এক মুঠো শিউলি

রূপকথা বসু 

মাথাটা চিড়বিড় করে উঠল। ওই ওই আবার কেমন কেমন লাগছে। বিছানায় এভাবে একপাশ হয়ে শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না নীলের। চোখের তলায় কালি। ঝাপসা হয়ে আসছে চারপাশ। একটু আগে ভিজিটিং আওয়ার ছিল। অনেকেই এসেছিল দেখা করতে। শ্রাবণও এসেছিল চকলেট নিয়ে। ও জানত নীল চকলেট খেতে ভালোবাসে। ওর চোখে কোনও আলাদা করে ঝিলিক দেখতে পেলো না নীল। শুধু চুপ করে এগিয়ে এলো নীলের কাছে। নীল শ্রাবণের আঙুল ছুঁয়ে থাকল কিছুক্ষণ। শুধু এইটুকুই তো চায় নীল। একটু ছুঁয়ে থাকতে। সে জানে শ্রাবণ আর ভালোবাসে না তাঁকে। আদর করে ডাকবেও না কখনও ‘ওগো, শুনবে একটু’।

ওদিক থেকে সিস্টার ডেকে উঠল। নীলাঞ্জনা এবার ঘুমিয়ে পড়ো, নাহলে আবার ইঞ্জেকশন দিয়ে দেবো। সিস্টারের কথা শুনে ও পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঘুম তো তার আসছেই না। বরং ওই টোল পড়া মুখের হাসিটা চোখের সামনে বারবার চলে আসছে। পাগলামো গুলো ভেসে আসছে শুধু। নার্সিং হোমের লাইট গুলো সব নেভানো। একটা হালকা আলো সিস্টারের বসার জায়গায় শুধু জ্বলছে। ওদিকে মাসিরা ঘুমে ঢুলছে। পাশের বেডের দিদাটা মিহি সুরে নাক ডাকছে। আজ তাঁকে কেউ দেখতে আসেনি বলে খানিকক্ষণ কাঁদছিল। মাসিরা অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে তাঁকে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে।

-এই এদিকে শোন না?

– হ্যাঁ বল কি বলবি?

– চল না আজ একটু নদীর ধারে গিয়ে বসি…

– যাবো, কিন্তু এতো কাজের চাপ যে। আচ্ছা কাল যাই তবে… আজকে তোকে নাহয় যাওয়ার পথে আইসক্রিম খাওয়াবো।

– ইয়ে, আইসক্রিম, বেশ তবে তাই হোক।

এই একটা জায়গায় নীল ভীষণ শান্ত থাকে। শ্রাবণের কাছে। ও যেটা বলে, যা বুঝিয়ে বলে সব সে শোনে। কোনো কিছুতেই না নেই তার। নীলও বলে, আরগুমেন্ট করে কি লাভ বলো তো। জোর করে কেউ কিছু কি পেয়েছে। আর এতো ভালোবাসা। দুদিনের জন্যে তো নয়। সারা জীবন পড়ে আছে। আজ নাহয় ব্যস্ত। কাল ঠিক যাবো। এই নিয়ে রিমির সঙ্গে ওর রোজ কথা কাটাকাটি হয়। রিমি বলে, ‘তুই কি করে পারিস বল তো, ও তো তোকে সময়ই দেয় না… কোথাও নিয়ে যায় না। নীল অমনি ঝাঁঝিয়ে ওঠে… কেন রে, তুই এত জ্বলিস কেন, শ্রাবণকে নিয়ে একটা কথাও বলবি না। ও যেমন আছে তেমন থাক। আমার কাছে ও অন্যরকম। ওকে ওর কাজগুলো গুছিয়ে নিতে দে। ও যেভাবে আমাকে সময় দেবে আমি সেটাই মেনে নিতে পারি। আমার বেশি কিছু চাওয়ার নেই। ওর গানের গলা শুনেছিস কখনও তুই। জানিস ও কি সুন্দর করে কথা বলে। আর ওর চোখগুলো যেন গভীর একটা দীঘি।

-আরে হয়েছে… হয়েছে… মরণ! আদিখ্যেতা দ্যখো। আর এক পাগলের তো হুশই নেই… রাধিকা যে তাঁর জন্যে এরকম পাগল হয়ে বুঁদ হয়ে থাকে। কবে যে বুঝবে পাগলটা।

– বুঝবে বুঝবে ঠিক বুঝবে … একটু সময় যাক। পড়ে আছে তো গোটা জীবনটা… এতো আর ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড এর গল্প নয়।

– আচ্ছা এই ব্যাপার। বেশ বেশ রাধিকা তবে শ্যামের প্রেমে মজে থাকো। দ্যাখো কবে শ্যামের বাঁশি বাজে।

‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়… বাজায় বাঁশি’ নীল গান শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে থাকে। শ্রাবণ যে তাঁর কাছে, কি এবং কতটা তা বুঝিয়ে বলতে পারবে না কোনওদিন। ও এতেই খুশি। শ্রাবণ থাকুক তাঁর নিশ্বাস জড়িয়ে। সময় না দিক, তাও ঠিক আছে। নীলেরই বা সময় কোথায়। সেই প্রেসের কাজে দৌড় ঝাঁপ। এদিক ওদিক দৌড়নো। সারাক্ষণ লেগেই আছে। স্বপ্ন গুলো যে পূরণ করতে হবেই। শ্রাবণ পাশে থাকলে সে সাহস পায় অনেকখানি। তাঁর আর কারো প্রয়োজন পড়ে না। একাই লড়াই করে তখন সবার সঙ্গে। আর শ্রাবণ হেসেই উড়িয়ে দেয়। আসলে সে বুঝলই না কোনোদিন।

হঠাৎ করেই সেদিন বলে দিল, আমাদের মধ্যে আর সম্পর্ক না রাখাই ভালো রে। অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলি তো। এখানেই স্টপ করে দেওয়াটা উচিৎ মনে করছি। নীল আর কোনও কিছু বলেনি। যেমন চাপা স্বভাবের সে… সেরকমই অভিমানী। একটা সম্পর্ক এরকম দুম করে শেষ করে দিতে পারল শ্রাবণ। যে সম্পর্কে ঝগড়া নেই ঝামেলা নেই… হ্যাঁ হয়ত সময় ছিল না। কিন্তু এটা তো জানত, যে এটা কেরিয়ারের সময়। নীল চুপচাপ বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। অভিমানে সেদিন ব্যাগ গুছিয়ে ট্রেন ধরে মুম্বাইয়ের। লাস্ট একটা মেসেজ করে জানায়। ডিসিশনটা যেদিন বুঝবি ভুল নিয়েছিস… সেদিন জানবি আমি শেষ দিনে দাঁড়িয়ে আছি।

গত ছয় মাসে নীল কোনো যোগাযোগ করেনি আর। শ্রাবণ বলেছিল বন্ধু হয়ে তাঁর পাশে থাকবে সবসময়। কিন্তু নীল চায়নি সেই বন্ধুত্ব। জেদী নীল একটু একটু করে সরে এসেছিল সবরকম সামাজিকতা থেকে। বাবা-মা অনেকবার বলেছিল বাড়ি ফিরে যেতে। সেও যে যেতে চায়নি তা নয়। বাড়ির উঠোনের সেই শিউলি গাছটা। আদরের কুচু ছানা টা। প্রিয় ডাকগুলো ভীষণ শুনতে ইচ্ছে করছিল তাঁর। কিন্তু পোড়া কপালে কি সুখ সয়। সে আর কাউকে কিছু জানায়নি। শুধু রিমি জানে ব্যাপারটা।   সে তো শুনেই চমকে উঠেছিল। আর ঠাটিয়ে এক চড় মেরেছিল নীলকে।

-তুই এসব কাউকেই জানাসনি কেন? বাবা,মা শ্রাবণ… আমাকে তো বলতে পারতিস। আজ এতোদিন পর তুই জানাচ্ছিস।

নীল! নীল! এই নীলাঞ্জনা। চোখ খোলো… কি বিড়বিড় করছ তখন থেকে। ডক্টর এসেছে চেক আপ করতে, একটু উঠে বসো তো দেখি। সিস্টার তাঁকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। এই কদিনে তাঁর শরীর আরও শুকনো হয়ে গেছে। সিস্টার রোজ এসে তাঁকে চুল বেঁধে দেয়, মুখে ক্রিম লাগিয়ে দেয়। আর গল্প করে। নীলও সেরকম, তাঁর শিউলি ফুলের গল্প করে, খরগোশের গল্প করে, তাঁর কাঠবেড়ালির গল্প করে। গল্প করতে করতে চুপ হয়ে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ফুলের উপত্যকার কথা ভাবে। শ্রাবণ বলেছিল নিয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর আর যাওয়া হবে না কোনোদিন। আসলে সে বড়োদের মতো কঠিন করে কিছুই ভাবতে পারে না।

আজ তাঁর লাস্ট কেমো। হ্যাঁ সে ব্লাড ক্যান্সারে ভুগছিল এতোদিন। ডক্টর বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু নীল তো জানে সে আর হবার নয়। বড্ড মিস করছিল কয়েকদিন থেকেই ডাকনাম গুলো। শ্রাবণ তাঁকে কত্ত কত্ত নামে ডাকত। আর নীল সবেতেই সাড়া দিত। আসলে কেউ কখনো এভাবে তাঁকে আপন ভাবেই নি। ভালোওবাসেনি কোনোদিন। শ্রাবণের মধ্যেই সে সব পেয়েছিল। ছেলেটাকে কত্ত না জ্বালিয়েছে সে।

