উপন্যাস ।। আবার এসো ফিরে ।। রামেশ্বর দত্ত

  -এই বিদ্যেসাগর, তুই ঠিক বলছিস? নাকি ওই সাহেবের কথা শুনে আমাদেরকে মিছে কথা বলছিস?

  ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চীৎকার করে কথাটা বলে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্র আবার জানালেন, তাঁর বেশি চোট লাগেনি। লোকগুলো তাই সত্যি মেনে ইঞ্জিনে চড়ে বসা লোকদের ডেকে নামিয়ে নিল।  হুইসেল দিয়ে ট্রেন প্ল্যাটফরম ছাড়ল। গাড়ি চলে যেতে সবাই মিলে তাদের বিদ্যেসাগরকে কাঁধে চাপিয়ে হৈ হৈ করে নিয়ে চলল তাঁর আবাসে। তিনি যাচ্ছেন আর ভাবছেন, কী বিপদটাই না বাধিয়ে ছিলেন তাঁর এই অশক্ত শরীরে।                               বাসস্থানে এসে দিন কয়েক অভিরামের যত্নে শরীরে বল ফিরে পেলেন। নিজের নৈমিত্তিক কাজে লেগে পড়লেন।

পর্ব- ৩৬ 

   সেদিন তিনি বসে রয়েছেন নন্দনকাননের প্রশস্ত উন্মুক্ত জায়গাটায়।  ক’মাস এখানে ছিলেন না। তার মধ্যে অভিরাম জায়গটাকে একটা বাগিচায় পরিণত করে ফেলেছিল। তা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন।  সেখানে কত ধরণের ফুলের গাছ। অভিরামের কাণ্ড। গাছে গাছে শরতের ফুলে ফুটেছে। স্থানটা সুবাসিত হয়ে উঠেছিল। সময়টা শরৎকাল । সামনে দুর্গাপূজো। এবার আসবার সময়ে তিনি গাঁঠরি ভরে নতুন জামাকাপড় নিয়ে এসেছেন। সাঁওতাল পুরুষ-মহিলা-বাচ্চাদের মধ্যে  বিলি করবেন। এখন এরাই তাঁর মনের কাছের মানুষ।  নতুন জামা কাপড় পেয়ে এদের মুখে যে হাসি ফুটে উঠবে, তা তাঁকে অনাবিল আনন্দ দেবে। কলিকাতা, বীরসিংহ, সব ভুলে যাবেন। তাঁর কাছের লোকেদের প্রবঞ্চনা, শঠতা, অপমান, সব ভুলে প্রাণে নতুন আশা উদ্দীপনা নিয়ে বাঁচবেন।

-অভিরাম…, অভিরাম…, হাঁক পাড়লেন। সে ছিল ভেতরের ঘরে। বাইরে বেরিয়ে এল।

-কেন বাবু, ডাক্তেছিস কেন?

-অভিরাম, পূজো তো শুরুর মুখে। আজকেই কাপড়গুলো বিলি করে দিলে হয় না?

তাঁর কথায় অভিরাম কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল, বাবু, তোর শরীরে এখনও পুরো বল ফিরে আসেনি, এই অবস্থায় সাঁওতালরা এসে যে হট্টগোল পাকাবে তা কি তুই সামলাতে পারবি?

-খুব পারব। তুই এখনই ওদের খবর দিয়ে আয়। ওরা যেন আজ দুপুরে এসে ওদের জিনিষগুলো নিয়ে যায়। ছেলেমেয়েদেরও  সঙ্গে নিয়ে আসতে বলবি।

-ক’জনকে বলব?

-তুই যাকে যাকে মনে করবি এরকম পঞ্চাশ গরীব ঘরের মানুষকে খবর দিবি; বাচ্ছাদেরও যেন সঙ্গে করে আনে…, কথাটা আবার মনে করিয়ে দিলেন অভিরামকে।

-তুই এত কাপড় সঙ্গে করে এনেছিস, বাবু? সত্যি এই জন্যেই ওরা তোকে এত ভালবাসে। মান্যি করে। জানিস তো বাবু, অনেকে তোকে সত্যিই ঈশ্বর বলে মানে…

-আমার নামই তো তাই রে, বোকা।

-না রে বাবু,  সে ঈশ্বরচন্দ্র নয়। ভগবান, ভগবান…

-ও তাই বুঝি? আচ্ছা, এখন যা। আর যা কাজ বললাম, তাই করে আয়।

-ঠিক আছে বাবু। হাতের কাজটা সেরে নিয়েই যাচ্ছি। দেখবি ওরা দুপুরে বললে, এখনই এসে তোর ঘরের সামনে লাইন দিয়ে বসে থাকবে।

-আচ্ছা, আচ্ছা। সে দেখা যাবেখন। কাজটা তুই আগে করে আয়।

বাবুর কথা মতো অভিরাম কাজ করল। বেছে বেছে সে গরীব থেকে গরীব পরিবারের লোকজনকে খবরটা পৌঁছিয়ে দিল। তার তো এ অঞ্চলটা চষা রয়েছে। ঠিক জানে, কে বাবুর আনা নতুন কাপড় পাবার যোগ্য। তাই ভুল হওয়া তার সম্ভব নয়।

