উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

  -কী সাহস তোর? মহিলাকে অমন অপমান করবার অধিকার তোকে কে দিল? তুই আমার সামনে থেকে এক্ষুণি বেরিয়ে যা। এ বাড়িতেও আর পা রাখবি না।

  -বাবু, আমার কাজ চলে গেলে দিন চলবে কেমন করে?   কাঁদো কাঁদো হরকালীর গলার স্বর।

  -যা, তোর জন্যে মাসহারা দু টাকা ধার্য করে দিলাম। মাস পয়লায় আমার কাছে এসে নিয়ে যাবি। কাঁদিস না, বাড়ি যা

  -বাবু, আপনার খাওয়া দাওয়া…?

  -ও তোকে দেখতে হবে না। আমি নিজেও করে নিতে পারি।

  এরপরে হরকালী আর কোন অধিকারে সেখানে থাকে? জামা কাপড় গুছিয়ে পরের দিনই সে দেশে রওয়ানা দিল

এরপর… 

 

পর্ব – ১৭ 

কথায় বলে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। তা ঈশ্বরচন্দ্রের কপালে ভাত ছড়াতে হয়নি, কিন্তু কাক এমনিতেই এসে হাজির হয়েছে। এ কাক দানা খুঁটতে আসল না। এলো, তাঁকে দানা ফুটিয়ে দেবার জন্যে। ঈশ্বরচন্দ্র হরকালীকে বিদেয় করলেন। পেয়ে গেলেন শিবমোহিনীকে।

কলিকাতা ফিরে এসেছেন। আছেন ১২ নং সুকিয়া স্ট্রীটে। ভাড়া বাড়িতে।  বাড়ির মালিক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। একতলাটা ভাড়ায় দিয়ে বাড়ুজ্জ্যে মশাই পরিবার নিয়ে দোতলায় থাকেন। নীচের তলার একলা মানুষটার জীবনযাত্রা দেখে রাজকৃষ্ণ মাঝে মাঝেই বাড়ির চাকরকে দিয়ে রাঁধা মাছটা, ডালের বাটি, প্লেট ভরে কষা মাংস ইত্যাদি পাঠিয়ে দেন। বাড়ির গিন্নীকে সেরকমটাই বলা আছে।

ঈশ্বরচন্দ্র গিয়েছিলেন বাজারে। সামনেই শিয়ালদহের বাজার। পাইকারি এবং খুচরো, দুভাবেই জিনিষ বিক্রি হয় সেখানে। রাস্তার এক পাড়ে কোলে বাজার। পাইকারির বিক্রির বাজার। আর উল্টোদিকের বাজারে খুচরো বেচার বিক্রতেরা বসে। তিনি খুচরো বাজার থেকেই আলু মূলো পটল, মাছ কিনে আনেন। কাজে কাজে সারা সপ্তাহ বাজারে যাওয়া হয়নি। তাই থলি ভর্তি করে বাজার নিয়ে আসছেন । দূর থেকে দেখছেন বাড়ির রোয়াকে কারা যেন বসে রয়েছে। কাছে আসতে মালুম পড়ল, দুটি মেয়ে বাড়ির রোয়াকে জুবুথুবু মেরে বসা। একটি বয়স্থা। অপরজন অল্প বয়সী। বালিকা বললেই চলে। তখনও তিনি জানেন না, তারা কার জন্যে, কীসের কারণে এই সাত সকালে তারই ঘরের সামনে রোয়াকে এসে বসে রয়েছে। মনে মনে ভাবছেন, নাও। এই হল বুঝি সারাদিনের কম্ম সারা। সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কাকে চাও বাছারা?

-আমরা দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসগরের কাছে এয়েছি।

গ্রাম্য ভাষায় বয়স্থা মেয়েটি উত্তর করল। ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এই যে আমিই সেই লোক। কিছু বলবার আছে?

-হ্যাঁ। বলে, মেয়েদুটি হাঁটু গেড়ে বসে তাঁকে প্রণাম করল। বলল, আমরা অনেক দূর থেকে আসতিছি বাবু।

-কত দূর থেকে?

-হুগলীর দেবানন্দপুর। নাম শুইন্যেছেন নিচ্চয়?

-খুব শুনেছি। কী নাম তোদের?

-আমার নাম হেমাঙ্গিনী, আর ওর নাম, শিবমোহিনী।

বয়সে বড়জন, হেমাঙ্গিনী উত্তর করে যাচ্ছে।  ঈশ্বরচন্দ্রের এবারের প্রশ্ন, তা আমার সঙ্গে কী দরকার?  প্রশ্ন শুনেই হেমাঙ্গিনী নামের মেয়েটা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

-আরে, আরে, কাঁদছিস কেন? কী দরকার না বললে আমি বুঝব কেমন করে? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিস তো? পুলিশে খবর করে দিই। তারাই তোদেরকে আবার বাড়ি পৌছিয়ে দেবে…

এবার শিবমোহিনী নামের মেয়েটাও কান্না জুড়ল। তিনি দেখলেন, ভারি মুশকিলের ব্যাপার হল! সাতসকালে বলা নেই কওয়া নেই, কোন সে দেবানন্দপুর থেকে দুটি মেয়ে তার খোঁজে এসে রাস্তায় বসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছে! তাড়াতাড়ি বাজারের থলিখানা হাত বদলে নিয়ে বললেন, না, বাপু, এভাবে কাঁদলে চলবে না। কাঁদতেই যদি হয়, তবে বাড়ির ভিতরে এসে বসে কাঁদ; যতক্ষণ খুশি কাঁদ। কান্না থামলে বাড়ি ফিরে যা। এখানে রাস্তায় বসে কাঁদলে, লোকে আমাকে বলবে কী?

কাজ হল। হেমাঙ্গিনী বলল, বাবু, আপনি শুনেছি দয়ার সাগর। এই মেয়েটাকে আপনি আশরয় দিন, বলে, শিবমোহিনীর হাত ধরে সামনে টেনে এনে ধমক দিয়ে বলল, এই ছুঁড়ি, নিজের কতাটা বল না, বাবুকে। বাবু খুব সদয় নোক।

-বুঝেছি, সাহায্য চাস। তা না হলে, অত দয়ার সাগর, ভালো নোক, এসব বলে, আমায় গাছে চড়াবি কেন? আরে বাবা, আমি যা, তাই। তোদের কথাটা চটপট বলে ফেল তো দেখি বাছা। আর তা না হলে এই আমি  চললাম, বলে, বাড়ির দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

মেয়েদুটো তাঁর পিছু নিল। বলল, বাবু, আমাদের বাড়ির মধ্যি ঢুকতে দিবেন নাই?

-তা কেন, আয়। আমার পেছু পেছু আয়। শুনি তোদের কী কথা। বাড়িতে ঢুকে বলবি তো কেন এসেছিস?

দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন। রান্না ঘরের দিকে গেলেন। বাজারের থলিটা ঘরের ভূঁয়ে নামিয়ে রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মেয়েদুটোর সামনে বসলেন। তাদেরকেও বসতে বললেন। হেমাঙ্গিনী, শিবমোহিনী উবু হয়ে মাটিতে বসল। সামনের খালি দুটো চেয়ারে বসল না। তিনি বুঝলেন, গ্রাম্য হলেও মেয়েদুটো সহবৎ জানে। বয়সে ছোট হয়ে বড়দের সামনে সমানে সমানে যে বসতে নেই, সে জ্ঞানটুকু রয়েছে।

-জল খাবি? কোথায় এসেছিলিস?  প্রশ্ন করলেন তিনি।

হেমাঙ্গিনী উত্তর করতে লাগল, গঙ্গা নাইতে এয়েছিলুম গো বাবু। তা সে তো শুধু চোখে ঠুলি পড়াবার জন্যি। আসলে, আপনার কাছেই এয়েছি। এই মেয়েটাকে নিয়ে।

-কী বলছিস সব! গঙ্গা নাইতে; ঠুলি পড়াবার জন্যি, আমি তো বাপু তোদের ঠিক ঠাওরাচ্ছি না। যা বলবার সোজাসুজি বল দেখি।

বিরক্তি দেখে হেমাঙ্গিনী এবার কথার ফোয়ারা ছোটাতে শুরু করল। -বাবু, শিবনোহিনী মেয়েটার বড্ড কপাল খারাপ। বারোও পেরোয়নি। এখনই সোয়ামিকে হারিয়ে বেধবা হয়ে বসে আছে। তা ওকে শ্বশুরবাড়ি তো আর ফুলচন্দন দেয়ে রাখবে নিই? পাঠ্যিয়ে দিলে বাপের কাছে। বাপ, সে আবার আর এক কাঠি সরেস। তার প্রেত্থম বউটা মরতে আবার বে করে বসেছে। এবার  বিমাতাটা এই মেয়েকে ঘরে ঠাঁই দেবে কেনে? তাও যদি বা দিলে, সে মেয়েটাকে এক্কেবারে কুকুর বেড়ালের থেকেও অধম করে রাখতেছিল গো। একবেলা খাওয়া দেওয়া, পরনের কাপড় আধ ছেঁড়া। মেয়ে সোমত্ত হচ্ছে, গায়ে সেমিজ নেই। সিঁড়ির তলায় বাসের জায়গা দিলে। ও মেয়েকে তো এরপরে সত্যিই মানুষ-কুকুরে টেনে নেয়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে খেত…

কথার মাঝ পথে হেমাঙ্গিনী শিবমোহিনীর গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠল, এই ছুঁড়ি, নিজে মুকে বল না নিজের কতা। আর না হলে, আমি চললুম। পড়ে থাক কলিকাতায়, খাক শেয়াল কুকুরে। দুদিন হল বেইরেচি, দেরী হলে কুলো আমার পিটে ভেঙে বাতাস দেবে আমার বাড়ির নোক…

নারী অবলা! কে বলে? ঈশ্বরচন্দ্র মনে মনে কথাটা বলে হেসে উঠলেন। বললেন, বুঝেছি। এখন এই মেয়েকে গছাতে এসেচিস আমার কাছে…

বাবু, আপনি তো বেধবাদের বিয়ে থা দ্যান। তা দেখুন না, এই মেয়েটার যদি একটা হিল্লে করে দিতে পারেন। মেয়েটা বেঁচে যায়। আর তা না হলে যে…,

আবার কাঁদতে শুরু করল হেমাঙ্গিনী। এবার আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না নয়। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে নাকের জলে একসা করতে থাকল সে।

ঈশ্বরচন্দ্র তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দ্যাখ বাপু। বিধবার বিয়ের আমি বন্দোবস্ত করি, এটা ঠিক। কিন্তু, পুরুষদের তো চিনিস? শুধু হাত কেউ উপুড় করে না। টাকাপয়সা নিয়ে তবে বিয়েথা করে। আর গোলটা বাঁধে সেখানেই। তাদের অনেকেই টাকা হাতাবার জন্যে বিধবা বিয়ে করে, পরে সেই মেয়েদের আর দুর্দশার শেষ থাকে না। আমি ব্যস্ত মানুষ। বিয়ে বললেই এক্ষুণি তা দেওয়া সম্ভব হবে না। না, আমি তা হতে দোবো। কারণটা তো বললাম। ভাল করে দেখেশুনে বিয়ে দিতে গেলে, ওকে অপেক্ষা করতে হবে। বাড়ি ছেড়ে যখন বেরিয়ে পড়েছে, ও মেয়ের সেখানে ফেরার আর পথ নেই, এ আমি ভাল করে বুঝছি। ও এখন আমার বাড়িতে থাক। কাজকর্ম করুক। পারলে লেখাপড়াও শেখাবো। তারপরে ঘরবর দেখে ভালো জায়গায় ওর একটা বিয়ে দিয়ে দোবো। রাজী ?

-খুব রাজী, বাবু।

শিবমোহিনীর হয়ে হেমাঙ্গিনী কথাটায় সায় দিল। ঈশ্বরচন্দ্র নির্দিষ্ট করে শিবমোহিনীর কাছে উত্তর চান। তাই তাকে কথা বলতে বললেন। সেও এক কথায় ঘাড় নেড়ে বলল, বাবু, আমি আপানার কাছেই থাকব। ওখানে আর ফ্যিরে যাবনি।

শিবমোহিনীর স্থান হয়ে গেল ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে আর হেমাঙ্গিনী খুশি খুশি মনে দেবানন্দপুরে ফিরে গেল। এরপরে ওই হেমাঙ্গিনীর কি হয়েছে, তা আর ঈশ্বরচন্দ্রের জেনে ওঠা হয়নি। তবে, শিবমোহিনীকে যে নিজের আর এক মেয়ের মতো মানুষ করবেন, ততক্ষণে তা মনে মনে স্থির করে ফেলেছেন তিনি।

শিবমোহিনীর সুপাত্রের জন্যে তিনি এদিক ওদিক বলে রাখছেন। কেউ কোনও খবর নিয়ে আসলে সেখানে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসছেন। পছন্দ হচ্ছে না। ছেলের হাবভাব কথাবার্তা বেচালা। পত্রপাঠ নাকচ করে দিচ্ছেন। ঠিক যেন হেমলতার  বিয়ের জন্যে পাত্র দেখছেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা।

বীরসিংহে গেলেন। শিবমোহিনীর কথাটা দীনময়ীকে বললেন। শুনে দিনময়ী একদিকে যেমন খুশি হলেন, অপরদিকে চিন্তায় পড়লেন। খুশির কারণ, শহর কলিকাতায় গিয়ে একলা থেকে তার স্বামীকে হাত পুড়িয়ে রান্না করে খেতে হচ্ছে না। হিল্লে একটা হয়েছে। ডাল ভাত, শাক ভাত, আর মাছের ঝোল রেঁধে খাওয়াক সে মেয়ে। মেয়ে মানুষ তো? এটুকু কাজ সে ঠিক চালিয়ে নেবে। তাও তো নিজের স্বামী অন্যকে এসব শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে কার্পণ্য করেন না, এ দিনময়ী ভালো করেই জানেন। আর ঈশ্বরচন্দ্র প্রকৃত তাই করছেনও। শিবমোহিনীকে একেবারে হাতে ধরে মানুষ করছেন। নিজের মেয়ে হেমলতা সামনে নেই। তাই হয়তো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন। উদ্দেশ্য, ওই মেয়েকে শুধু ঘরকন্নার কাজেই পটু করে না তুলে, ভবিষ্যতে যাতে বিয়ের পর বাচ্ছাকাচ্ছা হলে, নিজেই তাদের শিক্ষা, অন্ততঃ প্রাথমিক শিক্ষা, নীতি শিক্ষাটুকু দিতে পারে, তাই মেয়েটাকে লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন। যে যাই করুক, দীনময়ী দেখছেন, স্বামীর খাওয়া দাওয়ার  সুরাহা হচ্ছে, তাতেই তিনি খুশি।

দীনময়ীর অন্য চিন্তা, মেয়েটার বয়স হয়ে গেলে আর কি বিয়ে হবে? একে বিধবা, তায় বয়স্থা মেয়ে হলে আমড়া আঁটি হয়ে যাবে না?  গ্রামে নিজেই খোঁজ রাখছেন উপযুক্ত পাত্রের।  পাত্র জোগাড় হল না, উল্টে এক এমন পুরুষের খোঁজ পেলেন দীনময়ী যিনি বিবাহিত। তার কথা স্বামীকে না বলে পারলেন না । হাসতে হাসতে জানালেন , আপনার ওই দূরসম্পর্কের দাদা না কে হন, বিষ্ণু ভট্টচারি, একবার তাঁর কাছে যান না।

ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর কৌতুক বুঝতে না পেরে বললেন, কেন বলো তো? ওঁর কথা বলতে গিয়ে এত হাসছ, সত্যিই কি ব্যাপারটা হাসির?

