সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

নবম পর্বের পর… 

অনন্যা পাল

 

মহানিশা

বৈশাখের অপরাহ্ন, অসময় ঝঞ্ঝার আভাসটুকু মেখে আকাশ গম্ভীর, কালো মেঘে ঢাকা পড়েছেন অংশুমালী। বিষণ্ণতা মাখা নিষ্প্রভ আলোয় অতিথিপুরীর উন্মুক্ত অলিন্দে একাকী দাঁড়িয়ে পুষ্পকেতু, তাঁর অন্যমনস্ক মুখের ভাবেও আকাশের প্রতিফলন। বিগত এক পক্ষকাল ধরে বেশ কয়েকবার বার্তা নিয়ে এসেছে দূতী, সরোবর তীরে অপেক্ষায় থেকেছেন রাজকুমারী। আজ সকালেও লিপি নিয়ে এসেছিল সোমাশ্রীর সখী দশমী; কুমার গ্রহণ করেননি সে লিপি; কিন্তু এই আত্মসংযম সহজ হয়নি তাঁর নিজের কাছেও। আগামী ভাদ্রে দেশে ফেরার যাত্রাসূচী, এখনও তিনমাস কাল কাটাতে হবে এই দেশে; কিন্তু এর প্রতিটি দিবস যেন নিষ্ক্রীয় অবসাদে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে তাঁর চেতনা। বাইরের জগৎ থেকে যথাসম্ভব নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন পুষ্পকেতু, উল্মুক বুঝতে পারছেন পরিস্থিতি, কিন্তু প্রিয়বন্ধুকে যন্ত্রণামুক্ত করার উপায় তাঁর

জানা নেই।

যুবরাজ ভদ্রবর্মন বিদায় নেবার পর থেকে অমরাবতীর সাথে সন্ধিচুক্তির প্রস্তুতি চলেছে রাজসভায়, একান্ত মন্ত্রণা সভার রুদ্ধদ্বারের পিছনে কি আলোচনা ঘটে চলেছে সে বিষয়ে জল্পনার অবধি নেই। কিন্তু দুর্জয় বর্মার উদ্যোগে কোনও সংবাদ প্রকাশ্যে আসেনি; মহামাত্যের বিশ্বাস, অমরাবতীর চর আছে ব্যাধপুরে, তাই এই গোপনীয়তা। তবে শৈলদেশের রাজদূত রওয়ানা হয়েছে সিংহপুরের উদ্দেশ্যে, মকরধ্বজ জানিয়েছেন সে কথা; দূত না ফেরা অবধি সকলেই অপেক্ষায় রয়েছে নীরব উত্তেজনায়।

জাতিপুষ্পের মৃদু সৌরভে চকিতে ফিরে তাকান কুমার; দ্বারপ্রান্তে অলিন্দের একটি স্তম্ভকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন সোমাশ্রী না জানি কতক্ষণ। মর্মর মূর্তির মতই স্তব্ধ তাঁর দেহভঙ্গী, মুখশ্রী শান্ত, উদাসীন, পরনে শ্বেতশুভ্র বস্ত্র, কবরীতে শুভ্র মল্লিকা।

‘রাজকুমারী আপনি?’ কুমারের কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।

‘আশ্চর্য হলেন আর্য?’

‘হ্যাঁ, রাজদুহিতার পদধুলি পড়বে এখানে সে আশা করিনি।‘

‘যদি বলি, রাজদুহিতা নয়, সোমাশ্রী এসেছে আপনার কাছে?’

‘আমার কাছে দুজন আলাদা নন ভদ্রে’।

‘সেদিনের সেই অপরাহ্নে, সরোবর বক্ষে রাজকুমারীকেই খুঁজেছিলেন কি কুমার?’

‘সেই অপরাহ্নের স্মৃতি ভুলে যাওয়াতেই দুজনার মঙ্গল।‘

‘আমি অল্প বুদ্ধি রমনী, অত হিসাব করে চলতে জানি না।‘

‘আপনি রাজদুহিতা, ক্ষণিকের দুর্বলতাকে অযথা প্রশ্রয় দেওয়া আপনার সাজে না; রাজ অতিথি হিসাবে এদেশের স্বার্থরক্ষা করা আমারও কর্তব্য।‘ কথাটা যেন অতিরিক্ত জোরের সাথেই বলে ওঠেন পুষ্পকেতু।

‘ক্ষণিকের দুর্বলতা? ও!’ এতক্ষণে কেঁপে ওঠে দীর্ঘ আঁখিপল্লব, সকরুণ বেদনায় আর্দ্র হয়ে ওঠে রাজকুমারীর দুটি চোখ।

‘আপনার কর্তব্যে বাধ সাধব না কুমার, তবে আপনি যাকে ক্ষণিকের দুর্বলতা মনে করছেন, আমার কাছে তা অকপট, নিষ্পাপ ভালোবাসা।‘

‘ভদ্রবর্মনের সাথে আপনার বিবাহের আলোচনা চলছে, এ পরিস্থিতে ভালোবাসার কথা অবান্তর’।

‘এ আপনার আর্যভূমি নয় কুমার, এখানে নারীর সম্মতি বিনা তার বিবাহ হয়না।‘

‘সাধারণ নারীর ক্ষেত্রে হয়না হয়তো, কিন্তু রাজকুমারী? রাষ্টের মঙ্গলচিন্তা দূরে রেখে নিজ স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দেবেন আপনি, এটা কি বাঞ্ছনীয়? তাছাড়া আপনার পিতাকে আমি যদি এতটুকু চিনে থাকি, এ বিষয়ে আপনার মতামতের মূল্য নেই বিন্দুমাত্র।‘

‘পিতা যে সিদ্ধান্তই নিয়ে থাকুন, এ বিবাহে আমার সম্মতি নেই, তাঁকে জানিয়েছি, আজ আপনাকেও জানিয়ে গেলাম আর্য’, কথাকটি বলে নিঃশব্দে বিদায় নেন সোমাশ্রী। পুষ্পকেতু চেয়ে থাকেন দ্বারের পথে তৃষিত নয়নে।

সারারাত জানালার পাশে শূন্যদৃষ্টিতে বসে থাকেন কুমার, শেষরাতের হঠাৎ বৃষ্টির ছিটা ভিজিয়ে দিয়ে যায় তাঁর দেহ, তবু আত্মমগ্ন হয়ে থাকেন তিনি, বুঝিবা গভীর সংশয়ে।

***

এভাবে কেটে যায় কয়েকটা দিন, উল্মুকের উৎসাহে দুজনে আগের মতই নগর পরিদর্শনে বের হন প্রায়ই; কিন্তু সুর কেটে গেছে জীবনের ছন্দের, শত চেষ্টাতেও সেকথা লুকাতে পারেননা কুমার। ইতিমধ্যে সিংহপুর থেকে দূত ফেরত আসে মহারাজ বীরবর্মনের লিপি নিয়ে; লিপিতে সাক্ষর তাঁর হলেও ভাষা যুবরাজের বুঝতে অসুবিধা হয় না কারও;-

“শৈলদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, তদাপি অমরাবতীর সহিত সন্ধিচুক্তি করিতে অন্যান্য দেশের সম্মতি লইতে হইবে, অথচ পারস্পরিক বিশ্বাস অর্জনের হেতু বন্দরে অমরাবতীর পরিসংখ্যান পরীক্ষক নিয়োগে মহারাজ চন্দ্রদমনের আপত্তি; এরূপ পরস্পর বিরোধী মতাদর্শে একাধারে বিস্মিত ও বিভ্রান্ত বোধ করিতেছি। উপরন্তু, রাজকুমারী সোমাশ্রীর বিবাহে অসম্মতির অজুহাতে অন্য অপেক্ষাকৃত গৌন কোনও রাজবংশজার সহিত বিবাহ প্রস্তাব চম্পা রাজপরিবারের কাছে অত্যন্ত অগৌরবের, সেকারণে ইহা প্রত্যাখ্যান করিতে বাধ্য হইলাম। শৈলদেশ অমরাবতীর বন্ধুতায় আগ্রহী নয় ইহা স্পষ্ট হইয়াছে, অতএব ইহার পর আমাদিগের পক্ষ থেকেও আর প্রতিবেশীসুলভ শিষ্টতা রক্ষার দায় রহিল না।“

 

‘বিষয়টা যে এরূপ তিক্ততায় পরিণতি পাবে, আশা করিনি আমরা কেউই’, মকরধ্বজ অতিথিপুরীতে এসেছেন পুষ্পকেতু ও উল্মুকের কাছে, উদ্দেশ্য সাম্প্রতিক সন্ধি প্রস্তাবের ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করা।

‘এর জন্যে ভদ্রবর্মনকে দোষারোপ করা অন্যায় হবে, তিনি চেষ্টা করেছিলেন’, পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘তবে কি শৈলদেশের কারণেই অসফল হোল সন্ধিপ্রস্তাব?’ মকরধ্বজ কিছুটা বিস্মিত।

‘শৈলদেশের কারণে কি না জানিনা, তবে সদিচ্ছার অভাব ছিল অবশ্যই। দুই দেশের চুক্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সম্মতির অজুহাত কারও কাছেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। তাছাড়া, চীনা রাষ্ট্র অমরাবতীর প্রতিবেশী দেশ, তারা কলিঙ্গপত্তনে না গিয়ে কাটিগারে বাণিজ্য করছে, এ অতি অনৈতিক।‘

‘তারা যদি স্বেচ্ছায় এদেশে বাণিজ্য করে, এতে কিসের অন্যায় কুমার?’

‘বিষয়টি কি সত্যিই এত সহজ ভদ্র? এর পিছনে চীনা রাষ্ট্রকে প্রলুব্ধ করার প্রক্রিয়া থাকতে পারে; সেকারনেই পরিসংখ্যান পরীক্ষায় আপত্তি হয়তো।‘

‘কিন্তু শৈলদেশ যুবরাজের সাথে আত্মীয়তা স্থাপনে আগ্রহী ছিল, সে প্রস্তাবও তো প্রত্যাখ্যান করেছে অমরাবতী; আত্মীয়তা ঘটলে বাণিজ্যিক জটিলতা কমত নিশ্চয়’।

‘মহারাজ চন্দ্রদমন বৈবাহিক সম্পর্কে আগ্রহী থাকলে নিজপুত্রীর সাথেই বিবাহ সম্বন্ধ ঘটাতেন, অন্য কোনও আত্মীয়ার কথা বলতেন না। যুবরাজের সাথে রাজপুত্রীর বিবাহ ঘটবে এটাই তো স্বাভাবিক, পদসম্মানে গৌণ কারও সাথে নয়।‘

‘আমি যতদূর শুনেছি, রাজকুমারী অসম্মত ছিলেন এ বিবাহে, পত্রেও সেকথার উল্লেখ ছিল। ভদ্রবর্মনের তো অজানা নয়, নাগকন্যারা কতখানি স্বাধীনচেতা!’

‘মকরধ্বজ, আপনি বিশ্বাস করেন রাজকুমারীর অসম্মতির কারণেই প্রস্তাব পরিবর্তিত হয়েছিল?’

‘এছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে?’ উল্মুক এতক্ষণ নীরব শ্রোতার ভুমিকায় ছিলেন, এতক্ষণে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

‘ভদ্রবর্মনকে যতটুকু জেনেছি, একথা নিশ্চয় করে বলতে পারি, কালজয়ী হবেন তিনি সুবর্ণভূমীর ইতিহাসে। এরূপ প্রবল পুরুষকে কন্যাদান করলে নিজ সিংহাসনের স্বকীয়তা রক্ষা পাবে না আশঙ্কা করেছেন মহারাজ, একথা বুঝতে অসুবিধা কোথায়?’

‘আপনি তাহলে শৈলরাজকেই দোষী সাব্যস্ত করছেন কুমার?’ মকরধ্বজ প্রশ্ন করেন।

‘দোষ গুণের কথা নয়, হয়তো এই ভালো হয়েছে; এক বনাঞ্চলে দুই সিংহের বসবাস সম্ভব নয়, দুই ক্ষমতাবান রাজপুরুষের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক।‘

‘কি জানি এ থেকে আবার নতুন অশান্তি না সৃষ্টি হয় দুই রাজ্যের মধ্যে। ভদ্রবর্মন তো মোক্ষম চটেছেন বোধ হচ্ছে।‘ উল্মুক হালকা সুরে মন্তব্য করলেও কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার নয় বোঝেন বাকি দুজনেও।

***

‘এখন রাজকুমারীর বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবে ভেবে দেখেছ কিছু?’ মকরধ্বজ চলে যেতে মিত্রকে প্রশ্ন করেন উল্মুক।

‘সিদ্ধান্ত, কিসের?’

‘তোমাদের দুজনার কথা বলছি আমি, নিজের হৃদয়কে আর কত ছলনা করবে? তাছাড়া সোমাশ্রীর দিকটাও ভেবে দেখ একবার’।

‘ভদ্রবর্মনের সাথে বিবাহ প্রস্তাব সফল হয়নি বলে আমি তাকে পুনর্বার কামনা করব এ সমীচীন নয়।‘

‘কিন্তু বাধা কোথায়?’

