রেডিও, স্মৃতিকাতরতার অন্য এক নাম
শাঁওলি দে
ট্রেনের হুইসেলটা মিলিয়ে যেতেই ভোঁ করে সাইরেন বেজে উঠত দূরে কোথাও। উঠোন জুড়ে লেপ্টে থাকা কাঁচা গোবরের গন্ধের সঙ্গে মিশে থাকত কয়লার উনুনের ধোঁয়ার পোড়া পোড়া গন্ধও। পাখিদের কলকাকলি ও কড়াই খুন্তির টুং টাং-এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলত বাড়ির ছোটদের দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করার আওয়াজ। ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের বাড়ির বারান্দায় হেলান দিয়ে রাখা বড় ট্রানজিস্টারটা গমগমে গলায় সশব্দে ঘোষণা করত, ‘নমস্কার, আকাশবানী শিলিগুড়ি, খবর পড়ছি…’
আচ্ছা, মনে হয় না, এসব যেন গতজন্মের কথা ? ইদানিং সকাল এভাবে শুরু হয় না। যান্ত্রিক ব্যস্ততা কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। মুঠো ফোনের দাপাদাপিতে হাতের ফাঁকফোকর দিয়ে বালিকণার মতো গলিয়ে পড়েছে আঁকড়ে রাখা সুখ সুখ অনুভূতিগুলো।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবন যাপনকে কয়েক’শ ধাপ এগিয়ে দিয়েছে এটা সত্যি; কিন্তু একথা মানতেও কোনো দ্বিধা নেই যে, এই এগিয়ে যাওয়ার মাঝে হারিয়েও কিছু তো কম যায়নি। এই তো কিছু বছর আগেও সকাল সন্ধ্যা কিম্বা ছুটির দিনগুলো ভরে থাকত অনুরোধের আসর কিম্বা ফৌজি ভাইদের জন্য বাজানো গান দিয়ে। আধঘন্টা অন্তর অন্তর দেশ দুনিয়ার ‘আপডেট’ মিলত বিশেষ বিশেষ সংবাদে। কৃষিকাজের খবরাখবর ছাড়াও আবহাওয়া, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষত নাটকের শ্রোতা ছিল সবচাইতে বেশি।
ছোট পকেট সাইজ ট্রানজিস্টার হোক অথবা ঢাউস আকারের রেডিও, সেটা নিয়েই রমরমা আসর বসত পাড়ার ঠাকুর দালানে, ছেলে ছোকরার ‘ঠেকে’। ‘নব’ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট স্টেশন খোঁজার মধ্যে এক অদ্ভুত আমেজ লুকিয়ে থাকত তখন। কাঁটাগুলো একটু এদিক ওদিক হলেই নানা রকম শব্দ, গান, কথা মিলেমিশে একাকার। তবু বিরক্তির ছাপ ছিল না চোখে মুখে।
রেডিও’র কদর সবচাইতে বেশি লক্ষ্য করা যেত মহালয়া ও ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচে। বিশ্বকাপ হলে তো কথাই নেই। মহালয়ার আগের দিন বাজার থেকে নতুন ব্যাটারি কেনা ছিল অবশ্যিক কাজ যাতে কোনোমতেই ভোরের সেই আমেজ নষ্ট না হয়। সাড়ে চারটে বাজতে না বাজতেই প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বিখ্যাত সেই গলার আওয়াজ ভেসে আসত, ’আশ্বিনের শারদ প্রাতে’, আহ্ ! সে সব এখন কোথায় ? পাতলা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে মাথার বালিশের পাশে রাখা রেডিও থেকে ভেসে আসা সুমিষ্ট স্বরের সেই প্রভাতি গানগুলো আধা ঘুমন্ত, আধা জাগরণ অবস্থায় শুনতে শুনতে কী যে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে চলে যেত সকলে তা কোনো শব্দেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
খেলার দিনগুলোতে ছোট্ট রেডিওকে ঘিরে বসে থাকত উৎসাহী বেশ কিছু মানুষ। ইষ্টবেঙ্গল- মোহনবাগান ম্যাচে অথবা বিশ্বকাপের খেলাগুলোতে নিজের ভাষায় ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে পড়ত সকলে। এখনকার বড় এল ই ডি’র স্ক্রিনের সামনে বসলেও সেই দিনের স্মৃতি ভোলার নয়।
ইদানিং অবশ্য রেডিও-ট্রানজিস্টারের গালভরা নামকরণ করা হয়েছে এফ. এম। হরেক চ্যানেল, হরেক রকম তার অনুষ্ঠান। বেজেই চলছে সকাল থেকে মাঝ-রাত। থামাথামি নেই মোটেও। কিন্তু সেই আমেজ আজ কোথায় ?