-বুড়ো বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন উনি…,

আবার হাসি। শেষে বললেন, নিজে চোখেই গিয়ে দেখে আসুন। আপনাকে তো উনি ভালোমতোই চেনেন।

দীনময়ীর কথা রাখতে একদিন সত্যি সত্যিই ঈশ্বরচন্দ্র বিষ্ণু ভট্টচারির বাড়ি গেলেন। দুটো গ্রাম পরেই তার বাড়ি। একলা না গিয়ে সঙ্গে কৃষ্ণকমলকে নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণকমল তাঁর বাল্যবন্ধু। পাশের গ্রামে বাস। প্রায় সমবয়সী দুজনে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যার সাগর হয়ে তার বাড়িতে এসেছে, জেনে সে ব্যক্তি মহা খুশি। এসো এসো করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে বসালেন দুজনকে। কথায় কথায় প্রকাশ হল, বিষ্ণু মশায়ের সত্যিই এক অল্প বয়সের বউ রয়েছে। দ্বিতীয় বিয়ে। সে বিয়েও সদ্য হয়েছে।

তিনি মাঝে মাঝেই অতিথিদের বসিয়ে রেখে বাড়ির ভিতরে চলে যাচ্ছেন। আসছেন মিনিট কয়েক কাটিয়ে।  ইতিপূর্বে বিষ্ণু ভট্টাচারের কথায় প্রকাশ পেয়েছিল, পত্নীকে তিনি কখনই একলা বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে দেন না। স্ত্রীর সঙ্গে  তিনিও সেখানে ছোটেন। দুদিন থাকলে তিনিও দুদিন থাকেন; দশদিন হলে তাও।  এ কীর্তিকে নাকি বিষ্ণু মশায়ের ভাই আর এক কাঠি ওপরে নিয়ে গেছেন। তিনি নিজের বাড়ির পাত্তাড়ি গুটিয়ে শ্বশুর ঘরে গিয়েই বরাবরের স্থান নিয়েছেন।

একসময় দীর্ঘ কথপোকথনের মাঝে বিষ্ণু মশায় বেশ ছটফট করতে শুরু করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন, ওঁর কানটা ধরা আছে ভিতরে। তাই এত ছটফটানি। বলে উঠলেন, দাদা, যাও, যাও। আর উসখুস করতে হবে না। বাড়ির ভিতরেই যাও।

ছাড়া পেয়ে ফুড়ুৎ করে চড়াই পাখীর মতো উড়ে পলকে ভিতরে চলে গেলেন বিষ্ণু মশাই। পাশে বসা কৃষ্ণকমলকে ঈশ্বরচন্দ্র চোখ টিপে বললেন, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ।

ততদিনে মাইকেলের ওই নামের উপন্যাসখানা ঈশ্বরের পড়া হয়ে গেছে। কৃষ্ণকমল কথাটা বুঝলেন না। – আখ্যানটা পরে শুনে নিও আমার থেকে। ঈশ্বরচন্দ্র ব্যাখ্যা দিলেন।

বিষ্ণু আর অথিতিদের কাছে আসেন না। অস্বস্তি লাগছে দুজনের। ঈশ্বরচন্দ্র গল্প জুড়লেন কৃষ্ণকমলের সঙ্গে। গল্প এক সাবজজকে নিয়ে। বললেন, জানো তো কৃষ্ণ, সেদিন আমার পুরনো পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হল। ভদ্রলোক পেশায়  জজিয়তি করেন। পদ সাবজজের । অনেকদিন পরে দেখা হয়েছে। কথায় কথায় প্রকাশ হল ওনার প্রথমা পত্নী আর নেই। গত হয়েছেন মাত্র কয়েক মাস আগে। গৃহ খালি। সঙ্গে হৃদয়ও।  দুটোই এভাবে খালি রাখাটা তাঁর কাছে বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। অথচ ন্যায়বোধও  ষোলো আনা।  তা সেসব দমন করেই বৃদ্ধ বয়সে দ্বিতীয় ভার্যা ঘরে এনে তুললেন। কথায় কথায় বললেন, জানো তো ভায়া, এতে আমার অনেক লাভ হয়েছে।

মস্করা করে বললাম, তবে তো তোমার স্বর্গের দ্বার খোলা হে। আমার উপহাসটা উনি ধরতে পারলেন না। বলে উঠলেন, কেন, কেন? আমি তখন তাকে ব্যাখ্যা দিলাম, মরণের পরে মানুষমাত্রেই স্বর্গে প্রবেশের জন্যে স্বর্গের দ্বারে হুড়োহুড়ি করে। সেখানে চিত্রগুপ্ত খাতা নিয়ে বসে রয়েছে।  একে একে সকলকে জিজ্ঞাসা করে, পৃথিবীতে তুমি কি কাজ করে এসেছ? কেউ সত্যি কথা বলে। চিত্রগুপ্তের তা বিশ্বাস হলে তাকে স্বর্গে প্রবেশ করতে দেয়। যাদের বিশ্বাস করতে পারে না, তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নরকবাসে পাঠিয়ে দেয়। এটাই স্বর্গে প্রবেশের নিয়ম। এবার হয়েছে কী, একজনকে এমনই প্রশ্ন করাতে সে ব্যক্তি বিশেষ কিছুই পুণ্য বা পাপের কথা প্রকাশ করতে পারল না। তবে কথায় কথায় প্রকাশ করে ফেলল, বৃদ্ধবয়সে  দ্বিতীয় বিয়ে করেছে এক তরুণীকে। চিত্রগুপ্ত বেজায় খুশি। বলল, এসো, এসো, এখুনি স্বর্গে প্রবেশ করো পৃথিবীতে তোমার নরকভোগ হয়ে গেছে…

কৃষ্ণমল হো হো করে হেসে উঠলেন।  ঈশ্বরচন্দ্র তখনো গম্ভীর।

হাসির শব্দেই কিনা, বিষ্ণু তাড়াতাড়ি ছুটে এসে, দুঃখিত দুঃখিত, শব্দটা বার কয়েক আওড়ে জলযোগের থালা আনতে ফের ভিতরে চলে গেলেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বাড়ি ফিরে বিষ্ণু ভট্টর গল্পটা দীনময়ীকে শুনিয়ে দিলেন। সঙ্গে যোগ করলেন, জানো তো দীনময়ী,  জলযোগের জন্যে শুধু নারকেল নাড়ু দিয়েছিল বিষ্ণু ভট্টচারি। দুটো করে।

তারপর হাসতে শুরু করলেন।

(১৮)

 

একদিন এক চিঠি এসে পৌঁছাল ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে। পোস্টকার্ডে লেখা চিঠি। প্রেরকের ঠিকানা সুদূর মাদ্রাজ রাজ্যের। পত্র প্রেরক জানিয়েছে, ভীষণ রকম বিপন্নতার মধ্যে সাত সন্তান সন্ততি, স্ত্রীকে নিয়ে তার দিন কাটছে। উপোষ করেও রয়েছে কয়েকদিন। মাদ্রাজে কোনও এক বাড়ির নিচের তলায় ভাড়া থাকে। ছ মাসের ভাড়া বাকি পড়ে যাওয়ায় বাড়িওয়ালা বলেছে বাড়ি ছেড়ে দিতে। ত্রিশ টাকা পাঠাবার অনুরোধ করেছে।

