আবার এসো ফিরে

রামেশ্বর দত্ত

ঈশ্বরচন্দ্র কানাইলালের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। দেবেন্দ্রনাথ এতক্ষণ চুপ ছিলেন। বেতনের প্রস্তাব তিনিও মানছেন। তবে, তাঁর বক্তব্য, কেবল তত্ত্ববোধিনী  পত্রিকার আয়ে যদি বেতন দেওয়া যায়, তবে তা হতে পারে। কিন্তু তত্ত্ববোধিনী সভা এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আয় সংযুক্ত করে তা দেওয়া অবিধি হবে

অক্ষয়কুমারের শারীরিক অবস্থার কথা সকলের জানা ছিল। পত্রিকার জন্যে এত বছর অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে তাঁর শিরঃপীড়া রোগ দেখা দিয়েছিল। এমন এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত থাকাতে অক্ষয়কুমারের আয়ের সঙ্কোচ, সঙ্গে ব্যয়ের আধিক্য ,দুইয়ের জন্যে তিনি বেশ অসুবিধায় ছিলেন। আজকের সভা তাঁর জন্যে মাসিক বৃত্তি পঁচিশ টাকা ধার্য করায় তিনি যে বিশেষ উপকৃত হবেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে প্রশ্ন, তাঁর অসুখের কারণে তিনি কি আর পত্রিকা সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব বহন করতে পারবেন?এমন যখন আলোচনা চলছে, দেবেন্দ্রনাথ বললেন, এই দোলাচলের মধ্যে না থেকে, আমি প্রস্তাব রাখছি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে এই কাজে নিযুক্ত করা হোক।

সকলের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে কথাটা বললেন তিনি। ঈশ্বরচন্দ্র তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমায় মাফ করবেন দেবেন্দ্রবাবু। আমার হাতে এখন চার চারটে বই লেখার কাজ বাকি। তাই আমি এই ভার নিতে অপারগ। তবে, আমি এই পদের জন্যে নবীনচন্দ্রের নাম প্রস্তাব করছি। বয়সে উনি নবীন। এ ভার নেওয়া হয়তো তাঁর কাছে গুরুভার হবে না।

কথা শেষে তিনি নবীনচন্দ্রের দিকে তাকালেন। নবীনচন্দ্র নিরুত্তর। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন প্যাঁরিচাদ ।

-তবে তাই হোক, আমার তো মনে হয় নবীনচন্দ্র একজন সংস্কৃত ধর্মশাস্ত্রবিদ্যাবিশারদ, পণ্ডিত, ইংরেজি শিক্ষাতেও শিক্ষিত, সুলেখক, তাঁকেই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করলে ভালো হয়। আপনারা কী বলেন?

কথা শেষ করে দেবেন্দ্রনাথ সকলের মুখের দিকে চাইলেন।

একবাক্যে সকলে তাঁর কথা মেনে নিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও তাই করলেন।  নিম-তেঁতোর স্বাদে ঢোঁক গেলার মতো করে তা করলেন। তাঁর মুখের অবস্থা দেখে অবশ্য তাই মনে হল। ভদ্রলোক বরাবরই একটু নাক উঁচুতে রেখে চলেন।

দিনের কার্যবিবরণী-খাতায় লিপিবদ্ধ হল সেদিনের সভার সংক্ষিপ্ত বিবরণী এবং উপসংহার। পত্র মারফৎ অক্ষয়কুমারকে তাঁর মাসিক বৃত্তির বিষয় জানিয়ে দেবার কথাও লিপিবদ্ধ হল।

ঈশ্বরচন্দ্র এখন বুঝলেন, দেবেন্দ্রনাথ কেন তাঁকে এই বিশেষ সভায় আমন্ত্রণ করে আনিয়েছিলেন। তবে, এমত ভার থেকে নিজের অব্যাহতি সুনিশ্চিত হওয়ায় সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন তিনি। পরে উপস্থিত সকলে দেবেন্দ্রনাথের আতিথেয়তা গ্রহণ করে  মণ্ডামিঠাই নোনতা সহযোগে ভরপেট জলযোগ সেরে সায়হ্নকালে বিদায় নিয়ে যে যার গৃহের অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। হৃষ্টচিত্তে ঈশ্বরচন্দ্রও পা বাড়ালেন। তখনই বাড়ি না ফিরে তিনি চললেন  ছাপাখানার দিকে। সুহৃদ মদনমোহনকে সুসংবাদটা জানাবার প্রয়োজন রয়েছে তাঁর।

