টোকিও ডায়েরি। প্রবীর বিকাশ সরকার
৬
এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল টোকিও থেকে, ১৯৯৪ ডিসেম্বর-১৯৯৫ জানুয়ারি যৌথ সংখ্যা হিসেবে। তখন আমি আসাহি কোওসোকু প্রিন্টিং কোম্পানিতে চাকরি করি। দিন ও রাত মিলিয়ে এ্যাত ব্যস্ত কাজে যে দম ফেলারও উপায় নেই! কিন্তু কাগজ তো বন্ধ রাখা যাবে না। গভীর রাত পর্যন্ত সম্পাদনা ও লেআউট করি, আবার অফিসেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুক টুক করে কাজ এগিয়ে রাখি। এভাবে এই সংখ্যাটিরও লেআউট শেষ করার পর ছাপার জন্য নিজের কোম্পানিতে চেষ্টা করি, কিন্তু ঢোকানো গেল না, প্রচুর কাজ ঢুকে আছে। ভীষণ চাপ বললেন ম্যানেজার চিবা সান। বাধ্য হয়ে অন্য প্রেস খুঁজতে হল।
সেইসময় সাংবাদিক ও লেখক পি.আর.প্ল্যাসিড “মানচিত্র”র নিউজগুলো সম্পাদনা করত। তাকে বললাম, একটি প্রেস খোঁজো, ছাপার জন্য। অক্ষর তো বাংলা উল্টাপাল্টা ছাপিয়ে ফেলবে! এর আগেও এমন হয়েছে জানোই তো!
প্ল্যাসিড তখন টোকিওর ইতাবাশি শহরে একটি বুক বাইন্ডিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। সে বলল, প্রবীরদা, আমি ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করেছি, তার পরিচিত প্রেসে ছাপানো যাবে। ডিজাইন শিট দিয়ে দিচ্ছি, কালার প্রুফ আপনি এসে দেখে দেবেন। কাগজও আছে। সাদা পাতলা খুব ভালো ছাপা হবে। কভার ১১০ গ্রাম গ্লোসি পেপার। আমি এস্টিমেট নিয়ে রাতে ফ্যাক্স করে দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না।
এক সপ্তাহ পর আমি কালার প্রুফ, ইনার পেইজের পজিটিভ ও ব্লু প্রিন্ট চেক করে দিলাম। পরের দিনই ছাপা হয়ে গেল কাগজ। প্রচ্ছদটা অসাধারণ হয়েছে। জাপানিরাও প্রশংসা করলেন। তাদের প্রশংসা শুনে মনে হল, গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ তাহলে আমিও পারি! একটা আত্মবিশ্বাস নড়েচড়ে উঠল বুকের ভেতরে।
ঢাকা আর টোকিওর কাজের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে, সূক্ষ্ম কাজের। জাপানে যেভাবে “শোকুনিন” বা “কারিগর”রা যত্নের সঙ্গে কাজের পারফেকশন ফুটিয়ে তুলতে পারেন, ঢাকায় তখনো সেই কাজ শুরুই হয়নি। যেমন, ছবির ওপর আউটলাইন অক্ষর প্রসেস করা। যাকে জাপানিরা বলেন, ফুচি। এই সংখ্যায় একাধিক ছবির ওপর ফুচির কাজ রয়েছে। তাতে করে মুদ্রণে একটা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
“মানচিত্রে”র ডিজাইনে জাপানি ম্যাগাজিনগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে ডিজাইন করেছি। আমি আসাহি কোম্পানিতে কাজ করার সময় দেখেছি, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং সম্পাদকরা ছাপার কাজ দেখতে আসতেন। তারা প্রথমেই নজর দিতেন ছবির ওপর। ছবির টোন যথার্থ ফুটে উঠেছে কি না? কালার মিলেছে কি না? তারপর অক্ষরের লাইন একই রকম আছে কি না?
এমনও আমি দেখেছি, সম্পাদক অর্থনীতিবিদ নন, কিন্তু অর্থনীতি বিষয়ক খাসা প্রবন্ধ বা ফিচার লিখে ফেলছেন! অথবা শিল্পকলা নিয়ে, শিল্পকলার বই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও! রঙের অর্থ, গ্রাফিক ডিজাইনের ওপরও প্রচণ্ড দখল তাদের! অবাকই হয়েছিলাম। সম্পাদক মানেই, লেখা পেলাম, ছাপিয়ে দিলাম তা কিন্তু নয়! যে-কোনো লেখার উপলক্ষ ও তাৎপর্যটা তারা আগে দেখেন। ভাষা ও আকার-আকৃতি পরের কথা। প্রচ্ছদের ব্যাপারে অত্যন্ত কাড়াকড়ি দৃষ্টি, কেননা, প্রচ্ছদ হচ্ছে ম্যাগাজিনের সদর দরজা, যদি সেটা আকর্ষণীয় না হয় তাহলে সে ম্যাগাজিনের ভেতরে পাঠক প্রবেশ করতে চাইবেন না।
তখন আমি বুঝলাম যে, সম্পাদক কেন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার ক্ষেত্রে? কারণ, সম্পাদককে ষোলো কলা জানতে ও বুঝতে হয়। না হলে সে সম্পাদকই নয়!
লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিদারুণ কড়াকড়ি করতে সম্পাদকদের আমি দেখেছি। ভূলভ্রান্তি হলে বার বার ঠিক করে দিতে বলতেন, সংযোজন, সংশোধন তো আছেই। সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতেন, টাইপ আউট করার পর প্রিন্ট কপি সাক্ষাৎকারদাতাকে পাঠানো হচ্ছে প্রথম সম্পাদকীয় দায়িত্ব। এমনকি, সম্পাদক টেলিফোনেও কথা বলে মতামত ব্যক্ত করে নিতেন। আমার সাক্ষাৎকার পত্রিকায় ছাপানোর সময়ও তাই হয়েছে, এখনো হয়। এটাই জাপানের ঐতিহ্য।
এইসব অভিজ্ঞতা আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে অর্জন করেছি, প্রশ্ন করে জেনেও নিয়েছি অগ্রজদের কাছে। জাপানে সিনিয়রদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করা হয়। বিশেষ করে, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের লেখক, সাংবাদিক ও সম্পাদকের সম্মান এই দেশে রাজনীতিবিদদের চেয়েও ওপরে। প্রতিবাদ করার সাহস রাখেন না সচিব, মন্ত্রী ও সাংসদরা পর্যন্ত। কলমের খোঁচায় মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না জাপানে! কীভাবে যে ধোলাই দেয়া হয় জাপানি ভাষার পত্রপত্রিকা না পাঠ করলে বিদেশিরা বুঝতে পারবেন না। “মানচিত্রে”ও অনেক সংবাদ, প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে যা এখন ছাপালে বাদ-প্রতিবাদ তো হবেই, মামলাও হয়ে যাবে ডিজিটাল আইনে!
এই সংখ্যায়ও সেইসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, পাঠক শিরোনাম পড়লেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু “মানচিত্র” ছিল জাপানের “কর পরিশোধকৃত” মাসিক তথ্য ও অভিমতভিত্তিক কাগজ, তাই বাংলাদেশের আইন এখানে খাটেনি। এই দেশে ট্যাক্স সর্বদাই আইনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ট্যাক্সই কথা বলে!