সুবর্ণভূমে পুষ্পকেতু

পঞ্চম পর্বের পর 

মালব প্রণালী

মালব প্রণালীর যাত্রাপথ এর আগের সমুদ্রযাত্রার থেকে কিছু আলাদা, এখানে জলপথ অনন্তবিস্তৃত নয়; দুটি ভূখন্ডের মধ্যবর্তী সঙ্কীর্ণ প্রণালী দিয়ে পাড়ি দেয় সমুদ্রযান গুলি সুদূর প্রাচ্যের পথে। মালবদ্বীপের সমগ্র দক্ষিণ উপকূল পার হয়ে তবেই আবার খোলা সমুদ্রে পৌঁছান চলে এই পথে। উপকূল্ভূমী কাছে হওয়ায় এখানে ঝড় বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা কম, দিক ভুল হবারও সম্ভাবনা নেই; তবু অত্যন্ত বিপদসংকুল এই পথ, আর তার কারণ জলদস্যুর উপদ্রব। দ্রূতগামী যুদ্ধনাওয়ে জলদস্যুর দল আচমকাই আক্রমণ করে বাণিজ্যপোতগুলিকে, লুঠপাট এমনকি হত্যা, কিছুতেই হাত কাঁপেনা এদের, আর তার পরেই পলকে হারিয়ে যায় প্রণালী সংলগ্ন ভূখন্ডের খাঁড়িতে, এদের ধরা শক্ত, কারণ সংশ্লিষ্ট ভূখন্ডের খাঁড়িগুলি ঘন জঙ্গলে ঢাকা, একবার তার ভিতরে ঢুকলে পথ চিনে ফেরত আসা দুঃসাধ্য। তবে দলবদ্ধ নৌবহরে যাত্রা করলে জলদস্যুর ভয় থাকেনা; এরা লোভী তস্কর, তাই দুর্বলের উপর আঘাত হানতেই অভ্যস্ত, প্রশিক্ষিত সেনানীর সাথে সমুখ সমরে জড়িয়ে পড়ার দুঃসাহস এদের নেই।

 

‘আপনার সুরসঞ্চালনা বড় মধুর কুমার, মনকে কোনও মায়ালোকে নিয়ে যায় অনায়াসে’, প্রমোদকক্ষে পুষ্পকেতু বীনা বাজাচ্ছেন, গোধূলির মায়াবী আলোয় সকলেই মন্ত্রমুগ্ধ, বাজনা থামতে তাই মন্তব্য করেন চতুর্ভুজ। কক্ষে উপস্থিত রয়েছেন প্রত্যেক বিশেষ অতিথি, সুগন্ধি তক্র আর সমুদ্রের শীতল বাতাসে পরিবেশ মনোরম, আজ ধূর্জটিদেবও সন্ধ্যাহ্নিক সেরে যোগ দিয়েছেন আসরে।

‘আহা, দিনগুলি যদি এমন নিশ্চিন্ত বিশ্রামেই কাটে, আমার সমুদ্রযাত্রায় আপত্তি নেই কোনও’, উল্মুক বলে ওঠেন।

‘আপনাদের যৌবনকাল, তাই সহজেই নিশ্চিন্ত হতে পারেন, আমার এই দীর্ঘজীবনে দেখলাম তো অনেক কিছুই, এ বয়সে তাই চিন্তামুক্ত থাকা কঠিন’, ধূর্জটিদেব হেসে মন্তব্য করেন।

‘আপনি কি কোনও বিঘ্নের আশঙ্কা করছেন আচার্য?’ পুষ্পকেতু প্রশ্ন করেন।

‘ঠিক তা নয়, তবে রাজপ্রতিনিধিত্বের বৃহৎ দায়িত্ব, আপনাদের সকলের ভালোমন্দের ভারও তো আমার উপর, সঙ্গে অর্থসম্পদও কম নয়; সব মিলিয়ে চিন্তা হয় বইকি!’ দীনান্তের নিভে আসা আলোয় ব্রাহ্মণকে কিছু বেশীই প্রবীণ মনে হয়, কিছু আগের হালকা পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে গম্ভীর আলোচনায়।

‘কে! কে ওখানে?’ চতুর্ভুজ হেঁকে ওঠেন।

‘আলো এনেছি প্রভু’, ঠিক সেসময় একটি নবনিযুক্ত মালব কর্মচারী জালিক ঢাকা দীপদন্ড নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে; দীপের আলোয় উজ্জ্বল হয় স্থানটি, হাসি ফুটে ওঠে সকলের মুখে। পুষ্পকেতু আবার নতুন করে বীণায় সুর তোলেন।

***

দুপুরের আহার সবে মাত্র শেষ হয়েছে, বিশ্রামকক্ষের ছায়াঘন আলো আঁধারিতে দুজনেই কিছুটা তন্দ্রামগ্ন; এসময়ে কক্ষদ্বারের ঠিক বাইরে গোলমাল শুনে চমকে উঠে বসেন পুষ্পকেতু।

‘ব্যাপার কি? কে গোলমাল করে ওখানে?’ প্রশ্ন করেন তিনি।

তার উত্তরে সেবক দ্বৈরথ কক্ষে প্রবেশ করে, তার গলায় অভিযোগের সুর।

‘প্রভু এই জংলিটাকে যে আর সহ্য হয়না, অর্বাচীন ক্রমেই আমার জীবন বিষময় করে তুলেছে।‘

‘কেন হয়েছেটা কি?’

