গল্প।। আলু পোস্ত।। সৈকত ঘোষ

আজ মন ভালো নেই টুম্পার। মনের আর দোষ কি, পুজোর কদিনও যদি অফিস করতে হয় কার ভালো লাগে! কিন্তু ভালো না লাগার মতোও কিছু হয়নি। এই বাইশ বছরের জীবনে এটাই তো চেয়েছিল টুম্পা। এই কাজটা তো ওর জন্য শুধু কাজ নয় এটা ওর ভালোবাসা প্লাস প্যাশন। ছোটোবেলা থেকেই প্রচুর বকবক করতে ভালোবাসে, ইভেন স্কুলে বন্ধুরা ওকে বাচাল খেপি বলেই রাগাতো। অবশ্য এগুলোই হিয়ার ইন্সপিরেশন, কোথাও গিয়ে ভেতর ভেতর একটা জেদও তৈরি হয়েছিল এখান থেকেই। আর তারপর জীবন যেভাবে নিয়ে গেছে ওকে। ঝড় ঝঞ্ঝা তো কম সামলাতে হয়নি। ছোটো বয়সে বাবার চলে যাওয়া, হঠাৎ করে অনেকটা ম্যাচিওর করে দিয়েছিল। বাড়ির টুকিটাকি কাজ থেকে বাজার ব্যাংক সবকিছুই করতে হতো ওকে। তখন সবে কলেজ শেষ হয়েছে, কাজের খুব প্রয়োজন। বাবার যেটুকু সেভিংস ছিল সেই দিয়ে আর কতদিনই বা চলে…অফিস থেকে যেটুকু টাকা পেয়েছিল তার সুদেই মায়ের ওষুধ ওর পড়াশুনা সংসার খরচা। সুতরাং কাজটা খুবই দরকার ছিল টুম্পার।

ফাইনালি বকবক করার একটা প্ল্যাটফর্ম জুটে গেল। মাস গেলে মাইনেটাও খুব একটা কম নয়। কলকাতা শহরে ডাল ভাত আলু-পোস্ত দিব্বি হয়ে যায় সঙ্গে দু’চারটে স্টাইলিশ জামাকাপড় লিপস্টিক কবিতার বই। তাহলে জীবনের কাছে আর কি বা চাওয়ার থাকতে পারে একটা এই বয়সের মেয়ের…কবিতা টুম্পার জন্য মনখারাপের ওষুধ। সেরকম লিখতে না পারলেও পড়তে ভালোবাসে টুম্পা। ভাস্কর চক্রবর্তীর পাগল ফ্যান।
প্রেম? সেটাও কলেজ থেকে দিব্বি চলছিল প্রাঞ্জলের সাথে। একটু আধটু ঝগড়া-ঝাটি যে হয় না তা নয়, তবে সেটা তো একটা সুস্থ রিলেশনশিপের পার্ট। রেডিওতে বকবক করতে হেব্বি লাগে টুম্পার, বেশ একটা স্বপ্ন পূরণের গল্প। ডিএলএফে ওদের স্টুডিওর ন’তলার জানলা দিয়ে কলকাতাটাকে ছবির মতো মনে হয়। টুম্পা মনে মনে ভাবে একটা শহরের মধ্যে কতগুলো শহর, একটা মানুষের মধ্যে কতগুলো মানুষ। মাঝেমাঝে নিজের মধ্যেই নিজেকে খোঁজে। এই খোঁজটাই ওর অক্সিজেন।

আপনারা শুনছেন রেডিও টুয়েন্টি ফোর সেভেন আর আমি টুম্পা আপনাদের সঙ্গে। আজ মহাপঞ্চমী, ভিড় জ্যাম ধোঁয়া শহরটা সেজে উঠেছে পুজোর রঙে, কিন্তু এই খুশির দিনেও যাদের সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে তাদের মনখারাপ। ন্যাচারালি তোমাদের এই মনখারাপটাকেই একটু স্পাইসি করে দিতে আজকে একটা গেম খেলবো। হ্যাঁ, যারা এখনও কোনও হুকআপ প্ল্যান করে উঠতে পারোনি তারা চটপট আমাকে ডায়াল করো আর বলে ফেল তোমাদের সুপ্ত ইচ্ছের কথা, যে কথা কাউকে বলতে পারোনি এখনও। একজন লাকি কলার পেয়ে যাবে ড্রিমগার্ল মুভির কাপল পাস, তাহলে একটু ডেয়ারিং হয়ে যাক…ততক্ষণ শুনতে থাকো ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড মুভি থেকে ‘দো পেগ মার অর ভুল যা’ গানটি।

