে দেনাও শোধ হবে, এই তাঁর মনের ভাব। এমনই একদিন ঘটল এক কান্ড!
তিনি বর্ধমানে। কয়েক মাসের জন্যে এখানে এসে রয়েছেন। একলাই এসেছেন। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্যে। সঙ্গে আছে হরকালী। চাকর। পুরনো ভৃত্য। ঘরকন্নার কাজ দেখে। আর তিনি নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দয়ার সাগর, ঈশ্বরচন্দ্র বর্ধমান শহরে এসে রয়েছেন, এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একজনকে নাগালের মধ্যে পেয়ে প্রতিদিনই সেখানে গরীব দুঃখীরা আসছে। অনুদানের আশায়। তিনিও তাদের বিমুখ করেন না। যাকে যতটুকু পারেন, কাপড় জামা, চাল ডাল, পয়সা দিয়ে অনুগ্রহ করেন। তিনিই দেবার মালিক। মাধ্যম হরকালী । দান সামগ্রী যায় হরকালীর হাত দিয়ে। এখন সেখানে দান পাবার লোক যদি একবারের জায়গায় দুবার দান নিতে আসে, ঈশ্বরচন্দ্র দান পাঠাতে দ্বিধা করেন না। না তার মুখ চিনে রাখেন। মুখ চেনা হয় হরকালীর।
এই করতে গিয়ে সেদিন হরকালী হাতেনাতে ধরে ফেলল এক মেয়েমানুষকে। গরীব মহিলা। বয়স্কা। প্রায় বৃদ্ধের দলে। পরণে ছেড়া কাপড়। শুকনো মুখ। হম্বিতম্বি দেখাতে শুরু করল মহিলার ওপর। মহিলা মিনমিন করে কথা বলছে। দানে পাওয়া কাপড়টা হরকালী ছোঁ মেরে কেড়ে নিল। গাল পাড়ল, মাগী, বিদ্যাসাগরকে কি তোরা লেদা আমগাছ পেয়েছিস?
ভয়ে মহিলা থতমত খেয়ে গেছে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। চোখ ছলছল। বলল, বাছা, উনি তো গরীবের জন্যেই দেন। আমি বড্ড গরীব। কাপড়খানা তুমি নিয়ে নিলে?
-নোবো না তো কী? রোজ আসলে কী রোজ দান দিতে হবে? এসব নিয়ে তোরা বেচে দিস। আবার পরের দিন আসিস। যা ভাগ…
কথাটা বেশ উঁচু স্বরে বলেছিল হরকালী। ঈশ্বরচন্দ্রের কানে গিয়ে ঢুকল। তিনি ছিলেন ঘরের ভিতরে। লেখার কাজ করছিলেন। উঠে তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন। -কী হয়েছে! কাকে ভাগাচ্ছিস, হরকালী? বলে, একেবারে মহিলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মহিলার চোখের জল নজরে পড়ল। -কী হয়েছে মা,। কাঁদছিস কেন? কে কী বলল?
মহিলা হাত তুলে হরকালীকে দেখিয়ে বলল, আমায় কী অপমানটাই না করছে, বাবা। হাতে কাপড় দিয়েও কেড়ে নিয়েছে…
চিরবিরিয়ে উঠলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এত বড় আস্পর্ধা! মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন, হরকালীর হাতে একটা নতুন কাপড় ধরা। সেটা ছিনিয়ে নিয়ে মহিলাকে দিলেন। সঙ্গে দু কুনকে চাল। এক আনা পয়সা। বিদায় জানালেন তাকে। ঘরের ভিতরে ফিরে গেলেন। এবার পড়লেন হরকালীকে নিয়ে। ডাকলেন, হরকালী, এদিকে আয়।
হরকালীর মুখ চুন। বুঝতে পারছে, বাবু এবার একটা কিছু বলবেন। গলা খাকারি দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কত বছর কাজ করছিস এখানে?
-পঁচিশ বছর বাবু।
-কত মাইনে বাকি আছে, বল?
ভয়ে হরকালীর থরহরি কম্প লেগে গেছে। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আরও গলা উঁচিয়ে তিনি বললেন, তোর পাওনা টাকা দিয়ে দিচ্ছি, তুই এখনই বাড়ি থেকে দূর হয়ে যা। গরীব লোককে আমি দান করব, তাতে তোর কী?
-বাবু, ওই বুড়ি এক সপ্তাহও পেরয়নি আপনার কাছ থেকে টাকা কাপড় নিয়ে গেছে। আপনার তা মনে নেই। তাই ওকে ওই কথা বলেছি।
-কী সাহস তোর? মহিলাকে অমন অপমান করবার অধিকার তোকে কে দিল? তুই আমার সামনে থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যা। এ বাড়িতেও আর পা রাখবি না।
-বাবু, আমার কাজ চলে গেলে দিন চলবে কেমন করে? কাঁদো কাঁদো হরকালীর গলার স্বর।
-যা, তোর জন্যে মাসহারা দু টাকা ধার্য করে দিলাম। মাস পয়লায় আমার কাছে এসে নিয়ে যাবি। কাঁদিস না, বাড়ি যা।
-বাবু, আপনার খাওয়া দাওয়া…?
-ও তোকে দেখতে হবে না। আমি নিজেও করে নিতে পারি।
এরপরে হরকালী আর কোন অধিকারে সেখানে থাকে? জামা কাপড় গুছিয়ে পরের দিনই সে দেশে রওয়ানা দিল।
চলবে…