‘সেই প্রথম দিন থেকে, এ যে আমার সাথে ছায়ার মত লেগে রয়েছে, আপনি বললেন মানিয়ে নিতে, সে চেষ্টাই করছি এযাবৎকাল, কিন্তু আর পারছিনা। আপনি এর বিহিত করুন।‘ ইতিমধ্যে ধীয়ের ভাবলেশহীন মুখখানি দেখা দেয় দরজার পরিবস্ত্রার আড়াল থেকে।

‘সমস্যা যে প্রবল একটু বিশদে না বললে সেকথা বুঝি কেমন করে দ্বৈরথ? ধী তোমার ভারি অনুগত, দেখো তো এখনও কেমন চুপটি করে পিছনে এসে দাঁড়িয়াছে!’ উল্মুক মন্তব্য করেন, তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস।

‘সেই প্রথম দিন থেকে ক্ষার খৈল দিয়ে কতবার বললাম ভাল করে স্নান করতে, বুনো গন্ধে টেঁকা দায়! সভ্য বস্ত্র পরাতে গেলাম, মানলে না, এমনকি আমার নিজের একজোড়া পাদুকা দিলাম, তাও পায়ে না দিয়ে শোবার কালে মাথায় দেয়! আজ সকালে বললাম, আপনাদের কক্ষের দীপদন্ডগুলি তেন্তুল দিয়ে ভালো করে মেজে আনতে; খানিক পরে দেখি দীপদন্ড মাটিতে গড়াগড়ি খায়, আর ছোকরা তেন্তুল ফল নিজে ভক্ষণ করছে! এখন কাজকর্ম সেরে সবে একটু নিজ শয্যায় চক্ষু বুঁজেছি; বহুদিন গৃহছাড়া, তন্দ্রামধ্যে শিশু সন্তানগুলির মুখ দেখতে পাচ্ছি; আচমকা গায়ে গরম নিঃশ্বাস, চমকে তাকাতেই দেখি এ ব্যাটা ভাঁটার মত চোখ নিয়ে ঝুঁকে পরে আমাকে দেখছে!‘

অবস্থা বুঝে পুষ্পকেতু ধী কে কাছে ডাকেন ঘটনার মীমাংসা করতে। ধী কক্ষে প্রবেশ করে দ্বৈরথের ঠিক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, তার মুখে অনাবিল হাসি; দ্বৈরথ তাকে দেখে যত চটে, তার হাসির বহরও তত বৃদ্ধি পায়।

‘তোমার পরোপকারের দায় দ্বৈরথের অত্যাচারের কারণ হোল দেখছি’, উল্মুক জনান্তিকে বলেন বন্ধুকে। এরপর দুজনে মিলে বহুচেষ্টায় ধী কে বোঝান দ্বৈরথের থেকে দূরে থাকতে, কথা না শুনলে অন্যদুটি বহিত্রের একটিতে পাঠানো হবে তাকে একথাও জানানো হয়। ধী কতটা কি বুঝলো বলা যায় না, তবে এরপর থেকে সে দ্বৈরথের সাথে দূরত্ব রাখে, রাত্রেও শয়ন করে উন্মুক্ত আকাশের নীচে নৌকার পাটাতনে।

***

‘শৈলদেশ কেমন রাজ্য, মালবদেশের মতই হবে বলে মনে হয় কি?’ দেখতে দেখতে অর্ধপক্ষকাল গত হয়েছে, এক রৌদ্রস্নাত সকালে উন্মুক্ত পাটাতনে দুটি সুখাসনে মুখোমুখি বসে আলোচনা করছেন দুই মিত্র।

‘সুবর্ণভূমের অঙ্গ যখন, সমাজব্যবস্থা, রীতিনীতিতে কিছু মিল থাকাই সম্ভব; তবু ভিন্ন দেশ তাই তফাৎও থাকবে অবশ্য। শৈলদেশ সমগ্র সুবর্ণভূমের শিরোমনি, রাজা চন্দ্রদমনের আধিপত্য সমগ্র প্রাচ্যে সুবিদিত; অতএব রাজ্যটি যে আমাদের মত ভ্রমণপিপাসুর চোখে চমকপ্রদ হবে, এবিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই’ পুষ্পকেতু হেসে মন্তব্য করেন।

‘শুনেছি চন্দ্রদমন আর্য, স্বদেশ ছেড়ে পরভূমিতে গিয়ে বেতনভোগী যোদ্ধা থেকে একেবারে দেশের নৃপতি, এযেন গল্পকথা!’

‘চন্দ্রদমন কুষাণবংশীয় রাজপুরুষ, নিজদেশে উন্নতির পথ সীমিত অনুভব করে যৌবনে বিদেশ পাড়ি দেন; সুখী গৃহকোন ছেড়ে অনিশ্চয়তার উদ্দেশ্যে যাত্রা প্রবল পুরুষাকারের লক্ষণ, তিনি সফল হয়েছেন সেকারণেই।‘

‘তুমি যে ইতিমধ্যেই তাঁর অনুরাগী হয়ে পড়েছ দেখছি! কিন্তু অমরাবতীর সাথে তাঁর বিরোধের কারণ কি?’

‘কারণ কিছুটা রাজনৈতিক, অনেকটাই অর্থনৈতিক, আর হয়তো খানিকটা আত্মম্ভরিতা। অমরাবতীও পরাক্রমী দেশ, শুনেছি সেখানের যুবরাজ ভদ্রমর্মণ একাধারে বীর ও উচ্চাকাংক্ষী; বিগত কয়েক বছরে তাঁর উদ্যোগেই অমরাবতীর প্রতিপত্যি বেড়েছে সামুদ্রিক বাণিজ্যে। এমত অবস্থায়, মহারাজ চন্দ্রদমন অমরাবতীর প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন না সেটাই তো স্বাভাবিক, একই বনাঞ্চলে দুই সিংহ  বসবাস করতে পারে কি?’

