ফ্ল্যাট কালচার
পিনাকী চৌধুরী- বৃষ্টিস্নাত কলকাতাই হোক অথবা উৎসবমুখর কলকাতা, যতবারই দেখি, কেমন যেন মুগ্ধ হয়ে যাই ! বস্তুতঃ অষ্টাদশী কোনো সুন্দরীর মতো আরও মোহময়ী ও আকর্ষণীয় লাগে আমার এই প্রাণের শহরটিকে । তবে এই একবিংশ শতাব্দীর চরম ব্যস্ততার যুগে এসে অতীতের সেই একান্নবর্তী পরিবারের ধারণাটি আজ প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। শহরে একচিলতে নিজের বাসায় তখন হয়তো প্রাণের আরাম ছিল, ছিল পারস্পরিক সদ্ভাব এবং সৌহার্দ্য! পরিবারের সকল সদস্যরা এক ছাদের তলায় সুখে দুঃখে দিন অতিবাহিত করতেন!
অতীতের সেইসময় আর্থিক স্বচ্ছলতা হয়তো ছিল না, কিন্তু আতিথেয়তার আতিশয্য ছিল। বাড়িতে অতিথি এলে সবাই কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করতেন ‘ অতিথি দেব ভব!’ সেই আটপৌরে বাড়ির সামনে হয়তো গৃহকর্তা নিজের পছন্দ মত বাগান করতেন, পরিবারের সদস্যরা বাড়ির ছাদে উঠে জ্যোৎস্না রাতে আকাশের তারা দেখতেন! তখন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের দাপট তেমন একটা ছিল না, পরিবর্তে তাঁরা রেডিও স্টেশনের বিভিন্ন সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান শুনতেন! দিনগুলো এভাবেই বয়ে যেতো! কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ শহরের আনাচে কানাচে ফ্ল্যাট কালচার ভীষণ ভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
হ্যাঁ , যৌথ পরিবারের ধারণাটি আজ সোনালী অতীত। শহরের বাসিন্দারা আজ অনেকেই ফ্লাটে থাকতেই পছন্দ করেন, যেখানে শুধুই স্বামী স্ত্রী এবং সন্তান বাস করেন। আর ফ্ল্যাটের দরজাটি বন্ধ করে দিলেই যেন বহিঃবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ!
অতীতের সেইসময় প্রতিবেশীদের সঙ্গে পারস্পরিক সদ্ভাব আজ কিন্তু ফ্ল্যাট কালচারে পাওয়া যায় না। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা মূলত কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক , সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে তাঁরা যেন নারাজ! আর এই আত্মকেন্দ্রিকতা প্রসূত দুর্বলতার বীজটি বৃদ্ধি পেয়ে তাঁদের শোচনীয় পদস্খলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই ফ্ল্যাটের কোনো একরত্তি শিশু আজ হয়তোবা অতীতের মতো মাঠে গিয়ে জলকাদা মেখে দাপিয়ে ফুটবল খেলে না, পরিবর্তে শিশুরাও আজ বিকেলে কম্পিউটারের প্রতি আসক্ত। হ্যাঁ, বহুতলের বাসিন্দারা আজ নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন যাপন করতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন! তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজেকে জাহির করতে একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় করে থাকেন, যেখানে শুধুই একাকীত্ব এবং একাকীত্ব!