‘বাধা আছে বন্ধু, রাজপুত্রীর বিবাহে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। আজ ভদ্রবর্মনের সাথে সম্ভব হয়নি, কাল অন্য কোনও রাজকুলে সম্বন্ধ ঘটবে। সোমাশ্রীর তরুণ বয়স, আমি তাকে মিথ্যা আশা দিয়ে বিহ্বল করতে পারিনা।‘ পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বরের বেদনাময় অভিব্যক্তি ছুঁয়ে যায় উল্মুককে।

‘তুমি বড় আদর্শবাদী কেতু, অনেক দুঃখ পেতে হবে এর জন্যে।‘ তাঁর কন্ঠস্বরও স্খলিত শোনায়।

***

অমাবস্যার গভীর রাত্রি, চারিদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কাটিগারের তটভূমি জনশূণ্য। বন্দর সংলগ্ন অগভীর জলে ভেসে রয়েছে বেশ কিছু শৈলদেশীয় নৌকা, এগুলি গভীর সমুদ্রে সুবন্ধিত বিদেশী পণ্যতরণী থেকে পণ্য বয়ে নিয়ে আসে বন্দরে। এছাড়াও অদূরে জলের উপর প্রহরায় রয়েছে যুদ্ধযান, এরা জলসীমা প্রহরার কাজ করে; শৈলদেশের সমুদ্রসীমায় বিদেশী তরণী রক্ষা করার দায়িত্বও এগুলির উপরেই। বন্দরের স্থলভূমির একপাশে শুল্ক বিভাগের কার্যালয়, অন্যপাশে সুবিশাল পণ্যাগার, সেখানে সরকারী দায়িত্বে বিদেশী বণিকদের পণ্য মজুত করা হয় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে।

নিস্তব্ধ চরাচর, কর্মময় দিনের শেষে শান্তির নিদ্রায় ডুবে রয়েছে কাটিগার; আচমকাই বন্দর চত্ত্বরে অন্ধকার বিদীর্ণ করে জ্বলে ওঠে লেলিহান শিখা, আর তার সাথেই দশদিক প্রজ্জ্বলিত করে অগ্নুৎপাত শুরু হয় সমুদ্রের জলে। এ যেন এক নারকীয় অগ্নিকুন্ড, যার ভীষণ গহ্বরে একে একে তলিয়ে যাচ্ছে জলযানগুলি। আগুনের প্রতিফলনে জল ও আকাশ রক্তবর্ণ; নীশিথের নিস্তব্ধতা ভেদ করে কাষ্ঠবিস্ফোটের শব্দ, হতভম্ব নাবিকদের কোলাহল সচকিত করে তোলে চারিধার। দারুনির্মিত পণ্যভাণ্ডার অগরু, চন্দন আর চিনাংশুকের ইন্ধনে যেন সদ্য উন্মেষিত জ্বালামুখী, অচিরেই শুল্কদপ্তরেও ছড়িয়ে পড়ে সেই আগুন। ভাণ্ডার গৃহের নিদ্রালু প্রহরীরা গর্তবন্দী মূষিকের মত আকুল হয়ে দ্বারের পানে ছুটে যায় মুক্তির আশায়, কিন্তু তাদের বস্ত্রেও প্রজ্বলিত অঙ্গার। দাবানলের ধ্বংসলীলায় প্রাণভয়ে পলায়নরত বন্যপ্রাণীদের মতই অসহায় আর্তচিৎকারে ছুটে এসে ঝাঁপ দেয় কেউ কেউ সাগরের জলে। ভয়ার্ত চিৎকার, অসহায় আর্তনাদ, এসবের মাঝে বিপদ সংকেত বেজে ওঠে উপর্যুপরি শঙ্খনিনাদে; এতক্ষণে বুঝিবা সংবিত ফিরেছে কারও, সাহায্যের আশায় তাই এই শেষ চেষ্টা।

দেখতে দেখতে জড় হয় জনতা কিছুদূরে, উপস্থিত হয় সরকারি দণ্ডাধিকারিকের দল, কিন্তু আগুনের কাছে যাওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষেই; নীরব দর্শকের মতই ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করেন সকলে। জলে ঝাঁপ দিয়েছে যে সকল ভাণ্ডার প্রহরী, তাদের উদ্ধারে উদ্যোগী হয় বন্দরে নিয়োজিত পদাতিক সেনাবাহিনী। আগুন জ্বলতে থাকে সমস্ত রাত এবং পরদিন দিবা দ্বিপ্রহর অবধি, ততক্ষণে পণ্যভাণ্ডারের সামগ্রী সমস্তই পুড়ে ছাই, নষ্ট হয়েছে শুল্ক দপ্তরের মূল্যবান নথিপত্র। প্রহরারত দশটি রণতরী সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট, আরও চল্লিশটি পণ্যবাহী তরণীও ধ্বংস হয়েছে সেই সাথে। সীমান্তরক্ষী নৌবাহিনীর সাহায্য এসে পৌঁছয় পরদিন প্রভাতে, সমুদ্রবক্ষে ভাসমান নাবিকদের উদ্ধারকার্য শুরু হয় সেই সাথে।

***

জরুরি মন্ত্রণাসভা বসেছে ব্যাধপুর রাজপ্রাসাদে; মহারাজ চন্দ্রদমনের নেতৃত্বে সেখানে উপস্থিত রয়েছেন দুর্জয়, উদয়, ত্রিগুণ ও কিছু প্রবীণ অমাত্য; মগধ প্রতিনিধি হিসাবে উপস্থিত আছেন পুষ্পকেতু, উল্মুক ও ধূর্জটিদেব। কাটিগারের দুর্ঘটনার সংবাদ পৌঁছেছে রাজধানীতে তিনদিন পর দ্রূতগামী হস্তিবাহীর মাধ্যমে, আর তার ফলস্বরূপ এই আলোচনা সভা।

‘ভদ্রবর্মন কালক্ষেপে বিশ্বাসী নন, পত্রপ্রেরণের কয়েকদিনের মধ্যেই প্রতিহিংসা নিলেন’, দুর্জয়ের বক্তব্যে শ্লেষ ফুটে ওঠে।

‘কিন্তু, বন্দরের সতর্ক প্রহরা, জলপথের নৌসেনার টহলদারী, এত কিছু ভেদ করে শত্রুপক্ষ প্রবেশ করল কি রূপে? আমরা কি নিশ্চিত, এই অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়?’ ত্রিগুণ মন্তব্য করেন।

‘সেই প্রশ্ন তো আমাদেরও কুমার। আপনি নৌসেনাধ্যক্ষ, এর উত্তর আপনাকেই দিতে হবে। আর যেভাবে যুগপৎ জলে ও স্থলে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, একে দুর্ঘটনা ভেবে নেওয়া নিতান্ত বাতুলতা’, দুর্জয়ের কন্ঠস্বর ইস্পাত কঠিন।

‘কিছু পরেই রওয়ানা হব কাটিগারের উদ্দেশ্যে, সম্যক তদন্ত না করে কিছু বলা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে, আশাকরি তা আপনারাও বুঝতে পারছেন‘, ত্রিগুণবর্মা উত্তর দেন কৈফিয়তের সুরে।

‘আমিও যাত্রার জন্য প্রস্তুত, ঘটনাস্থলে ক্ষয়ক্ষতির বিচার করা দরকার; কাটিগারের দণ্ডাধিকারিকের সাথেও আলোচনার প্রয়োজন। এছাড়া প্রহরা বৃদ্ধির নূতন উদ্যোগ নিতে হবে সেখানে, যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তির অবকাশ না ঘটে সেবিষয়ে সচেষ্ট হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তদুপরি ব্যাধপুর, অনিন্দিতপুর ও শ্রেষ্ঠপুরে সেনাবাহিনীর বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে অবিলম্বে।‘ উদয়বর্মা নিজ পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করেন।

‘ভদ্রবর্মনের এই অনৈতিক আচরণের নিন্দা করবেন আপনারা আশাকরি, এই সংবাদ মগধেশ্বরের কর্ণগোচর হোক এই আমার ইচ্ছা’, পুষ্পকেতু ও ধূর্জটিদেবের উদ্দেশ্যে কথাকটি বলেন মহারাজ।

‘যদি প্রমাণ হয় এই অঘটনের পিছনে আছেন অমরাবতীর যুবরাজ, অবশ্য নিন্দা করব, তবে আপনাদের অন্তর্কলহ সম্রাটের গোচরে আনা প্রয়োজন কিনা সেটি আলোচনা সাপেক্ষ।‘ ধূর্জটিদেব সাবধানে উত্তর দেন, তিনি প্রবীন কূটনীতিবিদ, সহসা কোনও বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দানের বিরোধী।

***

একপক্ষকাল কেটে গেছে, উদয় ও ত্রিগুণ দুজনেই ফিরেছেন রাজধানীতে, তাঁদের দুর্ঘটনা সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আবার নতুন করে বসেছে আলোচনাসভা, সভায় উপস্থিত রয়েছেন পূর্বেকার সদস্যেরা।

‘গুপ্ত আক্রমণ ঘটেছিল জলপথে, এব্যাপারে সন্দেহ নেই, তবে বন্দরভূমিতে তাদের গোপন সহকারী ছিল। পথ প্রদর্শক ছাড়া অন্ধকার রাত্রিতে প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে জল থেকে পণ্যভাণ্ডার অবধি পৌঁছানো সম্ভব হোত না। পণ্যভাণ্ডারের পিছনকার দরজার দুই প্রহরীকে ছুরিকাঘাত করে ভিতরে প্রবেশ করে শত্রুপক্ষ, এরপর ভিতরকার প্রকোষ্ঠগুলির কয়েকটিতে অগ্নিসংযোগ করে নির্গত হয় তারা। সন্দেহ হয়, প্রহরীদের পূর্বাহ্নে মাদক প্রয়োগে নেশাগ্রস্ত করা হয়েছিল, সেকারণেই তারা সময় মত উদ্দোগী হতে পারেনি। অপরাধের ধরণ দেখে আন্দাজ হয়, এরা মালবীয় জলদস্যু।‘ উদয়বর্মা নিজের পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।

‘আততায়ীরা অমরাবতীর যোদ্ধা এবিষয়ে আমি নিশ্চিত, রাতের অন্ধকারে দ্রুতগামী নৌকায় কাটিগারের জলসীমায় প্রবেশ করেছিল তারা গোপনে, আর তারপর নিরন্তর অগ্নিবান নিক্ষেপ করে অগ্নিকাণ্ড ঘটায় আমাদের রণতরীগুলিতে।‘

‘অমরাবতীর সম্পর্কে আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কিরূপে?’ ত্রিগুনবর্মার বক্তব্য শুনে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘অগ্নিকাণ্ড চলাকালীন আমাদের নৌসেনাদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাধে, সেসময়ে তীরের আঘাতে আহত হয় বেশ কিছু সৈনিক। পরবর্তীকালে আততায়ীদের তীরগুলি পরীক্ষা করা হয়। বেতদণ্ডের তৈরী, পালকহীন ও বিষাক্ত ফলাবিশিষ্ট এই বিশেষ তীর অমরাবতীর সেনাদলকে চিহ্নিত করার পক্ষে যথেষ্ট।‘

‘সীমান্তবর্তী রণতরীগুলির চোখ এড়িয়ে অমরাবতীর নৌবহ কাটিগারে এলো কি ভাবে? তবে কি প্রহরায় শিথিলতা ছিল?’ উদয়বর্মার প্রশ্নে তির্যক সুর স্পষ্ট হয়।

‘আততায়ী নৌকাগুলি আয়তনে ছোট ও দ্রুতগামী, সংখ্যায় পাঁচ-ছটির বেশী ছিলনা; অতি সন্তর্পনে তারা সীমা পার করেছিল, প্রহরী নৌসেনার গোচরে আসেনি সেকারণে; তাছাড়া অমানিশার অভেদ্য অন্ধকারে বহির্শত্রুর অনুপ্রবেশ অভাবনীয় ঘটনা, এর জন্যে তৈরী ছিল না কেউ। অন্ধকারে শুধুমাত্র নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে নৌচালনার প্রশিক্ষণ ছিল আততায়ী নাবিকদের, সেকারণেই সম্ভব হয়েছিল এই দুঃসাহসিক অভিযান।‘

‘কুমার শত্রুপক্ষের রণমাহাত্যে যতটা উচ্ছসিত, আমাদের নৌপ্রহরীদের শিথিলতায় ততখানি লজ্জিত নন বোধ হচ্ছে।‘ উদয়ের এই আচম্বিত মন্তব্যে ত্রিগুণের মুখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে।

‘অগ্নিকাণ্ডের দায় জলদস্যুদের স্কন্ধে আরোপ করে আপনিও তো নিশ্চিন্ত হয়েছেন অগ্রজ! জানতে পারি কি বন্দরভূমিতে শত্রুপক্ষের সহযোগী অনুচরদের খুঁজে বের করার কি প্রচেষ্টা করা হয়েছে? অগ্নিসংযোগের পরে আততায়ীরা পলায়নই বা করল কি ভাবে? সেখানে তো আপনার সেনা মোতায়েন ছিল।‘

‘কুমার ত্রিগুণকে কৈফিয়ত দেবার দায়বদ্ধতা নেই আমার, তবু এই সভাস্থলে যখন প্রসঙ্গ উঠেছে, আমার কার্যপ্রণালীর বিবরণ নিশ্চয় দেব। কাটিগারে বহুজাতীয় লোকের আনাগোনা, সেখানে বিদেশী চর সনাক্তকরণ কঠিন কাজ, কোনও ভিনদেশী নাগরিকের অকারণ হেনস্থা বাঞ্ছনীয় নয়। তৎসত্ত্বেও বিগত কয়েকদিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় চর সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছে পাঁচজন বিদেশী, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের কাজ চলছে। খুব সম্ভবত, একটি ডিঙ্গিতে চেপে সমুদ্রতটে নেমেছিল চার আততায়ী, অগ্নিসংযোগের পরে তারা সেই ভাবেই ফিরে যায় মূল জলযানে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ থেকে সেরকমই ধারণা করা যাচ্ছে।‘

‘বিপদকালে অকারণ দোষারোপ ও উত্তেজনা থেকে  বিরত থাকাই উচিৎ, কুমার উদয় ও ত্রিগুণকে আমি সেই মত আজ্ঞা করছি। মহামাত্য, আপনি মনে করেন, অমরাবতীর চর রয়েছে আমাদের রাজ্যে; কিন্তু আপনার গুপ্তচর বাহিনী এর প্রতিকারে সচেষ্ট হয়েছে কি? এই মূহূর্তে চক্ষুকর্ণ উন্মুক্ত রাখা অতি প্রয়োজন, বিপদ আবার কোন দিক থেকে আসে বলা শক্ত’, মহারাজ উষ্ণ আলোচনা রুখতে হতক্ষেপ করেন। এরপর ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত হিসাব ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলে অমাত্যদের মধ্যে; সভাভঙ্গ হয় আলোচনা শেষে।

***

‘একটা বিষয় লক্ষ্য করেছ? দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শুধুমাত্র শৈলদেশীয় নৌকা, বিদেশী বাণিজ্য তরণীগুলির কোনও ক্ষতি করা হয়নি।‘ নিজস্ব আবাসে ফিরে মন্তব্য করেন পুষ্পকেতু।

‘ কিন্তু পণ্যভাণ্ডারে তো বণিকদের সম্পত্তিই গচ্ছিত ছিল, সেসব তো ভষ্মীভূত হয়েছে।‘

‘সম্পত্তি বণিকদের হলেও, তার দায়ভার প্রশাসনের, অতএব ক্ষতি যা হয়েছে তার ভরতুকি দেবে রাজ কোষাগার। ঘুরিয়ে সেই শৈলদেশেরই সম্পত্তি ক্ষয় হোল এক্ষেত্রেও। উপরন্তু, শুল্কদপ্তরের নথীপত্র নষ্ট হয়েছে, ফলে শুল্ক আদায়ে বিস্তর গোলমাল দেখা দেবে, সেখানেও রাজস্বের ক্ষতি।‘

‘তুমি কি বলতে চাইছ কেতু?’

‘শৈলদেশের সাথে অর্থনৈতিক বিরোধ, তাই শত্রুতাও অর্থনৈতিক ভাবেই করা হয়েছে। যুবরাজ অত্যন্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি’।

‘তাহলে সম্মুখ সমরের সম্ভাবনা নেই বলছ?’

‘জোর দিয়ে কিছুই বলছি না, তবে আমাদের উপস্থিতিতে সেরকম সম্ভাবনা কম।‘

‘কিন্তু চন্দ্রদমন যদি যুদ্ধ ঘোষণা করেন?’

‘অমরাবতীর নৌযুদ্ধশৈলীর যা নমুনা দেখা গেল, মহারাজ অতখানি ঝুঁকি নেবেন বলে মনে হয় না।‘

‘কিন্তু অমরাবতী আবারও যদি গুপ্ত আক্রমণ করে?’