‘যুবরাজের এত ক্ষমতা! ভারি চমকপ্রদ ব্যাপার তো?’

‘আরও চমকপ্রদ ঘটনা এই যে, তিনি মহারাজ বীরবর্মনের পৌত্র। পুত্র বর্তমান থাকতেও পৌত্রকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেছেন রাজা, বুঝতেই পারছ, ভদ্রবর্মণ সামান্য পুরুষ নন।‘

‘অতি আশ্চর্য স্থান এই সুবর্ণভূমি মানতেই হয়; কোথাও পুত্র থাকতেও জামাতা সিংহাসনের অগ্রাধিকার পায়, তো কোথাও পৌত্র!’

‘তাতে অন্যায় কোথায় বন্ধু? প্রজাপালনে রক্তের অধিকার অপেক্ষা পুরুষাকারই অগ্রগন্য হওয়া উচিৎ আমার বিচারে। শৈলরাজ শ্রীবর্মা ও অমরাবতীর বীরবর্মণ যে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন, তাতে জনগণের কল্যাণ, সমগ্র দেশের কল্যাণ। এ প্রথা আর্যভূমিতেও প্রচলিত হলে সর্বৈবঃ মঙ্গল হবে বলে আমি মনে করি।‘ পুষ্পকেতুর কণ্ঠস্বরে আবেগের স্পর্শ অনুভূত হয়।

‘তুমি কি সম্রাটপুত্র কুমার চন্দ্রগুপ্তের প্রতি ইঙ্গিত করছ কেতু?’

‘হ্যাঁ, আমি মগধ সিংহাসনের উত্তরাধীকারত্বের কথাই বলছি। জ্যেষ্ঠ্য রাজকুমার রামগুপ্ত এই নবীন বয়সেই লম্পট, ব্যাভিচারী হয়ে উঠেছে, সবাই জানে সেকথা, সমাট নিজেও জানেন নিশ্চয়। অথচ দেখো, বিদ্বান, বিচক্ষণ চন্দ্রকে যুবরাজ ঘোষণা করতে পারেননি এখনও, হয়তো শেষ অবধি পারবেনও না। এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের গুরুদায়িত্ব রামগুপ্ত কি সত্যিই পালন করতে পারবে?’

‘চন্দ্রগুপ্তকে তুমি স্নেহ কর জানি সে কথা, এখনও তো সময় যায়নি; শ্রী পদ্মনাভের আশীর্বাদে সম্রাট দীর্ঘজীবি হোন’। উল্মুক প্রসঙ্গান্তরে যেতে চান, তিনি আমুদে মানুষ, গম্ভীর আলোচনা বেশীক্ষণ সইতে পারেননা।

 

‘আপনারা কি মনোরম সকালের মৃদু শৈত্য উপভোগে ব্যস্ত?’ চতুর্ভূজ দুই বন্ধুর কাছে এসে দাঁড়ান কিছু সময় পরে। কুমারের ইঙ্গিতে কিছুদূরে অপেক্ষমান দ্বৈরথ একটি সুখাসন ও তিন পাত্র কর্পূর মিশ্রিত তক্র রেখে যায় পাশে।

‘আপনার সঙ্গগুনে সকাল আরো বেশী উপভোগ্য হবে, আসন গ্রহণ করুন ভদ্র’, উল্মুক এযাবৎ চতুর্ভূজকে কিছু এড়িয়েই চলছিলেন, তবে এই মূহুর্তে সেকথা বুঝতে দেননা।

‘আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আর দিন দশেকের পথ, দিশারু শুদ্রক তেমনি আশা করছে, আলোচনা হোল কিছু আগে’, চতুর্ভূজ আলাপ এগিয়ে নিয়ে যান।

‘এখন যত শীঘ্র সম্ভব কাটিগারে পৌঁছতে পারলেই মঙ্গল, এই অনন্ত জলযাত্রায়, নিজেকে থেকে থেকে কেমন জলজীব বলে বোধ হচ্ছে’, উল্মুক রসিকতা করেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।

‘সেকি হে, তোমার বাক্যে কেমন আঁশটে গন্ধ পাচ্ছি যেন!’ পুষ্পকেতুর মন্তব্যে চতুর্ভূজ হেসে ওঠেন।

 

‘আপনাদের আলোচনাসভা বেশ জমে উঠেছে দেখছি, যোগ দিতে মন চায়’, শশক অনঘবর্মা পাটাতনের একপাশে কর্মচারীদের তদারকিতে ব্যস্ত ছিলেন, হাস্যালাপে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে আসেন এতক্ষণে।

‘বিলক্ষণ! আপনার যোগদানে চতুরঙ্গ সভা জমে উঠবে রীতিমত’, আপ্যায়ন জানান পুষ্পকেতু। দ্বৈরথ পরিস্থিতি বুঝে আর একটি সুখাসনের সন্ধানে যায়, ধী কিছুদূরে মল্লক্ষেত্রের সমুখে বসে ছিল, এদিক পানে চোখ রেখে। এইক্ষণে তারও সম্ভবত কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়, আর কিছু করতে না পেয়ে, শীতল তক্রের কলসী থেকে একটি রূপার পাত্রে পানীয় ঢালতে উদ্যোগী হয় সে। ইতিমধ্যে দ্বৈরথ আসন নিয়ে ফিরেছে, ধী এর কর্ম দেখে চেঁচিয়ে ওঠে সে। দ্বৈরথের বকুনিতেই হোক, বা নিজের অপটুতায়, কলসীর তক্র পাত্রের পরিবর্তে পাটাতনেই গড়িয়ে পড়ে অধিকাংশ। আর তার পরেই শুরু হয়ে যায় শব্দযুদ্ধ; একদিকে দ্বৈরথের হুঙ্কার, অন্যদিকে ধীয়ের বিজাতীয় ভাষার প্রতিহুঙ্কার, অন্য সেবকদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয় অবশেষে।

