টোকিও ডায়েরি। প্রবীর বিকাশ সরকার

বন্ধু আনিসের পাঠানো এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল, ২২ মার্চ, ১৯৯৪ সালে। আনিসকে আবারও আন্তরিক ধন্যবাদ।
এই সংখ্যাটি যখন প্রকাশ করি তখন ব্যস্ত ছিলাম বলে মনে পড়ে। চাকরি বদল করেছিলাম। এতদিন চাকরি করছিলাম রিউবি প্রসেস কোম্পানি নামক একটি সিল্ক প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠানে, টোটাল প্রিন্টিং নো-হাউ জানার আগ্রহে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় কাজে লাগতে পারে ভেবে।
নতুন প্রতিষ্ঠান ছিল আসাহি কোওসোকু ইনসাৎসু কাইশা নামে একটি বিখ্যাত অফসেট প্রিন্টিং কোম্পানি। যার বয়স তখনই অর্ধ শতাব্দি। জাপানের তিনটি প্রধান প্রিন্টিং মহাপ্রতিষ্ঠান যথাক্রমে দাইনিপ্পন, তোপ্পান এবং কিয়োদোও এর মূল্যবান সব প্রিন্টিং কাজ করে দিত অধীনচুক্তিতে। অসম্ভব ব্যস্ত এক প্রতিষ্ঠান। ২৪ ঘণ্টা চারটি অফসেট মেশিনে ছাপা চলছে অবিরাম। ৫ কালারের একটি, ৪ কালারের দুটি এবং বাই কালারের একটি মেশিন। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ কপি অটোমেটিক প্রসেসে ছাপা হচ্ছে, বড় বড় ট্রাক আসছে কাগজ নিয়ে আর ফিরে যাচ্ছে মুদ্রিত কাগজ নিয়ে বইবাঁধানোর কারখানায়। দিনে রাতে ৩০ জন কর্মী কাজ করছেন। রোববার শুধু ছুটি। এলাহি কাণ্ড যাকে বলে! আমার কাজ কম্পিউটারে প্লেইট মেকিং সেকশনে। শত শত প্লেইট করতে হচ্ছে প্রতিদিন। জাপানে তখন প্রকাশনা বুম্ চলছিল।
আমার এক সপ্তাহে দিনে আরেক সপ্তাহে রাতে কাজ। দম ফেলার উপায় নেই। এই কাজ অভিজ্ঞতাহীন ফলে শিখতে হচ্ছে।
কিন্তু তখন তরুণ ছিলাম, ক্লান্তিবোধটা কম ছিল। “মানচিত্র”র টানে কঠোর পরিশ্রম তুচ্ছ মনে হত। যেহেতু কাজটি নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ তাই তিনটি মাস মনোযোগসহকারে কাজ শিখতে হয়েছিল। অন্যচিন্তা করার সময় পেতাম কম। কিন্তু কাগজ প্রকাশ তো বন্ধ থাকতে পারে না। আমার স্ত্রী বলল, যদি সুযোগ আসে তাহলে বাংলাদেশে ছাপিয়ে আনাই ভালো হবে। তা নাহলে তোমার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়বে। “মানচিত্রে” কতিপয় প্রবাসী বন্ধু জড়িত থাকলেও কারো পত্রিকা তৈরি করার অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে সব কাজ একাই করতে হত।
সেই তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও এই সংখ্যাসহ ট্যাবলয়েড সাদাকালো, রঙিন প্রকাশ করেছি। এই সংখ্যা ছিল একেবারেই সাদামাটা সজ্জায়। কিন্তু বৈচিত্র্যময় এবং খুব ভালো লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বেশকিছু লেখা ঢাকা থেকে কবি, সাংবাদিক ও সম্পাদক সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল পাঠিয়েছিলেন। খুব উপকার হয়েছিল, অবশ্যই সম্মানি প্রদান করেছিলাম।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছেন কবি শামসুর রাহমান, তৎকালীন বিরোধী দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা, এবং প্রফেসর ড.আনিসুজ্জামান। জননেত্রী শেখ হাসিনার নিবন্ধটি ছিল অসাধারণ একটি লেখা। তাঁর দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রয়াত পিতার পথকেই অনুসরণ করে চলেছেন আজও।
ফিচার লিখেছেন উর্মি রহমান, সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল, আশরাফুল আলম, ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক কেশব শূর, আলম খোরশেদ, সৈয়দ হায়দার, শান্তনু হাসান খান প্রমুখ।
“মানচিত্র” বরাবরই সাহিত্যকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই প্রতিটি সংখ্যায় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের লেখা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।
অন্যদিকে, বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করেছি। এই সংখ্যায়ও প্রথিতনামা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। গ্রহণ করেছেন শান্তনু হাসান খান।
পুরনো সংখ্যাগুলো যখন দেখি, মন কেমন করে ওঠে! কত মূল্যবান সময়, অর্থ আর লবণাক্ত শ্রম জড়িয়ে আছে পাতায় পাতায় যা আমার কাছেই শুধু স্মৃতিকাতর এবং অমূল্য।

