অভিমান নিয়ে যিনি কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ ৩৪ বছর, কবি নজরুলের জীবনে প্রেম
বৈশাখী নার্গিস
‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম, সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন প্রেমিক কবি। কবির জীবনে প্রেম এসেছে বহুবার। নারী প্রেম তার কাব্যে ফেলেছে গভীরতর প্রভাব। যার ফলে তিনি একাধারে হয়ে উঠেছেন দ্রোহ ও প্রেমের কবি। তার জীবনে এসব প্রেমের ছোঁয়া বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে অনন্যমাত্রা।
‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’ দিয়ে তাঁর বিদ্রোহী কবিতার পরিচয় আমরা পাই, অন্যদিকে নজরুল সাহিত্যধারায় দ্রোহের পাশাপাশি প্রেমের অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে চঞ্চল মেয়ের ভালবাসায় মুখর হয়ে বলেছেন,
‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণি, তন্বী নয়নে বহ্নি,/ আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!/ আমি উন্মন, মন-উদাসীর,/ আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।’ মূলত, তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন কবি।
মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত কবি প্রেমের শাশ্বত আবেদনের কাছে হার মেনে স্বস্তি খুঁজে পেতে চেয়েছেন- ‘হে মোর রাণী! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে/আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।’
নজরুলের জীবনে বহুবার প্রেমের উষ্ণ হাওয়া বইলেও বিশেষভাবে তিন নারীর সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। প্রথমত, নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয়ত, মিস ফজিলাতুন্নেসা।
নজরুল জীবনে প্রেমের প্রথম কলিটি হচ্ছে নার্গিস- ফার্সি ভাষায় নার্গিস অর্থ গুল্ম, নার্গিস একটি ফুলের নামও বটে। কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে আলী আকবরের সাথে পরিচয় ও সখ্যতার সূত্রে নজরুল তার সাথে ১৯২১ সালের মার্চে কুমিল্লা বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে নার্গিসের সাথে পরিচয় ও প্রণয়।
এক রাতে কবি খাঁ বাড়ির দীঘির ঘাটে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই বাঁশি সুরে মুগ্ধ হন সেই সুন্দরী যুবতি মেয়েটি। এরপর একদিন নজরুলের এই বাঁশি বাজানো সম্পর্কে আলোচনার সূত্রে কবির সঙ্গে তিনি আলাপ করেন।
নার্গিসের প্রেমে পাগল কবি তাঁকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের কাছে বিয়ের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তিনি সুযোগটি লুফে নেন। এরপর নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কাবিননামা সম্পাদনার সময় কবিকে ঘর জামাই হয়ে থাকতে হবে- কৌসুলি আলী আকবরের জুড়ে দেওয়া এমন একটি শর্তে ক্ষেপে গিয়ে কবি বিয়ের রাতেই নার্গিসকে ছেড়ে চলে যান। দীর্ঘ ১৬ বছর নজরুলের সাথে নার্গিসের আর কোন যোগাযোগ হয় নি।
এরপর নজরুল একটি গান লেখেন নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে-
‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/কেন মনে রাখ তারে/ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।/আমি গান গাহি আপনার দুখে,/তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,/আলেয়ার মত ডাকিও না আর/নিশীথ অন্ধকারে….।’
১৯৩৭ সালের ১ জুলাই নজরুল নার্গিসকে আর একটি চিঠি লেখেন। কিন্তু প্রথম প্রণয়ী নার্গিস কবির অন্তরে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। তাকে ত্যাগ করার পরে কবির মনে অপরাধবোধ ও বিষাদ ছিল। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি চক্রবাক কাব্যে বেশ কয়েকটি বিরহের কবিতা লিখেছিলেন। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’।
নার্গিসের বিয়ের বাসর থেকে পালিয়ে নজরুল যে বাড়িতে ওঠেন এবং পরে আরও কয়েকবার সেখানে যান। সেই বাড়িতেই যৌথ পরিবারে বিরজা সুন্দরী দেবীর বিধবা জা গিরিবালা থাকতেন। তার কন্যা আশালতার (প্রমীলা) সঙ্গে কবির পরিচয় ও প্রণয় গড়ে ওঠে। তিন বছর পর কবি এই আশালতাকে বিয়ে করেন এবং তার নাম দেন প্রমীলা। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়।
বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম । বিবাহ-আইনের অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩। বিয়ের পর স্ব ধর্ম-আচরণ বহাল রেখেই প্রমীলা দেবী আমৃত্যু সকল সুখ-দু:খের বোঝা মাথায় নিয়ে কবির জীবন সঙ্গিনী হয়েছিলেন। প্রমীলার প্রতি কবির প্রেমের কথা তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বিজয়ীনি’ ছাড়াও নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ‘প্রিয়ার রূপ’, ‘দোদুল দুল’ সহ আরও অনেক কবিতা রচনা করেন। ‘ দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন-