 

   (৬)

পরে একদিন।

ছাপাখানায় বসে ঈশ্বরচন্দ্র  নিজের বইয়ের প্রুফ দেখছেন। বাইরে দিন গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। সময়টা এখন শরৎ কালের মাঝামাঝি। তবু ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমটা কাটেনি। ঘরে বসে কাজ করছেন আর ঘামছেন।

এই সময় ঈশ্বরচন্দ্রের প্রিয় এক খাদ্য মুড়ি আর সেদ্ধ ছোলা। সামনের এক মুড়িওয়ালার দোকান থেকে তা কিনে আনেন। খান। মদনমোহন থাকলে দুজনে মিলে মুড়ি ছোলাসেদ্ধ চিবন। এখন তিনি একলাই রয়েছেন।

এমন সময়ে সেখানে এক দূত এসে হাজির। তার চেহারা আম জনতা থেকে ভিন্ন। উচ্চতায় প্রায় ছ ফুট। গায়ের রঙ সাদা। চোখমুখে উজ্জ্বলতা। নাকের নীচে সরু করে ছাঁটা গোঁফ। মাথায় শিরস্ত্রাণ। লাল রঙের। পরণে দুধ সাদা কোট প্যাল্টুলুন। দেখলেই বোঝা যায় আগন্তুক ইংরেজের বংশধর। হাতে রয়েছে একখানা খাম। হাল্কা বাদামী রঙ। ভিতরে জরুরী চিঠি। মুখে প্রশ্ন, ইজ দিজ দ্যা প্রেস অফ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র?

পত্রবাহক ঈশ্বরচন্দ্রকে বিলক্ষণ চেনে না। তাই ছাপাখানায় প্রবেশ করে  ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ নাম নিয়ে প্রশ্ন করল।   ঈশ্বরচন্দ্র ভিন্ন অন্য কেউ তখন ছাপাখানায় উপস্থিত নেই। তিনি উত্তর করলেন, ইয়েস। দিস ইজ দ্যা প্রেস অফ বাবু ঈশ্বরচন্দ্র।

পত্রবাহক ফের প্রশ্ন করল, ইজ হি হিয়ার?

-ইয়েস। আই অ্যাম বাবু ঈশ্বরচন্দ্র।

নিজেকে দেখিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, হাউ ক্যান আই হেল্প মিঃ জেন্টলম্যান?

-আই অ্যাম জন। জন স্টাফোরড। কামিং ফ্রম এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট। বলে, দূত তার হাতে ধরা খামটা ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে দিয়ে দু পা পিছনে সরে দাঁড়াল।  খাম হাতে নিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র উলটে পালটে দেখলেন। খামের মুখ বন্ধ। একদিকে কালি দিয়ে লেখা, টু বাবু ঈশ্বরচন্দ্র স্কোয়ার। পাশের অংশে একটু নিচে রয়েছে প্রেরকের নাম; জী টি মার্শাল।

ঈশ্বরচন্দ্র পত্রবাহকের দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন। আস্তে ধীরে খামের একদিকের মাথা ছিঁড়লেন। ভিতরের কাগজখানা বার করলেন। কালি কলমে হাতে লেখা চিঠি। মাত্র এক লাইনের বক্তব্য, বাবু ভিদ্যাসাগর এসকিউ, ফাইন্ড ইওর টাইম এন্ড মিট মী, দ্যা সুনার পসিবল।

পড়া হলে পত্রটি ভাঁজ করলেন। ফের তা খামের মধ্যে চালান করে  দিয়ে পত্রবাহককে বললেন, প্লিজ টেল মিঃ মার্শাল, আই উইল মিট হিম  টুমরো।

-থ্যাঙ্কু স্যার। এনি থিং মোর টু সে, স্যার?