সত্যিই দেখা গেল, অভিরামের কথাই সঠিক। দুপুরের আগেই ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ির চাতালে ভিড় জমে গেল। পুরুষ, নারী, কাচ্চা-বাচ্ছা এসে লাইন দিয়ে বসে পড়েছে। তাদের পরণে শতছিদ্র পোশাক। অথচ মুখে প্রগাঢ় প্রশান্তি; কী? না, বাবু তাদের নতুন জামা কাপড় দেবে। চাতাল জুড়ে বসে রয়েছে তারা।

দিনের খাওয়া সারা হতে ঈশ্বরচন্দ্র তাদের সামনে এলেন। অভিরাম একটা চেয়ার এনে দিল। তিনি বসলেন। লোকগুলো তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে। যেন সত্যিই কোনও ভিনগ্রহের মানুষকে তারা দেখছে।

ভিক্ষান্নে যাদের পেট ভরে, ভিক্ষাবস্ত্রে যাদের লজ্জা নিবারণ হয়, তাদেরকে ডেকে এনে নতুন কাপড় জামা দেবে, এ যেন তাদের চিন্তার বাইরে। যে এ কাজটা করবে, সে তাদের কাছে ঈশ্বর ব্যতীত অন্য কে হতে পারে?

ঈশ্বর তো তার মধ্যেই বিদ্যমান, যে কিনা দয়ার প্রতিমূর্তি; যার দয়া কোনও প্রতিদানের অপেক্ষা রাখে না, -অবশ্য এত গূঢ় কথা ভাববার মতো শিক্ষা বা জ্ঞান এই গরীব সাঁওতালগুলোর আছে কিনা, কেউ জানে না। ঈশ্বরচন্দ্রের ভাবনাতেও এত দরাজ কথা আসবার নয়; তবে এদের জন্যে কিছু করতে পেরে যে তিনি পরমতৃপ্তি পাচ্ছেন, তা যে তাঁর ঈশ্বরীক রূপে প্রকাশ পাচ্ছে, তা আর না বলে দিলেও চলে।

অভিরাম ঘাড়ে করে কাপড়ের মুখ বাঁধা গাঁটরিগুলো ঘর থেকে এনে ঈশ্বরচন্দ্রের হাতের সামনে রাখল। বাঁধন খুলতে থাকল একটার পর একটা গাঁটরির। চকচকে নতুন কাপড় গাঁটরির আড়াল থেকে মুখ বার করল । বাচ্ছা বুড়ো করে অনেকে ঝুঁকে  পড়ল সেগুলো দেখতে। যারা বুঝদার শিশু, তাদের মুখ হাসিতে ভরে উঠল। কেউবা হাত তালিও দিল। ঈশ্বরচন্দ্র হাত নাড়িয়ে একজনকে সামনে ডাকলেন। অনেকে একসঙ্গে হুড়মুড় করে এগিয়ে আসছিল। -এই্‌, সব জায়গায় বসে থাক, কেউ উঠবি না, করে, অভিরাম জোর ধমক লাগাতে সুড়সুড় করে সব সরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়ল।

এগিয়ে আসা  শিশু ছেলেটিকে ঈশ্বরচন্দ্র হাত বাড়িয়ে একটা জামা দিলেন। হাসতে হাসতে সে তা নিয়ে জায়গায় ফিরে গিয়ে বসল। পরের জনকে ডাকলেন। একটি মেয়ে শিশু। তাকে শাড়ি দিলেন। তা নিয়ে সে আবার হাত বাড়াল। কী? না, তার বাপের জন্যে পোশাক চাইছে।

-কার মেয়ে গো?

  ঈশ্বরচন্দ্র জানতে চাইলেন। ভিড়ের মধ্যে থেকে এক রমণী উঠে দাঁড়িয়ে জানান দিল, তার মেয়ে। সে আরও বলল,- ওর বাপ জঙ্গলে কাঠ আনতে গেছে গো, বিদ্যেসাগর। তাই মেয়েকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে, বাপের কাপড়টাও মেয়ে যেন নিয়ে আসে।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, বাপ আসলে আমার কাছে পাঠিয়ে দিবি। এভাবে মেয়ের হাত দিয়ে বাপের কাপড় আমি দেবো না।

রমণী কাকুতি জানিয়ে বলল, দিয়ে দেয়ে না, বিদ্যেসাগর। অর বাপের একটা বই দুটো কাপড় নেই।

-বলছি তো, বরকে পাঠিয়ে দিবি।

-তাহলে, একটা কাপড় রেখে দিস ওর বাপের জন্যে।

অন্য কেউ একজন বলে উঠল, ওরে রাখবে রাখবে। বিদ্যেসাগর যখন একবার দেবে বলেছে, তা সে যেখেন থেকেই হোক দেবে।

মেয়েটিকে কাছে ডেকে নিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। এক দুগ্ধ পোষ্য হাড় গিলগিলে শিশুকে নিয়ে রমণী উঠে এলো। খুবই অল্প বয়স। মেয়ে বললেই চলে। তবে এরমধ্যেই সে দু দুটো সন্তানের জননী হয়ে গেছে। ঈশ্বরচন্দ্র একটু অবাক হলেন। প্রশ্ন করলেন ,কত বয়স হল তোর?