অবাক হলেন। এমন কোনও লোককে চেনেন না। তিনি রয়েছেন কলিকাতা শহরে। মাদ্রাজে যাননি কখনও। অথচ চিঠি এলো সেখান থেকে! কার মাধ্যমে তাঁর ঠিকানা যোগাড় হল, তাও ভেবে পাচ্ছেন না। চিঠিটা উল্টে পাল্টে বার কয়েক পড়লেন।  কিছু উদ্ধার হল না। অথচ…

ভাবতে বসলেন। বিপন্ন লোকটার একটা ছবি আকঁতে চেষ্টা করলেন মনে মনে। শুকনো মুখ। জীর্ণ শরীর। গা হাত পা রুক্ষু। পাশে  স্ত্রী বসে রয়েছে। পরণে আধ ময়লা শাড়ি। চোখ কোটরাগত। সাতটা বাচ্ছা তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে। পেটে  ক্ষিদে। ঘরে চাল বাড়ন্ত। মাদ্রাজ প্রদেশে মুড়ি পাওয়া যায় কিনা জানা নেই। পাওয়া গেলেও, হাতে পয়সা নেই লোকটার। ক্ষিদের তাড়সে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটা মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ছে..

ভাবছেন আর  চোখ দিয়ে হু হু করে জল গড়িয়ে পড়ছে। দানধ্যান তিনি করেন। কিন্তু তার বিস্তার যে এতদূরেও হয়েছে, ভেবে বুকের ভেতরটা গভীর তৃপ্তিতে ভরে উঠল। একবার ভাবলেন, লোকটা সত্যি তো? কিন্তু সত্যি মিথ্যে যাচাই করতে গেলে দিন কয়েক কেটে যাবে। ততদিনে তারা হয়তো গৃহছাড়া হয়ে শহরের ভিড়ে হারিয়েই যাবে। দারিদ্রের চাপে অন্য কোনও অঘটনও ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

…নাহ। ভাবতে  আর মন চাইছে না। উঠে পড়লেন। গায়ে ফতুয়াটা চাপালেন। ধুতি তো পরেই ছিলেন। চাদরটা কাঁধে ফেললেন। বাক্স খুলে কিছু টাকা বের করে নিলেন। জমানো টাকা। হনহনিয়ে চললেন তার-ঘরের দিকে। এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন, যেন এখনই টাকাটা লোকটার কাছে পৌছাতে পারলে ভালো হয়।

অনেকটা দূরে তারঅফিস। ফোরট ইউলিয়াম দুর্গের ভিতরে এক অংশে সদ্য চালু হয়েছে। একমাত্র সেখানেই রয়েছে টরেটক্কা যন্ত্র। যার মাধ্যমে খবর খুব অল্প সময়ে দূর থেকে দূরের শহরে পৌছিয়ে যায়। সেই ডাকঘরেই যেতে হবে। তিনি চলেছেন স্ট্যান্ড রোড ধরে। গঙ্গার পাড় বরাবর। দুপুরের সময়। পথে গাড়িঘোড়ার চল অনেকটা কম। তারই মতো বহু লোক পায়ে হেঁটে চলেছে। তাঁর চলা অবশ্য হচ্ছে প্রায় দৌড়নোর মতো। আউট্রাম ঘাটের কাছে এসে পথ পেরলেন। উঠলেন ময়দানে। ইংরেজদের ভাষায় গড়ের মাঠ। সন্ধ্যেবেলা সাহেব মেমদের হাওয়া খাবার জায়গা। ঘোড়ায় চড়ে আসে। ময়দানে ঘোড়া ছুটিয়ে কাঠের বল আর লম্বা লাঠি নিয়ে পোলো খেলে।

দুর্গের গেটে পৌঁছলেন। ভিতরে ঢোকা এক ঝকমারি। অন্তত সাধারণ মানুষের পক্ষে। সেনাদের জন্যে সুরক্ষিত স্থান এই দুর্গ। প্রবেশ করতে গিয়ে গেটে একশ এক জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। শেষে এক সাহেবের বদান্যতায় ভিতরে ঢুকতে পারলেন। সোজা চলে গেলেন ডাকঘরে। সাহেবদের ভিড়। ডাক কর্মচারী সহ উপভোক্তা, সবই প্রায় সাহেব। হ্যাটকোট পরা। তিনিই একমাত্র ধুতি পরে রয়েছেন। অনেকে তাঁকে দেখছিল।

নির্দিষ্ট কাউন্টারে পৌঁছলেন। দাঁড়ালেন চারজন সাহেবের পিছনে। লোক লাইন দিয়ে টরেটক্কা মেশিনে বার্তা পাঠাচ্ছে। দেশ বিদেশে। টাকাও পাঠাল দুজন সাহেব। যন্ত্রের টকা টক, টকা টক আওয়াজ উঠছে। তাঁর লাইন আসতে হাত বাড়িয়ে টাকা দিলেন জানলার ভিতরে। অন্য হাতে ধরা লেখা কাগজখানাও সঙ্গে দিলেন। তাতে মাদ্রাজ শহরে প্রাপকের ঠিকানা সহ টাকার অঙ্ক বিশদে লেখা রয়েছে। মিনিট দশ সময় লাগল। যন্ত্র মাধ্যমে খবর চলে গেল যথাস্থানে। প্রাপক তাঁর প্রাপ্য একদিনেই পেয়ে যাবে। পরিতৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরে আসছেন। পথে দেখা হয়ে গেল নবীনচন্দ্রর সঙ্গে।  নবীনচন্দ্র সেন। এখনকার উঠতি কবিদের মধ্যে যথেষ্ট নাম করেছে। ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ রয়েছে।

ঈশ্বরচন্দ্র ডাকঘরের কাজ সেরে যাচ্ছিলেন শ্যামবাজারে একজনের সঙ্গে দেখা করতে। পায়ে হেঁটে। নবীনচন্দ্র আসছিল বেলগাছিয়া থেকে। গন্তব্য শিয়ালদহ। বিকেলের এক সাহিত্য সভায় যোগ দিতে । কবিতা পাঠ করবে।  সামনে ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে নবীনচন্দ্র দাঁড়িয়ে পড়ল। নিচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে ঢিপ করে প্রণাম সারল। ঈশ্বরচন্দ্র থমকে গেলেন। তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। ইতিপূর্বে দুজনের পরিচয় ঘটেছিল নবীনচন্দ্রের দাদা কেশবচন্দ্র সেনের মাধ্যমে। ব্রাহ্মসমাজের হোতা কেশবচন্দ্র সেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সেখানে যাতায়াত রয়েছে। দাদাই ভাইকে উঠতি কবি বলে, পরিচয় ঘটিয়েছিল।

নবীনচন্দ্রের বয়স মাত্র ঊনিশ। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ। প্রথম বিভাগে। ১৮৬৩ সাল। কলিকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে। জমিদার বাবা, গোপীনাথ ছেলেকে কলিকাতায় পাঠালেন উচ্চ শিক্ষার জন্যে। নবীন চন্দ্র হয়ে উঠল কবি। মাইকেলের অমিত্রাক্ষর ছন্দ তাকে আকৃষ্ট করেছে। কবিতা রচনায় মন দিল। লিখল, ‘এক বিধবা কামিনীর প্রতি’, নামের দীর্ঘ কবিতা। প্রকাশ হল এডুকেশন গেজেটে। অনেকের নজরে এল। নতুন কাব্য গ্রন্থ অবকাশরঞ্জনী’র প্রথম ভাগ লেখা চলছে তখন। সব খবরই রাখেন ঈশ্বরচন্দ্র।