সন্ধে সাতটা বাজে এখন। প্রাঞ্জলকে একটা টেক্সট করে টুম্পা। আটটায় শো শেষ করে অফিস থেকে বেরোতে আরও মিনিট দশ। সাড়ে আটটায় সল্টলেক, ক্যাফে সিক্সটিফোর। তারপর দশটা অবদি চুটিয়ে প্রেম। প্রাঞ্জল গিটার বাজায় গান লেখে মাস্টার্স করছে কিন্তু পড়াশুনায় মন নেই। ট্যালেন্টেড কিন্তু পুরো ঘেঁটে থাকা, টুম্পার মতো সর্টেড নয়। বড়লোক বাবা মার একমাত্র ছেলে, আর তাই ক্রাইসিস কাকে বলে সেটা জানে না প্রাঞ্জল। প্রথম প্রথম খুব চেঁচামেচি করতো, এখন এসব নিয়ে বলা ছেড়ে দিয়েছে টুম্পা। মানুষ ততদিন পর্যন্ত নিজেকে চিনতে পারে না যতদিন না সে একটা ধাক্কা খায়। টুম্পা জানে এভাবে বলে কিছুই হবে না, সময় এলে ঠিক রিয়ালাইজ করবে প্রাঞ্জল। সময়ের চেয়ে বড়ো শিক্ষক আর কে আছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই একের পর এক টুটা দিল হট লাইনে হাজির। তবে সবার গল্পই মোটামুটি এক। সেই ঘিসা পিটা বলিউড লাভস্টোরির মতো। কোনও ভেরিয়েশন নেই। টুম্পা ডিয়ার জিন্দেগি থেকে পরের গানটা চালিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। প্রাঞ্জলকে একটা রিপ্লাই দেয়। তারপর একটা সিগারেট ধরায় আনমনে। সন্ধের আকাশটার মধ্যে একটা অদ্ভুত রহস্য আছে, এই আকাশটাই তো ওর ভুবনডাঙার মাঠ। ছোটোবেলায় দিদুন বাড়ি গেলে দুপুরে জমিয়ে টকডাল আর আলু পোস্ত, কি দারুণ রান্না করতো দিদুন। দিদুনকে খুব মিস করে টুম্পা, দিদুনের হাতের আলু পোস্তকেও। সেই স্বাদ এখনও মুখে লেগে। এসব ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে টুম্পার।
-টুম্পা, তুমি না পারফর্মার। তোমাকে ইমোশনাল হলে মানায়! নিজেই নিজেকে বোঝায়, তারপর চোখ মুছে সোজা হটসিটে। এই চেয়ারটাতে বসলে এক নিমেষে পৃথিবীর বাকি সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়। রাগ দুঃখ মনখারাপ কিছুই যেন স্পর্শ করতে পারে না। সত্যিই চেয়ারটা ম্যাজিকাল। মনে মনে ভাবে এটাই হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা।
-দিল থাম কে বৈইঠিয়ে মেহেরবান কিউ কি আব ইন্তেজার কি ঘড়ি খতম। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পেয়ে যাবো আজকের বিজেতাকে। তবে তার আগে শুনে নেব পোস্ত সিনেমা থেকে অনুপম রায়ের গলায় একটা একদম অন্যরকম গান।

টুম্পা ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। এই লাল ক্যানভাস ব্যাগটাই ওর ছোটোখাটো পৃথিবী। একবার বেরোনোর আগে ওয়াশরুম যেতে হবে। ঘড়ি বলছে সাতটা সাতান্ন। হালকা করে লিপস্টিক আর আইলাইনারটা লাগিয়ে নেয়। টুম্পার সাজুগুজু বলতে এটুকুই। হটসিটে বসে ফাইনাল টাচ দিয়ে আজকের মতো ড্রিমগার্লকে তার লাকি উইনারের কাছে পৌঁছে দিলেই গল্প শেষ। তারপর পরের আরজে মহুয়াদিকে ডিউটি হ্যান্ডওভার করে ছুটি। তবে পুজোর এই কদিন কলকাতায় যা জ্যাম। তার ওপর এতগুলো রাস্তা ওয়ানওয়ে করে দিয়েছে, হুজ্জুতের আর শেষ নেই। অফিস থেকে বেরিয়ে প্রাঞ্জলকে একটা কল করে টুম্পা।


-হুম, এই বেরোলাম। দেখি অটো ধরবো…কি বলছিস তুই বাইক নিয়ে আসছিস… পেট্রোল পাম্পের কাছে পৌঁছে গেছিস। ওকে, তার মানে আর ম্যাক্স পাঁচ মিনিট। তাহলে রাস্তার অপোজিটে দাঁড়াচ্ছি।
ফোনটা কেটে একটা সিগারেট ধরায় টুম্পা। মনের মধ্যে দিদুনের আলু পোস্ত ঘুরঘুর করছে। মাকে ফোনটা করতে গিয়েও কেটে দেয়। কিছুতেই মাকে এসব বলতে পারে না।
-কিরে ছোটো হাতি…প্রাঞ্জলের ডাকে সম্বিৎ ফেরে টুম্পার। কিছু কথা বলে না, সোজা বাইকের পেছনে উঠে বসে।
-মুড খিঁচড়ে আছে মনে হচ্ছে, কি হয়েছে? আর ইউ অল রাইট?
-না, তেমন কিছু নয়, এমনিই। কথাগুলো বলতে গিয়েও ঢোক গিলে নেয় টুম্পা। প্রাঞ্জল তো এসব ইমোশন বুঝবে না, বেকার খিল্লি ওড়াবে। মুখে বলে, পুজোর দিন কাজ করতে হলে এরকমই হয় বুঝলি তো।
-চিল ইয়ার, এবার তো আমার সঙ্গে আছিস। আমার বাইকে বসলে তো তোর মন ভালো হয়ে যায়। ওয়েট, আমার পকেটে চকলেট আছে। নে…
মনে আছে কলেজের দিনগুলো। বাইকেই তো কলকাতার ঠাকুর দেখতাম আমরা। কাকিমা কি রেগে যেত, তুই রাত করে ফিরতিস বলে।


