মাহেশের রথের কাহিনি
পিনাকী চৌধুরী।। এইবছর হুগলি জেলার মাহেশের রথযাত্রা ৬২৫ তম বর্ষে পদার্পণ করবে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থগিত হয়ে গেল মাহেশের ঐতিহ্যমন্ডিত রথযাত্রা। যদিও নিয়মমাফিক বিগ্রহ পুজো হবে এবং আগামী ২৪ জুন জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা উৎসব এবং সেই উৎসব স্নানপিড়ির মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু এবার স্নানযাত্রা উৎসব পালিত হবে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে। বস্তুতঃ মাহেশের রথযাত্রা নিয়ে একটি সুন্দর কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।
আমরা যদি ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখি তাহলে দেখবো যে, আজ থেকে ৬২৫ বছর আগে মাহেশে একজন উদারমনস্ক সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী বাস করতেন। তাঁর নাম ছিল ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী। তিনি গঙ্গার তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গভীর সাধনায় মগ্ন হন । তারপরে হঠাৎই একদিন পরিব্রাজক হয়ে তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। তীর্থভ্রমণ করতে করতে অবশেষে তিনি শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছলেন। এই ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর মনের সুপ্ত বাসনা ছিল যে তিনি নিজেই ভোগ রান্না করে শ্রীক্ষেত্র পুরীতে প্রভু জগন্নাথ দেবেকে খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি তা করতে গেলে সেখানকার পান্ডারা তা জেনে ফেলেন এবং প্রচন্ড রেগে যান। সেখানকার পান্ডারা সেই সন্ন্যাসীকে রীতিমতো অপমান করে পুরী থেকে তাড়িয়ে দেন ।ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী মনে খুব আঘাত পেলেন এবং এক বটগাছের নিচে বসে মনের দুঃখে ভাবতে লাগলেন যে, ভগবানকে যখন আর ভোগ নিবেদন করা হল না, তখন আর বেঁচে থেকে কি লাভ ? তিনি ঠিক করলেন যে এ জীবন আর রাখবেন না । অন্তর্যামী প্রভু জগন্নাথ দেব ধ্রুবানন্দের মনের ব্যথা বুঝতে পারলেন। স্বপ্নে দেখা দিয়ে জগন্নাথ দেব ধ্রুবানন্দকে বললেন ” ধ্রুবানন্দ , তুমি দুঃখ করোনা । তুমি আমাকে অবশ্যই ভোগ নিবেদন করতে পারবে। আমি এখন থেকে মাহেশেও অবস্থান করবো । তাই তুমি মাহেশে ফিরে যাও। মাহেশের ভাগীরথীর পশ্চিমকূলে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে। সেই কাঠ দিয়ে তুমি প্রভু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণ করবে । আমি সেই মূর্তিতে অধিষ্ঠিত হবো ।”
স্বপ্নে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী জগন্নাথ দেবের দর্শন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন! তাঁর চোখের জল বাগ মানলো না। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী মাহেশেই ফিরে এলেন। ভাগীরথীর তীরে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী গভীর সাধনায় রত হলেন। বর্ষণমুখর এক প্রবল দুর্যোগের রাত ! প্রকৃতি যেন তান্ডবলীলা চালাচ্ছে।ভাগীরথীও উথাল পাথাল ! এসবের মাঝেও ধ্রুবানন্দ গভীর ধ্যানে মগ্ন । এরই মাঝে তিনি দিব্যকর্ণে শুনতে পেলেন , কে যেন তাঁকে বলছে ” ওঠো ধ্রুবানন্দ , জয় জগন্নাথ। ওই দেখো তোমার সেই কাঙ্ক্ষিত নিম কাঠ ভেসে আসছে !” চোখ মেলে তাকালেন ধ্রুবানন্দ । সত্যিই তো ! আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি কোমর সমান জলে নেমে পড়লেন। কাঠটি যেন ইচ্ছে করেই তাঁর বুকের কাছে এসে থেমে গেল ! পরম ভক্তিভরে ধ্রুবানন্দ সেই নিম কাঠটি মাথায় ঠেকালেন ! নিমকাঠ তো পাওয়া গেছে, কিন্তু শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করবে কে ? হঠাৎই একজন এসে উপস্থিত! বললো , সে সূত্রধর। সেই মূর্তি নির্মাণ করবে। ধ্রুবানন্দ বললেন , এই মুর্তি পুরীর মন্দিরের জগন্নাথ দেবের মূর্তির থেকে আলাদা হবে। সুভদ্রা ও বলরামের মূর্তি প্রভু জগন্নাথ দেবের থেকে কিছুটা ছোট হবে। আর প্রভু জগন্নাথ দেব আয়তলোচন হবেন। রুদ্ধদ্বার কক্ষে মূর্তি নির্মাণ শুরু হল এবং নির্মাণ সম্পন্ন হল । কিন্তু দরজা খুলতেই দেখা গেল সেই সূত্রধর নেই। অবাক কান্ড ! ভক্তদের বিশ্বাস সেই সূত্রধর ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা ! ধ্রুবানন্দ খড় ও পাতা দিয়ে পর্ণকুটির তৈরি করলেন। সেই পর্ণকুটিরেই প্রতিষ্ঠিত হলেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা । ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর মৃত্যুর পরে পুজোর দায়িত্ব পালন করেন কমলাকর ঠাকুর।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, মাহেশে প্রভু জগন্নাথ দেবের প্রথম মন্দিরটি গড়ে তোলা হয় ভাগীরথীর তীরে। পরে গঙ্গার ভাঙনে মন্দিরটি নষ্ট হয়ে যায় । তারপরে রাজপথের পশ্চিমদিকে মন্দিরটি গড়ে তোলা হয় । এখানে পুরীর মতোই শালগ্রাম শিলার ওপর রত্নবেদী । এই বেদীর ওপরেই অধিষ্ঠিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। পুরীতে যেমন দেবতাদের নতুন কলেবর হয়, মাহেশে কিন্তু হয় ‘ নবযৌবন ‘!