উপন্যাস ।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত
একটার পর একটা যুক্তি দেখাতে থাকলেন, ময়েট। তবে তাঁকে কথার মাঝ পথে থামিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র ঈষৎ অধৈর্য সহকারে বলে ফেললেন, আহ, ময়েট সাহেব। আপনি তো জানেন, আমি অর্থের জন্যে কোথাও মাথা নত করি না। তবু আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, আমি কি সেখানে আমার আগের রিপোর্টকে কার্যকর করতে সক্ষম হব?
-অবশ্যই।
প্রবল বাধার মাঝে ময়েট যেন আশার ক্ষীণ রেখা দেখছেন। প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন, এবার সংস্কৃত কলেজের পুনর্গঠন সংক্রান্ত রিপোর্ট শিক্ষা পরিষদকে আবার পাঠাবেন। আমার সঙ্গে শিক্ষা দপ্তরের আলাপ অনুযায়ী আমি জানাচ্ছি, ওই রিপোর্ট পুরোটাই গ্রহণ করা হবে।
এরপর…
ঈশ্বরচন্দ্রের সোজা শিরদাঁড়া এতক্ষণে সামান্য শিথিল হল। তিনি বললেন, হ্যাঁ। এই আশ্বাস যদি আমি আপনার কাছে পাই, তো ওই পদ গ্রহণে আমি রাজী।
-আপনি যে বিচক্ষণ ব্যাক্তি, তা আমি জানি। সামনেই আপ না র কাছে ওই কলেজের সম্পাদকের কাজের ভার নেবার অনুরোধ আসবে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আপাতত তা অস্থায়ী পদ হলেও, অল্পদিনে বাবু রসময় দত্ত মহাশয় চলে যাচ্ছেন। তখন অধ্যক্ষ পদ আ প নারই প্রাপ্য। তাই অনুরোধ করি, আ পনি সত্বর নতুন কার্যভার গ্রহণ করুন।
ঝড়ের শেষ মুহূর্তে ঠাণ্ডা বাতাস যেমন ঝলক দিয়ে বইতে থাকে, তেমন করে ময়েট কথাগুলো বলে ঈশ্বরচন্দ্রকে নিজের মতের দিকে নিয়ে আসলেন। খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ঈশ্বরচন্দ্রও হাসলেন। ধন্যবাদ জানালেন ময়েটকে। পরে অবশ্য নিজ চরিত্র বৈশিষ্ঠে রসিকতা করলেন, সামান্য ভোজনে যার অম্লরোগ হয়, তার সামনে অধিক মশলাযুক্ত সুস্বাদু খাবার যতই কি না রাখা হউক, তাতে তিনি অনীহা না দেখালেও, অধিক সর্তক হয়ে যান…
-হা হা, হা, মহাশয়, আবার হাসালেন আপনি…,
সজ্জন ইংরেজের চরিত্রগুণের বৈশিষ্ঠে মিঃ ময়েটের খুশিতে তখন বাঁধ ভাঙা জলের তোড় বইছে।
ঈশ্বরচন্দ্র ফোরট ইউলিয়াম কলেজে ইস্তফা দিলেন। সম্মানের সঙ্গে তাঁকে সেখান থেকে মুক্ত করে দেওয়া হল। মাথা উঁচু করে সংস্কৃত কলেজে এসে নতুন পদে যোগ দিলেন। অত্যন্ত গর্ববোধে সেই রাতেই প্রথম চিঠি লিখলেন মা-বাবাকে উদ্দেশ্য করে। ঠাকুরদাস এবং ভগবতীদেবীর চিঠিতে শুধু কুশল এবং শুভ সংবাদ দিয়ে ছোট করে লিখলেন। পরে দীনময়ীকে লম্বা চিঠি লিখতে বসলেন। পরিহাস এবং কৌতুকের সঙ্গে চিঠি লিখছেন। সেজন্যে তাঁর মন আজ বিশেষভাবে তৈরী। শুরুই করলেন, কৌতুক বশে।
শ্রীশ্রীহরিঃশরণম
কল্যাণনিলয়েষু,
তুমি যে কোন দীনময়ের প্রসাদ প্রাপ্ত হয়ে আমার জীবন কক্ষপথে এসেছিলে, যাতে তোমায় দীনময়ী না সম্বোধন করে ভাগ্যমতী বলতে ইচ্ছে করছে। বাহ্যিক অলঙ্কার তোমায় যতখানি না শোভিত করেছে তাহাপেক্ষা তুমি অনেক বেশি শোভিত নিজ গুণাবলীর দ্বারা।
ভাবছ বুঝি, তোমার সই, অন্নপূর্ণাদেবীর কথানুসারে কলিকাতায় বসে সুরা পান করে এই চিঠি লিখছি। তবে তা নয়। আজ আমি সত্যিই তোমার গুণগ্রাহী হয়ে তোমাকে দেবী রূপে দেখছি।
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষটকারঃ স্বরাত্মিকা
সুধা ত্বং অক্ষরে নিত্যে মাত্রাত্মিকা স্থিতা।
হয়ত সংস্কৃত বুঝবে না। তাই শ্লোকটির বাংলা তরজমা করে দিলাম। তা এই রকম- তুমি পবিত্র আগুনের প্রাণশক্তি, তুমি পুর্বপুরুষদের শক্তি, তুমি-ই পবিত্র আহুতি মন্ত্র স্বরূপ স্বরের আধার। অমৃত তুমি, অক্ষর তুমি, তুমি-ই নিত্য, তুমি-ই ত্রিমাত্রিক মন্ত্রের ধারক।
আজ আমি বড়ই খুশি। এ খুশির বহর এতটাই যে তার পরিমাপ করে ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ। আজ আমার পুরানো কলেজ, অর্থাৎ সংস্কৃত কলেজে অস্থায়ী অধ্যক্ষ পদে যোগ দেবার আমন্ত্রণ পেয়েছি। শীঘ্র ওই কাজে যোগ দেব। এ ছাড়াও আমার যা উদ্দিষ্ট পথ, অর্থাৎ কলেজের যে সংস্কার কাজে আগে অপারগাতার কারণে কলেজ ছেড়ে এসেছিলাম, তাই এখন উপরওয়ালার আদেশে পূর্ণরূপে করতে পারব। এ থেকে আনন্দের আর কী থাকতে পারে?