‘সে আশঙ্কা থেকেই যায়, কতদিনে প্রতিহিংসা চরিতার্থ হবে, সেকথা নিশ্চিত করে বলা যায় কি?’ চিন্তাগ্রস্ত দেখায় পুষ্পকেতুকে। বিদেশে বাসকালে যুদ্ধ, অন্তর্কলহ, এসকল বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে তিনি রীতিমত বিব্রত, অথচ এই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ থাকাও চলেনা।

***

সময় এগিয়ে চলে, বৈশাখ পেরিয়ে জৈষ্ঠ্য এসেছে; ব্যাধপুর নগরী সমুদ্র থেকে দূরে, সেকারণে এখানে গ্রীষ্মের প্রকোপ বেশী, দ্বিপ্রহরে সূর্যরশ্মির উত্তাপ বেশীরভাগ মানুষকেই গৃহবন্দী করে তোলে অন্তত এক প্রহর কাল। এই অলস মধ্যাহ্নের নিবিড়তা ছড়িয়ে যায় দুই তরুণ প্রবাসীর হৃদয়েও; বুঝিবা পাটলীপুত্রে ফেলে আসা মায়াময় গৃহকোণ হাতছানি দেয় এতদিনে, দেশে ফেরার জন্য চঞ্চল হয় মন।

রাজধানীতে এখন প্রবল তৎপরতা, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যভাণ্ডারের পুনঃনির্মাণ, ক্ষতিপুরণের হিসাব নিকাশ এ সকল বিষয়ে প্রবল ব্যস্ততা; উদয় ও ত্রিগুণ দীর্ঘসময় কাটাচ্ছেন কাটিগারে; বৈদেশিক বাণিজ্য গতিহীন হয়ে না পড়ে দুর্ঘটনার কারণে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি মহামাত্যের। মকরধ্বজ আসেন মাঝে মধ্যে অতিথিপুরীতে, রাজপরিবারের ছোটখাটো সংবাদ পাওয়া যায় তাঁর কাছে। ত্রিগুণ কাটিগারে ব্যস্ত, তাই এবারের পূর্ণিমা তিথিতে কাব্যসভার আয়োজন করতে মকরধ্বজ রাজকুমারীর কাছে যান, কিন্তু সোমাশ্রীও আগ্রহ দেখাননি, কাব্যসভা বাদ পড়েছে অগত্যা। রাজকুমার অভিরাজের শস্ত্রশিক্ষা শুরু হয়েছে, কুমার ইতিমধ্যেই তীরন্দাজীতে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। মগধ থেকে আনা অশ্বগুলি নতুন পরিবেশে বশ মেনেছে, তার থেকে একটি দুর্জয়কে উপহার দিয়েছেন মহারাজ, আনুগত্যের চিহ্ন হিসাবে। মহামাত্যের স্ত্রী মকরধ্বজকে স্নেহ করেন, বিগত শুক্লাষ্টমীতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছেন সযত্নে।

‘দুর্জয় পত্নী স্নেহশীলা বলতে হয়! তা তিনি রাঁধেন কেমন?’ উল্মুক রসিকতা করেন স্বভাবসিদ্ধ স্বরে।

‘ভোজনের আয়োজন ছিল বিশদ, বড় যত্ন করে খাইয়েছিলেন আর্যা। বহুদিন পরে মাতৃহস্তের স্বাদ পেয়েছিলাম আহার্যে। অমাত্য সৌমিকও নিমন্ত্রিত ছিলেন, রসিক ব্যক্তি, ভারি সুখকর হয়েছিল সেদিনের দ্বিপ্রহর।‘

‘অমাত্য সৌমিক মহামাত্যের জামাতা তো?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।

‘হ্যাঁ, তাঁর বড় পুত্রীর স্বামী।‘

‘ছোটটি এখনও অনূঢ়া বোধকরি?’ উল্মুক অর্থপূর্ণ ভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। মকরধ্বজের মুখশ্রী রক্তবর্ণ ধারণ করে, তিনি অপ্রস্তুত হাসিতে সম্মতি জানান। সেই দেখে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠেন দুই বন্ধু।

 

বহুদিন পরে সেদিন সন্ধ্যায় বীণায় সুর তোলেন কুমার, জাতিপুষ্পের গন্ধমাখা দখিনা বাতাস আর চন্দ্রমার আলোয় মায়াময় হয়ে ওঠে পরিবেশ, আলো আঁধারির ইন্দ্রজালে পুষ্পকেতু যেন শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব, নিবিষ্ট সাধনায় মগ্ন। উল্মুক মুগ্ধ হয়ে শোনেন এই অপূর্ব সুরলহরী, নিজের অজান্তেই বুঝিবা ভিজে ওঠে তাঁর দুটি চোখ।

***

আষাঢ়ের শুরুতে আসন্ন বর্ষার আভাস, থেকে থেকে দিগন্তে মেঘের দেখা মিললেও  বারিধারার আশায় তৃষিত ধরিত্রি, বাতাসে এখনও গ্রীষ্মের উত্তাপ। সকালের প্রাতঃরাশ সেরে দুই বন্ধুতে পদচারণা করছেন অতিথিপুরী সংলগ্ন উদ্যানে; পাখীর কুজন, ছায়াঘেরা শীতলতা, হালকা বাতাসে তরুশাখের হিন্দোল, সবমিলিয়ে উদ্যানের পরিবেশ ভারি শান্তিময়। কিন্তু শান্তি বজায় থাকেনা বেশীক্ষণ, রাজপুরী থেকে দূত ছুটে আসে দুঃসংবাদ নিয়ে, আবার দুর্ঘটনা, শীঘ্র যেতে হবে রাজসভায়। দূত বিশদে জানায় না কিছু, কিন্তু সাথে নিয়ে আসা শিবিকা দেখে অনুমান হয়, বিষয় অতি গুরুতর। অতঃপর ধূর্জটিদেব সহ দুই মিত্র রওয়ানা দেন রাজসভার উদ্দেশ্যে।

দুর্ঘটনা নয়, বজ্রপাত, ঘটনাস্থল এবারও কাটিগার বন্দর; বিষাক্ত সুরাপানে মৃত্যু হয়েছে দুর্জয় বর্মার, মৃত্যুর সাথে লড়ছেন ত্রিগুণবর্মাও। হস্তিপৃষ্ঠে তিনদিন, তিনরাত্রি যাত্রা করে দূত এসে পৌঁছেছে ভোররাতে দুঃসংবাদ নিয়ে, দ্রুতগামী নৌকায় উদয়বর্মাও রওয়ানা হয়েছেন সেখান থেকে, এসে পড়বেন শীঘ্রই, দূতের হাতে পাঠানো পত্রেও তাঁরই শীলমোহর, তাই অবিশ্বাস করার অবকাশ নেই। মহারাজ চন্দ্রদমন স্তব্ধ হয়ে রয়েছেন আত্মীয়সম মহামাত্যের মৃত্যুতে, হঠাতই যেন বয়স বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁর অনেকটাই, চোখমুখের সহজাত তেজ ও প্রত্যয় লোপ পেয়েছে সম্পূর্ণভাবে। এই মূহূর্তে সিংহাসনে যিনি বসে আছেন, তিনি পরাক্রমী রাজা নন, এক শোকবিহ্বল রক্তমাংসের মানুষ। ধূর্জটিদেব বেদমন্ত্র উচ্চারণ করেন, বুঝিবা আশ্বাস যোগাতে, মৌন সভাঘরে তাঁর উদ্দাত্ত কন্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে, এক উদাস করা আধ্যাত্মিক চেতনায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

 

‘ভদ্রবর্মনের এই দুষ্কর্মের ফল তাকে পেতে হবে, এর প্রতিকার চাই মহারাজ!’ অমাত্য সৌমিকের স্বর আবেগে কেঁপে ওঠে, তাঁকে সমর্থন করেন সভায় উপস্থিত প্রায় সকলেই। উদয়বর্মা ফিরে এসেছেন ব্যাধপুরে, মানসিকভাবে তিনিও বিদ্ধস্ত ঘটনা পরম্পরায়, তবু জরুরী সভা আহ্‌বান করা হয়েছে তাঁর আগমনের সাথে সাথেই।

‘যুদ্ধ, তবে কি যুদ্ধই এর একমাত্র সমাধান?’ চিন্তিত দেখায় শৈলরাজকে।

‘এছাড়া আর উপায়ই বা কি মহারাজ? যুবরাজ ভদ্রের  দ্বারা এরূপ নীচকর্ম সংঘটিত হতে পারে, এ অকল্পনীয়!‘ আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় স্খলিত শোনায় উদয়বর্মার কন্ঠস্বর।

‘আচার্য, আশাকরি এখন যুদ্ধ ঘটলে আমরা মগধ সম্রাটের নৈতিক সমর্থন পাব?’ ধূর্যটিদেবকে প্রশ্ন করেন মহারাজ।

‘ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি যেরূপ, শৈলদেশ যুদ্ধ ঘোষনা করলে তা অনৈতিক হবে না একথা সত্যি, কিন্তু মগধেশ্বরের সহানুভূতি পেতে হলে অমরাবতীর দুষ্কর্মের অকাট্য প্রমাণ আবশ্যক রাজন।‘

‘আমার মহামাত্য হত হয়েছেন, ভাতৃপ্রতিম শ্যালকের জীবন অনিশ্চিত, এর চেয়ে বেশী আর কি প্রমাণ আশা করেন আপনি?’ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন শৈলরাজ।

‘আপনি ভুল বুঝছেন রাজন, অপরাধ অতি ঘৃণ্য, ক্ষমার অযোগ্য, তবু তা ঘটেছে আপনার নিজের রাজ্যে; অকাট্য প্রমাণ ভিন্ন অমরাবতীকে দায়ী করা এক্ষেত্রে অন্যায্য’।

‘আপনার ন্যায় অন্যায় বোধ আমাদের পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানকর, তবে কি আপনি ইঙ্গিত করছেন, এ দুর্ঘটনা মাত্র, পরিকল্পিত হত্যা নয়?’

‘শান্ত হোন মহারাজ, আচার্যের বক্তব্য স্পষ্ট করে দিচ্ছি আমি। হত্যা অবশ্য ঘটেছে, আর অমরাবতীই সম্ভবত দায়ী এর জন্য, তবু হত্যার পদ্ধতি, হত্যার সাথে যুক্ত অপরাধী, এসব বিষয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন, তার পূর্বে তড়িঘড়ি যুদ্ধ ঘোষণা করলে মগধ প্রতিনিধি হিসাবে আমাদের কাছে নিরপেক্ষ থাকা ভিন্ন উপায় থাকবে না।‘ পুষ্পকেতু মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন।

‘হত্যা বিষয়ক অনুসন্ধান সঙ্ঘটিত হয়েছে ইতিমধ্যেই, হত্যাকারী অতিথিশালার পাচক, সে দুর্ঘটনার সময় থেকে নিরুদ্দেশ। পাচকটি আর্য বংশোদ্ভূত, তবে শৈলদেশীয় নয়। নিজেকে মালব বলেই পরিচয় দিত, তবে সন্দেহ হয় সে চম্পাদেশীয়। এর অধিক আর কী প্রমাণ চাই আপনার আচার্য?’ উদয়বর্মা মন্তব্য করেন।

‘শুধু সন্দেহকে প্রমাণ বলা চলে না, সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করুন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, তবেই তা গ্রাহ্য হবে মগধ রাজসভায়।‘ আচার্য নিজের যুক্তিতে অনমনীয় থাকেন।

‘মহারাজের আপত্তি না থাকলে, এ বিষয়ে প্রমাণ সংগ্রহের দায়িত্বভার আমি নিতে পারি,আচার্যকে সন্তুষ্ট করা আমার পক্ষে সহজতর হবে একথা মানবেন নিশ্চয়?’ পুষ্পকেতু প্রস্তাব করেন।

উদয়বর্মার অসন্তোষ অগ্রাহ্য করে শৈলরাজ মেনে নেন প্রস্তাব, মগধের সমর্থন ভিন্ন অমরাবতীর সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে তিনি স্বচ্ছন্দ নন স্পষ্ট হয় সেকথা।

***

দ্রুতগামী নৌকায় কাটিগার এসে পৌঁছিয়েছেন কুমার ও উল্মুক, কুমারের অনুরোধে মকরধ্বজও সাথে এসেছেন। বিশ্রামকক্ষে সময় ব্যায় না করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন কুমার অবিলম্বে। এই কাজে, বন্দর দণ্ডনায়কের এক আধিকারিক বাসুকি সাথে আছেন। তথ্যসন্ধানে ঘটনার যে বিবরণ পরিস্ফুট হয় তা এই প্রকার;-