সে হাসতে হাসতে জবাব দিল, ইটা তো জানি লাই গো, বিদ্যেসাগর। হবে বটে চোদ্দো-পনেরো।

-এই বয়সে দুটো বাচ্ছা বিইয়েছিস? খাওয়াবি কী?

মেয়েটা হাসতে থাকল। ঈশ্বরচন্দ্র এবার মেয়েটার কোলের শিশুটাকে হাত বাড়িয়ে নিজের ক্রোড়ে নিলেন। হাতে নিয়েই বুঝলেন, অপুষ্টির কারণে এই শিশু ক’দিন বাঁচবে, তার ঠিকানা নেই। বললেন, কী অবস্থা করেছিস ছেলের? বাচ্ছাকে বুকের দুধ দিস না?

মেয়েটা আরও লজ্জা পেল। ঈশ্বরচন্দ্র দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করায়, মেয়েটি উত্তর দিতে বাধ্য হল। বলল, দুধ লাই বুকে।

ভিড় করে থাকা মহিলাদের মধ্যে থেকে কয়েকটা অল্পবয়সী মেয়ে হি হি করে হেসে উঠল। জোরে ধমক দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। চুপ করে গেল তারা। কাছে ডাকা মেয়েটিকে বললেন, তুই আমার এখানে বসে থাক।

মেয়েটির অপর বাচ্ছাটির মাথার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, তোর এই মেয়েটারই বা কী অবস্থা করে রেখেছিস? ওর মাথার চুলে তেল দিস না কেন?

মেয়েটি মুখ নিচু করে রইল।

-তোরা দুজনেই বস, বলে, ঈশ্বরচন্দ্র অভিরামকে নির্দেশ দিলেন ঘর থেকে তেলের শিশি নিয়ে আসতে। অভিরাম স্থান ছেড়ে গেল।

তিনি অন্যদের কাপড় বিলি করতে শুরু করলেন। একে একে সকলকে কাপড় দিতে থাকলেন। পুরুষদের দিচ্ছেন ধুতি গেঞ্জি ; মেয়েদের শাড়ি, পেটিকোট। বাচ্ছাদের জন্যে ইজের, জামা অথবা জামা আর প্যান্টুলুন। যেমন যেমন হাতে উঠছে, তেমনটাই দিয়ে কাপড় দেওয়া শেষ করলেন। এরপর ধরলেন পাশে বসা শিশুটার মতো অন্য আরও কয়েকজন ছোট এবং একটু বড় মেয়েদের। তেলের শিশি খুলে তাদের কেশ পরিচর্যায় লাগলেন।

শেষে মেয়েদের মা অথবা বাবাকে ডেকে হাতে একটা করে আধুলি পয়সা তুলে দিয়ে বললেন, এই পয়সা অন্য কিছুতে খরচা করবি না; মাথার তেল কিনে মেয়েদের চুলের যত্ন নিবি। নাহলে, মেয়ের মাথায় খুস্কি জমে সব চুল নষ্ট করে দেবে। মেয়ে বড় হলে সে মেয়ের আর বিয়ে দিতে পারবি না।

তারাও হৃষ্টচিত্তে পয়সা হাতে নিয়ে কথা দিল, মেয়ের চুলের যত্ন নেবে। ঈশ্বরচন্দ্র বয়স্কদের হাতে দু টাকা করে পূজো বকশিসের অর্থ দিয়ে সকলকে বিদায় দিলেন। টাকা, নতুন কাপড় জামা নিয়ে কলকল করতে করতে পরম আনন্দে তারা বাড়ি ফিরে গেল। অসীম শান্তি পেলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

কর্মাটাঁড়ে আসলে ঈশ্বরচন্দ্রের এ ধরণের কাজের শেষ থাকে না। সেদিন হল কী, তাঁর হোমিওপ্যাথির দাতব্য চিকিৎসালয়ে বসে রয়েছেন বাঙ্গালিটোলার কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে। এক সাঁওতাল একটা জ্যান্ত মুরগী নিয়ে সেখানে এসে ঢুকল। দু পায়ে দড়ি বাঁধা নিচের দিকে  মুখ করে ঝোলানো মুরগীখানা চোখ উল্টে ঘাড় তুলে ঝুলছে। চিকিৎসালয়ে লোকটাকে ওভাবে ঢুকতে দেখে উপবিষ্ট তিন বাঙালির একজন কৌতুক করে ঈশ্বরচন্দ্রকে বলে উঠলেন, নিন, এবার বোধ হয় মুরগীর চিকিৎসাও আপনাকে করতে হবে।

ঈশ্বরচন্দ্র হেসে জবাব দিলেন, আপনাদের দেশ না হয় আমায় মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পশু চিকিৎসক করেও গণ্য করবে এবার থেকে।

হো হো শব্দে তিনজন হেসে উঠলেন। লোকটা থতমত খেয়ে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে করে একেবারে মুরগি হাতে নিয়ে এসে পড়লে যে বাপু?

