আমি বাড়ি ফিরিনি।। রাজাদিত্য ব্যানার্জী
পাঠপ্রতিক্রিয়া রূপকথা বসু
এখানে অনেক রাতে ঘুম ভেঙে যায়। কোথা থেকে ভেসে আসে শিস্-এর শব্দ। তীক্ষ্ণ শিস্ জানলার শার্সি ভেদ করে ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতর। অন্ধকার ঘরে খেলা করে বেড়ায়। ঠিক যেন মনের ভেতর টুকরো চাঁদের আলো। এ যেন এক অন্য মেলানকোলি আলো। মন খারাপের ভেতর উজ্জ্বল মোমের উষ্ণতা।
দুঃখের মেঘ পেড়িয়ে ছেলেটি ছবি আঁকতে চেয়েছিল উড়ন্ত ফিনিক্স পাখির …
আসলে হয়তো বোঝাতে চেয়েছিল… ‘কতগুলো শূন্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকলে/ বুঝতে পারবে আমি হারিয়ে গেছি?’
এরপর জেগে উঠতে হয়। স্লাইডিং কাঁচ সরাতেই হু হু করে সামুদ্রিক বাতাস ঢুকে পড়ে। আড়মোড়া ভেঙে সময় তখন তিনটে। এখানে কেউ যুদ্ধ লড়তে চায়নি। অথবা নিজের ছায়ার সঙ্গে লড়তে লড়তে একদিন বলেও ফেলেছে সে… ‘আমি একটা যুদ্ধ লড়ছি।/ বলছি না কাউকে সমর্থন করতে/ শুধু বলছি ভেবে দ্যাখো একটা মানুষকে কেন যুদ্ধ লড়তে হয়?’ সত্যিই তো তাই, আমরা প্রত্যেকেই এক একটা যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিক। সময়ের চক্রব্যুহে শুধুমাত্র লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশনের মুখোমুখি হচ্ছি।
একবার কোথাও পড়েছিলাম, ‘আমি’ যেন বাইরের পৃথিবীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছি, যাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। এই ‘আমি’ এসেই যত গণ্ডগোলের সূত্রপাত।
ঠিক যেভাবে সে বোঝাতে চেয়েছে ‘আমি বাড়ি ফিরিনি/অপেক্ষা করোনি তুমি/ অথচ দ্যাখো প্রতিদিন নিয়ম মেনে অপেক্ষা করে চলেছে একফালি অন্ধকার’। একটা বোবা টানেলের সামনে দাঁড়িয়ে এরপর নিজেকেই প্রশ্ন করতে হয়… এই ‘আমি’টাই কি তবে সব কিছুর কারণ।
একজন লেখকের কাজ মাতৃভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এক গুরু দায়ীত্ব থাকে কাঁধের ওপর। শব্দের মধ্য দিয়ে জাগাতে হয় আশার সঞ্চার। তারপরও অনেক কাজ বাকি থেকে যায়। একজন লেখককে সমস্ত রাষ্ট্র এবং ধর্মের উর্ধ্বে উঠে মানুষ হতে হয়। আর এখানেই আটকে যান অনেকেই। কিন্তু কারো কারোর লেখায় সেই আভাস পাওয়া যায়।
এভাবেই জানান দিতে হয়- ‘অন্ধকারকে আলো দেখায় লন্ঠন ধরা কাগজকুড়ানি রমা/ ছেলে বলে আমাকে দুনিয়ায় না এনে একফালি মার্স চকলেট আনতে পারতিস তো’।
যে জীবন বয়ে চলেছে চারপাশে, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে যে জীবন, তার ভিতরমহলে সাঁতার কেটে চলতে চলতে একসময় হাফিয়ে উঠতে হয়। সে লেখে ‘পারমাণবিক পৃথিবীর আকাশে/ তৃতীয় বিশ্বের ফ্যান বনবন করে ঘুরছে/ ঘুরেই চলেছে’। একটা নিরপেক্ষ দূরত্ব তৈরি হয় সামনে, একটা সুরক্ষাবলয়, শান্ত-নির্বিরোধী জীবনে তখন দাঁড়িয়ে থাকে উলম্ব ভঙ্গিতে।
ছেলেটি সরল বাক্যে জানতে চায় ‘মেঘ তোমার দেশ কোথায়?’ আস্তিনে লুকিয়ে থাকা সেই ম্যাজিক তাস সে তুলে রাখে ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’ নামের কবিতার বইতে।
আমরা চিনতে পারি তাঁকে। লেখকের মেলানকোলি সময়ের ভেতর হেঁটে হেঁটে ফিরি শব্দের রাজপথে। ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করি, ‘আড়াল কেনা যাবে কিছুটা?’ জলে ডুব দেওয়া শামুকের গভীরতা আমরা মানুষেরা অর্জন করতে পারব না ঠিকই, কিন্তু শব্দের ভেতর একটা ফড়িং-এর এসে বসা উপলব্ধি করতে পারি। সেই ছেলেটার মতো বলতে পারি ‘সারাটা জীবন আমি কী যেন একটা খুজেছি/ গুগলে সার্চ করলে পেয়ে যাব?’ ক্রমশ এপিটাফ লিখে রাখি জীবদ্দশা’তেই।
একজন লেখকের সবসময়ের ধর্ম গোষ্ঠীবদ্ধতাকে এড়িয়ে চলা। এই একার সন্ন্যাসীই গোষ্ঠীচক্ষুকে আড়াল করে মাঠ-সুন্দর-ঘাস-শহরের মেলানকোলি সুর এঁকে যেতে পারেন তার কবিতায়।
বারবার বলে ফেলতে হয় এভাবে ‘দূরে চলে গেলে বুঝি কাছে আসা যায় না?’ হয়ত যায়। অথবা আলোকবর্ষ দূরে এক নেবুলার ভেতর তীব্র অপেক্ষা হয়ে কাটাতে হয় সময়।
কেবলই অতিক্রমণের এক অঃনিশেষ উড়ালের নাম হয়ে ওঠে কবিতা গুলো। যার ভাষাগুলোই এই উড়ালের একমাত্র বাহন। ব্যাঞ্জনাই বাহন। এই ব্যাঞ্জনাই তার শ্রেষ্ঠ জ্বালানি। ‘পৃথিবীটা তো আমাদের হবার কথা ছিল/ হলুদ পোস্ট ইট নোটে ৩৪৬৭তম ভুলটা লিখে রাখলাম’।
সেই আড়াল সাধকের জন্য প্রতীক্ষাই এই গদ্যের উপসংহার হয়ে উঠুক আর একটা ভিসুভিয়াস নিশ্চিন্তে ঘুমোক দু-চোখ বুজে…
‘বৃষ্টি পড়ে না এখানে
ঝরে পড়ে ব্রহ্মান্ডের মতো ব্যর্থতাগুলো
তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম সবাই এখানে ঘুমোয়’
পাঠপ্রতিক্রিয়া রাজাদিত্য ব্যানার্জি’র ‘আমি বাড়ি ফিরিনি’
বইটি প্রকাশিত হয়েছে ধানসিঁড়ি প্রকাশনী থেকে। প্রচ্ছদে ‘প্লাবন দাস’
বইটি পাওয়া যাচ্ছে ‘কলেজস্ট্রিট-এ ‘ধানসিঁড়ি বইঘর, দে’জ, ধ্যানবিন্দু’তে