-নো, প্লীজ।

-আই এম লিভিং,স্যার।

পত্রবাহক কুর্নিশ জানিয়ে ছাপাখানা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ল । সোজা হনহন করে  উত্তরের দিকে হাঁটা দিল। ছাপাখানার ভিতরে বসে বাইরের রাস্তা দেখা যায়। ঈশ্বরচন্দ্র লোকটার চলে যাওয়া দেখলেন যতক্ষণ না সে দৃষ্টির আড়াল হল। মনে মনে লোকটার চলা বলা, চেহারার তারিফ করলেন। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলেন।  জন স্টাফোরড নামের দূত এসেছিল বিকেলের দিকে। সন্ধ্যার পর এলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। কলেজ থেকে সোজা ছাপাখানায় চলে এসেছেন তিনি।  মদনমোহন এখন  ফোরট উইলিয়াম কলেজে চাকরী করেন। তাঁর চাকরী হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্রের কথায়। সেও এক কাহিনি।-

ঈশ্বরচন্দ্র এবং মদনমোহন, দুজনেই সংস্কৃত কলেজে পড়তেন। একই সঙ্গে। এক ক্লাসে। সেসময়েই দুজনের মধ্যে গাঢ় বন্ধুত্ব  জমে ওঠে। বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। কলেজ পাশ দেওয়ার পরে আরও নানান শিক্ষান্তে  ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজে চাকরী পেলেন, মদনমোহন সেসময় দূরবর্তী কোনও একস্থানে মাসিক মাত্র পনেরো টাকা মাইনেতে বাংলা পাঠশালায় পড়ানো শুরু করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মাস মাইনে সেসময় পঞ্চাশ টাকা। বন্ধুর জন্যে ঈশ্বরচন্দ্রের বেশ চিন্তা ছিল। মদনমোহনও ততদিনে তর্কালঙ্কার হয়েছেন। তাঁর পক্ষে আরও উচ্চ বেতনের চাকরীই কাম্য। ইতিমধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র মদনমোহনের সঙ্গে ছাপাখানা খুলেছেন। দুজনে মিলে তাঁদের দৈনিক কাজের অবসরে ছাপাখানার কাজ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একদিন মদনমোহন ঈশ্বরচন্দ্রকে বললেন, ভাই, পাঠশালার চাকরী করে  মন ভরছে না।

-কেন? ভালই তো। ছোট ছোট ছেলেদের পড়াশোনা করাচ্ছ। তোমার সবল হাতে তাদের জ্ঞান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

-তুমি তো জানো, পাঠশালে আমার নিজস্ব জ্ঞানের আর কতটুকু উপযোগ করতে পারছি? সেখানে সব ছোট ছোট ছেলে। তাদের বর্ণ শিক্ষা দিতে দিতে আমার মাথা ব্যাথার উপক্রম হচ্ছে। তাও কেউ পড়ে, কেউ শুধু খেলেই বেড়ায়। ওই কচিকাঁচাদের কি আর বেশি বকাঝকা করা যায়? বেতের উপযোগ ? নৈব।

-তাহলে, কী করতে চাও, মদন?

‘মদন’, নামেই ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বন্ধুকে সম্বোধন করে  থাকেন। আবার মাঝে মধ্যে পুরো নামের সঙ্গে তর্কালঙ্কার  যোগ করেও কথাবার্তা বলেন। সে যখন দুই বন্ধুর মধ্যে গালগপ্পো চলে। বেশিরভাগ সময়ই তা হয় ছাপাখানার কাজ করতে করতে। ঈশ্বরচন্দ্র সেসময় প্রুফ দেখেন। আর মদনমোহন করতে থাকেন লেটার সেটিংয়ের কাজ। ওই কাজটা আবার ঈশ্বরচন্দ্রের খুব ভালো আসে না। মানে, হাত চলে না।

মদনমোহন বললেন, আমাকে ভাই, তোমার কলেজে একটা চাকরী যোগড় করে  দিতে পারবে না? এখন তো শুনছি অনেক কিছু হচ্ছে সংস্কৃত কলেজে।

-দেখো, ওই কলেজে আমিই আর কতদিন থাকি?

ঈশ্বরচন্দ্র বন্ধুকে সেদিন নৈরাশ্যের কথা শুনিয়েছিলেন। এসব কথা হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্রের চাকরিতে ইস্তফা দেবার আগে। তাও প্রায় বছর দেড়েক হয়ে গেছে।  শেষে সেদিন কিনা তিনি বলেছেন, দাঁড়াও হে। আমার সঙ্গে যার ভালো পটে, তাঁর কাছে তোমার কাজের জন্যে আর্জি জানাব।

মদনমোহন কথা চালিয়ে গেছেন। প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছেন, তিনি কে?