কথা শুরু হল দুজনের । ব্রাহ্মসমাজ, কবিতা, কাব্যগ্রন্থ, নানান বিষয়ে কথা। ভাইয়ের কাছে দাদার সংবাদ নিলেন । কেশবচন্দ্র ভালোই আছেন, নবীনচন্দ্র উত্তর করল।

তাঁরা দাঁড়িয়েছে চিৎপুর রোডের ওপরে। এক মন্দিরের সামনে। ভাঙাচোরা মন্দির। ভিতরে মলিন মূর্তি। চিত্রেশ্বরী দেবীর মূর্তি। পাথরের। তিনশ বছর আগে গড়া  মন্দির, যখন কিনা বাংলাদেশ থেকে বৈষ্ণবধর্মের আধিপত্য কমে আসছিল। বাঙালী সে সময় তন্ত্রমতে শক্তিপূজায় আত্মনিয়োগ করছে। কালী মূর্তির মতোই চিত্রেশ্বরী নামের দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরে মন্দিরে পূজো শুরু হয়েছিল। চলেছিল বহুকাল। পরে অবশ্য ওই দেবীর গুরুত্ব কমেছে। মন্দিরও জৌলুষ হারিয়েছে। মন্দিরের সংস্কার মাথায় উঠেছে। কিন্তু মন্দির সংলগ্ন বিশাল পুকুরটা এখনও স্থানীয় লোকেদের পরিচর্যার দৌলতে ব্যবহার যোগ্য হয়ে রয়েছে। সেখানে কয়েকটা সিঁড়ি করা। পুকুরে নামা ওঠা করবার। জলাশয়টার নাম হেদুয়া।

এক ব্রাহ্মণ পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল। গা মাথা ভিজে। স্নান সেরে উঠেছে। নবীনচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন, লোকটা  গায়ের উপবীত নিংড়োতে নিংড়োতে পথ ধরে তাঁদের দিকেই এগিয়ে আসছে। মানুষটাকে দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে ধন্ধ লাগল। স্নানের জন্যে তার গা মাথায় যদিও বা জলের আধিক্য রয়েছে, তবু কেমন যেন মনে হচ্ছে সে কাঁদছে। দুটো চোখ জলে টসটস করছে। গাল বেয়ে অশ্রু বইছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিচলিত হলেন। কোমল হৃদয়ের মানুষ তিনি। কারোও অশ্রু দেখলে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। নবীনচন্দ্রের সঙ্গে কথা থামিয়ে দিলেন। ক্রন্দনরত ব্রাহ্মণকে কাছে ডাকলেন ।  প্রশ্ন করলেন, কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?

চলতি পথে ব্রাহ্মণ থেমে গেল। কান্না ভেজা স্বরে উত্তর করল, মশায়, আমার সর্বস্ব যেতে বসেছে।

-কেন! কী হল? ব্যাপারটা খুলে বলো। চলো, সামনের ওই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসি?

নবীনচন্দ্রকে বিদায় দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র লোকটাকে নিয়ে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন। ব্রাহ্মণ বলতে শুরু করল, আমি গরীব ব্রাহ্মণ । আমার তিনটি সন্তান। তার মধ্যে একটি মেয়ে। বিবাহযোগ্যা হয়েছিল। বাকি দুই পুত্র সন্তান। ছোট ছোট। মেয়ের বিয়ে দিতে ধারকর্জ করেছিলাম। শোধ দোবো জানিয়েছিলাম উত্তমর্ণকে। টাকা ফেরতের সময় পেরিয়ে গেছে। অর্থ জোগাড় করে উঠতে পারিনি। তাই আমার বাড়ি নিলামের জন্যে উত্তমর্ণ আদালতে নালিশ ঠুকেছে। হায় , হায়! কপাল চপড়ালো। বলতে থাকল, কেসে হেরে গেলে  ঘরবাড়ি সব চলে যাবে। পরিবার সন্তানদের নিয়ে আমাকে পথে বসতে হবে…,  ঝরঝর করে জল ঝরছে ব্রাহ্মণের দুচোখ দিয়ে। সে কেঁদেই চলেছে।

ঈশ্বরচন্দ্র চুপ। মন ভিজে উঠেছে। ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুটা সময়ের জন্যে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।  বললেন, মামলা কি চালু হয়ে গেছে?

-হ্যাঁ। শুনানি চালু হয়েছে।

-কোন আদালতে কেস রয়েছে?

-আলিপুর জজ কোর্টে।

-কেস নম্বর মনে আছে?

-না। ঠিক মনে করতে পারছি না।

-ঠিক আছে। আগামীকাল তা নিয়ে এখানেই আমার সঙ্গে দেখা করবে। আমি আসব।

-আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না…

-চেনবার প্রয়োজন নেই। কাজ হয়ে গেলে জানতে পারবে। এখন এসো।

ব্রাহ্মণ চলে গেল। ঈশ্বরচন্দ্রও নবীনচন্দ্রকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা লাগালেন। শ্যামবাজারে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে পৌঁছলেন। কাজ সারলেন।

পরেরদিন আবার দেখা হল ব্রাহ্মণের সঙ্গে। চিরকুটে সবকিছু লিখে নিয়ে এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে তা তুলে দিল। দু দিন পরে ঈশ্বরচন্দ্র আলিপুর জজ কোর্টে গিয়ে নিজের এক চেনা উকিলকে আতিপাতি করে খুঁজে বার করলেন। বললেন, কেসটার বিশদ জোগাড় করে দিতে হবে। মায়, উত্তমর্ণের নাম, ঠিকানা, কত টাকা পেলে উত্তমর্ণ কেস তুলে নেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। উকিলের হাতে কুড়ি টাকা গুঁজে দিলেন। কাজের দক্ষিণা।

খোঁজ খবর সারা হয়ে গেল। কর্জর সঙ্গে সুদ মিলিয়ে আড়াই হাজার টাকা দিলে উত্তমর্ণ কেস তুলে নিতে রাজী। কয়েকদিন সময় চাইলেন ঈশ্বরচন্দ্র। উত্তমর্ণ কথা দিল, এক মাসের মধ্যে কেস আবার উঠলে তিনি নতুন দিন নিয়ে নেবেন।

কুড়ি দিনের মাথায় ঈশ্বরচন্দ্র, উকিল এবং উত্তমর্ণকে নিয়ে কোর্টে হাজির। নির্দিষ্ট দপ্তরে আড়াই হাজার টাকা জমা করলেন। বেনামে। আদালত চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। সেদিন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন এক বন্ধুকে। সাক্ষী মানার জন্যে।

বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কী হল, টাকাটা তুমি জমা করলে, আর নাম লেখালে অন্য জনের! ব্যাপারটা কেমন হল?

ঈশ্বরচন্দ্র হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, কাজটা তো হল? নাম দিয়ে কী হবে?

বন্ধু বিস্মিত!  বলল, তোমার মতো লোক যদি আর দুটো হয়…

-ওহে ভাই, আমার নাম জানলে আমি ঈশ্বরচন্দ্র শর্মণঃ থাকব; না জানলে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা থাকব। তা ঠাকুরদার দেওয়া নামটা থাকা তো ভালো। তাই না, হা হা হা…

কেস ডিসমিস হল। ব্রাহ্মণের বাড়িঘর বেঁচে গেল। অর্থদাতার নামের খোঁজ করতে থাকল ব্রাহ্মণ। তবে , তার হদিস আর কে দেবে তাকে?