‘মৃণালু হাত/নয়ানু পাত/গালের টোল,/চিবুক দোল/সকল কাজ/করায় ভুল/প্রিয়ার মোর/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কাকঁল ক্ষীণ/মরাল গ্রীব/ভুলায় জড়/ভুলায় জীব,/গমনু দোল/অতুল তুল্।’
দোলন চাঁপা কাব্যগ্রন্থে সবার আগে এই কবিতাটি রয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়।
এরপর কবির জীবনে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলিম ছাত্রী এবং সওগাত পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা মিস ফজিলাতুন্নেসা। যার প্রতি কবির অনুরাগকে কিংবদন্তী তুল্য বলা যেতে পারে।
কবির মন ফজিলাতুন্নেসার প্রতি প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কিন্তু নজরুল ফজিলতুন্নেসার হৃদয় জয় করতে ব্যর্থ হন। কবি ঢাকা ছেড়ে ফিরে আসেন কলকাতায় তার কৃষ্ণনগরের বাসায়, যেখানে তার পরিবার থাকত। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তারপর নজরুল বন্ধু মোতাহার হোসেনকে ৭টি এবং ফজিলাতুন্নেসাকে ১টি চিঠি পাঠান। বন্ধু মোতাহার হোসেনকে পাঠানো নজরুলের চিঠিগুলো মূলত ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
বাধা করা স্বত্ত্বেও ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে বন্ধু মোতাহারের কাছে চিঠি লিখে গেছেন।
ফজিলাতুন্নেসা ‘সওগাত’-এর জন্য একটি গল্প লিখেছিলেন-‘শুধু দু’দিনের দেখা’। সম্পাদক সেটা নজরুলকে দেখতে দেন। নজরুল সেখানে কিছু পরিবর্তন করার অনুমতি ও তার ‘সঞ্চিতা’-ফজিলতুন্নেসাকে উৎসর্গ করবার অনুমতি চেয়ে চিঠি লেখেন। ফজিলাতুন্নেসা সেগুলোরও কোন উত্তর কখনই দেননি, বরং তিনি সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন সাহেবকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন, ‘আমার গল্পটি যেমন আছে তেমনই ছাপালে সুখী হব’। এই ঘটনায় কবি আঘাত পান এবং ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন।
আঘাত পেয়েও কবির ফজিলাতুন্নেসাকে পাবার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না। তিনি কাজী মোতাহার হোসেনকে উল্লেখ করে আরো তিনটি চিঠি লিখেন। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ‘ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছি- আমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না’।
সৈয়দ আলী আশরাফ এ প্রসঙ্গে ঐ গ্রন্থে বলেন-‘তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, ব্যক্তির উপাসক নন। যে নারীর ভিতর সেই সৌন্দর্যে বিকাশ দেখেছেন এবং সে নারী তার মনে সেই পূজার যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করেছেন, তাকে পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা নিষেধ মানতে তিনি রাজী নন।
প্রেম পর্যায়ে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে দেবী বলে মনে হয়, মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই প্রেমকে কবি উপলব্ধি করেছেন, উপভোগ করেছেন। তাই এই প্রেমে একদিকে দেখি সাময়িক উচ্ছ্বাস, অন্য দিকে দেখি আত্মতৃপ্তি। দুঃখকে উপভোগ করার জন্যই যেন এই প্রেম। নার্গিস, জাহানারা, ফজিলাতুন্নেসা এদের সঙ্গে তার প্রেম কি একই প্রেমের পুনরুক্ত নয়? শুধু মনে হয় ফজিলাতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ বেশ গভীর হতে পারত কিন্তু সেই গভীরতা অর্জন করার সুযোগ পায়নি।’
ব্যক্তিগত জীবনে আরাধ্য নারীকে ভালবাসার পাশাপাশি নজরুল তাঁর দেশকেও ভালোবেসেছিলেন, মানুষকে ভালোবেসেছিলেন, মানবতাকে ভালোবেসেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন সত্য-সুন্দরকে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে প্রেমে ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সমাজ বাস্তবতার বৈপরীত্যে সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের স্বপ্নপুরীতে যখন কুৎসিত কীটের দংশন প্রত্যক্ষ করেছেন তখন কবি দারুণভাবে আহত হয়েছেন। তাঁর হৃদয়ে যে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে তার নিঃসরণ ঘটিয়েছেন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে, সুরের বেহাগে, সভা-সমিতির বক্তৃতায়-ভাষণে। তার কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে বারবার তাই উপজীব্য হয়েছে প্রেম। মানুষের মানবিক অনুভূতির অনন্য ভাষা ভালোবাসা ও প্রেমকে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
বস্তুত অভিমান নিয়েই নজরুল দীর্ঘ ৩৪ বছর নীরবে কাটিয়ে ৭৭ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছেন। প্রেমের কাঙাল এই কবি ব্যক্তিগত শত ব্যথা-বঞ্চনা ও দুঃখ-দারিদ্রের মাঝেও এক অপরিমেয় শক্তি বলে জীবনের ভাণ্ডার শূন্য রেখে সৃষ্টির ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে তুলছিলেন। যার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের ধারা। ঋদ্ধ হয়েছে বাঙালীর সাহিত্য জগত।