-বিদ্যেসাগর, মুরগিটা তুই দুটাকা দিয়ে কিনে নেয়ে।

সাঁওতালের কথা শুনে তো ঈশ্বরচন্দ্র আকাশ থেকে পড়লেন। কপালে চোখ তুলে বললেন, আমি মুরগী কিনব কেন?

-কেন, তুই এটাকে মেরে খাবি বটে…

-ওরে, আমি ব্রাহ্মণ, বলে, ফতুয়ার তল থেকে উপবীতটা বের করে এনে বললেন, এই দ্যাখ, আমি কি মুরগী খেতে পারি? আমি নোবো না। তুই তোর মুরগী ফিরত নিয়ে যা।

-না। তুই নিবি। আমাকে দুটো টাকা দিবি।

  সাঁওতাল নাছোড়বান্দা হয়ে ঘরের মেঝেতে বসে পড়ল। ঘরে উপস্থিত বাঙালিবাবুরা লোকটাকে খেদাতে উঠছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বারণ করলেন তাঁদের। ধুতির কোঁচর থেকে দু টাকা বের করলেন। লোকটার হাতে টাকা দিয়ে মুরগীটা নিজের হাতে নিলেন। বাকিরা সব হাঁ।  ঈশ্বরচন্দ্র কী করতে যাচ্ছেন, কিছুই বুঝতে পারছিল না।

সাঁওতাল দুটো টাকার বিনিময়ে তার মুরগীটাকে ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে গছিয়ে দিয়ে স্ফূর্তি দেখিয়ে চলে গেল। যাবার আগে ঈশ্বরচন্দ্রের দু হাঁটুতে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। লোকটা যখন বাড়ির বাইরে চলে গেছে, ঈশ্বরচন্দ্র চিকিৎসালয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে মুরগীটাকে ছেড়ে দিয়ে হুস হুস শব্দে উড়িয়ে দিলেন। মুরগী ছাড়া পেয়ে কঁ কঁ শব্দ তুলে উড়ে গিয়ে সামনের গাছের ডালে চড়ে বসল। তিনি ঘরে ফিরে এসে বসলেন এবং আগের মতোই স্বাভাবিক কথা বলা শুরু করলেন আগন্তুদের সঙ্গে। বাঙালীবাবুদের একজন বলে উঠল, এটা আপনি কী করলেন?

হাসতে হাসতে ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, যার জিনিষ তার কাছেই তো পাঠিয়ে দিলাম। পারলে ধরে নিক…

জবাব এলো, সাঁওতালগুলো ভারি বদ। এভাবেই আপনাকে ঠকিয়ে ওরা পয়সা আদায় করবে। সাবধানে থাকুন।

গৃহকর্তার আবার হাসি । বললেন, না, না মশাই। শহরের লোকের শঠতা অন্তত এদের মধ্যে নেই। দেখুন গিয়ে, সাঁওতালটার হয়তো সত্যিই টাকার দরকার হয়ে পড়েছে।

-তাই বলে, এভাবে…!

-তবু তো কিছুর বিনিময়ে সে টাকা নিতে এসেছিল। আর শহরের লোক…, যাক, সেসব কথা থাক।

-আপানার গুণের মহিমা লোকগুলো বুঝে গেছে। তা আর কী করার আছে। আপনি মশাই এদের স্বভাবটা খারাপ করে দিচ্ছেন।

হঠাৎ ঈশ্বরচন্দ্র চুপ হয়ে গেলেন। ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। বাক্যালাপের উৎসাহ হারালেন। বলে বসলেন, বেলা পড়ে যাচ্ছে, অভিরাম আমাকে তাড়া লাগাবে স্নানের জন্যে।…আপনারা তাহলে এখন আসুন।

অগত্যা তিন বাঙালীবাবু নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচায়ি করল। অনিচ্ছা স্বত্বেও উঠে পড়তে হল। ঠকাঠক চেয়ার সরানোর শব্দেই বোঝা গেল, এমন নিঃশব্দ কণ্টকিত অপমান তাঁদের গায়ে ভালই ফোস্কা ফেলেছে।

                                (৪০)

   কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। ঈশ্বরচন্দ্রের হল সেই দশা। কর্মাটাঁড়ে এসেছিলেন কলিকাতার ভার মুক্ত হয়ে। কলেজের নতুন বাড়ি হচ্ছে, সেখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির নির্মাণকাজ তদারকি করা তাঁর কাজ নয়। বাড়ির নকশা তৈরী হয়েছে। করিয়েছেন ইংরেজ স্থপতিবিদকে দিয়ে। টাকার জোগাড় তিনি দিয়ে যাচ্ছেন। সময় সময়ে তাতে টান যে পড়ছে না, তা নয়। তবে, নির্মাণ কাজ যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্যে বাজার থেকে টাকা কর্জ করেও তার জোগান বজায় রাখছেন।

সবটাই হচ্ছিল কর্মাটাঁড়ে বসে। আর এখানে সাঁওতালদের উন্নতি কল্পে কাজ করে যাচ্ছেন মনপ্রাণের আনন্দে। কিন্তু ভগবানের তা বুঝি সহ্য হল না। কলেজ চালানোর ভার তো তিনি দিয়ে এসেছিলেন সেজ জামাতা সূর্যকুমারের হাতে। যোগ্য ব্যক্তি সূর্যকুমার। কলেজ সেক্রেটারী পদে নিয়োগ করে দু বছরের মাথায় অধ্যক্ষ করে বসিয়ে সমস্ত কাজের ভার তাঁর ওপরে দিয়ে চলে এসেছিলেন। কিন্তু এখন সেখানেই আবার নজর দিতে হল!