 

(১৯)

 

ঈশ্বরচন্দ্র বীরসিংহে আসলেই ছেলেমেয়েদের জন্যে হাতে করে এটা সেটা নিয়ে আসেন। চার সন্তান তাঁর। ছেলে, নারায়ণচন্দ্র। মেয়েরা হল, হেমলতা, কুমুদিনী, বিনোদিনী। এবার এসেছেন ছেলের জন্যে শার্ট প্যান্টুলুন নিয়ে। নারায়ণ এই প্রথম ওই পোশাক পরবে। ধুতি জামার চল ছেড়ে নতুন ধরণের পোশাক। সে তো আনন্দে লাফাচ্ছে। মেয়েরাও পেয়েছে নতুন শাড়ি। হলুদ রঙের। সামনে সরস্বতী পূজো। তাতে হলদে শাড়ি পরে সাজবে। দীনময়ীকে সামনে রেখে ছেলে মেয়ের হাতে হাতে নতুন জামা কাপড় তুলে দিচ্ছেন।  হাসছেন। বললেন, এর পরে চতুর্থজন এলে তাকে কী দেওয়া হবে?

চতুর্থজন দীনময়ীর গর্ভে দিন গুনছে জগতের আলো দেখার জন্যে। দীনময়ীর আশা, এবার ছেলে হবে।  ছেলে হলে নাম রাখবেন, শরৎচন্দ্র। স্বামীকে বলেও রেখেছেন সেকথা।

-শরৎকাল। ছেলেই হোক আর মেয়ে, শরৎ দিয়েই নামা রাখা হবে , দীনময়ী। ছেলে হলে শরৎ ; আর মেয়ে হলে শরৎকুমারী। এই ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের কথা।

দীনময়ী স্বপ্ন দেখেন আর এক ছেলের। তা হলে, দুই পুত্র, তিন কন্যা নিয়ে তাঁর ঘর পূর্ণ হবে।  বারবার গর্ভধারণ করতে তাঁর ভালো লাগছে না। এক তো, গর্ভে ভ্রূণ এলেই সব আচারবিচার বন্ধ হয়ে যায়।  তাছাড়াও বছরে দুবছরে গর্ভেধারণের কারণে শরীর ভেঙে যাচ্ছে।  সারতে অনেক সময় লাগে। এদিকে সংসারের কাজের তো কম নেই। ঠাকুর চাকর ঝি রেখে কাজ হলেও তিনি গিন্নী মানুষ, বাড়ির বড় বউ, তাঁর কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলে? সঙ্গে যদিও থাকে মেজ সেজ দেওরের স্ত্রীরা। তবে তারা এখন ছোট।  সংসার সম্বন্ধে তাদের ধরণা এখনও স্পষ্ট হয়নি। কাজে হাত লাগালেও, বাড়ির বড়বউ হিসেবে তাকেঁই চতুর্দিক সামলাতে হয়। তারা বরং তাঁর কোলেরগুলোকে সামলায় যখন তিনি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

তবে, পরপর সন্তানের জন্ম দেবার কারণে দীনময়ীর মনে একটা গর্ব হয়, এককালে যাঁরা তার মাতৃত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেন, তাঁদের মুখে ভালো মতো ঝামা ঘষে দেওয়া গেছে। এটাই বা কোন কম সুখের জিনিষ? উল্টে তো এও মনে আসে; তাঁর স্বামী যে সিংহপুরুষ, তা তো প্রমাণ করে ছেড়েছেন। কথায় কথায় একদিন তা প্রকাশও করে ফেললেন । রসিকতা করে স্বামীকে বললেন, আপনি যে সিংহপুরুষ, তা এখন লোকে ভালই বুঝতে পারছে।

ঈশ্বরচন্দ্র কথাটা ধরতে পারলেন না।  প্রশ্ন করলেন, তার মানে?

-মানে আর কী? এই যে পরপর একটার পর একটা সন্তান উদপাদন করে যাচ্ছেন, তাতে কি মনে হয় না, আপনি কেশরবিহীন সিংহ?

-হা হা হা। কত মস্করাই করেত জানো, দীনময়ী।

-হ্যাঁ, মস্করা বুঝি আপনি একলাই করতে জানেন?

-তা বলি কী, আমাকে সিংহ বানালে, তুমি কী? সিংহী হলে না?

-সে হলে তো ভালই হোত। বারবার সন্তান বিয়োনোর হাত থেকে রেহাই পেতাম। একবারেই সবকটার জন্ম দিয়ে দিতাম।

ফের হাসি ঈশ্বরচন্দ্রের। আজ কী হয়েছে দীনময়ীর? ঈশ্বরচন্দ্র ভাবলেন। প্রকাশও করলেন তাই। দীনময়ী কিন্তু এবার হাসিতে লাগাম লাগিয়ে তোপ দাগলেন। বললেন, আগেও আপনাকে বলেছিলাম, আবার বলছি, নারায়ণকে আর এখানে ফেলে রাখবেন না। ওকে আপনার কাছে নিয়ে গিয়ে শহরের ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিন। আমার কিন্তু ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে…

-কেন? চিন্তা কেন?

ঈশ্বরচন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়ল। ছেলে কি কিছু অন্যায় করছে? হতে পারে, বড় হচ্ছে। মা হয়ে দীনময়ী একলা ছেলের দিকে নজর দিতে পারছে না। তাই কি চিন্তা?

দীনময়ী ব্যাপারটা খোলসা করে যা বললেন, তাতে ঈশ্বরচন্দ্রের অবশ্য সায় পেলেন না। তিনি বলেছেন, বাবা নারায়ণের মাথা খাচ্ছেন।

-তাই নাকি? আচ্ছা, এই নিয়ে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলবখন। ঠিক আছে?

-হ্যাঁ, আপনার যা বুদ্ধি! এই নিয়ে কথা বলবখন…

মুখ বেঁকিয়ে কথাটা বললেন দীনময়ী। পরে অবশ্য অন্য কথা যোগ করলেন, আপনি এ কথা বাবাকে বলুন, আর আমার পিণ্ডি চটকানো হোক। ওহ, কী কুক্ষণে যে আপনাকে বললাম।…কিচ্ছু বলতে হবে না…

দীনময়ী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মাঝ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বলে উঠলেন, বুদ্ধি আমার যা? নাকি তোমার? এটুকুও বুঝলে না, বাবাকে আমি কথাটা অন্যভাবেও বলতে পারি?

-ঘাট হয়েছে। আপনি যা ভালো বোঝেন, তাই করবেন। তবে নারায়ণকে আপনি কলিকাতায় নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করান।

দীনময়ী ঘর ছেড়ে নিচে চলে গেলেন। একটু পরেই সন্ধ্যে হবে। ভগবতীদেবী সন্ধ্যাবাতি দেবেন। বউদের তখন গলায় কাপড় দিয়ে ঠাকুরঘরের সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। এটাই এ বাড়ির নিয়ম। যদিবা দীনময়ী আপাতত তা থেকে বাদ। তবু তাঁকে ঠাকুরঘরের ধারেকাছে থাকতে বয় বৈকি।

 