রাজকীয় অতিথিশালার একটি শাখা শুধুমাত্র বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য নির্ধারিত, দুর্জয়, ত্রিগুণ ও উদয় সেখানেই বসবাস করছিলেন দুর্ঘটনার সময়। এই অতিথিশালার পাকগৃহ পৃথক, একজন মুখ্য পাচক ও তার দুইজন সহকারী মিলে অতিথিদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা করে সেখানে। প্রতিহারী বিষ্ণুদাসের সুরক্ষাবলয়ের অন্তর্ভুক্ত এই পাকগৃহটিও, সেখানে নিযুক্ত কর্মচারীরা পুরাতন ও বিশ্বস্ত। তবে মুখ্যপাচক দণ্ডিকের প্রধান সহকারীটির মৃত্যু হয় অগ্নিকাণ্ডের দিন রাতে, জলমগ্নদের উদ্ধারের কাজে যোগ দিয়েছিল সে আরও অনেকের মত, কিন্তু ভাণ্ডারগৃহের এক কর্মীকে উদ্ধার করতে গিয়ে মৃত্যু হয় তার নিজের। পরবর্তীকালে তার পরিবর্তে  নিযুক্ত হয় এক মালব কর্মী শ্রীধর। শ্রীধর বন্দরের প্রখ্যাত একটি পান্থশালায় কর্ম করত, লোকমুখে অতিথশালায় কাজের সন্ধান পেয়ে বিষ্ণুদাসের সাথে দেখা করে সে। পান্থশালার অধিপতির কাছে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে নিযুক্ত করা হয় দণ্ডিকের অধীনে। অগ্নিকাণ্ডের পশ্চাতে রাজপুরুষদের আগমন বেড়েছে; দুর্ঘটনার অর্ধপক্ষকাল আগে ত্রিগুণ ও তার দুইদিন পর উদয় বর্মা ও দুর্জয় কাটিগারে আসেন। সারাদিন নিজস্ব কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাতের আহার তিনজন একসাথেই সমাধা করতেন, আহারের পূর্বে সান্ধ্যকালীন বিশ্রম্ভালাপ চলত প্রায় প্রতিদিনই। সেসময়, নিভৃত বিশ্রাম কক্ষে ব্যক্তিগত পরিচারক ছাড়া কারও প্রবেশের অধিকার ছিল না। ঘটনার দিন রাত্রির আহারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত ছিল দণ্ডিক ও তার অপর সহকারী। শ্রীধর ভর্জিত মৎসান্ড ও সুরা সরবরাহে নিযুক্ত ছিল, পাকগৃহের সংলগ্ন ভাণ্ডারকক্ষে রাখা ছিল সুরাকুম্ভ। দুর্জয়ের পরিচারক ভক্ত আর ত্রিগুণের পরিচারক বোরা আহার্য ও পানীয় পাকগৃহ থেকে বয়ে নিয়ে গিয়ে বিশ্রামকক্ষে পরিবেশন করেছিল। সন্ধ্যা প্রগাঢ় হতে মহামাত্য অসুস্থ বোধ করতে থাকেন, তিনি রাতের আহার গ্রহন করবেননা বলে জানান, কিছুপরে কুমার ত্রিগুণেরও মুখচোখ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। দুজনেরই ভেদবমি শুরু হয় এরপরে, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হয়ে আসে ক্রমে। ইতিমধ্যে কুমার উদয়ের উদ্যোগে বৈদ্য ভৃগুদেব এসে উপস্থিত হন, কিন্তু দুর্জয় বর্মা জ্ঞান হারিয়েছেন ততক্ষণে, শতচেষ্টাতেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি এরপর। তবে কুমার ত্রিগুণ সজ্ঞানেই ছিলেন, যদিও নাড়ী অতিক্ষীণ; তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেন সমস্ত রাত্রির প্রচেষ্টায়। কুমার উদয় সেই সন্ধ্যায় স্বল্পমাত্রায় সুরাপান করেছিলেন, পরের দিন অতিপ্রত্যুষে তাঁর আনন্দপুর যাত্রার ব্যবস্থা ছিল। এই থেকেই একপ্রকার বোঝা যায়, বিষ সুরাতেই ছিল, পরবর্তীতে সুরাভাণ্ড পরীক্ষা করে ভৃগুদেব নিঃসন্দেহ হন। রোগীদের লক্ষণ পরীক্ষা করে বৈদ্যরাজ একপ্রকার নিশ্চিত যে এটি একটি ভেষজ বিষ, সম্ভবতঃ বৎসনাভ। পরদিন প্রভাতে কুমার উদয় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পাচক, পরিচারক তথা সমস্ত সেবকদের, সেসময়ই আবিষ্কার হয় যে শ্রীধর পলাতক। তার খোঁজ চলছে সেই অবধি, তবে এখনও সন্ধান মেলেনি, যেন বাষ্পীভূত হয়েছে সে কোনও যাদুমন্ত্রে।

 

‘শ্রীধরকে কতদিন থেকে চিনতেন আপনি?’ পান্থগৃহস্বামীর সাথে কথোপকথন শুরু হয়েছে পুষ্পকেতুর, জিজ্ঞাসাবাদ তাকে দিয়েই শুরু করেছেন কুমার।

‘দুইবৎসর পূর্বে আমার কাছে আসে সে কর্মের সন্ধানে, নিজেকে মালব দেশীয় আর্য বলে পরিচয় দেয়, রন্ধন কর্মে অভিজ্ঞ এমনটাই জানায় সে। এরপরে তাকে পাকগৃহে নিযুক্ত করি, রন্ধনশৈলীতে সে সত্যি বিশেষ পারদর্শী প্রমাণ হয় অল্প দিনেই। চাল চলন, ব্যবহার, সব দিক থেকেই সে ছিল একজন উচ্চমানের কর্মচারী; সেকারণে প্রতিহারী বিষ্ণুদাস যখন তাকে রাজ অতিথিশালে নিয়োগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, আমি আপত্তি করিনি।‘

‘আপনি কি এত সহজেই কোনও অজ্ঞাত কুলশীলকে কর্মে নিয়োগ করেন ভদ্র? বিশেষতঃ যখন এটি পাকশালার কর্ম, বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির আগমন ঘটে আপনার পান্থশালায়।‘

‘না, অজ্ঞাত কুলশীলকে কর্মে নিয়োগ করিনা আমি, শ্রীধরকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন, আমারই এক অতিপরিচিত পিতৃপ্রতিম ব্যক্তি শ্রেষ্ঠী পুণ্ডরিক, তিনি এই বন্দরের একজন নামী বস্ত্র ব্যবসায়ী।‘

‘সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠীর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন, আপনি তাঁর বাসভবন তথা কর্মস্থলের দিকনির্দেশ দিন আমাদের।‘

‘কিন্তু, তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব নয় আর্য, বিগত পৌষমাসে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে।‘

‘তাহলে আপনার বক্তব্যের উপর আস্থা রেখেই চলতে হবে আমাদের তাই তো?’

‘এ কথা কেন বলছেন আর্য, আমার কর্মচারীদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন, তারাও একই কথা বলবে। অজ্ঞাত ব্যক্তি, তায় বিদেশী, পরিচয় যাচাই না করে নিয়োগ করলে বিপদ তো আমারই সবচেয়ে বেশী।‘ এরপরে আর কথা বিশেষ এগোয় না, পান্থশালার মুখ্য পাচককে নিভৃতে প্রশ্ন করেও এর বেশী কিছু জানা যায় না।

 

‘শ্রীধরের কর্মে খুশী ছিলে তুমি?’ বন্দরের অতিথিশালার মুখ্য পাচক দণ্ডিককে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘স্বল্পদিনের পরিসরে ভাল মন্দ বোঝা কঠিন, তবে তার রন্ধনের হাত ছিল চমৎকার; ভক্তি শ্রদ্ধাও করত আমাকে, সব মিলিয়ে তাকে সজ্জন বলে মনে হয়েছিল আর্য।

‘ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তাকে মৎসান্ড ও সুরার দায়িত্ব কি তুমিই দিয়েছিলে?’

‘এ ব্যাপারে আমার কোনও দোষ নেই প্রভু, জম্বুক, আমার অপর সহকারীটি নিতান্ত অর্বাচীন, কোনও কাজই স্বাধীনভাবে করতে পারে না, সেকারণেই শ্রীধর নিজে থেকেই এই দায়িত্ব নিয়েছিল। প্রতিসন্ধ্যায় সুরা সরবরাহ ও তার সাথে লঘুভোজন প্রস্তুতির কার্যটি ছিল তার, আর জম্বুক আমাকে রাতের আহার্য পাকে সাহায্য করত।‘

‘ভাণ্ডারকক্ষে যে সুরা সংগৃহীত আছে, কোথা হতে এসেছিল তা?’

‘সুরা সংগ্রহের দায়িত্ব ভদ্র বিষ্ণুদাসের, নিকটবর্তী শুণ্ডগৃহ থেকে তাঁর নির্দেশে আসে সুরা। তবে এবার, কুমার উদয় সাথে করে কিছু উত্তম সুরা নিয়ে এসেছিলেন ব্যাধপুর থেকে, এযাবৎ সেই সুরাই পরিবেষিত হোত সন্ধ্যাকালে।‘

‘সুরা কলসটি এখন কোথায়?’

‘বৈদ্যরাজ পরীক্ষার জন্য নিয়ে গিয়েছেন সেটি’।

‘সেদিন সন্ধ্যায় ঠিক কি ঘটেছিল বিশদে বল, সুরা নিতে পাকগৃহে কে এসেছিল ও কতবার, শ্রীধর কি সুরাভাণ্ড ভাণ্ডারকক্ষে একাই নিয়ে গিয়েছিল, এই সকল তথ্যই প্রয়োজনীয়।‘

‘আমি পুষ্পান্ন রাঁধছিলাম, জম্বুক মশলা পিষতে গিয়ে এলাচ দিতে ভুলেছিল, তাকে ভৎর্সনা করেছিলাম তাই; সে পুনর্বার ভান্ডার কক্ষ থেকে উপকরণ এনে আমাকে দেখিয়ে মশলা প্রস্তুতিতে যুক্ত হয়, আমিও নিজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রন্ধন চলাকালে ভাণ্ডার কক্ষে প্রবেশের দরজাটি আমার পিছনে ছিল, তাই এর অধিক কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে জম্বুক হয়তো লক্ষ্য করে থাকবে।‘

‘তোমার সাথে শ্রীধরের সম্পর্ক কিরূপ ছিল?’ জম্বুককে প্রাথমিক অভয়দানের পর প্রশ্ন করেন কুমার; মধ্যবয়সী মানুষটিকে দেখলে বোঝা যায় সে স্বভাবে সুশীল তবে কিছুটা নির্বোধ প্রকৃতির। এধরণের ব্যক্তি সাধারণতঃ বাধ্য ও পরিশ্রমী হয়, যদিও নিজস্ব বিচারবুদ্ধির অভাবে ঠিক নির্ভরযোগ্য হয়না।

‘সম্পর্ক কিছুমাত্র ছিলনা প্রভু, ঐ বিদেশী যে বদ প্রকৃতির আমি বুঝেছিলাম আগেই, সযত্নে এড়িয়ে চলতাম তাই।‘

‘সে কি! বদ প্রকৃতির জেনেও নীরব ছিলে? ভদ্র দণ্ডিককে জানালে না?’ কুমারের অনুযোগে বিহ্বল হয়ে পড়ে জম্বুক, প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে এই ঝঞ্ঝাট ঘটবে আশা করেনি সে।

‘তার বদ প্রকৃতির কি পরিচয় পেয়েছিলে তুমি?’

‘আজ্ঞে, সে বিদেশী, তায় চম্পা দেশীয় হওয়া অসম্ভব নয়, সুযোগ পেলেই বিশ্রামকক্ষে উঁকি ঝুঁকি দিত, তাতেই বুঝেছিলাম,’ জম্বুক মরীয়া হয়ে সপক্ষে যুক্তি দেয়।

‘দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যাকালে, সুরা নিতে কে এসেছিল বিশ্রামকক্ষ থেকে?’

‘সেদিন ভক্ত আসেনি, বোরা একাই নিয়ে গিয়েছিল ভোজ্য ও পানীয় কয়েকবার, শ্রীধর তাকে মৎসাণ্ডের অবশিষ্ট আস্বাদন করতে দিয়েছিল। বোরা উঠানে দাঁড়িয়ে খেয়েছিল তা, আমি দেখেছিলাম ভিতর থেকে, শ্রীধর ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা করার চেষ্টা করত এইভাবে, আমি জানি।‘

‘সুরাভাণ্ড কি শ্রীধর ভরে দিত, নাকি বোরা নিজেই নিয়ে নিত ভাণ্ডারকক্ষ থেকে?’

‘ভক্ত এলে ভাণ্ডারকক্ষে যেত শ্রীধরের সাথে, বোরা পাকগৃহের দ্বারের বাহিরে অপেক্ষা করে, শ্রীধর একাই সেদিন সুরাভাণ্ড পূর্ণ করে এনেছিল মোট তিনবার।‘ এরপর জম্বুককে বিদায় দিয়ে যথাক্রমে ভক্ত ও বোরার সাথে জিজ্ঞাসাবাদপর্ব চলে।

ভক্ত একজন মধ্যবয়সী কর্মঠ পুরুষ; সে স্বল্পবাক ও বুদ্ধিমান, কথাবার্তা থেকে তাকে দায়িত্বশীল বলে বোধ হয়।

‘দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বিশ্রামকক্ষে কে কে উপস্থিত ছিল?’

‘কুমার উদয়, কুমার ত্রিগুণ ও আমার প্রভু মহামাত্য নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের পরিচর্যার জন্য আমি ও বোরা উপস্থিত ছিলাম। আমি তাম্বুল সরবরাহ ও ব্যাজনকর্মে ব্যস্ত থাকায়, বোরা খাদ্য পানীয় পরিবেশনের দায়িত্ব নেয়।‘

‘প্রতিদিনই কি এই ব্যবস্থাতেই সেবাকর্ম চলে?’

‘না, অন্যদিন কুমার উদয়ের সেবক হর্ষ ব্যাজনকর্ম করে, সেক্ষেত্রে বোরা ও আমি দুজনেই খাদ্য-পানীয় পরিবেশনে নিযুক্ত থাকি, তবে তাম্বুল প্রতিদিন আমিই প্রস্তুত করি; প্রভু আমার বানানো তাম্বুল ছাড়া খেতেননা।‘ কথাকটি বলতে বলতে কন্ঠরোধ হয়ে আসে ভক্তের।

‘কতদিন হোল মহামাত্যের সেবায় নিযুক্ত আছ?’

‘আমরা বংশপরম্পরায় রাজপুরীর সেবক, ছোটকাল থেকে রাজপুরীতে কর্ম করি, প্রভু যবে মহামাত্যের দায়িত্ব নিলেন, মহারাজের নির্দেশে রাজপুরী থেকে আমরা কয়েকজন তাঁর গৃহকর্মের দায়িত্ব পাই। সেও আজ দশ বছর হবে। ক্রমে ক্রমে, আমি তাঁর একান্ত সেবক হয়ে উঠি, বড় স্নেহ করতেন প্রভু আমায়।‘ ভক্তের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

‘হর্ষ সেদিন বিশ্রামকক্ষে আসেনি কেন?’

‘তার প্রভু পরদিন প্রত্যুষে যাত্রা করবেন আনন্দপুরে, সেকারণে যাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিল সে।‘

‘শ্রীধরের সাথে তোমার পরিচয় ছিল, তার সম্পর্কে তোমার ধারণা কিরকম?’ প্রশ্ন শুনে কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখায় ভক্তকে, কিছুক্ষণ নীরব থেকে সে নিজের মতামত জানায় এরপর।

‘আমার তাকে ভালোই লাগত, ভদ্র, মার্জিত, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার।‘

‘কোনওরূপ সন্দেহজনক আচরণ লক্ষ্য করেছিলে কি কখনও?’

‘সন্দেহজনক নয়, তবে রাজপুরুষদের সস্পর্কে, বিশেষতঃ আমার প্রভুর বিষয়ে কৌতুহল ছিল তার, কিন্তু আমার তা অস্বাভাবিক মনে হয়নি সেসময়। ভৃত্যদের মধ্যে উচ্চবংশীয়দের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কৌতুহল থাকা সাধারণ ঘটনা।‘

‘বোরা পাকগৃহের ভিতরে প্রবেশ করে না খাদ্য আনয়নকালে, একথা তোমার জানা ছিল?’