দীনময়ী, আমার জীবনে তোমার আগমন আমাকে সব বিষয়ে ঐতিহ্যমণ্ডিত করেছে। এখন ভাবি, সেদিনের পঞ্চম বর্ষীয়া কন্যা আজ কত বুদ্ধিমতী, কত দায়িত্বশীল, সহানুভূতিশীল, সহ্যশীলা হয়েছ। বীরসিংহে আমার অনুপস্থিতির দিনগুলি তোমার কেমন একেলা একেলা কাটে, তা ভেবে আমার মন ব্যকুল হয়। আশা, অবশ্যই ওই সময়ে তুমি আমার কথা সর্বক্ষণ মনে রাখো। তাই আমার আনন্দের উৎস হয়। আমি এই ভেবে কলিকাতায় নির্বিঘ্নে আমার সকল কাজ সম্পন্ন করতে থাকি।
আশা করি, তুমি মায়ের উপরে কুপিত নও। আজ যে দুর্নামের কথা তোমায় শুনতে হচ্ছে, এর জন্যে আমিও দায়ী। তবে, ওপরওয়ালাই জানেন, আমাদের একটি সন্তানও না হওয়ায়, আমি নিজ মনে কতখানি লজ্জা বোধে থাকি। জীবন আমাকে বা তোমাকে শূন্য হাতে রাখবে না। এ বিশ্বাস আমার রয়েছে। এখন সর্বদা আমি তোমার থেকে একটা সুখবর পাবার আশায় উদগ্রীব হয়ে থাকি। আমাদের শেষ মিলনের পর দু মাস কাল তো হল, তোমার কাছ থেকে একটা সুখবর পাবার আশায় রয়েছি।
মাকে ভিন্ন চিঠি দিয়েছি। এই চিঠি আমি তোমাকেই লিখলাম। পৃথকভাবে। চিঠি পড়ে তোমার মুখমণ্ডলে যে হাসির ছটা খেলবে, তা আগে থেকেই অনুমান করে আমি নিজ মনে হাসছি। চিঠি ডাকযোগে না পাঠিয়ে বাহনের হাতে পাঠালাম। নতুন কাজের দায়িত্ব গ্রহণে হয়তো সত্বর আসতে পারব না। সম্ভব হলে, নিজ হাতে দু চারটে লাইন লিখে এই বাহনের হাতে পাঠালে, আমি অত্যন্ত সুখী বোধ করব। সব শেষে বলি, এই চিঠি কাউকে দেখিও না। তা হলে, তারা আমায় নিয়ে মজা করবে। বলবে, বিদ্যার সাগর ঈশ্বরচন্দ্র কি স্ত্রৈণ হয়ে গেল? দীনময়ী, আমি তা না হলেও, নারীজাতির প্রতি আমি যে সম্মান বহন করি, তার উচ্চতম শিখরে তুমি বিরাজ কর আমার কাছে ।
আর অধিক কী? চিঠি শেষ করলাম।
ইতি
আশীর্বাদক স্বামী
ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা
পুরনো কাল হলে রাজারাজরা এই চিঠি সাদা পায়রার পায়ে বেঁধে প্রিয়তমার কাছে পাঠিয়ে দিত। পোষমানা পায়রা গন্তব্যে পৌঁছিয়ে সঠিক জনের হাতে চিঠি দিয়ে অপেক্ষা করত, প্রেয়সীর উত্তর নিয়ে ফিরবে। ঈশ্বরচন্দ্র অনেকটা সেরকম কল্পনা করেই পত্রবাহক, রমণীরঞ্জনকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠালেন বীরসিংহ গ্রামে।
দুটো চিঠি নিয়ে রমনীরঞ্জন রওয়ানা দিল। সে চলল জল পথে। নৌকো করে। অন্যান্য যাত্রীর সঙ্গে মিলে প্রথমে পৌঁছাল বর্ধমান। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বরাকর। একদিন সময় গেল। বরাকরে এসে দামোদর নদ পেরল। শেষে আবার হাঁটা পথে বীরসিংহ গ্রামে গ্রামে পৌঁছিয়ে গেল। সর্বসাকুল্যে সময় লাগল তিন দিন। পথে ঈশ্বরচন্দ্রের দেওয়া টাকায় খাওয়া দাওয়া, রাত্রিযাপন সারল।
সন্ধ্যের সময় সে ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়ি পৌঁছিয়েছে। তাকে দেখে সকলেই অবাক! জনে জনে কলিকাতার জনদের কুশল প্রশ্ন করল। রমণীরঞ্জন সংবাদ দিয়ে যুগল চিঠি যার যার হাতে দিল। সকলে নিশ্চিত হল।
রমণীরঞ্জন বীরসিংহ গ্রামে থেকে গেল একদিনের জন্যে। কিছুটা দয়াময়ী গৃহকত্রীর অনুরোধে, বাকিটা নিজের কৌতূহলে। সে কৌতূহলের উদ্যক্তা স্বয়ং দীনময়ী। পত্রবাহক নিজে এসেছে! বিষয়টা গুরুতর না হলেও, তা যে অত্যন্ত জরুরী বিষয় তা দীনময়ী বুঝেছেন। অথচ দিনের বেলা সকলের সামনে স্বামীর চিঠি খুলে পড়বেন, সে উপায় নেই। লোকে কী বলবে? বেহায়া বধূ, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাড়ির বউ দিন দুপুরে বরের লেখা চিঠি পড়ছে। এমনতেই তো কত গঞ্জনা! তায়, নিজেকে স্বামী সোহাগি দেখাবার ইচ্ছে তাঁর নেই। যেটুকু যা রয়েছে, তা তাঁর মন আর অন্তরেই থাকুক।
রাত হল। খাওয়াদাওয়া সেরে ঘর নিকিয়ে দীনময়ী নিজের ঘরে ঢুকলেন। দরজায় খিল আঁটলেন। কুপিতে নতুন করে তেল ঢাললেন। হতে পারে এখন তাকে সারারাত ধরে চিঠি পড়তে হবে। সম্ভব হলে, উত্তরও লিখে ফেলবেন। উড়ন্ত পায়রার মতো ছুটে আসা পত্রবাহকের হাত দিয়ে স্বামীকে চিঠি লিখে পাঠালে তিনি আহ্লাদিত হবেন। আসল খবর তো এখন তাঁর পেটে গজগজ করছে। তা পাচার করতে বেশি দেরী হলে বদহজমের বড়ি খেতে হতে পারে তাঁকে।
প্রাণ ভরে বন্ধ চিঠির ঘ্রাণ নিলেন। স্বামীর হাতের স্পর্শ রয়েছে তাতে। খামের মুখ ছিঁড়লেন। অতি সাবধানে। চিঠি বের করলেন। এক ঝলক সুবাতাস খেলে গেল। বাড়ির বাগানে নানান ফুল গাছের সমারোহ। সারা বছরই সেখানে থোকা হয়ে নানান ফুল ফোটে। তার সুবাস দীনময়ী রোজই পান। তবে বাতাসে এখন যে সুবাস পাচ্ছেন, তা যেন, বেলি, জুঁই, গোলাপ, টগর, রজনীগন্ধা, চামেলির মিলিত সুবাস!
এক নিঃশ্বাসে চিঠি পড়ে ফেললেন। প্রথমবার। আশ মিটল না। আবার পড়লেন। এবার ধীরে ধীরে। নাহ তাতেও নয়। আশ যেন মিটছে না। মোহের ফেরে পড়ে গেছেন দীনময়ী। রাত এগিয়ে চলেছে। চিঠি পড়ছেন। বার বার। মনে মনে জল্পনা করছেন, উত্তরে কী লিখবেন। কী গুণগান গাইবেন স্বামীর।
বাইরে গভীর রাতে পাহারাদারের হাঁক শোনা গেল। তারপরে শিয়ালের ডাক। হুঁকা হুয়া, হুঁকা হুয়া। দীনময়ী খাতা পেন্সিল নিয়ে চিঠি লিখতে বসলেন। বহুক্ষণ পর্যন্ত কাঠ পেন্সিলের পশ্চাতদেশ কামড়িয়েই সময় গেল। পেটে আছে অনেক কথা। কিন্তু লেখনীর ডগায় কিছুই আসছে না। মনে মনে ভাবছেন, বিদ্বান স্বামীর বিশেষ বিশেষ অলঙ্কারে ভূষিত ভাষার সামনে তার চিঠির ভাষা কী হবে? বক্তব্যই বা কী রাখবেন? একটা কথা তাকে জানাতেই হবে, সেটাই ঘুরেফিরে লেখনীর আগায় আসছে। অথচ তিনি চান, সব শেষে রাজসংবাদটা দিয়ে স্বামীর খুশির ধারাকে ফোয়ারার উচ্ছ্বাসে বইয়ে দিতে। লেখা শুরু করলেন। প্রথম শব্দ, পতিপ্রবর,
নাহ, ঠিক হল না। ভেবে ভেবে খাতার পাতাখানা টেনে ছিঁড়ে ফেললেন। নতুন পাতা খুলে লিখলেন,
শ্রীচরণকমলেষু,