-আছে ভায়া, আছে…,

ঈশ্বরচন্দ্র কিছুটা হাল্কা ভাবে কথা বলতে থাকলেন। তিনি বললেন, ওঁরা হচ্ছেন বিদেশি সাহেব। আমাদের দেশের মতো বাঙালি সাহেবসুবো নয়। বিশেষ করে  আমার কালেজের সেক্রেটারি, রসময় দত্ত মহাশয়ের মতো নয়। সাহেবরা যদি একবার হ্যাঁ, বলে দেয়, সেখান থেকে তাঁদের কথার নড়নচড়ন হয় না।…তুমি তো জানো, জী টি মার্শাল সাহেব আমায় কতখানি খাতির করেন। ওনাকেই না হয় ধরি তোমার কাজের জন্যে।

এরপর মাত্র তিনদিনের মাথায় ঈশ্বরচন্দ্র বন্ধু মদনমোহনকে ফোরট উইলিয়াম কলেজে চাকরী যোগাড় করে  দিয়েছেন। ফোরট উইলিয়াম কলেজের পড়ুয়া সাহেবদের  সম্পত্তি বিষয়ক আইন শিক্ষা দেবার কাজ। মাসিক চল্লিশ টাকা মাইনে। বন্ধু ভীষণ খুশি। ঈশ্বরচন্দ্রকে সেদিন জড়িয়ে ধরে তাঁর অনেক প্রশংসা  করেছিলেন মদনমোহন! প্রত্যুত্তরে ঈশ্বরচন্দ্র বলেছিলেন, মদন, এমন কাজ আমি ভবিষ্যতেও করব। কারোও কোনও কষ্ট আমি দেখতে পারি না। তা সে মানসিক হোক, আর আর্থিক। কষ্ট তো কষ্টই। কারোও কষ্ট দূর করাকে আমি আমার কর্তব্য জ্ঞান করি।

ঈশ্বরচন্দ্র বন্ধুকে সাহারা দিয়েছিলেন। আর আজ তাকেই প্রথম মার্শাল সাহেবের পত্রের কথাটা জানালেন। বললেন, কাল আমি দেখা করতে যাচ্ছি । দেখি, উনি আমার জন্যে কোন নৈবিদ্যের থালা সাজিয়ে এমন তলব দিলেন।

পরে হা…হা…, শব্দে হাসলেন।

 

ঈশ্বরচন্দ্র মার্শাল সাহেবের দপ্তরে পৌঁছেছেন। মিঃ মার্শাল নিজের দপ্তরে বসে কাজ করছিলেন। টেবিলে বিশাল এক জাব্দা খাতা। খোলা অবস্থায়। তাতে মুখ ডুবিয়ে এক মনে কাজ করে যাচ্ছেন। কলেজের হিসেব নিকেশের পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। মার্শাল মুখ তুললেন। ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখলেন। সোজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এগিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে নিজের চেয়ারের সামনে এনে বসালেন।

বিশাল আকারের টেবিল। পালিশ করা টেবিল চেয়ার। চকচক করছে। মার্শাল রয়েছেন টেবিলের একদিকে। অন্যদিকে সার দিয়ে গোটা চার চেয়ার।  তার একটাতে ঈশ্বরচন্দ্র বসেছেন। টেবিলেটার এক পাশে ডাঁই করা ফাইলের গুচ্ছ। সামনে দোয়াত কলম। সংখ্যায় চার্ জোড়া। সার দিয়ে রাখা। সব দোয়াতেই খাগের কলম। কোনটার রঙ নীল, কোনটা লাল । আবার কালি রঙেরও কলম রাখা রয়েছে সেখানে ।

মাথার ওপরে তালপাতার পাখা। ঢাউস আকারের। বাইরে থেকে একজন দড়ি ধরে তা টানছে। পাখা দুলছে। ঘরের আশপাশ করে  তিনটে বড় জানালা। সেগুলোতে খস লাগানো। খস জলে ভেজা। তা থেকে টুপ টুপ করে  জলের ফোঁটা পড়ছে। বাইরের গরম ভিতরে আসার পথ বন্ধ।  তালপাতার পাখার হাওয়া আর জানলায় জল শোষণ করা খস,  ঘরটাকে ঠাণ্ডা করে  রেখেছে। ঈশ্বরচন্দ্রের গায়ে বাতাস লাগছে। তিনি আরাম পাচ্ছেন । সময়টা আশ্বিনের মাঝামাঝি। বাইরের ভ্যাপসা গরম গায়ে মেখে এসেছেন তিনি। বড়বাজারের বাড়ি থেকে এতটা পথ হেঁটেই এসেছেন। ঘেমে গেছেন। ঘরের ঠাণ্ডা বাতাসে ঘাম মরছে।

