উপন্যাস।। আকাশ ভাঙে যখন।। সৈকত ঘোষ
|| দ্বিতীয় পর্ব ||
বাইকটা এখন আশিতে চলছে। পেছনের সিটে রাত্রি, অংশুকে টাইটলি জড়িয়ে। হাওয়ায় রাত্রির চুলগুলো কপাল থেকে গাল ছুঁয়ে যেন নিরুদ্দেশ ছুঁতে চাইছে। এই গতি এই হাওয়ার আলেখ্য রাত্রির বড়ো প্রিয়। তিরিশ পেরিয়েও হয়তো তাই আজও কোনও বন্ধনে বাঁধা পড়তে চায় না। হয়তো। নিজের শর্তে নিজের মতো করে বাঁচায় এক অদ্ভুত সুখ আছে। একটা অদৃশ্য কলার তোলা নেশা। নাহলে একটা আদ্যোপান্ত মফস্বলের মেয়ে এতোগুলো বছর কলকাতায় একা! মুখের কথা নয়। শুরুর দিনগুলো অবশ্য অন্যরকম ছিল। তখন সদ্য কলেজ পাস করে একটা স্বপ্নের তাগিদে কলকাতায় আসা। একদম অচেনা অজানা একটা শহর। স্বপ্ন পূরণ যে হয়নি তাই বা কি করে বলবে। এই দশ বছরে জীবনের গতিপথটাই তো বদলে গেল। সামান্য কনটেন্ট রাইটার থেকে আজ একটা অ্যাড এজেন্সির ক্রিয়েটিভ হেড। এই শহর আর এই শহরের বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা আর একটা শহর, মুখ আর মুখোশ দুটোকেই তো বড্ড ভালোবাসে রাত্রি। যে চ্যালেঞ্জটা নিয়ে হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়েছিল সেই চ্যালেঞ্জটাই তো দিনশেষে প্রতিদিন ওকে নতুন অক্সিজেন দেয়।
অংশুর সঙ্গেও তো বছর পাঁচ হয়ে গেল। এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক। ভালোবাসা আছে, কিন্তু কোনও কমিটমেন্ট নেই। লিমিটলেস আকর্ষণ আছে, বন্যতা আছে কিন্তু কোনও অভিযোগ নেই একে অপরের প্রতি। মাঝে মাঝে অংশুর চোখ দুটোর মধ্যে নিজেকেই দেখতে পায় রাত্রি। অংশু বলে ও নাকি রাত্রির আয়না। এসব ভাবতে ভাবতে মাঝে মাঝে ভাবনারাও তালগোল পাকিয়ে যায়। রাত্রি দু-হাত বাড়িয়ে হাওয়া মেখে নেয় শরীরে।
এই ঠিক করে ধরে বসো…
অংশুর কথায় হঠাৎ ঘোরটা ভেঙে যায়। রাত প্রায় সাড়ে নটা। আজ পূর্ণিমা। মাথার ওপর চাঁদ জেগে, কি এক অপার রহস্য ছড়িয়ে দিচ্ছে।
একটু স্লো চালাও। আর শোনো না বড্ড চা খিদে পেয়েছে…
ওকে হানিবানি, দু-মিনিট ওয়েট করো। সামনে একটা হেব্বি চা আছে, কেশর টি।
রাত্রি আলতো করে অংশুর কানে একটা কামড় লাগায়। এই আদরভাষা অংশুর জানা।
চা-টা খেয়ে সামনের কাউন্টার থেকে একটা সেভেন ফিফটি তুলে নিচ্ছি। বিপি চলবে তো?
অংশুর কোমরের কাছে একটা চিমটি কেটে রাত্রি বলে
দৌড়াবে…
কোলাঘাটের একটু আগে হাইওয়ের ওপরেই চরম সিং-এর ধাবা। এদিকে এলে এখানেই চা খায় অংশু। তন্দুরি টি থেকে মালাই কেশর, ভ্যারাইটিস চা পাওয়া যায় এখানে। আর প্রতিটাই জাস্ট চরম।
চায়ে চুমুক দিয়ে একটা সিগারেট ধারালো রাত্রি।
সত্যিই চা-টা চরম। মাথাটা পুরো ছেড়ে গেল।
এই জন্যই তো তোমাকে একটু ওয়েট করালাম। কাউন্টার দিও…
রাত্রি অংশুর মুখের ওপর ধোঁয়াটা ছেড়ে আর একটা সিপ নিলো চায়ের। তারপর একবার চাঁদটার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো…তারপর অংশুর দিকে সিগারেটটা এগিয়ে দিলো
আজ পূর্ণিমা না
হ্যাঁ, তো
একটা কথা বলবো…
বলো
সমুদ্রে যাবে…
এখন!