এবার প্রাঞ্জলকে থামিয়ে দিয়ে হেসে ওঠে টুম্পা।
-এখন মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে না, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বলে কথা। প্রাঞ্জল ঈষৎ বাঁকা হেসে কথাগুলো ছুঁড়ে দেয় টুম্পার দিকে।
টুম্পা প্রাঞ্জলের এই ইঙ্গিতগুলো বোঝে, কিন্তু চুপ করে থাকে। কিছু বললেই আবার ঝগড়া। এখন আর অশান্তি ভালো লাগে না।
ক্যাফে সিক্সটি ফোরের সামনে বাইকটা দাঁড় করায় প্রাঞ্জল। দুজনে হাত ধরে ক্যাফেতে ঢোকে। দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ আর ক্যাপুচিনো অর্ডার করে প্রাঞ্জল।
-তো বল, কি ভাবছিস…
টুম্পার গালটা আলতো করে টিপে দেয় প্রাঞ্জল।
-না রে তেমন কিছু না। খুব ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে। মনটা কেমন সমুদ্র সমুদ্র করছে।
-দেখ, এবার তো সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আমার শো। আর তোর যা অফিস! তোরও ছুটির বালাই নেই। লক্ষ্মীপুজোর আগে নো-ওয়ে। স্যান্ডউইচে কামড় দিতে দিতে শুকনো গলায় বলে প্রাঞ্জল।
তার চেয়ে চল, আজকেই রাজারহাটের দিক থেকে একটু বাইক রাইড করে আসি। একটু ফ্রেশ এয়ার নিলে মনটা ভালো লাগবে। সাড়ে দশটার মধ্যেই তোকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব।
-ওকে দেন চল। টুম্পা রাজি হয়ে যায়।

নটা কুড়িতে ক্যাফে থেকে বেরোয় দুজনে। বাইকের পেছনে বসে প্রাঞ্জলকে জাপটে ধরে টুম্পা। রাজারহাটের এই রাস্তাটা একদম অন্যরকম। এক ঝটকায় মনে হয় চেনা কলকাতাকে টাটা-বাইবাই করে বিদেশে চলে এসেছে। টুম্পা প্রাঞ্জলের ঘাড়ে একটা চুমু খায়।
-জানিস, হয়তো এই জন্যই তোকে এত ভালোবাসি। তোর এই পাগলামিগুলোর মধ্যে একটা সেই ব্যাপার আছে। জানিস, ভালোবাসার সত্যিই কোনও ডেফিনেশন হয় না। এই মুহূর্ত কোলাজগুলোই হয়তো ভালোবাসা।
-তুই না সত্যিই, পারিস ও বটে। এই জন্যই তোকে বলি শুধু আরজে হলে চলবে না এবার বরং কবিতাটাও লেখ। লোকজন পাগল হয়ে যাবে।
-লোকজন এমনিই আমার বকবক শুনতে শুনতে পাগল হয়ে যায়। কোনদিন দেখবো তুইও ফুড়ুৎ হয়ে গেছিস…প্রাঞ্জলের মাথায় এক চাঁটি মেরে বলে টুম্পা।

 

বাড়ি ঢুকতে পৌনে এগারোটা বেজে যায়। না, অবহাওয়া মোটামুটি শান্তই আছে। ইদানিং লেট হলেও মা আর তেমন কিছু বলে না। ইউজটু হয়ে গেছে ব্যাপারটা।
-কিরে, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার বাড়ছি। নির্লিপ্ত ভাবে কথাগুলো বলে মা রান্নাঘরে চলে যায়।
টুম্পা টাওয়ালটা নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। নিজের এই ভাসা ভাসা চোখ দুটোকে খুব ভালোবাসে টুম্পা। কোথাও গিয়ে কবিতার মতো মনে হয়। ছোটোবেলায় সবাই বলত ওর চোখ দুটো দিদুনের মতো। সোজা ডাইনিংয়ে এসে চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে। মা যত্ন করে ভাত বেড়ে দেন, সঙ্গে টুম্পার প্রিয় টকডাল আলু পোস্ত। খেতে খেতে চোখে জল এসে যায়। মা পেছনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। এই টকডাল আলু পোস্তর মধ্যে এক অদ্ভুত বাঙালিয়ানা আছে, মায়ের হাতের জাদু আছে, ভালোবাসা আছে। মায়েরা হয়তো সব বোঝেন। মনে মনে মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। মুখে কিছু বলতে পারে না টুম্পা, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পাতের আলু পোস্তটার দিকে…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page