‘হ্যাঁ, আমি জানি সেকথা। আসলে, বোরা আটবিক জাতীয়, দণ্ডিক পাকগৃহে তার উপস্থিতিতে স্বচ্ছন্দ নয়। প্রভু ত্রিগুণ এবিষয়ে কিছু জানতেননা, নাহলে হয়তো তাঁর রোষে দণ্ডিকের চাকুরী যেত।‘

‘ঠিক আছে, এখন তুমি যেতে পারো, বোরাকে ভিতরে আসতে বল’।

বোরা ধীয়ের মতই আটবিক জাতির মানুষ, তবে তার চেহারা ভিন্ন গোত্রের। বেত্রবৎ ঋজু, মধ্যম উচ্চতা, গাত্রবর্ণ শ্যামল তবে কৃষ্ণকায় নয়, ভাবলেশহীন মুখশ্রী দেখে বয়স আন্দাজ করা কঠিন। শৈলদেশের পর্বতগাত্রের অরণ্যে বসবাসকারী এক বৃহদাংশ এই জাতির মানুষ। এরা নিজস্ব ভষায় কথায় বলে, নগরসভ্যতার থেকে দূরে অরণ্যজীবনে গড়ে উঠেছে এদের নিজস্ব সমাজ। বোরা শিশুকাল থেকে ত্রিগুণবর্মার গৃহস্থালীতে আছে, তার মাতা ছিল কুমারের মাতার ব্যক্তিগত পরিচারিকা। বোরা আর্যভাষা বুঝতে পারে, তবে স্থানীয় প্রাকৃত অপভ্রংশ বুলিতেই সে অধিক স্বচ্ছন্দ। সেকারনে বোরার সাথে প্রশ্নোত্তর চলে আধিকারিক বাসুকির মাধ্যমে।

‘সেই সন্ধ্যায় কতবার সুরাভাণ্ড নিয়ে পাকগৃহে গিয়েছিলে?’

‘দ্বিতীয়বারের ভরে আনা সুরা অর্ধেক শেষ হতে, শেষবারের মত পাকগৃহে যাই নূতন করে পানীয় ভরে আনতে। তখন শ্রীধর আমাকে কিছু অবশিষ্ট মৎসাণ্ড দেয় আহার করতে, আমি সেগুলি কোঁচড়ে ভরে বিশ্রামকক্ষে ফেরত আসি। ততক্ষণে মহামাত্যের পাত্র খালি হয়েছে, তাঁকে ও প্রভুকে পানীয় পরিবেশন করি, কুমার উদয় সেসময় সুরা নিতে অস্বীকার করেন, পরিবর্তে তিনি ভক্তের কাছ থেকে তাম্বুল চেয়ে নেন। এর কিছু পরে আমার প্রভু ও মহামাত্যর ভেদবমি শুরু হয়।‘

‘দ্বিতীয়বারের সুরা নিঃশেষ হবার পূর্বেই আবার পাকগৃহে গেলে কেন?’

‘প্রভুর সুরাপাত্রে মক্ষিকা পরেছিল সুরাভাণ্ড থেকে, তাই  কুমার উদয়ের আদেশে ভাণ্ডের অবশিষ্ট সুরা নিক্ষেপ করে নূতন করে ভরে আনি।‘

‘শ্রীধরকে তোমার কেমন মানুষ মনে হোত?’

‘দণ্ডিকের অপেক্ষা অনেক ভালো, সহৃদয় ব্যবহার ছিল তার।‘

‘ভাণ্ডারকক্ষে ভাণ্ডপূর্ণ করতে প্রতিবার কি সে সম পরিমান সময় নিয়েছিল, না কি তৃতীয়বার অধিকক্ষণ ভিতরে ছিল সে?’

‘তৃতীয়বার সুরাভাণ্ড পরিষ্কার করে, তবে পানীয় ভরেছিল সে, তাতে সময় তো অধিক লাগবেই।‘

‘ঠিক আছে তুমি এখন আসতে পারো, তবে পরবর্তীকালে কিছু বিশেষ তথ্য স্মরণে এলে আমাদের জানাতে ভুলোনা’, সম্মতি জানিয়ে বিদায় নেয় বোরা।

 

‘ঘটনার বিচারে শ্রীধরের প্রতিই সন্দেহ নির্দিষ্ট হয়, তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল সুরায় বিষ মেশানোর, সে বিদেশী, চম্পাদেশের চর হওয়া বিচিত্র নয়, সেক্ষেত্রে অপরাধের উদ্দেশ্য স্পষ্ট।‘ বাসুকি মন্তব্য করেন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে।

‘হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত সেরকমই বোধ হচ্ছে। সে যে বিদেশী গুপ্তচর সেবিষয়ে আমিও একপ্রকার নিঃসন্দেহ, নতুবা, এভাবে আত্মগোপন করা সম্ভব হোতনা তার পক্ষে। তবে এই কার্যে তার কোনও সহায়ক ছিল কিনা, সেই বিষয়টিই ভাবাচ্ছে এই মুহূর্তে’, পুষ্পকেতু নিজের মতামত জানান। অপরাহ্ন হয়ে এসেছে প্রায়, বৈদ্যরাজ ভৃগুদেবের সাথে সাক্ষাৎ করে সেদিনকার মত অনুসন্ধান কার্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেন কুমার। অতিথিশালার একটি কক্ষে আপাততঃ ত্রিগুণবর্মার চিকিৎসা চলছে, তার সংলগ্ন দুটি কক্ষ জুড়ে বৈদ্যরাজের ওষধিপ্রস্তুতি ও শয্যার ব্যবস্থা হয়েছে, দুর্ঘটনার রাত্রি থেকে তিনি সেখানেই রয়েছেন। কুমারের আগমন বার্তা আগেই পেয়েছিলেন, ফলে আলাপের অপেক্ষায় প্রস্তুত ছিলেন ভৃগুদেব।

‘কুমার ত্রিগুণ এখন কেমন আছেন?’

‘নাড়ি দুর্বল, তবে এবারের মত বোধকরি বিপদ কেটেছে। অবশ্য সম্পূর্ণ সুস্থ হতে এখনও কিছুদিন লাগবে।‘

‘তিনি কি সজ্ঞানে আছেন? তাঁর সাথে বাক্যালাপ সম্ভব কি?’

‘বাক্যালাপ সম্ভব, তবে অধিকজন রুগীর কক্ষে ভীড় না করাই বাঞ্ছনীয়’, ভৃগুদেব পুষ্পকেতুর সঙ্গীদের প্রতি ইঙ্গিত করেন।

‘অবশ্য; কাল প্রভাতে আপনার অনুমতি নিয়ে তাঁর সাথে আমি একাই আলাপ করব আর্য। এখন আপনার সাথে দুএকটি বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। সুরার মূল কলসীটি আপনি পরীক্ষার জন্য এনেছিলেন, সেটিতে বিষ পেয়েছেন কি?‘

‘না কলসীতে বিষ নেই, সুরাভাণ্ডে ছিল। বৎসনাভ, একপ্রকার শৃঙ্গক বৃক্ষের মূল থেকে তৈরী বিষ, এর স্বাদ কটু; কিন্তু সুরার সাথে মিশ্রণ ঘটলে স্বাদ ঢাকা পড়বে সুরার তীব্রতায়। তাছাড়া বিষের কার্যক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় সুরার প্রভাবে।‘

‘তাহলে আপনি নিশ্চিত যে এই বিষ বৎসনাভ?’

‘হ্যাঁ রোগের লক্ষণ থেকে সেরকমই ধার্য হয়। এই বিষের প্রভাবে শেষ পর্যায়ে, অক্ষিপটল পর্যায়ক্রমে বিস্ফারিত ও নিস্তেজ হতে থাকে, সমস্ত দেহে খিঁচুনি জাগে সেই সাথে; মহামাত্যের সেরূপ লক্ষণ দেখা দিয়েছিল।‘

‘কুমার ত্রিগুণ কি বয়সের গুণেই রক্ষা পেলেন এযাত্রা?’

‘কতকটা তাই, তাছাড়া হয়তো বিষাক্ত সুরার মাত্রা কিছু কম ছিল তাঁর শরীরে। শুনতে পাই, শেষবারে আনীত সুরা প্রথমে মহামাত্যই সেবন করেন, ত্রিগুণের পানপাত্র খালি হতে কিছু পরে তিনি সেই সুরা গ্রহণ করেন। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই, তাঁর উদরে মহামাত্যের সমপরিমাণ বিষ প্রবেশ করতে পারেনি।‘

‘এই বিষ এ অঞ্চলে কতটা সহজলভ্য?’

‘রোজকার জীবনে এই বিষ সহজলভ্য নয়, তবে শৃঙ্গক বৃক্ষ স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে ওঠে এই দেশের অরণ্যাঞ্চলে, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনে বৎসনাভ সংগ্রহ করা কঠিন কাজ নয়।‘

এরপর ভৃগুদেবের কাছ থেকে বিদায় নেন সকলে। আধিকারিক বাসুকিকে সেইদিনের মত বিদায় জানিয়ে, বাকি তিনজন পূর্বনির্দিষ্ট পান্থশালায় যান রাত্রিবাসের উদ্দেশ্যে। পুষ্পকেতুর অনুরোধেই অতিথিশালার পরিবর্তে, পান্থশালায় বসবাসের ব্যবস্থা হয়েছে তাঁদের তিনজনের; বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজকীয় অতিথিশালায় রাত্রিবাস বিপজ্জনক হতে পারে মনে করেছেন কুমার।

সন্ধ্যাকালে তিনজন বিশ্রামকক্ষে বসে আছেন, সুগন্ধি শীতল তক্রের পানপাত্র হাতে সারাদিনের অনুসন্ধানপর্ব বিষয়ে রোমন্থন চলছে। পুষ্পকেতু মকরধ্বজের মতামতকে গুরুত্ব দেন, তিনি স্থানীয় মানুষ ও তাদের মানসিকতা সম্পর্কে অনেক বেশী অবহিত, সেকারণেই সঙ্গী করেছেন তাঁকে।

‘দণ্ডিকের বোরার প্রতি যে মনভাব, তা কি স্বাভাবিক?’ পুষ্পকেতু জানতে চান মকরধ্বজের কাছে।

‘দণ্ডিক স্থানীয় অনার্য নয়, সে জাতিতে ব্রাহ্মণ, আর্যরক্ত আছে তার ধমনীতে, ফলে, আটবিক জাতির প্রতি তার ছুঁৎমার্গ থাকতে পারে। আসলে উচ্চবর্ণ ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের গৃহে রন্ধনকার্যে এই জাতীয় মিশ্র ব্রাহ্মণদের বিশেষ চাহিদা, হয়তো নিজের স্বকীয়তা প্রমাণের চেষ্টায় এরা একটু বেশীই সচেতন।‘

‘বুঝেছি, এখানেও সেই শ্রেষ্ঠত্ববোধ। জম্বুক শুধুমাত্র মিশ্র রক্তের গুণেই তার আনুকুল্য পেয়েছে, কাজে অপটু হওয়া সত্ত্বেও।’ পুষ্পকেতুর মন্তব্যে হালকা শ্লেষের ছোঁয়া।

‘জম্বুকের কথাবার্তা একেবারেই ভরসাযোগ্য মনে হয়নি আমার, লোকটি আদতে নির্বোধ।‘

‘হ্যাঁ। এদিকে, পান্থগৃহস্বামীর বক্তব্য নিয়েও ধন্দ রয়ে গেল, শ্রেষ্ঠী পুণ্ডরিকের ব্যাপারটি কি সম্পূর্ণ মনগড়া?’

‘কি জানি, এ বিষয়টি আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। অমরাবতী যদি সত্যই চরবাহিনী নিয়োগ করে থাকে এদেশে, কাটিগারে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাদের সহায় থাকা বিচিত্র নয়। আপনার কি মনে হয় কুমার?’

‘আমিও সেকথাই ভাবছি,‘ চিন্তিত দেখায় পুষ্পকেতুকে।

‘আচ্ছা, রাজপরিবারে সকল কর্মচারী মিশ্ররক্তের, সেক্ষেত্রে কুমার ত্রিগুণের সেবক শুধু অনার্য নয়, একেবারে অরণ্যবাসী, এর কারন কি?’ উল্মুক কৌতুহল প্রকাশ করেন এতক্ষণে।

‘আপনারা জানেন না?’ মকরধ্বজ বিস্মিত হন প্রশ্ন শুনে।

‘কি জানি না?’ পুষ্পকেতু আগ্রহ দেখান।

‘কুমার ত্রিগুণের মাতা ছিলেন আটবিক প্রজাতির এক দলপতি কন্যা। মহারাজ শ্রীবর্মা একবার শিকারে গিয়ে অরণ্যমধ্যে পথভ্রষ্ট হয়ে বন্যশুকরের আক্রমণে গুরুতর আহত হন। তখন, দলপতির আশ্রয়ে ও তাঁর কন্যার সুশ্রুষায় সুস্থ হন তিনি, তাদেরই সাহায্যে নিজ তাঁবুতে ফিরতে পারেন কয়েকদিন পর। এর কিছুদিন পরে, সেই কন্যাকে বিবাহ করে ব্যাধপুরে নিয়ে আসেন শ্রীবর্মা, নতুন মহিষীর নামকরন করেন সেবাদেবী। কিন্তু নগরে আনলেও মূল রাজপুরীতে আশ্রয় দিতে পারেননি তাঁকে, পরিবার, বিশেষতঃ পট্টমহিষীর প্রবল বিরোধিতায়। নগরীর উপান্তে একটি ক্ষুদ্র প্রাসাদ বানিয়ে দেন তিনি সেবাদেবীর জন্য। সেবা আজীবন সেখানেই থেকেছেন, ত্রিগুণবর্মাও সেখানেই শিশুকাল কাটিয়েছেন, যদিও মাতার মৃত্যুর পশ্চাতে রাজপুরীতে অধিষ্ঠিত হন তিনি। সেকারণে, বিধিবদ্ধ আর্যপন্থায় জীবনযাপনে বিশ্বাসী নন ত্রিগুণ। রাজপুরীতে তাঁর উপস্থিতি উন্মুক্ত বাতাসের মত; রাজকুমার হিসাবেও তাঁর জনপ্রিয়তা কুমার উদয়ের চেয়ে বহূলাংশে বেশী তাঁর মানবিক গুণের জন্য।‘

‘এ যে রীতিমত গল্প কথা হে কেতু?’ উল্মুক বিস্ময় ধরে রাখতে পারেননা।

‘উদয় ও ত্রিগুণের মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ, সে তাহলে এই কারণেই!’ অন্যমনস্ক ভাবে মন্তব্য করেন পুষ্পকেতু।

***

পরদিন প্রভাতে ত্রিগুণবর্মার শয্যাকক্ষে তাঁর সাথে দেখা করতে যান পুষ্পকেতু, কথামত একাই উপস্থিত হন তিনি। এই কদিনের ধকলে, ত্রিগুণবর্মার শরীর শীর্ণকায়, চোখের কোনে কালি; তাঁর দোরের কাছে পাহারায় রয়েছে দুইজন সশস্ত্র রক্ষী, বোরাও বসে আছে দ্বারপ্রান্তে বিশ্বস্ত শ্বাপদের মত।

‘এখন কেমন বোধ করছেন কুমার?’

‘যা ঘটে গেলো, এরপর আর কেমন থাকা যায় আর্য? মহামাত্য চলে গেলেন, আমি রয়ে গেলাম, এ যন্ত্রণা ভুলি কি করে?’

‘তাঁর মৃত্যু দুঃখজনক, কিন্তু আপনার সুস্থতা শৈলদেশ তথা আপনার পরিবারের স্বার্থে একান্ত কাম্য, নিজেকে অযথা দায়ী করবেননা কুমার।‘ পুষ্পকেতুর কোমল বাক্যে ত্রিগুণের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে।

‘এই জাতীয় কোনও বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন কি? কাটিগারে আপনি অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তীতে দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন, সেসময় কোনও আভাস পেয়েছিলেন কি আপনার তদন্ত সূত্রে?’