‘আপনাদের এই মাণিকজোড়কে নিয়ে ভালোই সমস্যায় পড়েছেন যাহোক’, কলহ মিটতে চতুর্ভূজ মন্তব্য করেন।

‘আরে সমস্যার মূল তো ওই ধী, দ্বৈরথ বেচারা ওর আনাড়িপনায় জেরবার’, উল্মুক বিরক্তি প্রকাশ করেন, ধীয়ের প্রতি পুষ্পকেতুর নীরব প্রশ্রয় তিনি অনুমোদন করেননা প্রথম থেকেই।

‘শুধু ধী নয়, মালবদেশের সেবক মাত্রেই এই প্রকার, এই কদিনে আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। নব নিযুক্ত মাল্লাদের একজন আমার কক্ষ পরিষ্কার করে, কোনোদিন দেখি সে বস্ত্রপেটিকার উপর পুষ্পদানি সজিয়েছে, তো কোনোদিন শয্যাপার্শ্বে চামরের পরিবর্তে তাম্বুলদান’, অনঘবর্মার অভিজ্ঞতা শুনে হেসে ওঠেন দুই বন্ধু, পরিবেশ লঘু হয় এতে।

‘যতশীঘ্র সম্ভব কাটিগারে উপনীত হলেই সবদিক রক্ষা হয়’, চতুর্মূখ অন্যমনস্ক স্বরে মন্তব্য করেন, ইতিমধ্যে সূর্যের তাত প্রখর হয়েছে, সভাভঙ্গ হয় সেকারণে।

***

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি, শিয়রে রাখা নিভন্ত দীপের আলোয় কক্ষ মাঝে আধিভৌতিক পরিবেশ, মৃদু ঘর্ষণের শব্দে নিদ্রাভঙ্গ হয় পুষ্পকেতুর, যেন কক্ষের অন্যপাশে দ্রুত পেটিকা সরানো হচ্ছে ভূমিতে। শায়িত অবস্থাতেই পরিস্থিতি বুঝে নিতে চেষ্টা করেন কুমার, আধো অন্ধকারে কয়েকটি অস্পষ্ট ছায়া, এর বেশী বোঝা যায় না কিছু। চাপা আর্তনাদ, ভারি বস্তু পতনের শব্দ ভেসে আসে বুঝিবা অন্য কোনও কক্ষ থেকে, কতগুলি পদশব্দ, প্রবল চাঞ্চল্য বেধেছে তরণীর উন্মুক্ত পাটাতনে। ‘কে ওখানে?’ চেঁচিয়ে উঠতেই এক শীতল ধাতব স্পর্শ অনুভব করেন তিনি বক্ষের উপর, একজোড়া হিংস্র শ্বাপদের মত চক্ষু স্পষ্ট হয় ম্লান দীপের আলোয়।

‘ধন পেটিকা কোথায়?’ কর্কশ কন্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়। ইতিমধ্যে উল্মুক জেগে উঠেছেন পাশের শয্যায়, তিনি বন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে চান আততায়ীর দিকে, কিছু বোঝার আগেই একটি ছুরিকা ছুটে গিয়ে বিদ্ধ করে তাঁকে, ভূমিতে লুটিয়ে পড়েন উল্মুক।

‘মিত্র!’ প্রবল আবেগে আততায়ীর উপর ঝঁপিয়ে পড়েন পুষ্পকেতু, নিরস্ত্র কুমারের সাথে সশস্ত্র তস্করের অসম দ্বন্দযুদ্ধ স্থায়ী হয়না বেশীক্ষণ; উন্মুক্ত খঞ্জরবদ্ধ হাত প্রবল শক্তিতে ধেয়ে আসে বুক লক্ষ্য করে, প্রদীপের আলোয় ঝলকে ওঠে তার ফলক। আত্মরক্ষার নিষ্ফল চেষ্টায় খঞ্জরের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেন কেতু, তাঁর কর স্পর্শ করে এগিয়ে আসে ইস্পাতের ফলা,কিন্তু বক্ষভেদ করার ঠিক পূর্বমূহুর্তে হাত থেকে খসে পড়ে ছুরিকা, ভয়াবহ দানব যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়ে ভূমিতে কার্পাস পুতুলের মত, তার গ্রীবায় বিঁধে থাকে একটি শল্য। অবস্থার সুযোগ নিয়ে শয্যাপার্শ্বে রাখা তরবারি হাতে ছুটে যান কুমার কক্ষ মধ্যস্থ আরো দুটি ছায়ার দিকে, কিন্তু তিনি কিছু করার আগেই তারাও লুটিয়ে পড়ে ভূমিতে। দ্বার প্রান্তে দেখা দেয় ধীয়ের হাসিমুখ, তার হাতে একটি লম্বা ফাঁপা বাঁশ, যেটি সে নৌযাত্রা কালে সঙ্গে এনেছিল। দীপ হাতে উল্মুকের কাছে এসে বসেন কুমার; রক্তাক্ত শরীর, কপালে শ্বেদবিন্দু উল্মুক চেয়ে দেখেন বাল্যবন্ধুকে।