নাহ, তাও কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছে। এ পাতাটাও ছিঁড়লেন। পেন্সিলের শিস দিয়ে মাথার চুল খোঁচালেন। , কামড় দিলেন উড পেন্সিলে । এতক্ষণ খাটের ওপর উপুড় হয়ে শোয়া ছিলেন। এবার উঠে বসলেন। খাট ছেড়ে নিচে নামলেন। পায়ে পায়ে ঘরটাতে এক চক্কর মেরে খিড়কির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। খিড়কি সব বন্ধ। বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। রাতের সময় খিড়কি খোলা নিষিদ্ধ। খিড়কির পাখি তুলে বাইরে তাকালেন। কৃষ্ণপক্ষের রাত। আকাশে চাঁদের দেখা নেই। চরাচর অন্ধকার। বাইরের পরিবেশ প্রেতাচ্ছন্ন। গা ছমছম করে উঠল । মনে মনে স্বামীর নাম নিলেন। ফিরে এলেন খাটে। চুপটি করে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ঘরে রেড়ির তেলের বাতি দপদপ করতে শুরু করেছে। কুপিতে তেল কমে এসেছে। উঠে গিয়ে তেলের শিশি উপুড় করে কুপিতে তেল ঢাললেন। দীপশিখা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল। আবার লিখতে শুরু করলেন।-
শ্রীচরণকমলে প্রণাম পূর্বক নিবেদন,
মনে মনে উচ্চারণ করলেন, হ্যাঁ এবার ঠিক হয়েছে। হাসি ফুটল মুখে। লেখা চালিয়ে গেলেন-
আপনার চিঠি আমাকে যে কতখানি আনন্দ দিয়েছে তা ভাষায় লিখে প্রকাশ করতে পারছি না আপনি যে অত্যন্ত বিদ্বান তা আপনি প্রমাণ করলেন আপনার নতুন চাকুরীর সুসংবাদের সুবাস আমি কাছে থাকলে হয়ত আরও বেশি করে উপভোগ করতে পারতাম তবে এখানে থেকেও তা অনেকটাই পাচ্ছি আপনার মতো বিদ্বান সুপণ্ডিত সহৃদয় ব্যাক্তির জন্যে আরও কী কী উপহার উপরওয়ালা সাজিয়ে রেখেছেন তা কালে কালে প্রকাশ পাবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত আমি তো এক অতি সাধারণ রমণী আপনি আমায় যে যে ভাষায় প্রশংসা করেছেন আমি কি সত্যই তার যোগ্য আপনি উদার বলে আমার সম্বন্ধে এত কথা লিখেছেন তার জন্যে আপনাকে আমার শতকোটি প্রণাম এখন আমিও একটা সুসংবাদ আপনাকে জানাচ্ছি ভগবান বোধহয় আপনাকে ও আমাকে দুর্নামের হাত থেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা পাকা করেছেন এতদিনে গত মাস হতে আমার মাসিক শরীর খারাপ হওয়া বন্ধ হয়েছে এ সংবাদ আপনাকেই প্রথম জানালাম মাকে এখনও জানাতে সাহস হয় নি আরও এক বা দু মাস দেখবার পর জানাব এমনই মনে করি এ বিষয়ে আপনি কাছে থাকলে মতামত জেনে নিতে পারতাম উপরন্তু এই সময়ে… নাহ আমার কলম বাকি আখ্যান আর লিখতে চাইছে না অবোধের মতো শরীর নিয়ে এসব কথা আপানকে লিখছি খুব খারাপ ভাবছেন আমাকে তাই না আচ্ছা আজ এখানেই শেষ করছি আপনার চরণ আশ্রিত দীনময়ী
দাঁড়ি কমা বিহীন চিঠি। যা দীনময়ীর মতো অ আ ক খ গ জ্ঞান পাওয়া গ্রাম্য গৃহবধূর কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক। তা লিখেই দীনময়ীর মন তৃপ্তিতে ভরে উঠল। হয়তো বা স্বামীকে লেখা এটাই তাঁর প্রথম দীর্ঘ চিঠি।
রাতের দ্বিতীয় প্রহর। শেয়ালের অবিরাম ডাক রাতের নির্জনতাকে উপহাস করছে। দীনময়ী চিঠি ভাঁজ করলেন। খামে ভরলেন। স্থির করলেন, সকালে উঠে খামের মুখ আঁটবেন। ভাতের দানা চিপে আঠা লাগাবেন খামের মুখে। চিঠি বালিশের তলায় চালান করে দিয়ে ঘরের কুপিবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।
(১০)
রমনীরঞ্জনের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। সেদিন ঘরে বসে কাহিনি রচনা করছেন। এমন সময়ে হাঁকডাক। ঘরে রমণীরঞ্জনের প্রবেশ। গতপরশু সকালে সে বীরসিংহ থেকে রওয়ানা দিয়েছিল। আজ বিকেলে কলিকাতায় পৌঁছিয়েছে। সোজা চলে এসেছে এখানে। মনটা তার বেশ উৎফুল্ল। জ্যেঠার দেওয়া কাজ সুসম্পন্ন করে ফিরতে পেরেছে । তাই তার এত হাঁকডাক।
খাতা থেকে মুখ সরিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র প্রশ্ন করলেন, কী রমণীরঞ্জন, কখন এলে?
-এই তো জ্যেঠা। সেখান থেকে সোজা এখানে চলে এলুম। আপনার জন্যে চিঠি রয়েছে কিনা।
ঈশ্বরচন্দ্র হাত বাড়ালেন। রমণীরঞ্জন জামার পকেট থেকে একটা খাম এবং একটা খোলা চিঠি বের করে তাঁর হাতে দিল । খোলা চিঠিটায় নাম রয়েছে ঠাকুরদাসের । ভগবতীদেবীর নাম করে তিনিই চিঠি লিখেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র তা পড়লেন। নতুন চাকরীর জন্যে ঠাকুরদাস এবং ভগবতীদেবী, দুজনাই আশীর্বাদ জানিয়েছেন তাঁকে। চিঠি কপালে ঠেকিয়ে গুরুজনের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন।
এবার হাতের খামটা উল্টে পাল্টে দেখে বুঝতে চাইলেন, বাইরে কোথাও কারোও নাম লেখা রয়েছে কি না? তবে তা না দেখতে পেয়ে বুঝলেন, কাজটা তাঁর পত্নীর। মনে মনে হাসলেন, উচ্চারণ করলেন, অজ্ঞ রমণী। রমণীরঞ্জন তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, পথে কোনও ক্লেশ হয়নি তো?
-তা একটু হয়েছে বৈকি, জ্যাঠা। তবে…,
মাথা চুলকতে শুরু করল রমণীরঞ্জন। মুখের ভাবে স্পষ্ট, অতিরিক্ত কিছু দক্ষিণা চায়। ঈশ্বরচন্দ্র জানতে চাইলেন, পয়সা লাগবে ?
-একটু বেশি খরচ হয়েছে, জ্যাঠা।
-বুঝেছি। বাসায় আদর যত্নের খামতি পাসনি তো?
কথা বলতে বলতে ফতুয়ার পকেট থেকে একটা বাঘ মার্কা সিক্কা বের করে রমণীরঞ্জনের হাতে তুলে দিতে গাল এঁটো করা হাসি দিয়ে সে বলল, না গো জ্যেঠা, খুব খাতির হয়েছে আমার…
-হ্যাঁ, তুই তো বড় কুটুম গিয়েছিলি কিনা…, আচ্ছা এখন বাড়ি যা।
ঈশ্বরচন্দ্রের মন নিসপিস করছে, কতক্ষণে বন্ধ মুখের খাম খুলবেন। দীনময়ীর দেওয়া চিঠি পড়বেন।
সিক্কাখানা নাচাতে নাচাতে রমণীরঞ্জন দু লাফে ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে সোজা বাইরে। বাড়ির পথ ধরল। ঈশ্বরচন্দ্র এবার যত্ন করে খামের মুখ খুলতে লাগলেন। ঠিক সেই সময়ে ঘরে ঢুকে দীনু তার দাদার কাছে জানতে চাইল, বীরসিংহে বাবা মা সহ সকলে কুশলে রয়েছে তো?
রমণীরঞ্জনকে যে দাদা সেখানে পাঠিয়েছিলেন, এ সংবাদ দীনবন্ধুর কাছে ছিল। তাই পত্রবাহককে বাড়ি থেকে বেরতে দেখে তিনি সোজা চলে এসেছেন দাদার ঘরে। বাইরে থেকে যখন বাড়ির ভিতর ঢুকছিলেন তখনই রমণীরঞ্জনের সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
ঈশ্বরচন্দ্র ভাইয়ের কথার জবাব দিলেন, হ্যাঁ রে দীনু। বাবা মা সহ সকলে কুশলেই আছে।
-বৌদির খবর?