এই সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল টোকিও থেকে, ১৯৯৪ ডিসেম্বর-১৯৯৫ জানুয়ারি যৌথ সংখ্যা হিসেবে। তখন আমি আসাহি কোওসোকু প্রিন্টিং কোম্পানিতে চাকরি করি। দিন ও রাত মিলিয়ে এ্যাত ব্যস্ত কাজে যে দম ফেলারও উপায় নেই! কিন্তু কাগজ তো বন্ধ রাখা যাবে না। গভীর রাত পর্যন্ত সম্পাদনা ও লেআউট করি, আবার অফিসেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুক টুক করে কাজ এগিয়ে রাখি। এভাবে এই সংখ্যাটিরও লেআউট শেষ করার পর ছাপার জন্য নিজের কোম্পানিতে চেষ্টা করি, কিন্তু ঢোকানো গেল না, প্রচুর কাজ ঢুকে আছে। ভীষণ চাপ বললেন ম্যানেজার চিবা সান। বাধ্য হয়ে অন্য প্রেস খুঁজতে হল।

সেইসময় সাংবাদিক ও লেখক পি.আর.প্ল্যাসিড “মানচিত্র”র নিউজগুলো সম্পাদনা করত। তাকে বললাম, একটি প্রেস খোঁজো, ছাপার জন্য। অক্ষর তো বাংলা উল্টাপাল্টা ছাপিয়ে ফেলবে! এর আগেও এমন হয়েছে জানোই তো!

প্ল্যাসিড তখন টোকিওর ইতাবাশি শহরে একটি বুক বাইন্ডিং প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। সে বলল, প্রবীরদা, আমি ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ করেছি, তার পরিচিত প্রেসে ছাপানো যাবে। ডিজাইন শিট দিয়ে দিচ্ছি, কালার প্রুফ আপনি এসে দেখে দেবেন। কাগজও আছে। সাদা পাতলা খুব ভালো ছাপা হবে। কভার ১১০ গ্রাম গ্লোসি পেপার। আমি এস্টিমেট নিয়ে রাতে ফ্যাক্স করে দিচ্ছি। চিন্তা করবেন না।

এক সপ্তাহ পর আমি কালার প্রুফ, ইনার পেইজের পজিটিভ ও ব্লু প্রিন্ট চেক করে দিলাম। পরের দিনই ছাপা হয়ে গেল কাগজ। প্রচ্ছদটা অসাধারণ হয়েছে। জাপানিরাও প্রশংসা করলেন। তাদের প্রশংসা শুনে মনে হল, গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ তাহলে আমিও পারি! একটা আত্মবিশ্বাস নড়েচড়ে উঠল বুকের ভেতরে।

ঢাকা আর টোকিওর কাজের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে, সূক্ষ্ম কাজের। জাপানে যেভাবে “শোকুনিন” বা “কারিগর”রা যত্নের সঙ্গে কাজের পারফেকশন ফুটিয়ে তুলতে পারেন, ঢাকায় তখনো সেই কাজ শুরুই হয়নি। যেমন, ছবির ওপর আউটলাইন অক্ষর প্রসেস করা। যাকে জাপানিরা বলেন, ফুচি। এই সংখ্যায় একাধিক ছবির ওপর ফুচির কাজ রয়েছে। তাতে করে মুদ্রণে একটা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।

“মানচিত্রে”র ডিজাইনে জাপানি ম্যাগাজিনগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন আইডিয়া দিয়ে ডিজাইন করেছি। আমি আসাহি কোম্পানিতে কাজ করার সময় দেখেছি, গ্রাফিক ডিজাইনার এবং সম্পাদকরা ছাপার কাজ দেখতে আসতেন। তারা প্রথমেই নজর দিতেন ছবির ওপর। ছবির টোন যথার্থ ফুটে উঠেছে কি না? কালার মিলেছে কি না? তারপর অক্ষরের লাইন একই রকম আছে কি না?

