বাবা’কে লেখা চিঠি ও অন্যান্য

মার্ডার (এম. এ নুহমান)

গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি
গৌতমকে (বুদ্ধ) পুলিশ গুলি করে মেরেছে।
সেই পুলিশ, যারা আইনের রক্ষক।
তার শরীরটা অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে
জাফনা লাইব্রেরির সিঁড়িতে।

‘এ তো আমাদের লিস্টে ছিল না!
একে কেন মারলে তোমরা?’
প্রশাসন থেকে জিজ্ঞেস করা হলে উত্তর আসে
‘নাহ্, আসলে একে না মারলে
আমরা একটা মাছিও মারতে পারতাম না!’
প্রশাসন থেকে উত্তর আসে,
‘ঠিক আছে তাহলে, একে লুকিয়ে ফেলো।’

সশস্ত্র জঙ্গিরা জাফনা লাইব্রেরির সিঁড়িতে ফেলে
প্রায় নব্বই হাজার বইয়ের সাথে
পুড়িয়ে দিলো বুদ্ধের শরীরটা।

আমরা হতাশ হয়ে দেখলাম,
ধম্মপদের সাথে সাথে গৌতমের শরীরটাও পুড়ে
ছাই হয়ে গেল।

আপনার ভবিষ্যতও এরকম হতে পারে (এম এ নুহমান)

আপনি সিনেমা হল অথবা বিচ থেকে ফিরছেন
হঠাৎ একটা রাইফেল থেকে গুলির আওয়াজ,
বুটের আওয়াজে চারদিক থমকে গেছে।
আপনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছেন রক্তাক্ত অবস্থায়।

হাতে একটা ছুরি অথবা একটা বন্দুক ধরিয়ে
আপনাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা দেওয়া হবে, আর
কেউ কোনো প্রশ্ন করার সাহস পাবে না।

হঠাৎ চারিদিকে হিমশীতল নীরবতা নেমে আসে,
কিন্তু,
মানুষের মনের গভীরে একটু একটু করে
রাগ জমতে থাকে।

তারা এবং তুমি (এম এ নুহমান)

তারা একদিন জিপে করে এসে
তদন্তের জন্য তোমাকে নিয়ে যায়।
চিৎকার করে তোমার মা কাঁদে
অসহায় আর্তনাদে ফেটে পড়ে চারদিক।

তারপর সেই মা যখন তাদের কাছে গিয়ে
তোমার কথা জিজ্ঞেস করে,
তারা অস্বীকার করে।

এদিকে তোমার ছিন্ন ভিন্ন দেহ, ভাঙাচোরা হাড়
রক্ত মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

এখন তোমার পালা, তোমার সময় এসে গেছে…

তুমি খালি পায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে
তদন্তের জন্য আমার দরজায় কড়া নাড়লে,
আমাকে নিয়ে গেলে জিজ্ঞাসাবাদের নামে।

আমার মা কাঁদলো
অসহায় ভাবে লুটিয়ে পড়লো।

যখন সে তোমার কাছে আমার খোঁজ করতে গেল
তুমিও আগের মতোই অস্বীকার করলে।

এদিকে তখন আমারও ছিন্ন ভিন্ন শরীর
ভাঙাচোরা হাড়…
শরীর থেকে একটু একটু করে রক্ত
মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

বাবাকে লেখা চিঠি (এম জাবির)

(শান্তি চুক্তি লঙ্ঘন করে ২০০২ তে শ্রীলঙ্কায় বাত্তিকোল্লা সেক্টরে এলটিটিই জঙ্গিরা নৃশংস ভাবে একটি পরিবার এবং তার প্রতিবেশীদের মেরে ফেললে পরিবারের বেঁচে যাওয়া একটি ছেলের তার বাবাকে লেখা চিঠি / কবিতা)

 

বাবা,
আমার আজও মনে আছে
যে বৃহস্পতিবারে আমরা তোমাকে হারিয়েছিলাম

বাবা,
যখন আজও তোমার হাসি
তোমার কঠোর পরিশ্রমের কথা ভাবি
মনটা আজও হাহাকার করে ওঠে।

ওরা তোমার সাথে কী করেছিল বাবা?
তোমাকে কী গুলি করেছিল? নাকি
শরীরটা টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিল!
মাথায় রডের বাড়ি মেরে ওরা কী
পাশবিক আনন্দে মেতে উঠেছিল!

বাবা,
তোমার তৈরি ছিপ দিয়ে এখনও মাছ ধরি,
আমাদের পাতে এখনও তার গন্ধ লেগে আছে।

মা আর ছোট ছোট ভাইগুলো
এখনও তোমার কথা ভেবে কান্নাকাটি করে,

আজওয়ার্দ, খলিল, আবু সালে, মহম্মদ হুসেইন
যারা তোমার সাথে হারিয়ে গেছিল
তাদের জানিও গোটা গ্রাম তাদের কথা ভাবে
ভাই মোবারককে আমার সালাম জানিও
ওকে জানিও ওর বাচ্চারা ভালো আছে
কুফা মসজিদ আজও ওর কথা ভেবে কাঁদে

সবাইকে জানিও, গ্রামটা খুব অন্ধকারে আছে
কারণ তাদের স্ত্রীরা এখন ইদ্দা পালন করছে।

বাবা,
এখন আমি স্বপ্নে মাঝেমধ্যেই দেখি
তুমি এসব পার করে স্বর্গের পথে এগিয়ে চলেছ।

এক নাবালক সৈনিক (চেরান)