‘না, একেবারেই আশা করিনি এরূপ কিছু ঘটতে পারে, তবে পুনর্বার জলপথে শত্রুর আবির্ভাবের শঙ্কা ছিল, নৌসেনাদের নূতনরূপে সঙ্ঘবদ্ধ করার কাজে লিপ্ত ছিলাম তাই।‘

‘এই হীন ঘটনা অমরাবতীর দুষ্কর্ম, এই কি আপনার মত?’ প্রশ্ন শুনে কিছুটা থমকে যান কুমার ত্রিগুণ।

‘এ এক গভীর ষড়যন্ত্র, এই মুহূর্তে শুধু এটুকুই বুঝেছি।‘ ধীরে ধীরে উত্তর দেন তিনি।

***

পরেরদিন নৌপথে ব্যাধপুর প্রত্যাবর্তন করছেন পুষ্পকেতু, উল্মুক ও মকরধ্বজ, এবার সাথে আছেন ত্রিগুণ ও বৈদ্যরাজ। কাটিগার এখনও রাজপুরুষদের জন্য বিপজ্জনক, পুষ্পকেতু সেরকমই মনে করছেন, ত্রিগুণকেও সাথে নিয়ে চলেছেন তাই। তদন্তের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে দণ্ডিক, জম্বুক, ভক্ত ও বোরা সামিল হয়েছে নৌযাত্রায়।

রাত্রির আহার পর্ব শেষ হতে দুই মিত্র নিজকক্ষে জানালার ধারে বসে আছেন, অন্ধকার রাত্রির তারাভরা আকাশ উদাস করেছে তাঁদের গৃহমুখী হৃদয়কে। এই স্বজনহীন বিদেশে, গভীর রাজনৈতিক আবর্তে আটকে পড়ে কোথায় যেন ছন্দপতন ঘটেছে জীবনে, যৌবনের স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বলতা অদৃশ্য হয়েছে নিভৃত আলাপনে।

‘অমরাবতীর চক্রান্তে হত্যা, শ্রীধর গুপ্তহত্যার কাণ্ডারী, ধূর্জটিদেবকে একথাই জানাবে তাহলে?’

‘হ্যাঁ, সবদিক বিচার করে, সেরকমই বোধ হচ্ছে।‘

‘তবে কি এখন যুদ্ধই অবশ্যম্ভাবী?’

‘হয়তো। আমি শুধু একটি কথাই ভাবছি, শৈলদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনে অমরাবতীর লাভ, কিন্তু রাজপুরুষদের হত্যা করে, কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে?’

‘শৈলদেশকে কুক্ষিগত করার প্রচেষ্টা এটি, আমার তো সেরকমই বোধ হচ্ছে।‘

‘বাইরে থেকে শৈলদেশকে গুপ্তহত্যার দ্বারা কুক্ষিগত করা যাবে কি?’ পুষ্পকেতুর মন্তব্যে রহস্যের আভাস।

‘তুমি কি অমরাবতীর কোনও আভ্যন্তরীন সুহৃৎ থাকার কথা ভাবছ?’

‘দ্বিতীয়বারের সুরা ফেলে দিয়ে, তৃতীয়বার সুরা আনতে বললেন উদয় বর্মা, অথচ তিনি নিজে তা স্পর্শ করলেন না। তিনি স্থল সেনানায়ক, বন্দরের দণ্ডনায়ক তাঁর অধীন, তবুও শ্রীধর ধরা পড়ল না এতদিনে। ভদ্রবর্মনের পক্ষ নিয়ে মহামাত্য ও ত্রিগুণের সাথে ক্রমাগত দ্বন্দ বেধেছে তাঁর অতীতে, এসব কি নিছকই কাকতালীয়?’ পুষ্পকেতুর যুক্তির আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে পড়েন উল্মুক।

***

নবাগত বর্ষায় রাজধানীতে মাঝে মধ্যে দু এক পশলা বৃষ্টি হলেও, এখনও উগ্রতা কমেনি গ্রীষ্মের, সমুদ্র থেকে দূরে এ অঞ্চলে দাবদাহের প্রকোপ অধিক, পাটলিপুত্রের মতই। অপরাহ্নের নিভে আসা সূর্যের তেজে কিছুটা শান্তি, উদ্যানের জাতিপুষ্পের গন্ধে বিশ্রামকক্ষে ভেসে আসে এক সিক্ত মাদকতা। রাজপুরীর অতিথিশালায় গোপন আলোচনায় বসেছেন পুষ্পকেতু, উল্মুক ও আচার্য ধূর্জটিদেব। শৈলরাজের সাথে সাক্ষাতের পূর্বে তদন্ত বিষয়ক তথ্য আচার্যের গোচরে আনতে চান পুষ্পকেতু।

‘তোমার পর্যবেক্ষণের উপর আমার আস্থা আছে কুমার, উদয় এই ষঢ়যন্ত্রের মধ্যমনি, সেকথা স্পষ্ট হয়েছে সবদিক বিচার করে। কিন্তু মহারাজকে সেকথা কি ভাবে বলা চলে তাই চিন্তা করছি, প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো কিছু নেই, সবই অনুমান মাত্র।‘

‘অনুমান কেন, পরোক্ষ প্রমাণ বলা চলে এগুলিকে!’ পুষ্পকেতু যুক্তি দেন।

‘কিন্তু এক রাজকুমার তথা সেনানায়ককে অপরাধী সাব্যস্ত করার পক্ষে এই প্রমাণ যথেষ্ট নয় কুমার; তাও যদি তার নিজ ভ্রাতা ত্রিগুণ এই যুক্তি আনতেন, হয়তো বিষয়টি সহজ হোত। আমরা বিদেশী, তায় যুদ্ধে কোনও পক্ষ নিতে অরাজী, মহারাজ ধরে নেবেন, এ আমাদের ছল।‘

‘তাহলে তো শ্রীধরকে বন্দী করা ভিন্ন উপায় থাকে না, কিন্তু তাকে খুঁজে বের করা আমাদের সাধ্যাতীত।‘

‘তুমি ত্রিগুণের সাথে সাক্ষাৎ কর কেতু, তাঁর সাহায্য ভিন্ন কিছুই প্রমাণ করা যাবে না।‘

‘কিন্তু সেও তো সময়সাপেক্ষ, আজ কাটিগার থেকে ফিরেছি আমরা মহারাজ জেনেছেন নিশ্চয়, তাঁকে কি উত্তর দেব?’

‘তাঁকে ঠেকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার, তুমি চিন্তা কোরনা। এরূপ গূঢ় বিষয়ে ত্বরা করা চলে না।‘

সন্ধ্যা নেমে আসে, আবছায়া প্রকৃতির বিষাদ্গম্ভীর আবহাওয়া যেন গ্রাস করে কক্ষের আভ্যন্তরীন পরিবেশকে।

***

প্রভাতের দ্বিতীয় প্রহর, অলিন্দে দাঁড়িয়ে আকাশের ঘনঘটা লক্ষ্য করছেন পুষ্পকেতু অন্যমনে, আচমকা কোলাহল কানে আসে, যেন এক প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে রাজপুরীর চৌহদ্দিতে। কৌতুহলী হয়ে নীচে নেমে আসেন কুমার, বিশ্রামকক্ষ থেকে উল্মুকও বেরিয়ে এসে সঙ্গী হন তাঁর। সামনের উদ্যান পেরিয়ে এগিয়েছেন কিছুদুর দুজনে, ইতিমধ্যে এক রাজপুরীর প্রহরী ছুটে আসে তাঁদের দিকে।

‘আপনাদের সংবাদ দিতে পাঠালেন মহা প্রতিহারী; আজ প্রত্যুষে পদ্মনাভমন্দির সংলগ্ন অরন্যপথে অশ্বারোহন কালে তীরবিদ্ধ হয়েছেন কুমার উদয়, এক্ষণে রাজপুরীতে আনা হয়েছে তাঁকে, রাজবৈদ্য পরীক্ষা করছেন।‘

‘সেকি! তাঁর অবস্থা কিরূপ? আততায়ী ধরা পড়েছে কি?’ পুষ্পকেতুর প্রশ্নের সদুত্তোর দিতে পারে না প্রহরী, অগত্যা তাকে বিদায় দিয়ে আবাসে ফেরেন দুজনে। সেখানে এসে দেখেন মকরধ্বজ বার্তালাপ করছেন আচার্যের সাথে, দুজনেই অত্যন্ত উত্তেজিত।

‘সংবাদ পেয়েছেন বোধকরি? আমি রাজপুরী থেকেই আসছি। উদয়বর্মা হত হয়েছেন বিষাক্ত তীরের আঘাতে।‘ মকরধ্বজের বাক্যে স্তব্ধ হয়ে থাকেন সকলে বেশ কিছু মুহূর্ত।

‘উদয় অরণ্যে কি করছিলেন?’

‘সকলেই জানে অশ্বারোহন তাঁর প্রিয় ব্যাসন, নগরীতে উপস্থিত থাকলে তিনি প্রতিদিন প্রত্যুষে অশ্বারোহনে যান নগরীর উপান্তে উপত্যকাভূমি অবধি, যেখানে অরণ্যের শুরু। একাই যান চিরকাল, তবে সঙ্গে অস্ত্র থাকে। আজ উপত্যকা ও অরণ্যের সন্ধিস্থলে পৌঁছতে, একটি তীর এসে তাঁর স্কন্ধে বেঁধে, যদিও ক্ষত তেমন গভীর ছিলনা। কুমার তৎক্ষণাৎ অশ্বের মুখ ঘুরিয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে রওয়ানা হন। তবে বেশীদূর যেতে পারেননি তিনি, মন্দিরের কাছাকাছি এসে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন অচেতন হয়ে। সেসময়ে মন্দিরগামী কিছু ভক্ত তাঁকে দেখতে পেয়ে, মন্দির রক্ষীদের সংবাদ দেয়; তারাই তাঁকে রাজপুরীতে নিয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে, রাজবৈদ্য পরীক্ষা করে বলেন মৃত্যু হয়েছে কুমারের, তীরের ফলায় বিষ ছিল, সেই বিষের প্রভাবেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়েছিল তাঁর।‘ মকরধ্বজ ঘটনার বিবৃতি দেন বিশদে। বাইরে আচমকা শুরু হয় প্রবল বর্ষণ, যেন আচমকা দুঃসংবাদে প্রকৃতিও ক্রন্দনরতা।

‘এখন তো পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেল কুমার, কিছু ভাবছ এবিষয়ে?’ ধূর্জটিদেব পুষ্পকেতুর নিকটে এসে অনুচ্চস্বরে প্রশ্ন করেন।

‘ভাবছি, এই বর্ষণ যদি একপ্রহর পূর্বে শুরু হোত, কুমার জীবিত থাকতেন বোধহয়।‘

***

‘অরণ্যবর্তী কোনও একটি বৃক্ষের উপর লুক্কায়িত ছিল আততায়ী, কুমার উদয়ের গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা ছিল তার নিঃসন্দেহে’।

‘বিষতীর খানি দেখে কিছু বোঝা গেলো?’

‘বাঁশের তৈরী তীর, পালকহীন’, মন্তব্য করে অর্থপূর্ণভাবে তাকান অমাত্য সৌমিক।

‘তার অর্থ, আবার অমরাবতী?’ পুষ্পকেতুর মন্তব্যে সমর্পনের সুর।

অমাত্য সৌমিক, কুমার ত্রিগুণ ও পুষ্পকেতু উদয়বর্মার হত্যার বিষয়ে আলোচনায় বসেছেন কুমার ত্রিগুণের গৃহে।

‘এছাড়া আর কি বলা চলে? জানি না এর শেষ কোথায়!’ রুগ্ন ত্রিগুণবর্মার কন্ঠস্বরে হতাশার সুর প্রতিধ্বনিত হয়।

‘আপনি কি পুনরায় আঘাতের আশঙ্কায় আছেন কুমার?’ সৌমিক প্রশ্ন করেন, তিনিও এই মুহূর্তে বিভ্রান্ত।

‘হ্যাঁ, আর সেই কারণেই রাজকুমার অভিরাজ ও মহারাজের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিজ হস্তে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি; এ বিষয়ে শৈলাধীশের সাথে কথা হয়েছে আমার, তিনিও সেই মতই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।‘

‘এমত অবস্থায় ওঁদের দুজনকে সরক্ষিত রাখা প্রয়োজনীয়, নিঃসন্দেহে।‘ পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

আলোচনা শেষে বিদায় নেন পুষ্পুকেতু, প্রাসাদ অলিন্দ হয়ে মুখ্যদ্বারের দিকে যেতে গিয়ে, থমকে দাঁড়ান তিনি; নীলবর্ণ রেশমী ঝালরে সজ্জিত রাজকীয় শিবিকা থেকে নেমে আসছেন কুমারী সোমাশ্রী। শ্রাবণদিনের বর্ষণক্লান্ত প্রভাতের ম্লান আলোয়, তাঁর মুখখানিও যেন সিক্ত মল্লিকা, বড় বিষাদগম্ভীর। আচমকা সোমাশ্রীর সম্মুখীন হয়ে আত্মসচেতন হয়ে পড়েন কুমার, বুঝতে পারেননা কিভাবে সম্ভাষন করবেন তাঁকে; রাজপুত্রী স্মিত হেসে এগিয়ে যান নিজ গন্তব্যে, সে হাসির আড়ালে না জানি কি ছিল, অলিন্দপ্রান্তে স্তব্ধ হয়ে থাকেন কুমার দীর্ঘমুহূর্ত।

***

পূর্বেকার মত নগরীভ্রমণ আর নিরাপদ নয় মগধ প্রতিনিধিদের জন্য, ত্রিগুণের এই নির্দেশিকা মেনে, রাজপুরীর পরিসীমার মধ্যেই পরিভ্রমণ সীমিত রেখেছেন পুষ্পকেতু ও উল্মুক। কয়েকদিন কেটেছে এই ভাবে, চারপাশের এক নিদারুণ দমবন্ধ করা পরিস্থিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন দুজনেই; এখন শুধু ভাদ্রমাসের অপেক্ষা, শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে কাটিগার রওয়ানা, আর কাটিগার থেকে পূর্ণিমা তিথিতে পুনর্বার সমুদ্রযাত্রা।