-ভালই তো লিখেছে। তবে দেখি, তোর বউদি নিজে হাতে কী লিখল…
হাতে ধরা খামটা তুলে দীনবন্ধুকে দেখালেন।
-বেশ, বেশ। পড়ো। বলে, দীনবন্ধু ঘরের বাইরে চলে গেলেন। ঈশ্বরচন্দ্র খামের মুখে সামান্য জলের প্রলেপ লাগিয়ে অতি সাবধানে তা খুললেন। পড়তে শুরু করলেন দীনময়ীর দাঁড়ি, কমাবিহীন চিঠিখানা। পড়ছেন, আর হাসছেন। নিজের মনে বললেন, নাহ, এবার নিজ পত্নীর লেখাপড়া নিয়ে লাগতেই হবে।
তবু স্ত্রীর চিঠির মর্মোদ্ধারে বিশেষ বেগ পেতে হল না তাঁকে। শেষে এসে তো প্রায় হৈ হৈ করবার মতো অবস্থা হল । এই সুসংবাদটুকুর জন্যেই তো তিনি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন। এমনকি তাঁর চিঠির উত্তর সত্বর পাওয়ার জন্যে পত্রদূতও নিযুক্ত করেছিলেন।
শেষ লাইন কটা বারবার পড়েও আশ মিটছিল না। দুহাত কপালে তুলে, কার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন, তা তিনিই জানেন। মনে মনে স্থির করলেন, এবার শীঘ্রই তাঁকে বীরসিংহে যেতে হবে। লম্বা ছুটি নিয়ে। সুখের অনুভূতি এল। মুহূর্তটাকে মনে ধরে লেখার কাজে ফিরে গেলেন।
আপন মনে লিখে চলেছেন। কাহিনি, শকুন্তলা আখ্যান। মূল সংস্কৃত কাব্য, অভিজ্ঞানশকুন্তলম। বর্তমান লেখায় পর্ব, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা।
এমন সময় আবার। -বাবু, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এয়েছেন…, এবার এসেছে চাকর, শ্রীরাম নাপিত। ঈশ্বরচন্দ্রের লেখার তাল কেটে গেল। খাতা থেকে মুখ তুললেন। কপালে ভ্রুকুটি চিহ্ন। প্রশ্ন করলেন, কে এসেছে?
-নাম বলেনি। শুধু বললেন, ফরাসডাঙা থেকে এয়েছেন।
-এতদূর থেকে! আশ্চর্য! সগোক্তি করলেন। পরে বললেন, ঘরে নিয়ে এসো।
শ্রীরাম চলে গেল। একটু পরে এক ব্যাক্তি ঘরে এসে ঢুকল। ঈশ্বরচন্দ্র তাকে বসতে বললেন। ভালো করে দেখলেন তাকে। মনে হল না, আগে দেখেছেন। আগন্তুক মধ্য বয়স্ক। বয়স আন্দাজ ত্রিশের ঘরে। পরণে ধুতি শার্ট। মাথায় অনেকটা লম্বা। যে চেয়ারটায় সে বসেছে, তাতে তার উচ্চতা ঈশ্বরচন্দ্রের মাথা ছাপিয়ে ইঞ্চি ছয়েক উপরে উঠে গেছে। ঘাড় উঁচিয়ে কথা বলতে হচ্ছিল ঈশ্বরচন্দ্রকে।
ভদ্রলোক নিজের নাম প্রকাশ করে জানাল, তিনি ফরাসডাঙার উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় পণ্ডিত। হাত বাড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের পা ছুঁল । ঈশ্বরচন্দ্র আশীর্বাদ করলেন। প্রশ্ন রাখলেন, কী কারণে আসা?
-একটি বিষয়ে পরামর্শ নিতে আপনার কাছে এসেছি, বিদ্যাসাগর মশায়। আশা করি, আপনি আমাকে সঠিক পরামর্শ দেবেন। উত্তর দিল আগন্তুক।
-পরামর্শ! আমার কাছে!
তার কথায় ঈশ্বরচন্দ্র বিস্মিত হয়েছেন। চেনা নেই জানা নেই, অত দূর থেকে সোজা তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে হাজির ! তবু ভাবলেন, মানুষটি তাঁকে সম্বোধনে বিদ্যাসাগর উপাধিটা যখন নামের সঙ্গে যোগ করেছে, এ ব্যক্তি নিশ্চিত কারোও কাছ থেকে তাঁর পণ্ডিতি করবার কাজের বহরের কথা জেনেই এসেছে।
-আপনি পণ্ডিত মানুষ। মানুষের দুঃখে আপনার প্রাণ কাঁদে, এ খবর জানি। ভদ্রলোক নিজের থেকে কথাটা যোগ করল।
-এই বয়সে তোমার কী দুঃখ হে, বাপু? বয়সে নবীন মানুষটাকে ঈশ্বরচন্দ্র তুমি সম্বোধনেই কথা বললেন। সে উত্তর করল, আমি সংসার ত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস নিতে চাই।
সরাসরি কথা। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমটায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন। পরে উচ্চারণ করলেন, সংসার ত্যাগ! কিছুক্ষণ চুপ। চিন্তা করলেন, কী উত্তর দেবেন? শেষে বললেন, দেখো, এ তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ বিষয়ে আমি কী পরামর্শ দোবো?
-আমি আপনার পরামর্শের জন্যে এতদূর থেকে এসেছি। আপনি সুপণ্ডিত। অবশ্যই আমায় সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন।
নাছোড়বান্দার মতো কথা তার। ঈশ্বরচন্দ্র ফের কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করে এবার প্রশ্ন রাখলেন, সংসারে কে কে আছে?
-সংসারে আছে আমার বাবা, বিমাতা, আমার স্ত্রী ও দুটি শিশুসন্তান। আমার নিজের মা পাঁচ বছর আগে গত হয়েছে…
-বাহ, বেশ ভরা সংসার তো তোমার?
ঈশ্বরচন্দ্র যেন এবার কথা বলার সুযোগ পেলেন, যোগ করলেন, কী এমন হল, সংসার ছাড়তে চাইছ?
-বিমাতা ভালো নয়। তার প্ররোচনায় পড়ে আমার বাবা আমার এবং আমার পরিবারের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।
লোকটির কথায় বিমর্ষ ভাব।
-বুঝেছি। তা তোমার স্ত্রীটি কেমন? সতীত্ব আছে তো? শিশুসন্তান দুটি তোমার ঔরসজাত, না অন্য কারো?
মানুষটির কথায় ঈশ্বরচন্দ্র রুষ্ট হয়েছিলেন। তাই নিজের কথায় রূঢ় হতে দ্বিধা করলেন না। স্ত্রীলোক সম্বন্ধেও অমন কথাগুলো নির্দ্বিধায় আওড়ে গেলেন। আসলে তাঁর রাগটা স্ত্রীলোকের উপরে নয়; মানুষটির উপর।
মানুষটি হতবাক! মুখ থেকে তাঁর কথা বেরচ্ছিল না।
-কী হল, কথার উত্তর দাও।
ঈশ্বরচন্দ্র এবার তাকে নিয়ে পড়লেন। কথা তার মুখ থেকেই বের করতে হবে।
সেও বলতে শুরু করল, একি বলছেন, বিদ্যাসাগর মশায়! আমার স্ত্রী অতি সাধ্বী রমণী, পতিপরায়ণা। তাঁর চরিত্রে কোনও দাগ নেই…,
-তাহলে?