‘ভয় নেই, এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যাব না তোমায়’, কুমার ক্ষত পরীক্ষার উদ্যোগ নিতে, বলে ওঠেন তিনি স্বভাবসিদ্ধ স্বরে। ‘ছুরিকা আমার কাঁধ ছুঁয়ে পালঙ্কের পাদপীঠে বিঁধেছে, আমার চিন্তা ছেড়ে ওদিকে দেখো কি হোল’। কথাকটি বলে হাঁপাতে থাকেন তিনি।

আর কালক্ষেপ না করে কক্ষ থেকে সাবধানে বের হন পুষ্পকেতু, পিছনে ছায়ার মত অনুসরণ করে ধী নিঃশব্দ পায়ে। কুমারের কক্ষের দক্ষিণপাশে চুতুর্ভূজ আর দেবদত্তের শয়নকক্ষ, আধো অন্ধকারে সেটি নিঃশব্দ, প্রাণের সাড়া নেই সেখানে। কুমার সেই স্থান পেরিয়ে এগিয়ে যান ধূর্জটিদেবের কক্ষের উদ্দেশ্যে, দধিচি ও শ্রীমন্তের কক্ষটি তারই সংলগ্ন।

 

ধূর্জটিদেবের শয়নকক্ষে যেন তাণ্ডব ঘটে গেছে কিছু আগে, প্রতিটি আসবাব লণ্ডভণ্ড সেখানে; বস্ত্র পেটিকা তছনছ, উল্টে পড়ে আছে দীপদণ্ড, শয্যাটিও ছিন্নভিন্ন প্রবল ছুরিকাঘাতে। আচার্য ভূমিতে উপবিষ্ট, হাত দুটি পিছমোড়া করে বাঁধা; এক মালব দস্যু তাঁর কন্ঠনালীতে খঞ্জর ধরে আছে।

‘শেষবারের মত জিজ্ঞাসা করছি, সিন্দুকের তল্লিকা কোথায়?’ তার কর্কশ স্বরে শীতল নিষ্ঠুরতা। কক্ষমধ্যে রাখা লৌহসিন্দুকের তল্লিকার খোঁজেই এই উৎপীড়ন বুঝতে কষ্ট হয়না। আচার্য অত্যাচার সয়েও নীরব থাকেন, সম্রাটের প্রতিভূরূপে যাত্রা সংক্রান্ত যাবতীয় অর্থ তাঁর কাছেই সঞ্চিত রয়েছে; প্রাণ থাকতে সে সম্পদ কারো হাতে তুলে দেবেননা আদর্শবাদী ব্রাহ্মণ।

‘তল্লিকা ওঁর নয়, আমার সংগ্রহে আছে’ শয়নমন্দির সংলগ্ন বিশ্রামকক্ষের মধ্যবর্তী দ্বারে চতুর্ভূজ দেখা দেন’, তাঁর কটিতে ঝুলছে একটি তল্লিকা। বহির্দ্বারের আড়াল থেকে ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেন পুষ্পকেতু; কক্ষমধ্যে মূল দস্যুর সহকারী আরো দুইজন, দলনেতার আদেশের অপেক্ষায় তরবারি হাতে প্রস্তুত।

‘তল্লিকা এদিকে ছুঁড়ে দাও শীঘ্র, নতুবা প্রাণ যাবে বৃদ্ধের’, দস্যু চাপাস্বরে হুঙ্কার দেয়।

‘ওঁকে মুক্তি দাও তল্লিকা দিচ্ছি আমি’, কথাটি বলে বামহস্তে তল্লিকা তুলে ধরেন চতুর্ভূজ, তাঁর দক্ষিণ হস্তে খোলা তরবারি, ধীরে পায়ে নিকটের জানালার পানে সরতে থাকেন তিনি।

‘আবারও বলছি, আচার্যকে মুক্তি দাও, নতুবা তল্লিকা সমুদ্রগর্ভে যাবে’, চেঁচিয়ে ওঠেন চতুর্ভূজ, তল্লিকা ধরা তাঁর বামহস্ত জানালার কিনারে। কয়েক মূহূর্তের জন্য ইতস্ততঃ করে দলপতি, তারপর বৃদ্ধকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। আর ঠিক সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই বোধ করি দেবদত্ত দ্বারের পরিবস্ত্রার আড়ালে অপেক্ষায় ছিলেন, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন দলপতির উপর তরবারি হাতে। চতুর্ভূজ প্রতিরোধ করেন ছুটে আসা দুই সহকারী দুর্বৃত্তকে; পুষ্পকেতুও কক্ষে প্রবেশ করে তাঁর সাহায্যেএগিয়ে যান এই সময়ে। সহকারীদুটি পর্যুদস্ত হয় অবিলম্বে; দেবদত্ত দলপতির জন্যে যথেষ্ট নন, ধীয়ের শলার আঘাতে ভূপতিত হয় সেও।

‘কুমার, ওরা নাবতলের সাথে পাটাতনের সংযোগী দ্বারটি পাহারা দিচ্ছে, সেটিকে মুক্ত করা আবশ্যক, মাঝিমাল্লা সহ অনঘবর্মা বন্দী আছেন বহিত্রগর্ভে।‘ কথা কটি বলে উন্মুক্ত পাটাতনের দিকে ছুটে যান চতুর্ভূজ।

‘দধিচি ও শ্রীমন্ত?’ পুষ্পকেতু জিজ্ঞাসু হন।

‘ওঁদের কথা ভাবার সময় এখন নয়, শীঘ্র সাহায্য না পেলে আমরা কজন রুখতে পারবনা দস্যুদের।‘ চতর্ভূজ ত্রস্ত্য হয়ে পড়েন।