এক বর্ষণ রহিত বিকালে, দুজনে হাঁটতে বেরিয়েছেন অভ্যস্ত নিয়মে, চলতে চলতে উদ্যানের অপরপ্রান্তে অশ্বশালায় উপস্থিত হন দুই মিত্র। তাঁদের দেখে অশ্বপাল স্বয়ং এগিয়ে আসেন অভ্যর্থনায়, সেইসঙ্গে অশ্বশালার সংগ্রহ ঘুরে দেখান সম্মানিত অতিথিদের। শৈলদেশে অশ্ব উপলব্ধ নয়, তবু রাজসংগ্রহে রয়েছে বেশ কিছু উৎকৃষ্ট মানের অশ্ব, তার সাথে মগধেশ্বরের প্রেরিত অশ্বগুলিও যুক্ত হয়েছে অবশ্যই। মহারাজ চন্দ্রদমন কুষানবংশীয় আর্য, তাঁর অশ্বপ্রীতি সম্ভবতঃ পরিবারের মধ্যেও ব্যপ্ত হয়েছে, রাজপরিবারের বেশ কিছু সদস্য অশ্বচালনায় পটু। তবে অশ্বচালনা এদেশে নেহাতই ব্যাসন, সামরিক শক্তি বা পরিবহনের সহায়ক নয়। অশ্বশালা থেকে বেরিয়ে সামনেই একটি আম্রকুঞ্জ, ঘোর বর্ষাতেও সেখানকার বৃক্ষগুলি ফলবতী; আম্রকুঞ্জের ভিতর শিশুর কলহাস্য শুনে আকৃষ্ট হন পুষ্পকেতু।

‘কুমার অভিরাজ রয়েছেন ওখানে’, ব্যাখ্যা করেন অশ্বপাল। তাঁর কথা শুনে শিশুকন্ঠ লক্ষ্য করে এগিয়ে যান পুষ্পকেতু, তাঁকে অনুসরণ করেন উল্মুক ও অশ্বপাল। উদ্যানের ভিতর কিছুদূর যেতেই এক চমকপ্রদ দৃশ্য চোখে পড়ে। বৃক্ষ সন্নিবিষ্ট এক উন্মুক্ত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে অভিরাজ একটি বৃক্ষের শাখায় ঝুলন্ত আম্রের প্রতি ইঙ্গিত করছেন, এক সুবেশ যুবক বল্লম হাতে সেই মত লক্ষ্যস্থির করেন, আর তারপরেই ক্ষিপ্রহস্তে ছুঁড়ে দেন সেটি বুক্ষশাখার উদ্দেশ্যে। বল্লম লক্ষ্যভেদ করে ভূমিতে পতিত হয়, সাথে বৃন্তচ্যূত হয়ে ঝরে পড়ে বালক নির্দেশিত একখানি পাকা আম। দেখে উচ্ছসিত হয়ে করতালি দিয়ে ওঠেন রাজকুমার অনাবিল আনন্দে।

‘উনি ভদ্র হেং, অভিরাজের বর্তমান সুরক্ষাধিপতি।‘

আগন্তুকদের দেখে খেলা বন্ধ হয়, অভিরাজ ও হেং দুজনেই এগিয়ে আসেন তাঁদের দিকে। হেং আর্য পোষাকে সজ্জিত হলেও, তাঁর চেহারায় আটবীয় ছাপ সুস্পষ্ট।

‘আপনার ভল্ল চালনা অসাধারণ!’

‘এদেশের সেনাবাহিনীর মূল অস্ত্র ভল্ল, আপনাদের যেরূপ তরবারি; সেকারণে সকলেই প্রায় এই বিদ্যায় পারদর্শী’, পুষ্পকেতুর প্রশংসার উত্তরে, হেং এর এই পরিশীলিত বাক্য থেকে বোঝা যায়, পোষাকের মত আচার ব্যবহারেও তিনি আর্যরীতিতে সুশিক্ষিত। এরপর, দুএকটি ভদ্রতাসুচক বাক্য বিনিময় শেষে বিদায় নেন পুষ্পকেতু। ফেরার পথে, অশ্বপাল জানান, কুমার ত্রিগুণের মাতুলপুত্র হেং, সেবাদেবীর স্নেহচ্ছায়াতেই বড় হয়েছেন তিনি ত্রিগুণের সাথে। এতদিন ত্রিগুণের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দলপতি ছিলেন হেং, সম্প্রতি অভিরাজের দায়িত্বে আছেন। ইতিমধ্যেই রাজকুমার বিশেষ অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন তাঁর, আর সেই থেকেই নিত্যকার এই খেলা।

দুইদিন পরের এক অপরাহ্ন, সেদিন ভ্রমণে বের হননি দুই বন্ধু, পুষ্পকেতু পুস্তকে ডুবে আছেন বিশ্রামকক্ষের জানালার পাশে। সম্প্রতি বিষবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়েছেন তিনি, রাজবৈদ্যের কাছ থেকে সেইমত সংগ্রহ করেছেন সুশ্রুত সংহিতা। উল্মুক একাই উদ্যানে বিচরণ করছেন ইতস্তত, মিত্রের খামখেয়ালীপনায় রীতিমত অসন্তুষ্ট তিনি। আচমকা একটি শিবিকাকে ঝড়ের বেগে আতিথিশালার দিকে যেতে দেখে বিস্মিত বোধ করেন উল্মুক, পাল্কীবাহকদের পিছু পিছু তিনিও গৃহের পথ ধরেন।

‘সর্বনাশ হয়েছে কুমার, রক্ষা করুন!’ নারীকন্ঠের আর্তিতে চমকে তাকান পুষ্পকেতু, ইতিমধ্যে কক্ষে প্রবেশ করেছেন রাজকুমারী; বিশৃংখল কেশ, বেশ, দুচোখে জলের ধারা, স্থিতপ্রজ্ঞা সোমাশ্রীর এই বিচলিত রূপ দেখে বিহ্বল বোধ করেন কুমার। এদিকে রাজকুমারী একই কথা বলে চলেন কোনও আকস্মিক অভিঘাত থেকে।

‘কি হয়েছে, স্পষ্ট করে বলুন সোমা’, কুমারের দৃঢ়কন্ঠের তর্জনে সম্বিত ফেরে তাঁর।

‘অভিরাজ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, বৈদ্যরাজ বলছেন বিষক্রিয়া। সকলে ব্যস্ত তাকে নিয়ে, পিতা ভেঙে পড়েছেন, মাতুল ত্রিগুণ গ্রেপ্তার করেছেন সকল গৃহসেবককে। এ অবস্থায়, আপনার কাছে ছাড়া আর কোথায় যাব সাহায্যের আশায় কুমার?’

‘এই পারিবারিক সঙ্কটে অনাহূতের মত আমাদের উপস্থিতি কি অভিপ্রেত কেতু?’ দুজনার অলক্ষ্যে উল্মুক কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন কিছু আগে, এখন পরিস্থিতি বিচার করে মন্তব্য করে ওঠেন তিনি।

‘এখন এসব ভাবার সময় নয় উল্মুক, রাজকুমারের অসুস্থতা কোনও পারিবারিক সঙ্কট হতে পারেনা, এতে সমগ্র রাষ্ট্রের বিপদ। আপনি অপেক্ষা করুন ভদ্রে, আমি এখনি আসছি’, কথাকটি বলে দ্বিতলে নিজের শয়নকক্ষের দিকে ছুটে যান পুষ্পকেতু।

 

অভিরাজের কক্ষটি প্রহরীবেষ্টিত, অনুমতি ভিন্ন ভিতরে প্রবেশের অধিকার নেই কারো; পুষ্পকেতু ও উল্মুককে দ্বাররক্ষী বাধা দিতে গিয়ে নিরস্ত হয় রাজকুমারীর ভ্রূকুটিতে। ভিতরে শয্যার উপর শায়িত শিশু কুমারের দেহ, শিথিল অঙ্গ, অক্ষিপটল পর্যায়ক্রমে বিস্ফারিত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ছে থেকে থেকে; রাজবৈদ্য শিয়রে বসে আছেন, বৈদ্য ভৃগুদেবও রয়েছেন সাথে। কক্ষের অপরপ্রান্তে মহারাজ চন্দ্রদমন নতমস্তকে বসে আছেন একখানি সুখাসনে, অভিরাজের মাতা শচীদেবী শোকে অচেতন হয়ে পড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে তাঁকে কিছু আগে। মহারাজের নিকটে দাঁড়িয়ে আছেন কুমার ত্রিগুণ, ইস্পাত কঠিন তাঁর মুখভঙ্গী।

‘কি রকম বুঝছেন দেব?’ বৈদ্যরাজ ধন্বন্তরিকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু। উত্তরে হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়েন প্রৌঢ়।

‘সাধ্যমত সব রকম প্রচেষ্টাই করেছি, আমার আর কিছু করার নেই। নাড়ি অতিক্ষীণ, এখন শ্রীপদ্মনাভই ভরসা।‘

‘যদি অভয় দেন আমি একবার চেষ্টা করতে চাই দেব,’ কথাটি বলে একটি ক্ষুদ্র স্ফটিকের প্রকোষ্ঠ থেকে ছোট একখানি বটিকা বের করেন পুষ্পকেতু। ‘দয়া করে এটি বালককে সেবন করান আর্য, উপকার না হলেও নতুন করে ক্ষতির আশঙ্কা তো কিছু নেই।‘

‘কি ও বটিকা?’ বিস্মিত হন ধন্বন্তরিদেব।

‘মিথরিদাতম, পারস্যদেশীয় বিষনাশক প্রতিষেধক এটি। আমি কখনও প্রয়োগ করিনি এরপূর্বে, তবু আপনাকে অনুরোধ করব একবার শেষ চেষ্টা করতে।‘

‘মিথরিদাতম! কোথায় পেলেন এই ওষধি? পুঁথিতে পড়েছি এর কথা, কিন্তু বাস্তবে এর অস্তিত্ব আছে, এ কথা ভাবিনি কখনও’, স্বগোক্তির সুরে মন্তব্য করেন বৈদ্যরাজ।

‘এক রোমক বণিকের থেকে পেয়েছি, অতি দুষ্প্রাপ্য ও অব্যর্থ এই ওষধি, এমনই বলেছিলেন তিনি।‘

সামান্য ইতস্তত করে বটিকাটি চূর্ণ করে অভিরাজকে সেবন করান ধন্বন্তরিত দেব অতি সতর্ক ভাবে, যেন ওষধি সম্পূর্ণটাই শিশুর উদরে পৌঁছয়। এরপর শুধুই নীরব অপেক্ষা, শ্বাসরোধকারী এই স্নায়ুযুদ্ধ কতক্ষণ চলবে কেউ জানেনা।

‘বিষক্রিয়া কিভাবে হোল কিছু জানা গেছে কুমার?’ পুষ্পকেতু ইতিমধ্যে ত্রিগুণবর্মার নিকটে গিয়ে মৃদু আলাপে রত হন।

‘সঠিকভাবে এখনো কিছু বলা চলে না, মধ্যাহ্ন গতে অভিরাজ অশ্বারোহনের জন্য অশ্বশালার নিকটস্থ প্রান্তরে যায়; সে বালকমাত্র, তাকে গৃহবন্দী করে রাখা চলেনা বিপদের আশঙ্কায়। তবে তার সাথে ভদ্র হেং সহ পাঁচজন দেহরক্ষী ছিল, অশ্বপালও সাথে ছিলেন অশ্বারোহন কালে। এরপর গৃহে ফিরে, সে দুগ্ধ পান করে রোজকার মতই। তার কিছুসময় পরেই শুরু হয় ভেদবমি। দুগ্ধ নিয়ে এসেছিল এক দাসী, পান করিয়েছিল অভিরাজের ধাত্রীমাতা, পাকশাল থেকে দুগ্ধ এসেছিল, সেখানে কর্মরত ছিল দশজন পাচক ও সহকারী। আপাততঃ এদের সকলকেই বন্দী করেছি, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তবে বৈদ্যরাজ দুগ্ধপাত্র পরীক্ষার অবসর পাননি এখনও।‘

প্রায় দুইদণ্ডকাল পার হয়েছে, আচমকা শিশুর চোখের দৃষ্টি সহজ হয়ে আসে, হৃদস্পন্দনও স্পষ্ট হতে থাকে ধীরে ধীরে।

‘বিষের প্রভাব কাটতে শুরু করেছে রাজন, আশার আলো দেখতে পাচ্ছি বালকের নাড়ি স্পন্দনে!’ উত্তেজিত শোনায় বৈদ্যরাজের কন্ঠস্বর। পালঙ্কের কাছে ছুটে আসেন সকলে, ‘মাতা!’ অস্ফুটে উচ্চারণ করে বালক, তার শ্রান্ত চক্ষু মাতাকে খুঁজে ফেরে। মহারাজের চোখে জল, পুষ্পকেতুর হাতদুটি করবদ্ধ করেন তিনি, মুখে কিছু বলতে পারেননা।

‘কি বিষ প্রয়োগ হয়েছিল, কিছু অনুমান করতে পেরেছেন দেব?’ প্রাথমিক উচ্ছ্বাস শান্ত হতে, ধন্বন্তরিকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘আমার ধারণা, এও সেই বৎসনাভ’, ভৃগুদেবও সমর্থন জানান, ধন্বন্তরির কথায়।

এরপর, মহারাজের কাছে বিদায় নিয়ে কক্ষত্যাগের উদ্যোগ করেন দুই বন্ধু, রাজকুমারী দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ান নীরব কৃতজ্ঞতায়।

‘আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনুন সোমাশ্রী, কুমারের বিপদ কাটেনি এখনও; পুনরায় প্রাণহানির চেষ্টা অসম্ভব নয়। সেকারণে, আপনি দিনে রাত্রে কুমারের শয্যাপার্শ্ব ত্যাগ করবেন না যতদিন না সে সুস্থ হয়, কোনও খাদ্য পানীয় পরীক্ষা না করিয়ে দেবেননা তাকে। স্মরণে রাখবেন এ কথা’। জনান্তিকে কথাগুলি বলেন পুষ্পকেতু। রাজকুমারীর চোখে মুখে ফুটে ওঠে দৃঢ়তা, তিনি সম্মতি জানান নিঃশব্দে।

 

শুধু দ্বারের বাহিরেই নয়, সমগ্র প্রাসাদচত্বর রক্ষীবাহিনীতে পরিপূর্ণ, নিষ্ক্রমণ কালে লক্ষ্য করেন দুই মিত্র।

‘রক্ষীদলের অধিকাংশই আটবিক জাতীয় লক্ষ্য করেছ কেতু?’