তখনকার মতো নারায়ণ প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র ঠিক সুযোগ বুঝে পরের দিন বাবাকে ধরলেন। ঠাকুরদাস বাড়ির উঠোনে বসে গড়গড়া টানছেন। বিকেল গড়াবে গড়াবে করছে। দিনের আলো  কমে আসছে। পাখীরা ঘরে ফিরছে। গাছের ডালে ডালে বসে কিচিরমিচির শব্দ করছে। সঙ্গীকে খুঁজছে। একটু পরে চুপ করে যাবে। এই সময়টা ঠাকুরদাস এভাবেই বাইরে বসে সময় কাটান। তার সামনে বাড়ির বাচ্ছারা খেলা করে। তিনি  নজর  রাখেন। কখনও সখনও ভগবতীদেবীও পাশে এসে বসেন। দুজনের নানান আলাপ আলোচনা চলতে থাকে। সাংসারিক কথাবার্তা। তা বাদ দিয়েও, জীবনের নানা সুখ দুঃখের দিনের স্মৃতিচারণ চলে। আজ অবশ্য ভগবতীদেবী সেখানে অনুপস্থিত। ঈশ্বরচন্দ্র তা দেখে নিয়েছেন। বাবার পাশে গিয়ে বসলেন তিনি। আরামকেদারাটা পাতা ছিল। সেটাতে বসলেন। একথা সেকথা চলতে থাকল। সুযোগের অপেক্ষা করছেন। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার  কথা উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র বলে উঠলেন, আমি তো জানি, আপনি নিরামিষাশী। মাছ মাংস পেঁয়াজ রশুন খাওয়া অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন।

ঠাকুরদাস ঈশ্বরচন্দ্রের দিকে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন, কেন? এ প্রসঙ্গ আসছে কেন?

-না, ইদানীং আপনি আমিষও ভক্ষণ করছেন দেখছি।

ছেলের হেঁয়ালি বুঝে উঠতে পারছেন না ঠাকুরদাস। বললেন, এ সংবাদ তুমি পেলে কোথা থেকে? কে তোমাকে বলছে এসব কথা?

-কেউ বলেনি। আমিই বলছি। আপনি আপনার নাতির মাথা খাচ্ছেন।

-হো, হো, হো।

হেসে  ফেললেন ঠকুরদাস। -আরে বাবা, একটাই নাতি, তাকে যদি একটু আধটু প্রশ্রয় না দিই, সবসময়েই যদি তার সামনে গুরুগম্ভীর হয়ে থাকি, তো চলবে? ও তুমি এখন বুঝবে না। বয়স হোক, দেখবে আসলের থেকে সুদ বেশি মিষ্টি।

-বাবা, আমি নারায়ণকে কলিকাতায় নিয়ে যেতে চাই। ওখানে রেখে পড়াশোনা করাবো বলে স্থির করেছি। এতে আপনার কী মত?

ঠাকুরদাস চুপ করে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের ওপর বরষার মেঘের ছায়া নেমে এলো। উদাস হয়ে গেলেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন অদূরের গাছগুলোর দিকে। চোখের মনি স্থির।

ঈশ্বরচন্দ্রের মনও ভেঙে যাচ্ছে। অথচ উপায় নেই। তিনি যে দিনময়ীকে কথা দিয়েছেন। এছাড়াও তিনি জানেন, বীরসিংহে শহর কলিকাতার মতো ইশকুল কলেজ গড়ে ওঠা সুদূরে; বা আদৌ তা কোনোদিন হবে কিনা। তাই সেখানে পড়ে নারায়ণের যে বিদ্যাশিক্ষা হবে, তা কি কোনোদিন নিজেদের বংশের সমকক্ষ হবে? যেখানে ছেলের বাবা, কাকারা, এক একজন বিদ্যারত্ন হয়েছে। শিক্ষার বিস্তার তো পরিবেশের ওপরেও নির্ভর করে। দীনময়ী নিশ্চয়ই সেসব বুঝেছে বলেই না, নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছে।

ঠাকুরদাসের এমন উদাস হয়ে যাওয়াকে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ধরে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, জানি, নারয়াণ দূরে চলে গেলে আপনার মন খারাপ হবে। কিন্তু বিষয়টা একটু ভেবে দেখুন।

-এই বিষয়ে ওর ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলেছ তুমি?

-বলিনি। তবে আপনি রাজী হলে তবেই বলব।

-দেখো ঈশ্বর, এতে রাজী না হওয়ার কিছু নেই। আমি বাধ সাধতে পারব না। কষ্ট হবে জানি। তবু আমি তোমার প্রস্তাবে সায় দিচ্ছি…

ঠকুরদাসের গলার স্বর ভেঙে আসছিল। চোখের কোলে জল এসে গেছে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে  বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন। একলা বসে রইলেন ঈশ্বরচন্দ্র । তাঁর মনের অবস্থাও তথৈবচ। বসে আছেন। এমন সময় সেখানে ভগবতীদেবীকে আসতে দেখা গেল। কাছে এসে তিনি বললেন, উনি আমায় পাঠিয়ে দিলেন। কী, কিছু বলবার আছে?

ঈশ্বরচন্দ্র বুঝেছেন, বাবা, বিষয়টাকে জিইয়ে না রেখে এখনই ফয়সালা করতে চান। তাই মাকে পাঠিয়ে দিলেন। নারায়ণের বিষয়টায় একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসবার জন্যে এমন একটা সুযোগকে ঈশ্বরচন্দ্র হাতছাড়া করতে চান না।  মাকে বসতে অনুরোধ করলেন। ঠাকুরদাসের ছেড়ে যাওয়া কেদারাটায় তিনি বসলেন। ভগবতীদেবীর কপালে চিন্তার ভাঁজ। ছেলে সচরাচর তো এসময়ে বাড়ি থাকে না। আর তা থাকলেও নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। তাহলে কিসের জন্যে এ তলব? তাও, ওর বাবার মাধ্যমে! তিনি চিন্তা করছেন। প্রশ্ন করলেন, -কী হল, তোমার বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন? কিছু বলবে?

-মা, বাবাকে একটা কথা বলাতে, বাবা রাজী হলেন দেখলাম। তবে তোর কী অভিমত তা জানাবার জন্যেই বোধ হয়, তোকে পাঠিয়ে দিল।

-ব্যাপারটা কি, একটু খুলে বল, আমি তো বুঝতে পারছি না…

ঈশ্বরচন্দ্র পুরো বিষয়টা সবিস্তারে মাকে জানাতে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মায়ের মন যে নারায়ণের প্রতি আরওই দুর্বল, ঈশ্বরচন্দ্রের তা বুঝতে অসুবিধা হল না। বুঝলেন, বাবা পুরুষ মানুষ হয়ে তাৎক্ষণিক যে আঘাত পাবার আশঙ্কাকে কষ্ট করে গলাধঃকরণ করেছেন, মা স্নেহময়ী নারী হয়ে তা পারলেন না। নারীহৃদয়ের চিরন্তন ব্রহ্মাস্ত্র অশ্রু, তা দিয়ে আগত আঘাতের আশঙ্কাকে প্রতিরোধ করবার প্রয়াস করছেন তিনি।

ভগবতীদেবী দুর্বল চিত্তের নন। তবে, আর পাঁচজন পিতামহীর মতো, তাঁরও যে পৌত্রের প্রতি অলঙ্ঘ্য আকর্ষণ তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। ঈশ্বরচন্দ্র একবার ভাবলেন, প্রসঙ্গটা এখনকার মতো না হয় বাদ রাখবেন। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ল, দীনময়ীর মুখ। সেও তো মা। অথচ সন্তানের ভালোর জন্যে কী দুর্দমনীয় অনাগত প্রত্যাঘাতকে বুক পেতে সহ্য করে নেবার ভরসায় সে এ কাজ করছে। তার মূল্য কি স্বামী হয়ে তিনি চোকাবেন না? আর তা যদি না করেন, তবে তিনি কোন সিংহপুরুষ? তাঁকে এ বিশেষণ তো দিনময়ীরই দেওয়া।

মনটাকে স্থির করলেন। মায়ের দিকে তাকালেন। ভগবতীদেবী তখনও কেঁদে চলেছেন। তিনি বললেন, তুই এত ভেঙে পড়ছিস কেন মা? আমার আট বছর বয়স থেকে তুইই কি আমাকে নিজের থেকে দূরে করে ছিলিস না?