মেট্রোপলিটন কলেজের হিসেবে নাকি কিছু গরমিল ধরা পড়েছে। সেরকমটাই খবর এল তাঁর কাছে। মন ভেঙে গেল। যে সুখশান্তি নিয়ে কর্মাটাঁড়ে দিন কাটছিল তাতে বাধা পড়ল। স্থির থাকতে পারলেন না। ভাঙা শরীর নিয়ে আবার সেই কলিকাতাতেই ফিরতে হল।

বাদুরবাগানের বিশাল বাড়িটায় তিনি একলা। চাকর দিয়ে রান্না খাওয়া চলছে। ভাবছেন, সূর্যকুমারকে নিয়ে কী করবেন। কানে যখন এমন একটা অন্যয়ের কথা এসেছে, চুপ করে তো বসে থাকা যায় না। এর কিছু একটা বিহিত করতেই হয়। অভিযোগটা যদি সত্যি হয়, তাহলে আর এক মুহূর্তও সূর্যকে সেখানে রাখা নয়।

বিনোদিনীর মুখটা মনে পড়ল। আজ যদি জামাতার কিছু একটা বিপরীত করে দেন, তো মেয়েটার কী দুরাবস্থা হবে? অবশ্য অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবার মানুষ যে তার বাবা নয়, তা বিনোদিনী ভালো মতো জানে। তবে, তাকে ডেকে আগে থেকে সব জানিয়ে দেওয়াটাই সমীচীন হবে। তার আগে সূর্যর ব্যাপারটা কলেজ থেকে আরও ভালো করে জেনে নেওয়া দরকার।

সেদিন কলেজে গেলেন। সকলেই তটস্থ। এতদিন পর আবার কলেজ সম্পাদকমণ্ডলীর সভা বসেছে। সভা শুরু হতে ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নিজের কিছু কথা ব্যক্ত করলেন। তার মধ্যে তাঁর নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা বাদ দিলেন না। দুঃখের সঙ্গে সেসব জানিয়ে বললেন, আমার এই দুঃসময়ে আমি কলেজের অনেক কিছু শুভ ভেবে তবে পা বাড়িয়েছিলাম। সকলেই দেখছে, কলেজকে  নতুন বাড়িতে তুলে নিয়ে প্রতিষ্ঠা দেবার  জন্যে আমায় কী ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। বহু অর্থ কর্জ করতে হচ্ছে। এই সময়ে আমি চেয়েছিলাম, কলেজের প্রতিজন শিক্ষক, অধ্যক্ষ আমার পাশে এসে দাঁড়াবে। তা না হয়ে, আজ খোদ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে। তাতে আমি যেমন মর্মাহত হয়েছি, তেমনই যার-পর- নাই লজ্জিতও। এ সম্বন্ধে আমি সত্যকে যাচাই করতে চাই। এতে আপনাদের কী অভিমত?

সভার প্রতিটি সদস্য চুপ। কেউ কিছু বলছে না। তা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র আবার বললেন, আপনারা নিরুত্তর থাকবেন না। তাতে আমার কাজটা দুরূহ হয়ে পড়বে। কিছু বলুন।

-আপনি যা ভাল মনে করেন, তাই করবেন।

সকলের মধ্যে থেকে একজন কথাটা বলে উঠল। জবাবে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এতো সহজ কথা। কিন্তু আমি জানতে চাই সত্যটা কী?

-অধ্যক্ষকেই না হয় চিঠি দিয়ে তা জানাতে বলা হোক। তিনি নিজে কী বলেন, তা দেখে তারপর বিচার করা যাবে।

অপর একজনের কথায় অন্য সদস্যরা সকলে সায় দিল।

-সেটাই বরং ঠিক। ঘটনাটা তবে সেভাবে এগোক। ততদিন অধ্যক্ষ সূর্যকুমার অধিকারীকে ছুটিতে যেতে বলা যাক?

-তার কি খুব প্রয়োজন আছে, বিদ্যাসাগর মশাই?

-আমার অভিমত তাই। কারণ, অভিযোগের সারবত্তা খুঁজতে গেলে আমাদেরকে হিসাবপত্রের ছানমিন করতে হবে। তা তো ওঁকে পদে রেখে হবে না?

-কিন্তু সেটা কি একটু চরম ব্যবস্থা হয়ে যাবে না? দোষ তো এখনও প্রমাণিত হয়নি…

-দোষ প্রমাণিত হয়নি বলেই তো ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে; হবার পর তো তাঁকে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে, মশাই।

-সূর্যকুমার বাবু আপনার আপনজন, বিদ্যাসাগর মশাই। তার জন্যে এতখানি কঠোর শাস্তি ভেবে বসে রয়েছেন আপনি?