অনুরোধের আসরগুলোর মজাই ছিল আলাদা। ঘোষকের মুখে নিজের নাম শোনাটা ছিল জীবনের অন্যতম ভালোলাগা। ঘোষক যখন বলে উঠত, এখন শুনবেন আশা ভোঁসলের কন্ঠে অমুক গানটি, এবং এই গানটি শুনতে চেয়ে অনুরোধ পাঠিয়েছেন জলপাইগুড়ি থেকে পিউ, পঙ্কজ, সোমা, তুলি কোচবিহার থেকে রানা, বিনতা, আলি, শান্তিপুর থেকে সুব্রত, রমেন এমন আরও অনেকের নাম… অনুরোধকারীরা যেন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠত। এখন অবশ্য ঘোষক শব্দটাও কোনঠাসা হয়ে পড়েছে, বদলে এসেছে রেডিও জকি, সংক্ষেপে আর জে। সেই সঙ্গে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে একসময়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী, জৌলুশহীন, তার ছাড়া ম্যাটম্যাটে যন্ত্রটা। টেবল থেকে আলমারি, ঘরের তাক পেরিয়ে রেডিও রাখার জন্য এখন একটা আস্ত বাড়িও কম পড়ে যায়, তাই অবশেষে তার ঠাঁই হয় ভাঙাচোরার দোকানগুলোতে।
আমাদের আধুনিক হওয়ার পথে আমরা ফেলতে ফেলতে যাই অনেক কিছু। যে পথ দিয়ে হেঁটে যাই, ফিরে আসা হয়না আর সে পথেও। তাই হয়ত ফেলে যাওয়া কোনো মহার্ঘ্য বস্তুই আর কুড়িয়ে নিতে পারি না, ফিরিয়ে আনতে পারি না আমাদের যাপনে। যা রেখে যাই তা চিরকালীন, জুড়ে নিতে পারি না জীবনের সঙ্গে। তাই তো চোখের নিমেষে পোস্ট কার্ড, টেলিগ্রাফ, সাদা কালো টিভি অথবা অ্যান্টেনা, মাটির কুঁজোর ঠান্ডা জল, গল্পের বই ইত্যাদি অনেক কিছুর মতোই রেডিওটাও কিভাবে যেন হারিয়ে গেল।
তবু আজও কখনো কখনো পুরোনো কিছু মানুষের মুখে মুখে ফেরে রেডিওর সেই সোনালি অতীত। মহালয়ার আগের দিন খোঁজ পড়ে চিলেকোঠায় রেখে আসা নষ্ট রেডিওটার। ভোর ভোর ঘুম ভাঙলে দূর থেকে ভেসে আসে চিরচেনা সানাইয়ের আওয়াজ আর একটা গমগমে গলার স্বর।
এই যে ‘‘পুরানো সেই দিনের কথা, সে কি ভোলা যায় ? ”
শাঁওলি দে, শিক্ষিকা (জি. এইচ জুনিয়র হাই স্কুল, দেওয়ানগঞ্জ, কোচবিহার)