‘আচার্য, আপনি দ্বারের আড়ালে নিজেকে গোপন রাখুন আপাততঃ’, ধূর্জটিদেবের বাঁধন খুলতে খুলতে পরামর্শ দেন দেবদত্ত।

পাটাতনের দরজায় পাহারায় ছিল চারজন, অন্তরাল থেকে আচমকা বেরিয়ে আসা রাজপুরুষদের আক্রমনে পরাস্ত হয় তারা অল্পক্ষণে। কালক্ষেপ না করে দরজার শৃঙ্খল খুলে নীচে প্রবেশ করেন চতুর্ভূজ ও কুমার, ধীকে সাথে নিয়ে দেবদত্ত সতর্ক থাকেন দরজার মুখে। নাবতলের পরিবেশ দেখে চমকে ওঠেন দুজনেই, কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রামশালার দ্বার বাইরে থেকে কপাটবদ্ধ, গুটিকয়েক নাবিক, যারা রাত্রির পাহারায় ছিল, গুরুতর আহত হয়ে পড়ে আছে ভূমিতে। নাবতলের একপাশে সিন্দুক কক্ষ, সেটির লৌহশলাকা যুক্ত দ্বার বলপূর্বক উন্মোচিত হয়েছে বোঝা যায় সে কথা। ভিতরকার সিন্দুকটির দ্বার খোলা, তল্লিকা যুক্ত রয়েছে তাতে। পাশের কক্ষটি অনঘবর্মার, সেটির দ্বার ভেজানো রয়েছে, ভিতরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার, কোনও প্রকার শব্দ কানে আসেনা ভিতর থেকে। একটি দীপালোক নিয়ে সাবধানে কক্ষে প্রবেশ করেন দুজনে; অনঘবর্মা অচৈতন্যভাবে ভূমিতে লুটিয়ে আছেন, হাতদুটি পিছনে বাঁধা, মস্তকে আঘাতের চিহ্ন, বস্ত্র রক্তে ভেসে যচ্ছে। চতুর্ভূজ দ্রূত পাশের কক্ষটিতে ছুটে যান, সেটিও বাইরে থেকে অর্গলবদ্ধ ছিল, কপাট খুলে তরণীর দুই বৈদ্যরাজকে মুক্ত করেন তিনি।

‘অনঘবর্মা! তাঁর সুশ্রুষার ব্যবস্থা করুন শীঘ্র’, কথাকটি বলে ছুটে যান তিনি মূল বিশ্রামশালার দিকে। পুষ্পকেতু ততক্ষণে অর্গল্মুক্ত করেছেন তার বহির্দ্বার, কক্ষমধ্যস্থ অধিকাংশ নাবিক ও সেবক গভীর নিদ্রায় অচেতন, যাদের জ্ঞান রয়েছে, তারাও প্রকৃতিস্থ নয়। ইতিমধ্যে উপরের পাটাতনে পদশব্দ প্রবল হয়েছে, তার উন্মুক্ত অংশে অধিকাংশ দস্যুর জমায়েত ঘটেছে সন্দেহ থাকেনা। নিশ্চয় মশাল সংকেতে তাদের নৌকা এসে ভিড়েছে বহিত্রের পাশে, এখন লুন্ঠিতবস্তু স্থানান্তরের কার্য শুরু হয়েছে সম্ভবত। কালক্ষয় না করে পুষ্পকেতু সঙ্কেত শঙ্খে ফুঁ দিতে থাকেন বারংবার। দুজনে নিঃশব্দে পাটাতনে উঠে আসেন এরপর, ধী তখনও দরজার প্রহরায়, তাঁদের দেখে পথ ছেড়ে দেয় সে। ইতিমধ্যে ছায়ার মত অন্ধকার বেয়ে আবির্ভত হন দেবদত্ত, ‘ওরা ওইদিকে, আমাদের উপস্থিতি টের পেলে সর্বনাশ’ মৃদুস্বরে বলে ওঠেন তিনি।

পাটাতনের উন্মুক্ত অংশে লুন্ঠিত সম্ভার সারিবদ্ধ করে রাখা, প্রত্যেকটিকে রজ্জুবদ্ধ করার কাজ চলছে নীরবে, প্রায় বিশজন দস্যু ব্যস্ত রয়েছে কাজে; তাদের তদারকিতে যে রয়েছে, মশালের আলোয় তাকে প্রধান সহকারী পাচক হিসাবে চিনতে ভুল হয় না কুমারের। পাটাতনের ধারে আপেক্ষমান দ্রূতগামী নৌকা, সামগ্রী বোঝাই সম্পন্ন হলে সকলকে নিয়ে হারিয়ে যাবে নিকটবর্তী জলারণ্যে। তবে শঙ্খনিনাদ কানে গেছে তাদের, তাতেই তৎপরতা বেড়েছে, কোনওপ্রকার সাহায্য এসে পড়ার পূর্বেই অন্তর্হিত হতে চায় তারা।

‘যে ভাবে হোক বিলম্ব ঘটানো দরকার, যতক্ষণ না সাহায্য আসে’, দেবদত্ত বলেন।

‘সে কি করে সম্ভব? আমরা মাত্র চারজন! এমত অবস্থায় ওদের বাধা না দেওয়াতেই মঙ্গল’ চতুর্ভূজ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন, পুষ্পকেতুও সায় দেন তাঁর কথায়।

কিছু সময়ের মধ্যেই লুঠের বস্তু নিয়ে একে একে অদৃশ্য হয় দস্যুদল তাদের নৌকায়, শুধু পিছনে পড়ে থাকে বেশ কিছু নাবিকের রক্তাক্ত দেহ। চতুর্ভূজ অসহায় ক্রোধে নিক্ষেপ করেন হাতের তরবারি; দীর্ঘশ্বাস ফেলেন কুমার চরম আক্ষেপে।