-ওরে আমার একটাই যে নাতি…,

কান্না এবার সোচ্চার হল। বলতে থাকলেন, ওই কি পারবে আমার থেকে দূরে সরে থাকতে?

-আমিই কি পেরেছিলাম? কী কষ্ট হত। ঠাকুমাকে কাছে পেতাম না। দিনরাত তাঁর কথা মনে আসত।  জেগে জেগে রাত কাটাতাম। ঠাকুমার জন্যে আমার মন খারাপ করত। রায়মণি দিদিকে তো তুই জানিস। তাঁর স্নেহ পেয়েছিলাম বলে না, আমার দিন কেটেছিল। চিন্তা করিস না, আমি ওর যত্ন নোবো। মাঝে মধ্যে তো বাড়িতেও আসবে। তখন না হয় বেশি বেশি করে আদরযত্ন দিয়ে ওকে ভরিয়ে দিবি…

কথা শেষে ঈষৎ হাসলেন। মায়ের মন রাখার জন্যে তাঁকেও হাসাবার চেষ্টায় বললেন, তোর জন্যে তো আরও তিনজনকে রেখে দিয়ে যাচ্ছি। নাতির বদলে না হয় নাতনীদেরকে নিয়ে শুবি…

-থাক, তোমাকে আর পথ দেখাতে হবে না।

ভগবতীদেবীর মুখে হাসি না ফুটলেও কপট রাগের বিচ্ছুরণ ঘটল। তা বুঝেই ঈশ্বরচন্দ্র আরও প্রগলভ হয়ে বললেন, বুঝেছি, নারায়ণ বুঝি তোকে বশ করে রেখেছে…

হাসতে হাসতে ভগবতীদেবী উঠে যাচ্ছেন দেখে ঈশ্বরচন্দ্র মায়ের হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললেন, কী, জানিয়ে গেলি না, তোর পোষ্যটাকে ছেড়ে থাকতে পারবি কিনা?

-যা খুশি তাই কর তোরা। আমার কথা তো কেউ চিন্তা করিস না? নিয়ে যা। ছোঁড়টাকে ওর মায়ের বুক থেকেও কেড়ে নিয়ে যা।

এবার সত্যি সত্যি ভববতীদেবী কেদারা ছেড়ে উঠে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্রও আর তাতে বাধা দিলেন না। মন তার খারাপ হলেও সন্তুষ্টির একটা জায়গা খুঁজে পেলেন। বাবা, মা দুজনকে রাজী করিয়েছেন। এবার দেখতে চান, ছেলের মা কতখানি মন শক্ত করে ছেলেকে বিদায় জানায়। মাঝে তো আর মাত্র দুটো দিন।

 

মা, বাবা, দুজনাকেই রাজী করাতে পেরেছেন, কথাটা দীনময়ীকে জানাতেই তিনি দেখলেন, দিনময়ীর মুখটা বিবর্ণ হয়ে উঠল। সেও তো মা। আজ যখন সব বাধা দূর হল, তখনই মায়ের মন কেঁদে উঠেছে।

মা তার সন্তানের যতই কিনা ভালো চাক, কোন মা-ই বা পেটে ধরা সন্তানকে চোখের বাইরে রাখতে চায়? তবু রাখতে হয়। আর সেজন্যে মায়ের মনকে যে কতখানি কঠিন করতে হয়, তা একমাত্র সন্তানের জননীই বোঝে। সেখানে পুরুষের প্রবেশের অধিকার থাকে না। জননী তখন জগজ্জননী হয়ে একাধারে নিজেই নিজের সংহার মূর্তিতে বিচরণ করে; আবার হৃদয় নেংরানো বেদনা থেকে উৎসারিত পুষ্পবারিসম স্নেহ ভালবাসা, মায়া মমতা দিয়ে সন্তানকে আশীর্বাদ জানায়। মনে মনে উচারণ করে, যাও বৎসে, যাও। জীবন যুদ্ধে জিতে এসো।

 

দুটো দিন যাবত দয়াময়ী নারয়ণকে এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দিচ্ছেন না। সব সময়, -কোথায় গেলি রে? -ওরে নারায়ণ, আয় বাবা, আজ আমি তোকে খাইয়ে দিই। -ওরে তোর ওই জামাটা নিয়েছিস তো, ওই কাপড়খানা? –হ্যাঁরে, বাবার সঙ্গে যাচ্ছিস, মাকে ভুলে যাবি না তো?-বই পত্র গুছিয়ে দোবো, ওখানে গিয়ে বাবার কথা শুনবে কিন্তু…, – হ্যাঁরে, রাতে হিসি পেলে বাবাকে ডাকবি। একলা একলা কলঘরে গিয়ে হিসি করবি না। -বাবা, তোকে নতুন ইশকুলে ভর্তি করে দেবে, সেখানে মন দিয়ে পড়বি। দাদুকে কিন্তু পাবি না সেখানে…,

কত উপদেশ! কত চিন্তা! তার মাঝেই এতদিনের অভ্যাস, রীতি ভেঙে দীনময়ী নারায়ণকে তাঁর ঠাকুমার কাছে অনুমতি নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে শুলেন। একাবারে নিজের পাশটিতে। সারারাত ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমলেন। ঘুম কি আর হয়েছে? মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখার মতো চমকে চমকে উঠেছেন দীনময়ী। যেন দুঃস্বপ্ন দেখছেন। এই বুঝি ছেলে সেখানে গিয়ে কাঁদছে। পড়াশোনায় মন বসাতে পারছে না। বাবার কাছে বকুনি খাচ্ছে। এমনিতে তো ওর বাবা, আজ পর্যন্ত নিজের ছেলেকে নিয়ে পড়াতে বসেননি। তায় তাঁর এত কাজের মাঝে কি ছেলেকে পড়াতে গিয়ে মাথা ঠিক রাখতে পারছেন?

শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়লেন দীনময়ী। সারা রাত চিন্তা আর ভাঙা ভাঙা স্বপ্নে ঘুম হচ্ছিল না। ভোর হবার আগেই উঠে পড়েছেন। পাশে বসে নারায়ণের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। ঘুমন্ত ছেলের মুখে চুমু খাচ্ছেন। বারবার। নারায়ণ নড়েচড়ে উঠল। তারও বোধ হয় ঘুম হচ্ছিল না; নাকি মায়ের চুমুতে নিদ্রার ব্যাঘাত হওয়ায় সেও আধজাগা অবস্থায় উঠে দীনময়ীর গলা ধরে ঝুলে ঘুমে নেতিয়ে পড়ল?

ঈশ্বরচন্দ্র আজকাল অন্য পালঙ্কে শোন। তিনি এসবের কিছু  বুঝতে পারছিলেন না। তবে হঠাৎ তাঁর কানে কান্নার শব্দ আসায় চোখ খুললেন। দেখেন, দীনময়ী খাটের ওপর বসে রয়েছে। মুখ নিচু। তবে কি সে-ই কাঁদছে?

গায়ের চাদর সরিয়ে উঠে এলেন। দীনময়ীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। গায়ে হাত রাখতে দীনময়ীর চমক ভাঙল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামীর বুকে। হাউ হাউ শব্দে কান্না বেরিয়ে এলো তাঁর।  ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, এরকম ভেঙে পড়লে চলবে কেন, দীনময়ী? নিজেকে শক্ত করো। তুমি তো নারায়ণের ভালো চিন্তা করেই  দূরে পাঠাবার কথা বলেছ…

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page