ঈশ্বরচন্দ্রের গলার স্বর বেশ কঠোর হল। বলতে থাকলেন, তাহলে ওই সাধ্বী অনুরক্তা স্ত্রী কী এমন দোষ করেছেন যে, সংসার ত্যাগ করে তাঁকে শাস্তি দেবে? একের দোষে অন্যের শাস্তি? তোমার শিশুসন্তান দুটোই বা কী দোষে পরিত্যাক্ত হবে? অমন কাজ কি অমার্জনীয় অপরাধ নয়?…দেখো, সংসারে দুঃখ তাপ আছেই, ঈশ্বরচন্দ্রের গলায় এখন কোমল স্বর। তিনি বলে চললেন, সংসারে এসেছ, কর্তব্য পালন করে যেতে হবে। সকলের প্রতি কর্তব্যপালন করতে হয়। অমন যে বিমাতা, তাঁর প্রতিও কর্তব্য আছে। তুমি ঠিকমতো কাজ করলে একদিন তিনি তোমার প্রতি প্রসন্ন হবেন। এইভাবে চললে সকলকে সংসারে সুখী করতে পারবে।
মানুষটি দু একবার কিছু বলবার চেষ্টা করল বটে, তবে সে খুব সহজ মানুষের কাছে আসেনি, তা বুঝতে পেরেই ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে গেল। ঈশ্বরচন্দ্র হাফ ছাড়লেন । বিক্ষিপ্ত মন কিছুটা শান্ত করে লেখায় মনোযোগ আনলেন।
গদ্য রচনায় পংক্তি যোগ করলেন, ‘শকুন্তলা যাইবে বলিয়া আমার মন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, নয়ন বাষ্পবারিপরিপূর্ণ হইতেছে, কণ্ঠরোধ হইয়া বাক্শক্তিরহিত হইতেছি, জড়তায় নিতান্ত অভিভূত হইতেছি। কি আশ্চর্য্য! আমি বনবাসী, স্নেহবশতঃ আমারও ঈদৃশ বৈক্লব্য উপস্থিত হইতেছে, না জানি সংসারীরা এমত অবস্থায় কি দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করিয়া থাকে। বুঝিলাম স্নেহ অতি বিষম বস্তু !’
আরও লিখলেন,
‘শোকাবেগ সংবরণ করিয়া শকুন্তলাকে কহিলেন বৎসে! বেলা হইতেছে, প্রস্থান কর, আর অনর্থক কাল হরণ করিতেছ কেন । এই বলিয়া তপোবনতরুদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন হে সন্নিহিত তরুগণ ! যিনি তোমাদিগকে জলসিঞ্চন না করিয়া কদাচ অগ্রে জলপান করিতেন না, যিনি ভূষণপ্রিয়া হইয়াও স্নেহবশতঃ তোমাদের পল্লব ভঙ্গ করিতেন না, তোমাদের কুসুম প্রসবের সময় উপস্থিত হইলে যাঁহার আনন্দের সীমা থাকিত না, সেই শকুন্তলা পতিগৃহ যাইতেছেন তোমরা সকলে অনুমতি কর ।
‘অনন্তর, সকলে গাত্রোথান করিলেন।…’ খাতা বন্ধ করলেন।
এরপর দীনময়ীর সুসংবাদে ঘরমুখো হতে বেশিদিন দেরী করলেন না ঈশ্বরচন্দ্র। তিনি চললেন বীরসিংহ গ্রামে। মন আনন্দে উদ্বেল। এক তো, কপালে যোগ হয়েছে সন্তান জন্মাবার সম্ভাবনা । এত বছর পরে পত্নী গর্ভবতী হয়েছে। কত কথা, অকথা, কুকথা শোনাবার পর। পিতৃত্বের পরীক্ষায় তিনিও সফল হয়েছেন। এ এক অনাস্বাদিত আনন্দ। আত্মতৃপ্তির বিষয়।
এ ছাড়াও রয়েছে, কাজে উচ্চতর পদ পাওয়া।
কলিকাতা ছাড়বার আগেই তাঁকে ময়েট সাহেব জানিয়েছেন, সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক বাবু রসময় দত্ত চাকরী ছেড়ে চলে গেছেন। যার ইঙ্গিত তিনি আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। ঘটনাটা ঘটেছে ঈশ্বরচন্দ্রের সহ অধ্যক্ষের পদপ্রাপ্তি হওয়ার মাত্র সতেরো দিনের মাথায়। অর্থাৎ পূর্বের কথা মতো ঈশ্বরচন্দ্র স্থায়ী পদ পেয়ে গেলেন। কলেজ সম্পাদক, সহ-সম্পাদক, দুটো পদেরই অবলুপ্তি ঘটল। তিনিই এখন কলেজের শেষ কথা। শুধু কি তাই? বেতনও বর্ধিত হয়েছে। নব্বুই টাকা থেকে একেবারে একশত পঞ্চাশ টাকা। যেন সর্ববিষয়ে বৃহস্পতির যোগ। এখন লক্ষ্মীই তাঁকে নিজে এসে ধরা দিয়েছে। অতএব নিজের সঞ্চয়ের পুঁজি নিয়ে তিনি বীরসিংহে এলেন। বীরসিংহে এবার ইশকুল গড়েই ছাড়বেন ।
আলোড়ন উঠল ঈশ্বরচন্দ্রের আগমনে। তাঁর নিজের বাড়ি এবং সারা গ্রাম জুড়ে। দিন দুই ঘরে থেকে বাবা, মা, স্ত্রীর সঙ্গে আয়েশে আবেশে কাটিয়ে কাজে নেমে পড়লেন। গ্রামে রটনা করালেন, ফের এক সভা বসবে গ্রামের চন্ডীমন্ডপে। গ্রামময় শিঙা ফুঁকে দিনক্ষণ জানান দেওয়া হল। সঙ্গে বাদ্যি বাজল। গ্রামে সাজসাজ রব পড়ল।
শীতকালের দিন। বেলা তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে। তাই, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে সভা বসল। মানুষজন একে একে এসে হাজির হচ্ছে। মণ্ডপ ভরছে। ছেলে বুড়ো , বয়স্করা আসছে। ঠিক আগের দিনের সভার মতোই। সভার কাজ শুরু হতে গ্রামের মোড়ল কথা বলতে উঠলেন। ভদ্রলোক বেশ বয়স্ক। একমাথা সাদা চুল আর লম্বা দাড়ি নিয়ে মোড়লকে ঋষির মতো দেখায়। সাত্ত্বিক মানুষ। গ্রাম্য প্যাঁচপয়জারে থাকেন না। সৎ চরিত্র। তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন ঈশ্বরচন্দ্রের গুণগান গেয়ে। সঙ্গে জুড়লেন ঠাকুরদাসের নাম। ঠাকুরদাস আজকের সভার সভাপতি। মোড়ল বলছেন, অমন যে পিতা যিনি এমন সব রত্নের জন্ম দিয়েছেন, তাঁর জন্যে যে কোনোও প্রশস্তিই কম।
সভার প্রধান উদ্যোক্তা, বিদ্যাসাগরের নাম উচ্চারণ করে দুবার কপালে হাত ঠেকালেন। মুখে বললেন, এমন নমস্য ব্যক্তি যে আমাদের এই বীরসিংহ গ্রাম পেয়েছে, তায় গ্রামের অশেষ ভাগ্য।
আরও কথা বলতে থাকলেন। অনেকটা পড়া বলার মতো । মোড়লের বক্তৃতা শুনে বোঝা যাচ্ছিল, ভদ্রলোক ভালই তৈরী হয়ে এসেছেন। আসলে, গত সভায়, ঈশ্বরচন্দ্রের কাজ অসফল হওয়ায় নিজে যে তিনি ভূমিকাহীন ছিলেন, মণ্ডল সভাপতি হয়েও কিছুই করে উঠতে পারেননি, সেই দুঃখ তাঁকে এতদিন কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। তারই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এবারে তাঁর বক্তৃতা অনেক জোড়ালো করে পেশ করলেন। নিজের বক্তব্য শেষ করে সভাপতিকে ডেকে নিলেন বক্তৃতা করবার জন্যে।