‘উল্মুকেরও চিকিৎসার প্রয়োজন, গোলমালে তার কথা ভুলেছিলাম’, লজ্জিত শোনায় পুষ্পকেতুর কন্ঠস্বর, তিনি দ্রূত নাবতলের দিকে অগ্রসর হন। সোপান বেয়ে নামতে নামতে কানে আসে কোলাহলের শব্দ, আবার ফেরার পথ ধরেন কুমার কৌতুহলে। মশালের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল, সমুদ্রবক্ষে যেন তাণ্ডব বেধেছে; এরই মাঝে মনুষ্য কন্ঠের আর্তনাদ, কোথাও একটি মেঘমন্দ্র স্বরের বজ্রনির্ঘোষ। অবশেষে, চোখে পড়ে যুদ্ধনাও, কাঠের ফলকের মাধ্যমে যুক্ত হয় দুটি বইত্রের পাটাতন, দন্তিবর্মা নৌসেনা ও দুইজন চিকিৎসক সঙ্গে নিয়ে অবতরণ করেন এই পাড়ে। মশালের উজ্জ্বল আলোয় রক্তাক্ত পাটাতনের বিভৎসতা প্রকট হয়।

‘দস্যুদলটি ধরা পড়েছে, আমরা সঙ্কেত পাওয়া অবধি দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিলাম নৌকাটির উপর, সেসময়ে কাছে এলে, আপনাদের প্রাণের আশঙ্কা ছিল। পলায়ন পথ রোধ করে বন্দী করেছি প্রায় সকলকেই, আপনাদের লুন্ঠিত সামগ্রীও উদ্ধার হয়েছে সেইসঙ্গে। শুধু দলনেতা আর তার কয়েকটি সহকারী জলে ঝাঁপ দেয়; তবে এই অন্ধকারে তাদের বেঁচে ফেরার আশা খুবই কম।‘ দন্তিবর্মার বক্তব্যে আশ্বস্ত হন সকলেই।

***

‘সাতজন নাবিক মৃত, দশজন গুরুতর আহত; অনঙ্গবর্মার জ্ঞান ফিরেছে তবে খুবই দূর্বল। আপনারা যে দুজন দস্যুকে পরাস্ত করেছিলেন, তারাও আহত, তবে বেঁচে আছে। ধীয়ের শলাকার আঘাতে যে চারজনের পতন ঘটেছিল, বিষক্রীয়ায় তারা সকলেই মারা গেছে। পানীয়ের সাথে মাদক মিশিয়ে অচৈতন্য করা হয়েছিল যাদের, তার সুস্থ হয়েছে‘, সূর্যোদয়ের কিছু পরে পাটাতনের প্রমোদকক্ষে বসে দন্তিবর্মা রাজপুরুষদের সম্বোধন করেন। সেখানে জড়ো হয়েছেন চতুর্ভূজ, দেবদত্ত, ধূর্জটিদেব, পুষ্পকেতু, এমনকি উল্মুকও, বৈদ্যের বারণ সত্ত্বেও তাকে নিরস্ত করা যায়নি। একপাশে বসে আছেন দধিচি ও শ্রীমন্ত, তাঁরা অক্ষত আছেন শরীরে, তবে মানসিকভাবে যে অতি বিদ্ধস্ত, বোঝা যায় কালিমাঘন চোখ ও শুষ্ক মুখশ্রী দেখে।

‘লুন্ঠিত ধন প্রায় সবই উদ্ধার করা গেছে, আপনারা নিজ নিজ তালিকা দিলে সেইমত ফেরত দেবার ব্যবস্থা করা যাবে। ভালো কথা, আপনারা দুজন রক্ষা পেলেন কিভাবে, আপনাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে ইচ্ছা করি’, দন্তিবর্মা শেষের বাক্যটি দধিচি ও শ্রীমন্তের উদ্দেশ্যে বলেন।

‘প্রায়ান্ধকার কক্ষমধ্যে পদশব্দ পেয়ে আমার নিদ্রাভঙ্গ ঘটে, নিঃশব্দে ব্যাপার বোঝার চেষ্টা করছি, এরমধ্যে বুঝতে পারি ভদ্র দধিচিও জেগে উঠেছেন; দস্যুরা যে বস্ত্রপেটিকার ভিতর থেকে ধনপেটিকা খুঁজে বের করেছে, আন্দাজে বুঝতে পারি। দুইজন বলিষ্ঠ দস্যু, তার উপর সশস্ত্র, বিপদ বুঝে আমরা নিদ্রিত থাকার ভান করে শয্যায় পড়ে থাকি। কিছু পরে দস্যুরা বিদায় হয়, পাশে আচার্যের কক্ষে ততক্ষণে হুলুস্থুলু বেধেছে, এমত অবস্থায় দ্বারের পিছনে লুকিয়ে থাকাই শ্রেয় মনে হয়।‘ শ্রীমন্তের বক্তব্যে দন্তিবর্মা ও চতুর্ভূজের ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।

‘ভদ্র চতুর্ভূজ, আপনি সিন্দুকের তল্লিকার ব্যাপারটা বিশদে ব্যাখ্যা করলে ভালো হয়; আচার্য এ যাত্রা নিঃসন্দেহে আপনার বুদ্ধিবলেই রক্ষা পেয়েছেন।‘ পুষ্পকেতু মৌনতা ভঙ্গ করেন এতক্ষণে।