-আ প নি এখন কোথা  থেকে আসছেন, ভিদ্যাসাগর মহাশয়?

মার্শালের বাংলা কথা। এদেশে তিনি বেশ কয়েক বছর আছেন। বাংলা এবং সংস্কৃত ভাষা চর্চা করেছেন। দেশীয় দুটো ভাষাতে কথা বলায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বিশেষত ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে কথা বললে, তিনি বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেন।

-আজ্ঞে মহাশয়, আমি  বড়বাজার থেকে আসছি। ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন। সাহেবর নির্দিষ্ট কথ্যবাংলায় তিনিও কথা বলেন মার্শালের সঙ্গে। প্রশ্ন করলেন, আপনি কি আমাকে তলব করেছেন?

-হ্যাঁ। আপনার কোনও অসুবিধা হয়নি তো?

মার্শাল বেশ উঁচু পর্যায়ের অফিসার হলেও ইংরেজ রক্তের জন্যে সৌজন্যেতায় কমতি যান না।  ঈশ্বরচন্দ্র উত্তর দিলেন, বিলক্ষণ নয়। বলুন। আপানার কী  কাজে আমি আসিতে পারি?

-আপনি কি পুনরায় চাকরী করবেন?

ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন। চাকরী! চাকরী তিনি তো তিনি আর করবেন না, তেমনই মনস্থির করে রেখেছেন। উত্তর দিলেন, মহাশয়, চাকরীতে আমার সেরকম প্রবৃত্তি নেই। তবে, আপনি যদি মনে করেন, আমার জন্যে উপযুক্ত কোনও চাকরী আপনার হাতে রয়েছে, তাহলে অন্য কথা।

-ভিদ্যাসাগর মহাশয়…, আমার মনে হয়, এই দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে আপনার মতো লোকের অত্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে।  আমি জানি, আ প নি চাকরী না করে নিজের পাণ্ডিত্বের দ্বারা পুস্তক রচনা করেও অর্থ উপার্জন করতে পারবেন। তবে আমি এও জানি, অর্থ আ প না র জন্যে কিছু নয়। চাকরী করলে বাংলার শিক্ষার অনেক উন্নতি সাধন আ প নি করতে পারেন। নিজস্ব ব্যবসা করলে, বা শুধু মাত্র পুস্তক রচনা করে প্রকাশ করলে যা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই আমি অনুরোধ করব, আপনি আবার কলেজে ফিরে আসুন…

-কলেজ!

ঈশ্বরচন্দ্রের ভ্রু কুঁচকে গেল। অতীত অভিজ্ঞতার তিক্ত প্রকাশ ঘটল মুখে চোখে। পরে অবশ্য বললেন, কোন কলেজের কথা বলছেন, মহাশয়? সংস্কৃত কলেজে? তা যদি হয়, দয়া করে আপনি আমাকে অনুরোধ করবেন না। একবার যাঁদের অধীনে চাকরী করতে গিয়ে মতান্তরে তা ছেড়ে এসেছি, সেখানে দ্বিতীয়বার যাওয়ার আমার আর কোনও ইচ্ছেই নেই।

মার্শাল এবার বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, যদি অন্য কোনও কলেজে, অন্য পদে আপনার চাকরী হয়?

-যেমন!

ঈশ্বরচন্দ্রের ধন্ধ কাটছিল না। তিনি সঠিক করে জানতে চান, কোন কলেজে চাকরীর কথা উনি বলছেন।

-আমি আপনার জন্যে ফোরট উইলিয়াম কলেজে চাকরীর ব্যবস্থা করেছি। সেখানে আপনি কোষাধ্যক্ষ ও হেড রাইটার হিসাবে চাকরী করবেন। মাসিক বেতন আশি টাকা। তবে হ্যাঁ, আ প নাকে কোষাধ্যক্ষ পদে বহাল করতে হলে কিছু জামিন রাখতে হবে। বুঝবেন, পদটি অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ।

মার্শাল সাহেবের কথায় দৃঢ়তার প্রকাশ ঘটল। তবু বিষয়টা  ঈশ্বরচন্দ্রের খুব মনপুতঃ হল না। তিনি বললেন, আবার জামিন! কত টাকা জামিন রাখতে হবে, মহাশয়?