মনটা খুব সমুদ্র সমুদ্র করছে, প্লিইজ অংশু…
কাল তো অফিস যাচ্ছি না। তুমি পারবে…আর সাড়ে এগারোটার মধ্যেই তো পৌঁছে যাবো।
ওকে ট্রাই করছি
ট্রাই না, একবার হোটেল শান্তিনিকেতনে ফোন করে দেখো। তোমার তো সেটিং আছে…
অংশু হাসে, রাত্রির চোখে পড়ে নিতে চেষ্টা করে রাত্রিভাষা। আসলে এই জন্যই রাত্রি আর সকলের থেকে আলাদা। একদম আলাদা। রাত্রির এই পাগলামিগুলোই অংশুকে আরও বেশি করে ওর দিকে টানে। চটপট ফোন করে পুরো ব্যাপারটা সেট করে নিলো অংশু। মন্দারমনি শুটিংয়ে এলে ও এই হোটেলেই ওঠে। ম্যানেজার থেকে ওয়েটার সকলেই পরিচিত। আর তাই আলাদাই খাতির।
সো, প্ল্যান ডান। চলো রাতের ওষুধটা তুলেই…
অংশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর গালে চকাত করে একটা চুমু খায় রাত্রি। তারপর হেলমেটটা গলিয়ে বাইকে উঠে বসে।
আজ সারারাত চাঁদের সাথে গ্যালা খেলা হবে। মোবাইলটা ডু নট ডিসটার্ব মোডে দিয়ে একটা বড়ো নিশ্বাস নেয় রাত্রি। সমুদ্রের গন্ধ ফিল করার চেষ্টা করে। পূর্ণিমার উত্তাল সমুদ্র আর রাতের নৈঃশব্দ্য, সঙ্গে প্রিয় মানুষ। মন ভালো করার জন্য আর কি চাই।
সমুদ্রের একটা অদ্ভুত ম্যাজিক আছে জানো। আজ পর্যন্ত সমুদ্র আমাকে খালি হাতে ফেরায়নি। কলকাতায় আসা থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে এই অদ্ভুত সম্পর্কটা তৈরি হয়েছে। মনকেমন হলেই ওর কাছে ছুটে আসি। ওকে জাপটে থাকি। হাসি কাঁদি ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলি। একেই বোধহয় টান বলে। একটা সেই নেশা! কি যে শান্তি…
অংশুর বাহন মানে ওর নতুন অ্যাভেঞ্জার টু-টোয়েন্টি ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো ছুটে চলেছে হাইওয়ে দিয়ে। হাওয়ার বুকে এ যেন এক অন্য জীবনের নামতা। মাঝে মাঝেই এরকম নিরুদ্দেশ হতে ভালো লাগে অংশুর। না, নিজের থেকে পালানো নয়, নিজের মধ্যে আরও বেশি করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। এটাই কি রূপকথা! ছোটোবেলা থেকে এরকম নিজের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ হারিয়ে যাবার স্বপ্নগুলোই তো ওর কাছে অ্যাডভেঞ্চার। আর রাত্রির সঙ্গে পরিচয়! সেটাও তো একটা রূপকথার মতোই…
ঘড়িতে সাড়ে দশটা, রামনগর ক্রস করে দিঘা রোড ধরে নিয়েছে ওরা। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
রাস্তার ধারে বাইকটা দাঁড় করার অংশু। তারপর দুটো সিগারেট ধরিয়ে একটা রাত্রির দিকে এগিয়ে দেয়।
এই, এবার তো আইডিয়াটা বলো
রাত্রির চোখের দিকে তাকিয়ে একটা কোয়েশ্চেন মার্ক ছুঁড়ে দেয় অংশু…
শালা জাতে মাতাল তালে ঠিক। ঢ্যামনা কাহিকা…
রাতে সমুদ্রের সামনে বসে অ্যালকোলাহল করতে করতে পুরোটা বলছি। তার আগে একটু মাথায় সাজিয়ে গুছিয়ে নিই…
অংশু জানে রাত্রির এই থম মেরে থাকা মানেই ওর মাথার ভিতর রেসিপি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। পুরোটা ঠিকমতো রান্না না করে সার্ভ করার মেয়ে রাত্রি নয়। সুতরাং নিশ্চিন্ত মনে সিগারেটটা শেষ করে অংশু।
ডিনারে কি বলবো, জলদি বলো নাহলে আর কিছু পাওয়া যাবে না…
রুটি চিকেন বলে দাও। আর কি সঙ্গে আসল জিনিস তো আছেই…
দুটো পমফ্রেট ফ্রাই, পাঁচটা রুটি আর একপ্লেট কাড়াই চিকেন…ঝালটা একটু কম দেবে, বেশি স্পাইসি নয় আর সঙ্গে একটা গ্রিন স্যালাড…
হ্যাঁ, আর আধ ঘন্টার মধ্যেই ঢুকে যাবো
ফোনে অর্ডারটা দিয়ে রাত্রির দিকে তাকায় অংশু
ঠিক আছে তো…
একদম কারেক্ট আছে কাকা
ক্রমশ…