‘মালব প্রনালীতে যাত্রার শুরু থেকেই অস্বস্তিতে ছিলাম একপ্রকার, কোথাও যেন একটা ছন্দপতন ঘটেছিল। অতজন নাবিক হঠাতই একসাথে অসুস্থ হয়ে পড়ল শুণ্ডালয়ে, পরিবর্তে যারা এলো কেন জানি দেখে ঠিক বেতনভুক কর্মচারী গোত্রের মনে হয়নি কাউকেই। পেশীবহূল দেহ, এখানে, ওখানে নিঃশব্দচারণ, সন্দেহ তীব্র হোল যখন কথা প্রসঙ্গে অনঘবর্মা জানালেন তাঁর মালব সেবক কক্ষের বস্তুসামগ্রীর স্থান পরিবর্তন করছে। অনঘবর্মার দায়িত্বে রয়েছে নাওয়ের সিন্দুক,  সেই তল্লিকার খোঁজে গিয়ে তড়িঘড়িতে ব্যবহার্য্য বস্তুর স্থানবদল ঘটছে না তো, আশঙ্কা দেখা দেয় মনে। সেদিনই আচার্যকে সবকথা জানিয়ে তাঁর সিন্দুকের তল্লিকাটি নিজের কাছে রাখি। রাত্রে সতর্ক থাকতাম; দস্যুরা সম্ভবতঃ নাবতলের কার্য সম্পন্ন করে উপরকার কক্ষগুলি আক্রমণ করে, আমি অস্পষ্ট পদশব্দে চকিত হয়ে কক্ষত্যাগ করি, তার আগে ভদ্র দেবদত্তকেও সাবধান করে যাই। অস্পষ্ট আলোয় নাবতলের সংযোগ দ্বারটিতে দস্যুদের পাহারা চোখে পড়ে, একা কিছু করতে যাওয়া মুর্খামি হবে জেনে, ধীরে আচার্যের কক্ষের দিকে এগোই। তাঁর কক্ষে তখন দস্যুদের তাণ্ডব চলছে, আমি নীরবে অপেক্ষা করি সুযোগের অপেক্ষায়, এরপরের ঘটনা সকলেই জানেন। তবে দেবদত্ত যে আমার পিছু নিয়েছেন, বুঝিনি তখন, আর কুমারের সহায়তা না পেলে আচার্যকে বাঁচানো অসম্ভব হোত।‘

‘সর্বশক্তিতে তরণী সঞ্চারণের ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে কাটিগার আনুমানিক আরও সাতদিনের পথ, যত শীঘ্রসম্ভব সেখানে পৌঁছে, আহতদের যথাযথ বিশ্রামের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ধৃত দস্যুদেরকেও বন্দরের দণ্ডনায়কের হাতে সমর্পন করব, আইনত এরা তাঁদেরই অপরাধী।‘ দন্তিবর্মার বক্তব্যের সাথে সভাভঙ্গ হয়।

 

‘ধীয়ের বংশ দণ্ডের কেরামতি দেখলে? ছোকরা ফুৎকারেই কেমন কাত করল দস্যুদের?’ উল্মুক মন্তব্য করেন বন্ধুর উদ্দেশ্যে।

‘ওই বস্তুটির নাম ধমনাড, মালব দেশের জঙ্গলবাসীরা হিংস্র জন্তু শিকার করে এই অস্ত্র দিয়ে। ওর ভিতরে থাকে মরণাত্মক বিষ মাখানো শলাকা, ধমণীতে গিয়ে বিঁধলে, বড় বড় প্রাণীরও নিস্তার নেই।‘ উত্তর দেন দেবদত্ত, পূর্বকার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এই বিচিত্র অস্ত্রের সাথে পরিচিত, বোঝা যায়।

‘ভদ্র দেবদত্ত, আপনাকে একটি প্রশ্ন না করে পারছি না; কটাহ বন্দরে নিজস্ব যাবতীয় পণ্য বিক্রয় করেছেন, সে বাবদ আপনার সঞ্চয়ে প্রভূত অর্থ থাকার কথা। বিগত যাত্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন, তার পরেও ধনপেটিকা রক্ষার চেষ্টা না করে চতুর্ভূজের অনুগামী হলেন কেন?’ প্রশ্নটি করেন পুষ্পকেতু।

‘ধনপেটিকা রক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম পূর্বথেকেই, দস্যুরা আমার অর্থ হস্তগত করতে পারেনি।‘

‘একটু বিশদে বলুন ভদ্র, কৌতুহল প্রবল হচ্ছে।‘

‘কক্ষের এককোণে রাখা আছে জলের কলসী, সেটি স্থাপিত আছে যে পীঠিকার উপর, তারই ভিতরে রাখা আছে আমার ধনপেটিকা।‘

‘অহোঃ, দুস্যুদের দেহের পেশী অপেক্ষা আপনার মস্তিষ্কের পেশী ঢের বেশী শক্তিমান’, উল্মুকের রসিকতায় হেসে ওঠেন বাকি দুজন।

***  ***

দুরূহ শব্দের অর্থঃ তেন্তুল – তেঁতুল, পরিবস্ত্রা – পর্দা, সুখাসন – সোফা, তক্র – ঘোলের সরবত, পেটিকা – বাক্স, চামর – হাতপাখা, ধনপেটিকা – ক্যাশবাক্স, শলা – ডার্ট,বা তীক্ষ্ণ বস্তু, তল্লিকা – চাবি, নাবতল – জাহাজের নীচের ভাগ, ধমনাড – ব্লো পাইপ, পীঠিকা – পিঁড়ে

ছবি-গুগল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page