-পাঁচ হাজার টাকা।

হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে মার্শাল কথাটা বললেন। এরপরেও যোগ করলেন, এক লপ্তে না পারলে দু বারে তা জমা করবেন। কলেজ সেক্রেটারিকে বলে সে ব্যবস্থা আমি করে দোবো।

ঈশ্বরচন্দ্র চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর সম্মতি দিয়ে দিলেন। দীর্ঘ ভাবনার শেষে নিশ্চিন্ত হাবার মতো করে মার্শাল নিশ্বাস ছাড়লেন।  একাজে ঈশ্বরচন্দ্রের সম্মতি তাঁর বিশেষ প্রয়োজন ছিল।

কাজে লাগলেন ঈশ্বরচন্দ্র। নতুন চাকরী তাঁকে অনেকটা স্বস্তি দিল। ইতিপূর্বে প্রথম চাকুরী থাকা কালে তিনি ঠাকুরদাসকে স্বেচ্ছা অবসরে দেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন ।  আশ্বাস দিয়েছিলেন, মাসে  মাসে কুড়ি টাকা করে  তাঁর কাছে পৌছিয়ে যাবে। খরচ করবেন তাঁর নিজের জন্যে। কিছুটা বা সাংসারের খরচখরচা চালানোর কাজে । এখন আবার চাকরী নিয়ে সে বিষয়ে তিনি অনেকটা নিশ্চিত হলেন।

বাড়ি ফিরে এলেন। সে রাতেই মাকে চিঠি লিখলেন-

 

     শ্রীশ্রীহরিঃশরণম

প্রণতি শ্রীমণ্মাতৃদেবী শ্রীচরণাবিদেষু

প্রণতি পূর্বকং নিবেদনমিদম-

 আজ এই চিঠি মারফৎ তোকে একট বিশেষ সুসংবাদ দিচ্ছি। জি টি মার্শাল সাহেব শিক্ষা বিভাগের অধিকর্তা।  তাঁর আনুকুল্যে আমি আবার একটি কাজে যোগ দিতে যাচ্ছি। তবে এ  কথা মনে করবি না,  তিনি আমাকে  পুরানো কলেজে চাকরীর জন্যে উমেদারী করছেন। তার পরিবর্তে তিনি আমার জন্যে নতুন কলেজে চাকরী জোগাড় করে পত্র মারফৎ আমাকে আহ্বান করেছিলেন। আমি সেখানে যেতে আমায় এই নতুন চাকরীর কথা বলেন এবং তাতে আমি রাজী হয়ে যাই।

 নতুন চাকরী ফোরট উইলিয়াম কলেজে । সেখানে আমার কাজ কলেজের তহবিল সামলানো। সঙ্গে হেড রাইটার হিসাবে কাজ করতে হবে। মাসে বেতন পাবো আশি টাকা। যেহেতু পদটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, সেকারণে কলেজে আমাকে পাঁচ হাজার টাকা জমা রাখতে হবে। এ বিষয়ে মার্শাল সাহেব দু কিস্তিতে টাকা জমা করবার অনুমতিও করিয়ে দেবেন। চিন্তার কারণ নেই। টাকা  জোগাড় হয়ে যাবে। কিছু আমার কাছে আছে। বাকিটা ঋণ হিসেবে কারোও কাছ থেকে নিয়ে নোবো। পরে শোধ করে দোবো।

  এই মুহূর্তে আমার হাতে অন্য অনেক কাজ থাকা সত্ত্বেও এই চাকরীটা আমি গ্রহণ করলাম। এর কারণ, আগামী দিনে তো খরচখরচা বাড়বে। তোর ইচ্ছানুসারে শীঘ্র যদি সংসারে নতুন অতিথি আসে, তবে তো এর দরকার হয়ে পড়বে। সুবিধাই হবে।