(এলটিটিই -র দ্বারা অপহৃত হওয়ার সময় চেরান মাত্র ১৫ বছর বয়সী ছিলেন। তিনি দু’বছর পরে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পালিয়ে এসেছিলেন।)

 

সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে
একদল যুদ্ধবাজ কুকুরের হাতে আমি
একদিন ধরা পড়েছিলাম।

তারা আমার সব বইপত্র ছিঁড়ে দেয়,
আমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে
আমার মাথা কামিয়ে দেওয়া হয়।

আমার হাতে বন্দুক ধরিয়ে দেওয়া হয়
বলা হয়,
‘যাও! দেশের জন্য যুদ্ধ করো
দেশের সেবা করো।’

আমাকে কথাটা শুনতে হয়েছিল
না শুনলে,
আমাকে মেরে ফেলা হতো।

আমি এটাকেই আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছিলাম
আমার ভাগ্য,
শুকনো রক্তের ধুলোয় মাছির ভনভন
কিছুটা করুণা আর কিছুটা সহানুভূতি
যা হয়তো কয়েকজনের কাছেই থাকে।

এই সবকিছুই খুব নিষ্ঠুর…

আর এখন
অজানা এক যুদ্ধক্ষেত্রে একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে
আমি শুধু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি।

চাঁদের প্রতি এক শরণার্থী কবির কিছু কথা (সোলাইকিল্লি)

চাঁদ
আমি আজ আর কবিতা লিখবো না

এই অস্থায়ী বাড়িতে
আমার নিজস্ব কোনও দরজা নেই
নেই কোনো গাছগাছালি, ফুলের সুবাস

তোমার আলো বারান্দায় এসে পড়লে ভাবি
এ বুঝি অন্য কোনও জগতের থেকে আসছে।
এই আলো যদিও একরকম নয় কিন্তু
আমাকে কষ্ট দেয়।

গত তিন দিন ধরে আমি শরণার্থীর মতো ঘুরছি
আর এর মধ্য দিয়ে কিছু কবিতা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে

যারা আমার বাড়ি দেখেছে, তারা জানে
এর একটা দিক ভেঙে পড়েছে
যে ফুলের গাছগুলো আমার পছন্দ ছিল
সেগুলো ষাঁড়ের পেটে চলে গেছে
গোবর হতে।

এখানে আমার নিজস্ব কোনও আকাশ নেই
যে বাতাসে আমি শ্বাস নেই
সেটাও অন্যের মনে হয়।

চাঁদ,
আমি কীভাবে লিখবো কবিতা বলো!
যখন আমি অসহায় ভাবে ন’ লাখ তারা হারিয়েছি।
যদিও জানতে ইচ্ছে করে
সেই সব ধূর্তদের কী হলো!
তবে সত্যিই তুমি আর আকাশের মাঝে
আমার ইচ্ছেদের হারিয়ে ফেলেছি।

চাঁদ
মেঘের আড়ালে তোমার মুখটা লুকিয়ে রাখো…
কারণ, কবি যদি দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
এরকম ঠাণ্ডা মেঘ এমনিই জড়ো হয়ে যাবে।

কৃষ্ণান্তি (ভিনোথিনী)

(কবিতাটি ১৯৯৬ সালে জাফনার একটি সেন্ট্রি পয়েন্টে স্কুল পড়ুয়া মেয়ে কৃষ্ণান্তীকে ধর্ষণ ও হত্যার একটি বহুল প্রচারিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিনোথিনীর লেখা।)

দিন শেষে পাখিদের শেষ ডাকের সাথে সাথে
সূর্য ডুবে গেলে সমুদ্রের সাদা বালির উপর
মেয়েটা মারা গেল।
যদিও এ সম্পর্কে কেউই কিছু জানতো না…

একটা মেয়ে হয়ে জন্মানোর সময়
সে জানতোও না তার এই পরিণতি হবে।
নাহ্, তার মা’ও ভাবেনি কখনও।

যখন বর্বর হাতগুলো তার শরীরটা ছুঁয়েছিল
তাদের চেহারাগুলো তাকে কাঁটার মতো বিঁধেছে।
অজ্ঞান শরীরটাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বারবার,
কোনও আওয়াজ করতে পারেনি মেয়েটা।

কোনো প্রতিবাদ নেই,
নেই কোনো পালাবার পথ…
নোনা সাদা বালির বিছানায় শেষ ঘুমে
নিষ্পাপ শরীরটা।

যখন তার জন্ম হয়,
সে কী সত্যিই এরকম পরিণতির কথা ভেবেছিল?

 

অরুণাভ চট্টোপাধ্যায়

 

এই সিরিজের কবিতাগুলি একটি নির্দিষ্ট সময়ের কথা বলে। এমন একটি সময় যা আমরা পেরিয়ে এসেছি। শ্রীলঙ্কা’র গৃহযুদ্ধ, এল.টি.টি.ই’র উত্থান, অন্ধকার সময় এবং  তৎকালীন কবিদের প্রতিবাদের কলম … শুধু এই সময়টাকে ধরতেই সব মিলিয়েই এই অনুবাদের সিরিজটার জন্ম। 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page