এমনও আমি দেখেছি, সম্পাদক অর্থনীতিবিদ নন, কিন্তু অর্থনীতি বিষয়ক খাসা প্রবন্ধ বা ফিচার লিখে ফেলছেন! অথবা শিল্পকলা নিয়ে, শিল্পকলার বই নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও! রঙের অর্থ, গ্রাফিক ডিজাইনের ওপরও প্রচণ্ড দখল তাদের! অবাকই হয়েছিলাম। সম্পাদক মানেই, লেখা পেলাম, ছাপিয়ে দিলাম তা কিন্তু নয়! যে-কোনো লেখার উপলক্ষ ও তাৎপর্যটা তারা আগে দেখেন। ভাষা ও আকার-আকৃতি পরের কথা। প্রচ্ছদের ব্যাপারে অত্যন্ত কাড়াকড়ি দৃষ্টি, কেননা, প্রচ্ছদ হচ্ছে ম্যাগাজিনের সদর দরজা, যদি সেটা আকর্ষণীয় না হয় তাহলে সে ম্যাগাজিনের ভেতরে পাঠক প্রবেশ করতে চাইবেন না।

 

তখন আমি বুঝলাম যে, সম্পাদক কেন গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার ক্ষেত্রে? কারণ, সম্পাদককে ষোলো কলা জানতে ও বুঝতে হয়। না হলে সে সম্পাদকই নয়!

লেখা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নিদারুণ কড়াকড়ি করতে সম্পাদকদের আমি দেখেছি। ভূলভ্রান্তি হলে বার বার ঠিক করে দিতে বলতেন, সংযোজন, সংশোধন তো আছেই। সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতেন, টাইপ আউট করার পর প্রিন্ট কপি সাক্ষাৎকারদাতাকে পাঠানো হচ্ছে প্রথম সম্পাদকীয় দায়িত্ব। এমনকি, সম্পাদক টেলিফোনেও কথা বলে মতামত ব্যক্ত করে নিতেন। আমার সাক্ষাৎকার পত্রিকায় ছাপানোর সময়ও তাই হয়েছে, এখনো হয়। এটাই জাপানের ঐতিহ্য।

এইসব অভিজ্ঞতা আমি কাজের ফাঁকে ফাঁকে অর্জন করেছি, প্রশ্ন করে জেনেও নিয়েছি অগ্রজদের কাছে। জাপানে সিনিয়রদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করা হয়। বিশেষ করে, সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের লেখক, সাংবাদিক ও সম্পাদকের সম্মান এই দেশে রাজনীতিবিদদের চেয়েও ওপরে। প্রতিবাদ করার সাহস রাখেন না সচিব, মন্ত্রী ও সাংসদরা পর্যন্ত। কলমের খোঁচায় মন্ত্রীত্ব চলে যাওয়া কোনো ব্যাপারই না জাপানে! কীভাবে যে ধোলাই দেয়া হয় জাপানি ভাষার পত্রপত্রিকা না পাঠ করলে বিদেশিরা বুঝতে পারবেন না। “মানচিত্রে”ও অনেক সংবাদ, প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে যা এখন ছাপালে বাদ-প্রতিবাদ তো হবেই, মামলাও হয়ে যাবে ডিজিটাল আইনে!

এই সংখ্যায়ও সেইসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে, পাঠক শিরোনাম পড়লেই বুঝতে পারবেন। কিন্তু “মানচিত্র” ছিল জাপানের “কর পরিশোধকৃত” মাসিক তথ্য ও অভিমতভিত্তিক কাগজ, তাই বাংলাদেশের আইন এখানে খাটেনি। এই দেশে ট্যাক্স সর্বদাই আইনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ট্যাক্সই কথা বলে!

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page