 আর বিশেষ কী? তুই ও বাবা সহ বাসস্থ সকলের কুশল কামনা করে চিঠি শেষ করলাম।

                                                                                   ইতি

                                                                                ঈশ্বরচন্দ্রচন্দ্র শর্মা

মাকে সব কথা জানিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের মনে তুষ্টি এল। একবার মনে হল, দীনময়ীকেও নতুন চাকরীর বিষয়টা আলাদা করে  জানান । তবে পরক্ষণে কী মনে করে  তা থেকে বিরত হলেন। মনে মনে ভাবলেন, মা নিশ্চয়ই  সুসংবাদটা দীনময়ীকে না দিয়ে থাকবে না। আর, তা না হলেও, কয়েকদিন পরেই দীনময়ীর শারীরিক খবর নেবার জন্যে তাকে চিঠি লিখবেন। তখন এই কথাটাও লিখে জানাবেন। দীনময়ীর শারীরিক পরিবর্তনে কিছু সুখবর পাবার জন্যে তিনি সবসময় উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। মনেপ্রাণে একটা সন্তানের আশা করছেন । গত যাত্রায় তাঁদের মিলন যেন সুফল দান করে , সেজন্যে নানান সংকল্প করে রাখছেন।

                                 (৭)

 

কয়েক মাস পরের ঘটনা।

ঈশ্বরচন্দ্র ফোরট উইলিয়াম কলেজের অফিস ঘরে বসে হিসেব পরীক্ষার কাজ করছেন। টেবিলের ওপর লম্বা জাব্দা খাতায় বছরের আয় ব্যায়ের হিসাব। তাঁর পদটা কোষাধক্ষের। গুরুত্ব পূর্ণ পদ। সারা বছরের আয় ব্যায়ের হিসেব মিলিয়ে তবে চূড়ান্ত এ্যকাউন্টস তৈরী হবে। ব্যাল্যান্সশীট তৈরী হবে। তা করবে বাইরের ভাড়া করা চাটারড এ্যকাউন্টেন্ট।  তিনি আবার ইংরেজ। হিসেব নিকেশে কোনও রকম গরমিল থাকলে পুরো এ্যকাউন্টস নতুন করে  করতে হবে। সেকারণে কোষাধক্ষকে হিসাব সম্বন্ধে সদা সতর্ক থাকতে হয়। অবশ্য হিসেব রাখে কলেজের বড়বাবু। ঈশ্বরচন্দ্রকে তা পরীক্ষা করে  নিতে হয়।  পড়ুন- আবার এসো ফিরে

ব্যাল্যান্সশীট যাবে কোম্পানির ঘরে। তাতে শুধু আয় ব্যায়ের হিসেবই  থাকবে না। সারা বছরের জমা খরচের সঙ্গে থাকবে কলেজের স্থায়ী আমানত কতখানি বাড়ল। গত বছরের থেকে চলতি বছরে তা কত শতাংশ বেড়েছে, দেখা হয়। কম হবার তো কথাই নেই। তা যদি হয়ও, তাহলেই কলেজ অধ্যক্ষর ডাক পড়বে। কৈফিয়ত তলব হবে। বাড়লে অবশ্য সকলেই খুশি। তখন বিনা বাক্য ব্যয়ে সামনের বছরের জন্যে কোম্পানির ঘর থেকে অনুদান আসবে। কলেজ তো আর শুধু ছাত্র বেতনের ওপর চলে না? কোম্পানির অনুদান নিতেই হয়। এখন অবশ্য এই অনুদানের পরিমাণে অনেকটাই ধরাকাট হয়ে গেছে। কারণ ইতিমধ্যে  বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ঈশ্বরচন্দ্রের দেওয়া প্রস্তাব মতো বাংলায় একশ’টা  ইশকুল প্রতিষ্ঠা করিয়েছেন। শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ভাষা। সেখানে শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন সংস্কৃত কলেজ থেকে সদ্য পাস করা ছাত্ররা।  তারা  সেখানে মাষ্টারী করছে। ইশকুল সবই অবৈতনিক। আবার শিক্ষকদের বেতন না দিয়ে তো পড়াতে বলা যায় না? তাই এত জনের বেতন সবটাই কোম্পানির ঘর থেকে আসে। যে কারণে কলেজের অনুদানে বেশ টান পড়েছে।

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page