ঠাকুরদাস উঠে দাঁড়ালেন। জোড় হাতে সকলকে প্রণাম জানিয়ে বলতে শুরু করলেন, আজ আমি এই সভায় নিজের ছেলের কোনও গুণগান গাইতে আসিনি, তা আগেই জানিয়ে রাখি। আমি এসেছি, আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র, ঈশ্বরচন্দ্রের মাথায় সেদিন হাত রেখে তাকে শুধু আশীর্বাদই করিনি, মনে মনে সঙ্কল্পও নিয়েছিলাম, তার দ্বারা এই গ্রামে ইশকুল প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার ইষ্ট দেবতাকে ভুলে থাকব। ফুল বেলপাতা চড়াবো না বাবার মাথায়। তাতে আমার যে ক্ষতিই তিনি করুন না কেন।
সভা নিস্তব্ধ হয়ে শুনছে ঠাকুরদাসের কথা। তিনি বলে চললেন, জীবনের একটা সময় আমি কলিকাতায় থেকেছি। সেখানে ইশকুলে আমার ছেলেদের পড়িয়ে মানুষ করেছি। তারা আজ মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। শহরে নামী ইশকুল কলেজে চাকুরী করছে। অর্থ যশ, মান, সম্মান পাচ্ছে। কাল যদি এই গ্রাম এবং আশপাশ গ্রামে ইশকুল হয়, তাতে করে সকলের বাড়ির ছেলেরাই পড়ার সুযোগ পাবে। সেখানে উচ্চবর্ণ, নিচু বর্ণে ভেদ থাকবে না। পড়ালেখা ছাড়া মানুষের উন্নতি হয় না। আর মানুষ নিজে না উন্নত হলে, দেশ দশের উন্নতি সাধন করবে কী ভাবে? তাই আমি সকলকে অনুরোধ করব, ঈশ্বরচন্দ্রের এই প্রচেষ্টায় সামিল হন। গ্রামে গ্রামে ইশকুল গড়ে উঠুক। সকলে এগিয়ে আসুন। একবাক্যে বলুন, জয় বীরসিংহ গ্রাম…
শ্রোতামণ্ডলীর ভিতর থেকে সমস্বরে রব উঠল, জয় বীরসিংহ গ্রাম, জয় বীরসিংহ গ্রাম। কেউ একজন ঈশ্বরচন্দ্রের নামেও জয়ধ্বনি দিল, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জয়। দুচার জন তার সঙ্গে গলা মেলালো, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জয়।
শ্রোতার দলে বসে ঈশ্বরচন্দ্র চোখ মুছলেন। চোখে তাঁর আনন্দের অশ্রু। উঠে দাঁড়ালেন। ভিড়ের ভিতর থেকে সামনে এগোবার চেষ্টা করলেন। লোক সরে গিয়ে তাঁকে যাবার জায়গা করে দিল। সামনে গিয়ে সভা মঞ্চে উঠে বলতে শুরু করলেন, আপনাদের সহযোগিতা বিনা আমি এ কাজ সম্পন্ন করতে অপারগ। আপনাদের মধ্যে থেকে যদি কেউ কিছু জমি দান করেন , তবে সেখানেই ইশকুল গড়া সম্ভব হবে। নচেৎ…, বলে, চুপ করে গেলেন।
এর ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু হল। সভা জুড়ে গুঞ্জন। সভায় উপস্থিত ভাই, শম্ভুচন্দ্রকে আদেশ করলেন, শীগগির একটা হিসেব কষতে। ইশকুল গড়তে কত টাকার প্রয়োজন।
শম্ভুচন্দ্র দাদার কথায় ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়ে বললেন, কিন্তু দাদা, জমি কোথায়?
-তুই তো শুনলি, জমির জন্যে সকলের কাছে আপিল রেখেছি। এখন একান্তই যদি জমি জোগাড় না হয়, তাহলে আমরাই জমি দোবো। আমাদের বাড়ির লাগোয়া জমিতে ইশকুল গড়তে হবে। এটা জেনে রাখ।
বেশ জোড় গলায় কথাটা বললেন ঈশ্বরচন্দ্র।
-বাবা ঈশ্বরচন্দ্র, মহীতোষ বাড়ুজ্যে বলে উঠলেন, তুমি এতটা করছ, আর আমরা কি সেখানে পিছিয়ে থাকব? কেউ না দেয়, আমি আমার জমির ভাগ থেকে তিন দশক জমি তোমাকে দোবো। একেবারে লেখাপড়া করে। তুমি সেখানেই ইশকুল গড়ো।
মহীতোষ বাড়ুজ্জ্যে গ্রামের বয়োবৃদ্ধের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। এ বিষয়ে তিনি বরাবর ঈশ্বরচন্দ্রের পক্ষেই ছিলেন। এখন সুযোগ পেয়ে তার সদ্ব্যবহার করলেন। ভিড়ের নজর তাঁর দিকে ঘুরে গেল।
-জ্যাঠামশায়, আপনিই প্রথম ব্যাক্তি, যাঁকে দেখে এখন আমার মনে হচ্ছে, একাজে আমি সফল হব। ঠিক আছে, আগামীকাল থেকেই ইশকুল গড়ার কাজ শুরু হয়ে যাবে। লেখাপড়ার কাজও চলতে থাকবে।
বেশ একটা গদগদ ভাব করে ঈশ্বরচন্দ্র কথাগুলো বললেন। সভা একেবারে নিশ্চুপ।
-কাদের দিয়ে কাজ করবে, ঈশ্বরচন্দ্র?
মহীতোষ বাড়ুজ্জ্যেরই প্রশ্ন। দাঁড়িয়ে উঠে কথাটা জিজ্ঞেস করলেন। মুখটা তার উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। এ বিষয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের মনেও ধন্ধ ছিল। তিনি তাই পাল্টা প্রশ্ন রাখলেন, দিনমজুর কি পাওয়া যাবে? পরে নিজেই সমস্যার সমাধান হিসেবে জানালেন, তা যদি নাও পাওয়া যায়, তাহলে আমিই কাজে হাত লাগাব। আমার ভাইরা তো রয়েছেই। এরপর সভার দিকে তাকিয়ে বললেন, আর যে আসতে চায়, তাকেও আমি আহ্বান জানাচ্ছি।
একদল বালক দাঁড়িয়ে গেল ঈশ্বরচন্দ্রের পাশে। সমস্বরে তারা বলল, কাকাবাবু, আমরা আছি। কী করতে হবে, আমাদের বলে দিন।
-এই তো। অনেকজন পাওয়া গেল। শম্ভু, কাল থেকে কাজ শুরু হবে। আজ বাড়ি পৌছিয়ে আমি তোর হাতে কিছু টাকা দিয়ে দিচ্ছি। তুই এদেরকে নিয়ে কাজ শুরু করে দে।
বিজয়ের হাসি হাসলেন ঈশ্বরচন্দ্র । চোখ চকচক করে উঠল। লন্ঠনের আলোয় বোঝা গেল না তাঁর চোখে জল রয়েছে কি না। তবে চোখের ওপরে বার কয়েক হাতের তেলো ঘষতে দেখা গেল তাঁকে।
পরেরদিন থেকেই কাজে নেমে পড়ল শম্ভুচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র, শিবচন্দ্র, তিন ভাই। যোগ দিল জনা কুড়ি নানান বয়সের ছেলেরা। ঈশ্বরচন্দ্র কাজের তদারকি করতে শুরু করলেন। মাটি কাটা শুরু হল। ইশকুল হবে তিন ঘরের।
কথায় আছে, ভাগ্যবানের বোঝা ভূতে বয়। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র ভাগ্যবান হলেও, তাঁর বোঝা ভূত তো বইলোই না। উল্টে তা শনির কোপে পড়ল। কথায় কথায় চতুর্দিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে, কলিকাতা থেকে ঈশ্বরচন্দ্র নামের লোকটা অনেক অর্থ নিয়ে ঘরে এসেছে। চাষবাসের জন্যে বীরসিংহ গ্রাম বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হলে কী হবে আশপাশে অনেক হাড়হাভাতে গ্রামও আছে। অভাব সেখানে হারমজ্জায় জড়িয়ে রয়েছে। তাই চোর ছ্যাঁচড়ের বাসও অবাধ। ইদানীং আবার যোগ হয়েছে হা রে রে, হা রে রে’র দল। মানে, ডাকাত। গোষ্ঠী বেঁধে তারা গৃহস্থের বাড়ি ডাকাতি করে । খবর তাদের কানেও পৌঁছিয়েছে, বীরসিংহের ঈশ্বরচন্দ্র নামের লোকটার অনেক টাকা আছে। সদ্য সে গ্রামে ফিরেছে অনেক টাকাকড়ি নিয়ে। সেখানে ইশকুল গড়ছে। ছেলেদের, মেয়েদের। মানুষটা পয়সাওয়ালা। কলিকাতায় চাকরী করে অনেক টাকা বানিয়েছে।