কথাটা যে বলল সে ঈশ্বরচন্দ্রের সুহৃদ হলেও পশ্চাতে তাঁর সমালোচনা করতে ছাড়ে না। ঈশ্বরচন্দ্র তা ভাল মতো জানেন। আর জানেন বলেই, তাঁর কথার যথাযথ উত্তর দিয়ে বললেন, আপনজন বলে তো আমি ভুলটাকে মেনে নিতে পারি না? দোষ করলে তাকে শাস্তি দিতে হয়। এই আমার নীতি।

ভদ্রলোক একটু অপ্রস্তুত হয়েই বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে তো আপনি আপনার নীতি কথা বইতেই গোপালের মায়ের কান কামড়ানো, গল্পে শুনিয়েছেন।

-শুধু গল্পে শুনিয়েছি, তা নয়; নিজের জীবনেও তার দৃষ্টান্ত রেখেছি, সে তো  সকলেই জানে। যাক, তাহলে, আজকের সভায় এই ঠিক হল, প্রথমাবস্থায় সূর্যকুমারকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হোক। চিঠির উত্তর এলে তা বিচার করে যথপোযুক্ত ব্যবস্থা নেবার জন্যে আবার আমরা বসছি। আজ তাহলে সভা এখানেই শেষ করি।…ও, আর একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমার ইচ্ছে সামনের বছরের প্রথম দিনে কলেজ নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত করব।

-ঠিক ঠিক। কলেজে যে হারে ছাত্র বাড়ছে…

বলতে বলতে সকলে প্রস্থান করল। এবং দুদিনের মাথায় সূর্যকুমারকে চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হল। কলেজ সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্রই চিঠিতে স্বাক্ষর করলেন।

 

বিনোদিনী এসেছে তার দুই মেয়ে নিলিনী, সরযূ, আর ছেলে, সুকুমারকে সঙ্গে নিয়ে। বাবার ডাকে সে এসেছে। ঈশ্বরচন্দ্র জামাতাকেও আসবার জন্যে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তবে সে আসেনি। লজ্জায় হোক, বা ক্ষোভে, সূর্যকুমার শ্বশুরের সামনে আসেনি।

কতদিন পর নাতি নাতনীকে কাছে পেয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে ভারী আনন্দ হচ্ছে। ক্ষণিক সময়ের জন্যে হলেও তিনি চুটিয়ে আনন্দ করছেন ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে। শরীর নিয়ে পারছেন না; তবু বড় বাড়ির ওপর নিচ করছেন সকাল থেকে। একবার বাজারে গেলেন। মাছ মাংস সবজী নিয়ে এলেন। পরক্ষণেই চললেন ময়রার দোকানে। দই মিষ্টি কিনতে। সঙ্গে করে নাতিকেও নিয়ে যাচ্ছেন। যাচ্ছেন আসছেন পাল্কিতে। তবু তো শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। বয়স যেন অনেকটাই কমে এসেছে। আসলে, আজ বাদ কাল, দিনময়ীরও আসবার কথা। চিঠি দিয়ে তিনি এমনটাই জানিয়েছেন। সঙ্গে নিয়ে আসছেন, নারায়ণের ছেলে মেয়ে, মৃণালিনী, কুন্দমালা, মতিমালা আর প্যারীকে।  মেয়েগুলো বড় হয়ে গেছে। তারা তাদের মাকে ছেড়ে আসতে দ্বিধা করে না। তবে প্যারীরও একটু বয়স হয়েছে। তবু মাকে ছাড়া সে থাকে না সাধারণত। কিন্তু এখন যেহেতু তার দিদিরা আসছে, আর সঙ্গে ঠাকুমা রয়েছে, তাই সেও আসছে। ঈশ্বরচন্দ্রের এখন কটা দিন বেশ ভালই কাটবে। অথচ তার মধ্যে উটকো এসে পড়ল, জামাতার বিষয়টা। সেটা তাঁকে যে ভাবাচ্ছে না, তা নয়। আনন্দও করতে হবে, সাথে কর্তব্যকেও বাদ দেওয়া যাবে না। তাই ঈশ্বরচন্দ্র একদিন বিনোদিনীকে ডেকে নিয়ে বসলেন।

বিশাল বাড়িতে ঘরের অভাব নেই। সেখানে লাইব্রেরী  বাদ দিয়েও ওপর নিচ করে সাত-আট খানা ঘর।  এমন একটা বাড়িতে পরিবার, সঙ্গে মেয়েরা তাদের ছেলেপুলে নিয়ে এসেও হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারে, সেরকম ভাবেই বাড়ি বানিয়েছেন তিনি।

এখন ঈশ্বরচন্দ্র বসেছেন দোতলায় তাঁর নিজের ঘরে। ঘরের অবস্থান বাড়ির পূবদিকে। পূব, উত্তর, দুদিকেই জানলা কপাট। উত্তরের কপাট খুললে সামনে নজরে আসে শহরের প্রধান পথ। আর পূবের জানলা দিয়ে দূরের  শিয়ালদহ রেল স্টেশন; ফাঁকা ময়দানে ওপর। দুটি মাত্র লাইন দিয়ে ট্রেন যাওয়া আসা করে।