‘সে তো খুবই স্বাভাবিক। বর্তমান পরিস্থিতে আর্য বংশজ কাউকেই আর বিশ্বাস করতে পারছেন না ত্রিগুণ, যদি তাদের কারো সাথে অমরাবতীর সংযোগ থাকে? এখনও দিনের আলো রয়েছে, চলো অশ্বশালা হয়ে আবাসে ফিরি।‘

‘আজ বিকালে, রাজকুমার যখন এখানে আসেন, সে সময়কার বিশদ বিবরণ চাইছি আপনার কাছে, ঘটনা, তা যত নগন্যই হোক কিছুই বাদ দেবেন না দয়া করে।‘ অশ্বপালের সাথে বাক্যালাপ শুরু হয় অশ্বশালার বাহিরের উন্মুক্ত প্রান্তরে। প্রান্তরটি তেমন বিস্তৃত নয়, উদ্যানের কিছুটা অংশ পরিষ্কার করে অশ্বচালনার উপযুক্ত করা হয়েছে এটি। অশ্বপাল অরুন কিছুটা চিন্তা করে শুরু করে তার বক্তব্য।

‘রাজকুমার আজ এসেছিলেন বেলা তৃতীয় প্রহরের শেষভাগে, একটি খর্বকায় ঘোটকী আছে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট, তিনি সেটিতে আরোহন করে এই প্রান্তরে চালনা করেন। আমি সঙ্গে ছিলাম সর্বক্ষণ, ভদ্র হেং ও সাথে ছিলেন; কয়েকজন প্রহরী তটস্থ ছিল কিছুটা দূরত্বে। অশ্ব ধীর গতিতেই চলেছিল এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে, তার রশি ধরা ছিল আমার হাতে গতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে; কিন্তু কুমার চঞ্চল প্রকৃতির, এই ব্যবস্থা তাঁর পছন্দ ছিল না। এ নিয়ে আমার উপর অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন তিনি থেকে থেকে, অবশেষে হেং সমুখের তরু থেকে কয়েকটি পক্ক কর্মরাঙ্গা ফল রক্ষী দিয়ে পাড়িয়ে এনে তাঁকে শান্ত করেন।‘

‘কুমার কি কর্মরাঙ্গা খেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ, তিনি খেয়েছিলেন, সাথে আমরা দুজনেও। তাতেই কুমারের কি আনন্দ; শিশুমনের অনাবিলতায় রাজপুত্র ও চাষীপুত্রের তফাৎ নেই’, অরুনের এই মন্তব্যের মধ্যে গভীর স্নেহ প্রকাশ পায় কুমারের প্রতি।

‘ফল কি গাছ থেকে পেড়ে সরাসরি খেয়েছিলেন সকলে?’

‘আমরা দুজন তাই করেছিলাম, তবে কুমারকে তাঁর জন্য বাহিত পানীয় জলে ধুয়ে তবে দেওয়া হয়েছিল কর্মরাঙ্গা।‘

‘ধোয়ার কাজটি কে করেছিল?’

‘কেন, কুমারের প্রহরীদের একজন!’

এরপর, আর কথা এগোয় না, সন্ধ্যা নেমে এসেছে ততক্ষণে, পুষ্পকেতু ও উল্মুক অতিথিশালার ফিরে যান শিবিকায় চড়ে।

রাতের আহারের সময় অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন পুষ্পকেতু, বিনা বাক্যব্যয়ে শয়নকক্ষে আশ্রয় নেন তারপরেই; উল্মুক বিস্মিত হন না, বাল্যসখার এরূপ আচরণের সাথে তিনি পরিচিত।

***

প্রভাতের প্রথম প্রহর তখনো সমাপ্ত হয়নি, শয্যাত্যাগ করে তৈরী হয়ে নীচের বহির্কক্ষে এসে বিস্মিত হন উল্মুক, পুষ্পকেতু অস্থিরভাবে পদচারণা করছেন সেখানে।

‘তোমার পায়ে কি কাষ্ঠ পিঁপিড়া দংশন করেছে, এত ছটফট করছ যে?’

‘এখন তামাশার সময় নয় উল্মুক, দ্বৈরথ ভৃত্যাবাসে গেছে জম্বুককে ডেকে আনতে।‘

‘জম্বুক! সে কি আমাদিগের প্রাতঃরাশের দায়িত্ব নিয়েছে? সেক্ষেত্রে আমি নাহয় একবেলা উপবাসে থাকি।‘ বন্ধুর পরিহাসে উত্যক্ত হতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেন কেতু, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই দ্বৈরথের সাথে জম্বুক প্রবেশ করে কক্ষে।

‘তোমাকে একটি বিশেষ দরকারে ডেকে পাঠিয়েছি জম্বুক; কিছু জানার আছে তোমার কাছে, চিন্তা করে উত্তর দিও। তুমি বলেছিলে, শ্রীধর দুর্ঘটনার দিন সন্ধ্যায় মৎসাণ্ড ভোজন করতে দিয়েছিল বোরাকে, তুমি বোরাকে আহার করতে দেখেছিলে সে ভোজ্য। ঠিক কি দেখেছিলে সেদিন?’

‘আমি তখন, মশলা পিষ্টন সেরে মুষল-খল ধুয়ে রাখছি, বোরা শেষবারের মত সুরাভাণ্ড নিয়ে চলে যাবে, তাকে থামিয়ে শ্রীধর কটাহের অবশিষ্ট মৎসাণ্ড একটি কদলীপত্রে মুড়ে প্রদান করে। এরপর, শ্রীধর ভাণ্ডার কক্ষে প্রবেশ করে, রাত্রিভোজনের জন্য বাসনের আয়োজন করতে। আমি ক্ষণিক অবসরে পাকগৃহের দরজার বাহিরে গিয়ে দাঁড়াই ক্লান্তি দূর করতে; সেসময় দেখি বোরা অঙ্গনের একপাশে গোপুর-চম্পক বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে মৎসাণ্ড ভক্ষন করে শেষে বিশ্রামকক্ষের দিয়ে অগ্রসর হোল।‘

‘তুমি কি তাকে সম্মুখ থেকে দেখেছিলে জম্বুক?’

‘নাতো! সে পাকগৃহকে পিছনে রেখে, বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়িয়ে ভক্ষন করেছিল, আমি পশ্চাৎ থেকে দেখেছিলাম; আহার্য ভক্ষণ কালে সেটাই তো স্বাভাবিক।‘

‘বুঝলাম, আপাততঃ এই বাক্যালাপের বিষয়ে আর কারো সাথে আলোচনা কোর না,’ জম্বুককে গম্ভীরমুখে বিদায় দিয়ে ঝটিকা গতিতে বেরিয়ে যান পুষ্পকেতু।

‘আমি রাজপুরীতে চললাম, মহারাজের সাথে সাক্ষাৎ করব, তুমি যত শীঘ্র সম্ভব আচার্যকে নিয়ে সেখানে এসো।‘ হতভম্ব উল্মুকের দিকে নির্দেশ ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হন কুমার।

 

‘সত্ত্বর মন্ত্রীসভা আহবান করুন মহারাজ, আর বোরাকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সকল সত্য বেরিয়ে পড়বে। ত্রিগুণবর্মাকে এসকল বিষয়ে এখনি কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই।‘ হতচকিত মহারাজ এরূপ অনুরোধে বিস্মিত হলেও দ্রুত ব্যবস্থা নেন সবকিছুর। বহূপ্রচেষ্টায় বোরা স্বীকার করে সুরায় বিষ সেই মিশিয়েছিল, তবে সম্পূর্ণ নিজ ইচ্ছাতেই একার্য করেছিল সে। কিন্তু হেং এর অধীনস্থ রক্ষী, যে রাজকুমারকে কর্মরাঙ্গা দিয়েছিল, সে স্বীকার করে তার প্রভু হেং এর নির্দেশেই বিষ মিশিয়েছিল সে ফলে।

ত্রিগুণবর্মার বাসগৃহ স্থলসেনা দ্বারা অবরোধ করা হয়েছে ইতিমধ্যে, মহাদণ্ডনায়ককে সঙ্গী করে কুমারের কক্ষে প্রবেশ করেন সৌমিক, তিনি এখন শৈলদেশের নব নিযুক্ত মহামাত্য। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে, শয়নকক্ষ মাঝে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে থাকতে দেখা যায় ত্রিগুণকে, নিজকন্ঠ ছুরিকাবিদ্ধ করেছেন তিনি। পাশের কক্ষে শিশুপুত্র কোলে পাষাণপ্রতিমা ত্রিগুণের স্ত্রী, যেন ইহ সংসারে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই তাঁর।

‘আমাদের গ্রেপ্তার করবেন না আর্য?’ স্খলিত কন্ঠস্মরে কী অপরিসীম উদাসীনতা, চক্ষু আর্দ্র হয়ে ওঠে সৌমিকের। ঈর্শাকাতর মানব, ক্ষমতার লোভে ভুলে যায় সংসার পরিজন; নিজে আত্মহত্যা করে মুক্তি নিয়েছে দুরাচারী, রেখে গেছে অসহার পরিবারকে কলঙ্ক ও গ্লানির পঙ্কসায়রে। মাতৃকোলের অবোধ শিশুটি হয়তো আমরণ বয়ে চলবে পিতার অপরাধে বোঝা; এই তো জীবন!

***

বর্ষণমুখর মধ্যাহ্ন, অতিথিশালার বহির্কক্ষে জড়ো হয়েছেন মগধ প্রতিনিধিদের ছোটদলটি, ধূর্জটিদেব, উল্মুক ছাড়াও দধিচি, শ্রীমন্ত ও চতুর্ভুজ আছেন, এছাড়া রয়েছেন মকরধ্বজ। সভার মধ্যমণি নিঃসন্দেহে কুমার পুষ্পকেতু। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহের ব্যাখ্যা শুনতে উন্মুখ হয়ে আছেন সকলে; বহূদিন পরে একপ্রকার নিশ্চিন্ততা ফিরেছে ব্যাধপুরের পরিবেশ, এছাড়া গৃহে প্রত্যাবর্তনের দিনও এগিয়ে আসছে, এও উৎফুল্লতার একটি বিশেষ কারণ। সকলের অনুরোধে পুষ্পকেতু রহস্য উন্মোচন করেন সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের।

‘ত্রিগুণবর্মা তাঁর মাতৃপরিচয়ের কারণে রাজকুলে ব্রাত্য হয়ে থেকেছেন বহূকাল, সেই থেকে একপ্রকার হীণমন্যতা ও বিতৃষ্ণার জন্ম হওয়া অস্বাভাবিক নয়। পরবর্তীকালে, রাজদরবারে সসম্মানে অধিষ্ঠিত হলেও, অপমানিত হতে হয়েছে প্রায়শঃই। এরূপ পরিস্থিতিতে, অনেকেই হয়তো আত্মগ্লানিতে ভোগেন, কিন্তু ত্রিগুণের ক্ষেত্রে জন্ম নেয় ঘৃণা, আর তারই আগুনে সমগ্র রাজপরিবারকে ধ্বংস করার ইচ্ছা জাগরুক হয়। তিনি জনপ্রিয় ছিলেন প্রজাদের কাছে, সে থেকেই সিংহাসনের স্বপ্ন দেখার শুরু, কিছু পরামর্শদাতাও ইন্ধন জুগিয়ে থাকবে এবিষয়ে। তাঁর নিজস্ব সৈন্যদলে আটবিক জাতীর আধিক্য, উপরন্তু শৈলদেশের সামরিক শক্তির ভিত্তি তার নৌসেনা; কুমার হয়তো সামরিক বিদ্রোহের স্বপ্ন দেখতেন অনেকদিন থেকেই। অবশেষে অমরাবতীর সাথে বিবাদ ও তার পরবর্তীতে অগ্নিকাণ্ড, তাঁকে সাহসী করে দেয়। এই পরিস্থিতিতে যে কোনও ষঢ়যন্ত্রই অমরাবতীর স্কন্ধে চাপিয়ে দেওয়া সহজ, সেকারণেই কাটিগারের বিষপ্রয়োগের পরিকল্পনা। নিজেকে সন্দেহমুক্ত রাখতে, সামান্য বিষাক্তসুরা তিনি নিজেও পান করেছিলেন, তবে সুরারসিক উদয়বর্মা যে ঠিক সেইদিনই আত্মসংযমের পরিচয় দেবেন সেটা তাঁর হিসাবের বাইরে ছিল। শ্রীধর সত্যই অমরাবতীর চর ছিল, সেকারণে কাটিগার অতিথিশালায় সুযোগ পেয়ে কাজে যোগ দেয়, তবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভয় পেয়ে পলায়ন করে সে, এতে ত্রিগুণের লাভই হয়। পরবর্তীতে উদয়বর্মাকে বৃক্ষের আড়াল থেকে যেরূপে হত্যা করা হয়, তা আতর্কিতে হামলাকারী অথবা অরণ্যবাসীদের যুদ্ধ কৌশল; সম্ভবতঃ হেং এর সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল, অমরাবতীর অনুরূপ বিষাক্ত তীরের ব্যবহারেও সেই একই চাতুর্যের পরিচয় পাওয়া যায়। আর সেই অযুহাতে ত্রিগুণ রাজপুরী সুরক্ষার দায়িত্ব নিজে হাতে তুলে নেন, প্রথমে অভিরাজ ও পরে মহারাজকে হত্যা করে সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা ছিল তাঁর।‘

‘আপনি ত্রিগুণকে সন্দেহ করলেন কিভাবে?’ চতুর্ভুজ প্রশ্ন করেন।

‘কাটিগার ও অভিরাজ দুইক্ষেত্রেই বিষবাহী পানীয় ও খাদ্য পরিবেশন করেছিল কোনও আটবিক সেবক, আর তাদের প্রভু হলেন ত্রিগুণবর্মা, সেইথেকেই সন্দেহ প্রবল হয়। জম্বুক তার বয়ানে জানিয়েছিল, সুরা বয়ে নিয়ে যাবার কালে মৎসাণ্ড ভক্ষণ করতে বোরা অঙ্গনে দাঁড়িয়েছিল কিছুসময়। প্রথমদিকে কথাটির গুরুত্ব না বুঝলেও, কর্মরাঙ্গা কাণ্ডের কথা জানার পর ঘটনাটি আমাকে চিন্তিত করে তোলে, তখনই জম্বুককে দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে জানতে পারি, সে বোরাকে পিছন থেকে দেখে ধরে নিয়েছিল সে ভক্ষণ করছে। বাস্তবে, বিষ মেশানোর কাজটি তখনই করেছিল বোরা। সুরাপাত্রে মক্ষিকা পড়েছে, এটি সম্ভবতঃ বিষপ্রয়োগের সঙ্কেত বাক্য ছিল বোরার প্রতি, সেসময়, তাকে ভাণ্ডের সুরা ফেলে দিয়ে নূতন করে ভরে আনতে বলে উদয়বর্মা অজান্তে সাহায্যই করেন।‘

‘অমরাবতী হত্যাকাণ্ডে যুক্ত নয়, এই বিশ্বাস কেন হোল আপনার; বিশেষতঃ যখন তাদের প্রতিহিংসার বিভৎস্য রূপ প্রত্যক্ষ করেছি আমরা অল্পদিন আগেই?’ মকরধ্বজ জানতে চান।

‘ভদ্রবর্মণ বীরপুরুষ, অমরাবতীকে শিক্ষা দিতে গুপ্তহত্যার সাহায্য নেবেন, বিশেষতঃ সেই হত্যায় একটি শিশুকে সামিল করবেন, এ আমি মানতে পারিনি কিছুতেই।‘

বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসে ধীরে, সভাভঙ্গ হয় সেই সাথে। বহূদিন বাদে নিজকক্ষে গিয়ে বীণায় সুর ধরেন কুমার, মন্দ্রমধুর সুরলহরীর আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবেশ।

***  ***

দুরূহ শব্দের অর্থঃ

বৎসনাভএ্যাকোনাইট বিষ, পুষ্পান্ন – পোলাও, এলা – এলাচ, গোপুর চম্পক – কাঠ গোলাপ

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page