ডাকাতদলের সিদ্ধান্ত হল, সেদিনই ডাকাতি করে সব টাকা পয়সা লুট করতে হবে। যেমন কথা তেমন কাজ।
শীতে বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ রেখেই মানুষ রাতের ঘুম দেয়। মহিলারা দোর এঁটে শোয় । শীতের দাপট আটকাতে কখনও সখনও পুরুষ মানুষরাও ঘরের দোর আঁটে।
ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে ত্রিশ জন লোক। এছাড়াও রয়েছে দুজন রাত পাহারা দেবার চৌকিদার। মাঝ রাত। একটু আগেই চৌকিদার মাটিতে লাঠি ঠকঠকিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে গেছে। ঘুমের মাঝে কেউ তা শুনেছে; কেউ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থেকেছে। এমন সময় ডাকাত দলের আগমন ঘটল। একদল ডাকাত! মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। হাতে পেল্লায় লাঠি। দুজনের হাতে আবার মশাল। রেড়ির তেল খেয়ে চুপচুপ হয়ে মশালের আগা আকাশের দিকে লকলকে শিখা তুলে জ্বলছে। রাতকে অন্ধকার মুক্ত করেছে।
নজর পড়ল চৌকিদারদের । চিল চিৎকার শুরু হল, ডাকাত পড়েছে,…ডাকাত। এমন চেঁচানিতে মরা মানুষও জেগে উঠে বসে পড়বে। তায় বাড়ির ঘুমন্ত জ্যান্ত মানুষ তো জাগবেই। শুধু কী জেগে ওঠা? দুড়দাড় করে পালাতে শুরু করল সকলে। ডাকাতের দলটা তখন মশালের আলো জ্বালিয়ে ঠাকুরদাসের বাড়ির মধ্যদ্বার ভাঙছে। পাকাপোক্ত কাঠের দরজা। তা ভাঙতে সময় লাগছে। এই ফাঁকে ঈশ্বরচন্দ্র, শম্ভুচন্দ্র যে যা পারলেন, অর্থকড়ি, সোনাদানা হাতড়িয়ে কাপড়ে পুঁটলি পাকিয়ে বাড়ির মহিলাসহ ত্রিশজনকে নিয়ে খিড়কি দোরের দিকে এগিয়ে গেলেন। খিড়কি দরজা বাড়ির পিছন দিকে। ডাকাতদলের নজরের বাইরে। ওদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেখান দিয়ে সকলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ডাকতরা যখন ঢুকল, ততক্ষণে বাড়ি ফাঁকা।
ঘরদোর ফাঁকা পেয়ে ডাকাতদলের সে কি নাচানাচি! খালি বাড়িতে সর্বস্ব লুট করেই তবে তারা যাবে। হাতের সামনে যা পেল, তাই খপাখপ বস্তা বন্দী করতে শুরু করল । ওপর নিচ করে সবকটা ঘরের জামা কাপড়, রান্না-খাওয়ার ঘর থেকে যাবতীয় বাসনকোসন নিয়ে বেঁধে ছেঁদে ফেলল। খোঁজ চলছিল টাকাকড়ি, সোনাদানার। তা সে গুড়ে তো বালি দিয়ে রেখেছেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র । সাধে কি আর তাঁকে বিদ্যারসাগর বলা হয়? বুদ্ধিতেও যে তিনি দর তার প্রমাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন নগদ টাকাকড়ি, সোনাদানা। ডাকাতদলের হাত ছাড়া হল সেসব। ভোর হয়ে আসছিল। তারা যা যোগাড় করেছিল, তাই নিয়েই চম্পট দিল।
আকাশে আলো ফুটতে বাড়ির লোকজন সকলে ফিরে এল। বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল, অনেকের প্রায় এক কাপড়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে ডাকাতের দল । রান্নাঘরে ঢুকে একটাও বাসন নেই দেখে ভগবতীদেবী কান্নায় বুক ভাসাতে শুরু করলেন। ঠকুরদাস সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, প্রাণে বেঁচেছ এই অনেক। পয়সা ফেললে ওরকম অনেক বাসন পাওয়া যাবে। বেলা বাড়ুক, হাটে গিয়ে হাড়ি কড়াই, থালা বাসন কিনে আনছি। এখন চুপ করো, কেঁদো না।
সেই রাতেই ঈশ্বরচন্দ্র ঘাঁটাল থানায় সংবাদ পাঠালেন। ভোর হতে থানা থেকে পুলিশের দারোগাবাবু এসে হাজির। মোটা হোঁতকা, বিশাল ভুঁড়ি যুক্ত মানুষ; ধড়াচুড়োয় যেন বংশীধারী। কাজে এসেই তার মেজাজ গরম হয়ে গেল, যখন শুনল, এখানে দক্ষিণার ব্যবস্থা নেই।
ঠাকুরদাসকে বলেছিল, দক্ষিণা দিন তবে কেস হবে। ডাকাতদলকে ধরে জিনিষ আদায় করে দোবো।
ঠাকুরদাস তো অবাক! বলে কী লোকটা! গৃহস্থের ঘরে চুরি, আর তা উদ্ধারের জন্যে টাকা! এতটাই ঔদ্ধত্য! কথা শুনে ঠাকুরদাস রাগে গরগর করতে লাগলেন । সৎ ভদ্র ব্রাহ্মণ বলে নিজেকে সামলে রাখলেন। কিন্তু দারোগাবাবুকে উপযুক্ত কথা শোনাতে ছাড়লেন না। মিষ্টি কথায় দারোগাবাবুর কাছা খোলার অবস্থা করলেন। বললেন, -আপনি কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে বলে আপনার মর্যাদা রাখতে পারি, কিন্তু এ সম্বন্ধে আপানকে কিছু দিতে পারব না…
কথা শেষ করে দারোগার সামনে দিয়ে গটগট করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেলেন। উদয়গঞ্জ ও খড়ারের দিকে পা বাড়ালেন। সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় থালা ঘটি বাটি প্রভৃতি কিনতে।
ঈশ্বরচন্দ্র আবার আর এক কাঠি ওপরে । তাঁর কাছে এ যেন কিছুই হয়নি, এমন তিনি বাড়ির বাইরে চলে গেলেন । গৃহ লাগোয়া খালি জমিতে গিয়ে নামলেন। হাঁক পারতে থাকলেন ভাইদের, পাড়ার ছেলেদের। একে একে এসে জড়ো হল তারা। জনা বারো ছেলে। ভাগাভাগি করে দুটো দল তৈরী করলেন। মাঠের মাঝে দাগ কাটলেন। দাগের দুপাশে দু দল। কাবাডি খেলা শুরু করে দিলেন।
হাঁ করে দারোগাবাবু এ বাড়ির লোকেদের রগর দেখছে আর রাগে গরগর করছে। কান মাথা গরম। অপমানে মুখে কথা সরছে না। আলটপকা মন্তব্য ছুঁড়ে দিল, ও বামুনের এত কিসের জোর? আমি দারগাবাবু, আমার মুখের ওপর বলে দেয়, এক পয়সাও হবে না! আমার ক্ষমতা জানে না…
বাবা ঠাকুরদাসের থেকে ছেলে ঈশ্বরচন্দ্রের ওপর বেশি ক্রুদ্ধ দারোগাবাবু। তার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বলল, ওই ছোড়াটাই বা কী রকমের লোক? কাল ডাকাতি হয়েছে আর আজ বাড়ির সামনে কাবাডি খেলছে!