কিছুকাল আগে পর্যন্তও সেখানে বাষ্প চালিত ট্রাম গাড়ি এসে থামত। এখন তা বন্ধ হয়ে রেল স্টেশন হয়ে গেছে। ঈশ্বরচন্দ্র যখন একলা থাকেন সেসময় মাঝে মাঝে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে দূরের রেল লাইন দিয়ে ট্রেনের যাতায়াত দেখতে থাকেন। বাড়িটাকে ঘিরে শ্যমলীমার বাহার। সবুজ গাছে গাছে ভরা।

এই ঘরে তিনি একলাই থাকেন। দিনময়ী আসলে এক আধ দিন তাঁর সঙ্গে এক বিছানা ভাগ করে নেন।

তাঁর ঘরে বসেই বিনোদিনীর সঙ্গে কথা বলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। একথা, সেকথা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বিনোদিনীর শ্বশুর বাড়ির খবরাখবর বিষয়ে কথা বলে চলেছেন। বিনোদিনী উত্তর দিয়ে যাচ্ছে । সেও মঝে মধ্যে বাবাকে প্রশ্ন করছে। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর করছেন; কিন্তু আসল কথায় কিছুতেই আসতে পারছেন না তিনি।

ছেলেমেয়েরা বাড়ির ওপর নীচ বাগান করে খেলে বেড়াচ্ছে। তাদের মাকে বারবার উঠে গিয়ে  দেখে আসতে হচ্ছে, পড়ে-ঝরে যাচ্ছে কিনা। এমন একটা সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিনোদিনীর কাছে জানতে চাইলেন,  সূর্যকে আসবার কথা বলা সত্বেও সে কেন এলো না।

বিনোদিনী বলল, তা তো জানি না, বাবা। আমাকেই ছেলেমেয়ের সঙ্গে একলা পাঠিয়ে দিল। উনি বললেন, যাও, বাবা ডেকে পাঠিয়েছে। আমি ভাবলাম, তুমি বুঝি আমাকেই শুধু ডেকেছ।

-তা তো নয়। সেই কবে বিয়ের পর পর তোরা দুজন আমার কাছে থাকতিস। তারপরে এতগুলো বছর কেটে গেল, তোদের আর সেরকম ভাবে এনে আদর যত্ন করে রাখতে পারলাম কৈ?

-দুঃখ করছ কেন বাবা? মেয়েকে কি চিরকাল নিজের কাছে রাখতে পারবে? তখন  নতুন ছিলাম, বাসা ঘর ঠিক ছিল না, তাই কিছুকাল ঠাঁই দিয়েছিলে । পরে পত্র দেওয়া নেওয়ায় খবরাখবর হয়েছে। তাছাড়াও এখন তো আর সেদিন নেই? এখন আমার সংসার হয়েছে, ছেলেমেয়ে হয়েছে, উনিও ভালো উপার্জন করছেন, এখন আলাদা থাকব, সেটাই তো স্বাভাবিক, বাবা।

ঈশ্বরচন্দ্র দেখেলেন উপার্জনের কথা যখন উঠল, এই সুযোগ। তিনি বললেন, জানিস তো বিনু, কলেজে সূর্যর নামে  বদনাম রটেছে…

-কী বলছ বাবা! বিনোদিনী  আকাশ থেকে পড়ল। বলল, বদনাম! কৈ, উনি তো আমাকে এসব নিয়ে কিছু বলেননি?

-কেউ কি নিজের বদনাম নিজ মুখে বলে রে, মেয়ে?

-বাহ, আমি তাঁর স্ত্রী। আর আমাকে জানাবে না? কীসের বদনাম, বাবা?

-টাকা তছরুপের। কলেজের টাকা।

কথাটা শুনে চোখ বন্ধ হয়ে গেল বিনোদিনীর। কিছুক্ষণ সেভাবেই রইল। পরে চোখ খুলে বলল, বাবা, তোমার কিছু ভুল হচ্ছে না তো?

-বিনু, আমি তো চাই, আমিই ভুল হই। আর সেজন্যে তাকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে নিজের পক্ষে সাফাই দেবার। তোদের ডেকে পাঠানোও সে কারণে। তা, সে এলো কৈ? দোষ করেছে, তাই হয়তো লজ্জায় সে আমার সামনে আসতে পারল না। আসলে না হয়, একটা কিছু শলাপরামর্শ করা যেত। তবে যখন আসেনি, আমিও ধরে নিচ্ছি, যা রটেছে, তা সত্যি। আর তার ফলও তাকে ভোগ করতে হবে।

বাবার গলার আওয়াজেই বিনোদিনী বুঝল, বাবা বিষয়টাকে সহজভাবে নেয়নি।

তবু তিনি যখন আবার বললেন, দেখা যাক, চিঠির উত্তরে সে কী লেখে, বিনোদিনী সামান্য আশ্বস্ত হল।

ঈশ্বরচন্দ্র আবার বলতে থাকলেন, আমার মান অপমানের দিকটা একবারও সে ভেবে দেখল না? এই কি মানুষের সততা? নিজে আমি চিরকাল সৎ পথে থেকেছি। যাকে পেরেছি, উদ্ধারের পথ দেখিয়েছি, নিজের ভালো মন্দের দিকে কখনও তাকিয়ে দেখিনি। আর আজ কিনা…