-এই ছেলেটা… এদিক শোন। আজ তোর জামায় আমি পিঁপড়ে ছেড়ে দেবো। যদি না নিয়ে যাস।

– কোথায় যাবি বল তো আগে। চল নিয়ে যাচ্ছি।

-অনেক অনেক দূরে ফুলের জায়গায়… যেখানে শুয়ে শুয়ে তুই আর আমি আকাশ দেখবো।

– ধ্যাত তোর শুধু দিবা স্বপ্ন, এতো স্বপ্ন দেখলে চলে। এরকম বাচ্চাদের মতো থাকিস। একটু তো প্র্যাকটিকাল ভাব। একটু বোঝ সময় গুলো।

– তুই পারিস না , তাই না এভাবে ভাবতে। কত ভালো রে তুই। যদি তোর মতো ভাবতে পারতাম। কঠিন হতে পারতাম। আচ্ছা ছাড় কোথাও যাব না। জানি তো তোর সময় নেই। কাজের মধ্যে থাকিস। চল দু-কাপ চা’ই খাই চল…

আজ সাজো সাজো রব নার্সিং হোমে। নীল চোখ খুলতেই দেখল সিস্টাররা সাজিয়ে দিচ্ছে চারদিক। কি যেন একটা আছে আজকে। কত তারিখ সেটাও বুঝতে পারছে না সে। কিছু কি আছে আজকে। কি জানি হবে হয়তো। সে আর কিছু না ভেবে পাশ ফিরে শোয়। হঠাৎ পেছন থেকে চেনা আওয়াজ।

-কীরে আর কতদিন এভাবে শুয়ে থাকবি। চল এবার পার্টি করব। এভাবে টাকা ধ্বংস করছিস।

-আরে রিমি, তুই কবে এলি। এখানকার ঠিকানা কে দিলো তোকে।

-দাঁড়া… দাঁড়া একটু স্বস্তি নিতে দে। আরও একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্যে। তার আগে দেখি তোর চুল কত বড়ো হল।

রিমি নীলের মাথার ক্যাপ সরিয়ে দেখল তার মাথায় একটাও চুল নেই। খানিকটা চুপ থেকে আবারও তড়বড়িয়ে উঠে বলল, ‘একটা জিনিস দেখবি… রিমি তার মাথার স্কার্ফ সরিয়ে দেখাল… এই দ্যাখ নতুন স্টাইল’।

রিমি তার চুল কামিয়ে পুড়ো ন্যাড়া করে ফেলেছে। বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল। বলল, কিরে তুই কেন চুল কাটলি?

-কেন রে, একা তুইই ন্যাড়া হতে পারিস। আমি নই।

হঠাৎ কেবিনের গেট খুলে সিস্টার আর ডক্টর আর মাসিরা এসে হাজির। তাঁদের হাতে একটা কেক। অমনি সবাই জোরে চেঁচিয়ে উঠল… হ্যাপি বার্থ ডে নীলাঞ্জনা… হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…

নীলাঞ্জনার চোখ জলে ভরে আসছিল। ও আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিল না। সব কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছিল। সে যেন উড়ছে হাওয়ার মধ্যে। সবাই মিলে তার জন্মদিনের কেক কাটল। এভাবে বাড়ি থেকে দূরে এক অচেনা জায়গায়। সবকিছুর মূলে রিমি। এই মেয়েটা এতদূর ছুটে এসেছে তার জন্য। সে পাশ ফিরে শুতেই রিমি ডক্টরের সঙ্গে কথা বলতে গেলো।

আর কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁকে কেমো দিতে নিয়ে যাওয়া হবে। মনে হয় সেই নিয়েই কিছু কথা। রিমির মুখটা কেমন শুকনো হয়ে আছে। ডক্টর নার্সকে বলল নীলকে রেডি করতে। নার্স তার ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে দিতে দিতে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। হঠাৎ নীল শিউলি ফোঁটার গন্ধ পেলো। ভীষণ কাছেই কোথাও শিউলি ফুটে উঠছে। সে চোখ বন্ধ করে একবার শ্রাবণের কথা ভাবল। একবার বাড়ির কথা ভাবল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ খুলতেই দেখল সামনে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতের মুঠোয় কমলা সাদা রঙের শিউলি। আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নীল মাথা নীচু করে বসে রইল। তাঁর হাতে শিউলি গুলো দিয়ে শ্রাবণ হাত রেখে বলল, সুস্থ হয়ে ওঠ… আমরা ফুলের উপত্যকায় যাবো। অনেক জায়গায় ঘুরব। নীল চোখ তুলে আলতো করে হাসলো শুধু।

কিছুক্ষণের মধ্যে ওয়ার্ডবয় নীলকে নিয়ে যেতে এলো। নীল শিউলিগুলো ফেরত দিয়ে বলল… যত্নে রাখিস স্বপ্নগুলো, আগলে রাখিস সব।

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page