দারোগাবাবু দাঁড়িয়েছিল কিছুটা তফাতে। তার কথা ঈশ্বরচন্দ্রের কানে গেল না বটে, তবে পাশে দাঁড়ানো ফাঁড়িদার তা শুনে বুঝল, এ মানুষটাকে তো ঠাণ্ডা করতে হয়। না হলে, আরোওই কী না কী বলে বসে! আর তা যদি একবার ওই গণ্যমান্য ব্যক্তিটির কানে যায়, তো অনর্থ বাধিয়ে দেবেন তিনি। ঈশ্বরচন্দ্রের এলেম ফাঁড়িদার ভালো মতোই জানে। তিনি যে কলিকাতায় নামী কলেজের অধ্যক্ষ তাও তার বিলক্ষণ জানা আছে। তাই নিজে দারোগাবাবুর গায়ের কাছে সরে আসল । ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল, চুপ চুপ, দারোগাবাবু। ও ছোঁড়া সে ছোঁড়া নয়। উনি গ্রামে আসলে জাহানাবাদের ডেপুটি সাহেব নিজে ওনার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। লাটসাহেবের সঙ্গেও খাতির রয়েছে। কলিকাতায় ওনার সঙ্গে ওঠাবসা করেন। ওনার কানে এসব গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
-এ্যাঁ ! বলে ক্যোঁৎ দিয়ে উঠল দারোগাবাবু। চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে গেল। বলে কী! একেবারে লাটসাহেবের সঙ্গে চেনা!
মুখে কুলুপ পড়ে গেল । ফাঁড়িদারের বগল থেকে ডায়রি লেখার খাতাখানা চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। -চলো চলো। চুরির ছানমিনের কাজ শুরু করতে হবে…, বলে, ভুঁড়ির ওপর প্যান্টুলুন তুলে দৌড়ল ঠাকুরদাসের বাড়ির দিকে।
ঈশ্বরচন্দ্রের স্কুল গড়া হল না। পুরনো আপ্তবাক্য, ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিজপোজেস, স্মরণ করতে করতে ঈশ্বরচন্দ্র কলিকাতায় ফিরে চললেন। ক্ষতি যা হবার, তা তো গেল গৃহস্থের ঘরে ডাকাতের হানা; তবে হ্যাঁ, লাভের মধ্যে লাভ হল, কিছুদিনের জন্যে দীনময়ীর পাশে থেকে সঙ্গসুখ, শরীর সুখ নিয়ে ফিরলেন। মন প্রাণ ভরে দুজনে দুজনের সঙ্গ উপভোগ করতে পেরেছেন।
ছুটির মেয়াদকাল শেষ হবার আগেই ঈশ্বরচন্দ্রকে কাজে ফিরতে দেখে অনেকেই অবাক হল! সেকি! এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে, বিদ্যাসাগর মশাই।
সকলের এক প্রশ্ন। ঈশ্বরচন্দ্র জনে জনে আর কী কৈফিয়ত দেবেন? তাই করলেন কী, একটা বড় কাগজে ডাকাতির ঘটনাটা লিখে বুকে সেঁটে বেড়াতে লাগলেন। লোকে দেখে। পড়তে শুরু করলে স্ট্যাচু হয়ে যান। লোক পড়ে। মুখে কিছু জানতে চাইলে আঙুল দেখিয়ে দেন ঝোলানো নোটিশের দিকে। লোক হাসতে থাকে। তিনি এগিয়ে যান। বেশি পীড়াপীড়ি করলে একটাই বাক্য আওড়ান, নোটিশ বোর্ড দেখুন।
তবে তাই বলে কী নোটিশ সেঁটে যত্রতত্র ঘোরেন? নাকি , তা এক কলেজ অধ্যক্ষের পক্ষে সম্ভব? মজার ছলে তিনি যখন নিজের কলেজে ঘোরাঘুরি করেন, তখনই অন্যের প্রশ্নবাণ থেকে রেহাই পাবার জন্যে ওই কীর্তি করেন। লোকে বলে, রসিক মানুষ বটে ঈশ্বরচন্দ্র!
এমন এক রসালো খবর একদিন হ্যালিডে সাহেবের কানে পৌঁছাল। ব্যাপারটা কী, তা জানবার কৌতূহল হল ছোট লাটের। ঈশ্বরচন্দ্র সেদিন কী এক কাজে হ্যালিডে সাহেবের দপ্তরে গেছেন । একথা সেকথার পর তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, শুনছি, ইদানীং কলেজে আপনি নাকি বুকে কী একটা নোটিশ ঝুলিয়ে ঘোরেন?
-সত্যই শুনেছেন আপনি। ওই নোটিশটি না ঝুলালে আমাকে যতবার ঘটনার ফিরিস্তি দিতে হত, তাতে কলেজে আমার অধ্যপনায় সময়ের অভাব হয়ে পড়ত।
-তাই নাকি, মশায়!
যুগপৎ হাসি এবং বিস্ময় হ্যালিডের কথায়। ঈশ্বরচন্দ্র গম্ভীর। উত্তর দিলেন, আজ্ঞে হ্যাঁ।
হ্যালিডে ব্যাপারটা জানতে আগ্রহী। তিনি বললেন, ঘটনাটা এক্সপ্লেন করবেন?
-বিলক্ষণ । কী জানেন? চুরির ঘটনা বলতে গেলে, চোরের থেকে নিজের ওপর বেশি বিরক্তি লাগে। চোর চোরের কাজ করে চলে যায়। গৃহস্থ নিজের জিনিষ বাঁচায়। যতখানি পারে। বাকিটুকু চোরের প্রাপ্য। কাজে এসে খালি হাতে তো ফিরে যেতে পারে না…
-হা, হা, হা। কথার মাঝে হেসে উঠলেন ছোটলাট। বললেন, আপনি মশায় মজার মানুষ। চোরের কাজকেও সমর্থন করছেন?
-দোষ নেবেন না, স্যার । বলি কী, বেতনভুক রাজকর্মচারী চুরি করতে পারে আর চোরের বেলায় যত দোষ? তার কাহিনি সকলে শুনতে চায়। আর অন্য চুরির কাহিনি কারপেটের তলায় চাপা পড়ে যায়। তবে আপনি শুনতে চাইছেন, তাই বলছি, সেদিন ঘরে অনেক টাকা কড়ি ছিল। ইশকুল গড়বার টাকা। কে বা কারা সে খবর ডাকাতদের কানে দিয়ে দিয়েছিল। তারাও প্রস্তুত হয়েই এসেছে। ভালো দাঁও মারবে। কিন্তু ব্যাটাদের কপালে বালি চাপা দিয়ে টাকাকড়ি, সোনাদানা নিয়ে বাড়িসুদ্ধু মানুষ পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছি।
-সেকি মশাই! বাড়িতে ডাকাত পড়ল। বাধা না দিয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে চলে গেলেন! এ তো ভয়ানক কাপুরুষতা।
ঈশ্বরচন্দ্র হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। হ্যালিডের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। শেষে বললেন, আপনারা মজার লোক। প্রাণ নিয়ে পালালাম তাতে বললেন কাপুরুষ। আর ত্রিশ চল্লিশজন দস্যুর সামনে একা প্রাণ দিলে বলতেন, তাই তো, লোকটা বড় আহাম্মক, এত লোকের সামনে একা এগিয়ে মিথ্যে প্রাণটা দিল। আপনাদের মনের মতো কাজ করা কঠিন। এগুলেও দোষ, পিচুলেও দোষ।
মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র হ্যালিডে সাহেবের ঘর ছাড়লেন। হ্যালিডে সাহেবের রসিকতা কিছুটা নিম্নবর্তী বলে মনে হয়েছে তাঁর।
রসিকতায় রসনা থাকে। সেখানে চারিত্রিক গুণাবলীর প্রশংসা থাকতে পারে; কিন্তু নিম্নবর্তী চরিত্রের পাঁক রসনাকে তিক্ত করে তোলে। এটাই স্বাভাবিক।
চলবে…