কথার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র উত্তেজত হয়ে পড়েছিলেন। তাই দেখে বিনোদিনী প্রমাদ গুনল। বলল, তুমি শান্ত হও বাবা। আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।

-সে তুই বল। তবে জেনে রাখিস বিনু, অন্যায় যদি ও করে থাকে, আমি ওকে শাস্তি স্বরূপ কাজ থেকে অবসৃত করে দোবো।

-বাবা…,   বিনোদিনী কঁকিয়ে উঠল।

-তোর ভয় নেই বিনু। ওকে কাজ থেকে বসিয়ে দিলেও তোর, তোর ছেলেমেয়েদের  থাকা খাওয়া, পরা, মায় ওদের বিদ্যাভাসের জন্যে আমি খরচ চালিয়ে যাব। চিন্তা করিস না।

মুখে কাপড় চেপে কান্না রোধ করল বিনোদিনী। ঈশ্বরচন্দ্র উঠে এলেন। বিনোদিনীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, কর্মফলই মানুষকে ওপরে তুলে রাখে, আবার কর্মফলই মানুষকে পথে বসায়। তবে অপেক্ষা কর। সূর্য কী জবাব দেয় দেখা যাক। কলেজ পরিচালকমণ্ডলী কী সিদ্ধান্ত নেয়, তাও দেখার। যা। কাল তোর মা, ভাইপো ভাইজিরা আসছে, তাদের সঙ্গে মন খুলে আনন্দ কর। আবার বলছি চিন্তা করিস না; তোদেরকে জলে ফেলব না।

কথা না বাড়িয়ে বিনোদিনী সেখান থেকে উঠে গেল। পরে ঘরে গিয়ে মন খারাপ করে বসে রইল। কান্না এসে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে তা রোধ করে পরের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইল।

  নাতি নাতনীদের নিয়ে দীনময়ী এলেন। স্বামীর শরীর যে খারাপ, তা তিনি বীরসিংহে বসেই খবর পেয়েছিলেন। তাই মন খারাপ নিয়ে এসেছেন। এ যাত্রায় ওনার সেবায়  কিছুদিন কলিকাতায় থাকবেন, এমন মনস্থ করে এসেছেন। উপযুক্ত পথ্য দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তুলতে হবে। কারণ,  তিনি জানেন, কলেজকে নতুন বাড়িতে স্থানান্তরিত করবার জন্যে তাঁকে অজস্র পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বাচ্ছাদেরও ইশকুল পাঠাশালায় গরমের ছুটি রয়েছে। তাই অসুবিধে হবে না।

একদিন দুদিন করে সময় কাটছে। বিনোদিনী সেদিনের পর থেকে বাবার অনুরোধে এখানে থেকে গিয়েছিল। গরজ অবশ্য তারও আছে। মাকে দিয়ে বিষয়টায় ফয়সালা করাতে হবে।  দিন গুনছিল।

এই সময়েই একদিন সুযোগ বুঝে বিনোদিনী মায়ের কাছে কথাটা পাড়ল। মুষড়ে পড়লেন দীনময়ী। তাঁর স্বামী যে মানুষ, তাতে তাঁর পক্ষে সবই করা সম্ভব, মায় নিজের জামাতাকেও চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে তাঁর হৃদয় টলবে না, এ দীনময়ী ভালোই বোঝেন। সে কারণে মেয়েকে রেখেঢেকে আশ্বাস দিলেন। কথা দিতে পারলেন না। অথচ বিনোদিনী চাইছিল, মা-ই তাঁর স্বামীকে এ যাত্রায় উদ্ধার করুক।

এরপর থেকে দীনময়ী সুযোগ খুঁজছেন স্বামীর কাছে প্রসঙ্গটা পাড়বার।   সুযোগ আর আসে না। একদিন গেল। দুদিন পেরিয়ে গেল। তৃতীয় দিন মনস্থ করে বসলেন, আজ ধরবেনই তাঁর স্বামীকে। কারণ, বিনোদিনীর ফেরবার দিন এগিয়ে এসেছিল।

সেদিন কিছুটা আগেই দুজন আগন্তুক এসেছে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। বৈঠকখানায় বসে কথা বলছেন ঈশ্বরচন্দ্র। অনেক সময় ধরে আলোচনা চলছে। দীনময়ী বারবার বৈঠকখানায় চাকরকে পাঠিয়ে জানতে চাইছেন, বাবুর অতিথিরা আছে, না চলে গেছে। চাকর বার দুই এসে দেখে গেল, বাবু কথা বলছে বাইরের লোকেদের সঙ্গে। মাকে গিয়ে সেই খবর দিতে দীনময়ী তাকে বলে দিলেন, ঘরের সামনে বসে থাকতে, লোককে উঠতে দেখলেই যেন এসে খবর দেয় সে। চাকর তাই করল। মানুষ দুজনকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সে দৌড়ে ওপরে গিয়ে খবর দিল, মা ঠাকরুন, মনে হচ্ছে  মানুষ দুজন এবার চলে যাবে,..

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page