বাদল সরকার || নাট্য দর্শন
শুভদীপ সাহা
বাঙালীর শেষ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন থিয়েটার ব্যক্তিত্বের কথা উঠলে, যাঁর নাম প্রথমেই উঠে আসে, তিনি সুধীন্দ্র সরকার, যার পরিচিতি মূলত বাদল সরকার (Badal Sircar) নামেই। গতানুগতিক থিয়েটারের পথ ও প্রথা ভেঙে তিনি এগিয়েছিলেন এক অন্যধারার থিয়েটারের খোঁজে। বলা বাহুল্য, পরীক্ষানিরীক্ষার পথ হিসেবে এই প্রথাকে বেছে নিলেও শুধুমাত্র পরীক্ষানিরীক্ষার স্তরেই তাকে আবদ্ধ রাখেননি, নতুন এই পথের কার্য-কারণ বিশ্লেষণ করেছেন ; কেন এই অন্যধারার থিয়েটারের প্রয়োজনীয়তা আছে তার পিছনে যুক্তিসম্মত কারণ দর্শিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য, অন্যধারার এই থিয়েটার তথা থার্ড থিয়েটারের পিছনে নাট্য দর্শন আধুনিক নাটকের রূপ অনেকটাই পালটে দিয়েছে।
থার্ড থিয়েটার নিয়ে আলোচনা করতে বসলে প্রথমেই উঠে আসে, থিয়েটার শব্দটি। সার্বিকভাবে না হলেও, থিয়েটার বললেই আমাদের অধিকাংশের মনে যে ছবি প্রতীয়মান হয়, তা হ’ল, এক বিরাট ঘর, যেখানে একটি অংশ উঁচু (মঞ্চ), সেদিকে মুখ করে রাখা কিছু চেয়ার (প্রেক্ষাগৃহ)। ঘরের মধ্যে যা কিছু সব ‘খেলা’ তা হবে ওই মঞ্চের উপরেই, দর্শকরা বসবেন ওই চেয়ারে, নির্দিষ্ট আসনে। প্রতিটি চেয়ারের মূল্য নির্ধারিত। যত বেশী টাকা আপনি দিতে পারবেন, ‘খেলা’ বা ‘ঘটনা’ আপনি তত কাছ থেকে দেখতে পারবেন। যত আলো, তা ওই মঞ্চ তাক করেই। নির্দিষ্ট সময়ে প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার হয়ে যাবে। আপনাকে ওই অন্ধকারে নিজের অস্ত্বিত্ব যথাসম্ভব গোপন করে থাকতে হবে। কারণ আপনি এই ঘটনার বা খেলার অংশ নন। যারা অংশ, তাঁরা ওই মঞ্চের ওপরে, আলো মেখে আছেন।
থিয়েটার বললে মোটামুটি এরকম এক কম বেশী দৃশ্য আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। যদিও এইরকম থিয়েটারের বয়েস খুব বেশী নয়। এবারে, স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, ‘এইরকম’ থিয়েটারের বাইরেও তাহলে ‘অন্যরকম’ থিয়েটার আছে কি? হ্যাঁ, আছে। কিন্তু অন্য নামে। আমাদের দেশজ ‘থিয়েটার’ বা ‘ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার’ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাদলবাবু এই দেশজ থিয়েটারকে অভিহিত করছেন ‘ফোক থিয়েটার’ নামে)। যেহেতু ‘থিয়েটার’ এক বিদেশী শব্দ, তাই সেই সম্পর্কিত ধারণাও সেখান থেকেই আমদানী করা। এর বাইরে, ঘটনা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে যদি আমরা আমাদের দেশজ সংস্কৃতির দিকে চোখ রাখি, দেখতে পাবো, তামাশা (মহারাষ্ট্র), ভাওয়াই (গুজরাট), যক্ষগান (কর্ণাটক), কথাকলি (কেরল), থেরুকুটু (তামিলনাড়ু), নৌটঙ্কি বা রামলীলা (উত্তরপ্রদেশ), যা বললে আমাদের ধারণার ‘থিয়েটার’ ফুটে ওঠে না। যা ফুটে ওঠে, তা বিবিধ এবং এর সাথে যুক্ত হয় নানান সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে rituals. এই ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার বা লোকনাট্যের সাথে ‘আধুনিক’ মঞ্চ থিয়েটারের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন বাদল সরকার। বিদেশী থিয়েটারকে দেশজ ছাঁচে ফেলে এই ‘থার্ড থিয়েটার’-এর প্রবর্তন করেছিলেন।
ঠিক কী কারণে প্রয়োজন হ’ল এই থার্ড থিয়েটারের?
প্রশ্নাতীতভাবে থিয়েটার হ’ল এক জীবন্ত কলামাধ্যম, ‘লাইভ শো’। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনার ধারাবিবরণী দেওয়ার প্রয়োজন যদি হ’ত, তাহলে এই সময়ে এসে উন্নতমানের ক্যামেরায় তা বন্দী করে ‘সিনেমা’ format-এই দেখানো যেত। সেখানে, যেভাবে দর্শক অন্ধকারে থেকে, কোনোরকম ভূমিকা না নিয়েই। বরং আরও স্পষ্ট করে বললে, নিজেদের অস্ত্বিত্বকে লুকিয়ে রেখে উপস্থিত থাকে, সেভাবেই তাঁরা থাকতে পারতেন। কিন্তু, থিয়েটারের মূল শর্তই হ’ল, এখন, এখানে। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে একটা ঘটনা এখানে ‘তৈরি’ হ’ল। দর্শক যদি নিজের অস্ত্বিত্ব ‘লুকিয়ে’ রাখার তাগিদ অনুভব করে তাহলে সে ঘটনার প্রত্যক্ষ কোনো ছাপ তার ওপর পড়বে না। এই মানবিক ক্রিয়া বা human action-এর অভাব প্রবলভাবে লক্ষ করা যাবে যদি দর্শকরা নিজেরাই অনুভব করেন এবং অন্যকে করাতে সচেষ্ট হন যে তাঁরা সেখানে উপস্থিত নন – সেই ঘটনার অংশ নন, অর্থাৎ যে বাস্তব, সেখান থেকে দূরে সরে এসে এক কল্পনার জগত তৈরী করা, এবং ‘Illusion of reality’-র মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ থিয়েটারকে চালিত করা। অর্থাৎ, থিয়েটারের মূল শর্ত, ‘বাস্তবতা’র থেকেই সরে আসা এখানে।
তাহলে, ঠিক কীভাবে এই ইলিউশন ভেঙে দেওয়া যায়?
যদি, দর্শকরা নিজেদেরকে ওই থিয়েটার পরিসরে নিজেদের ব্রাত্য মনে না করেন। যদি নিজেদেরকে অন্ধকারে ‘লুকিয়ে’ রাখার তাগিদ অনুভব না করেন এবং মূল ঘটনার যত কাছাকাছি, শারীরিক এবং মানসিকভাবে নিজেরা থাকতে পারেন, রাখতে পারেন তাহলেই এই ইলিউশন ইমেজ ভাঙা সম্ভব।
অর্থাৎ, দর্শকদের জন্য আলাদা করে অন্ধকার জায়গা তৈরি না করা। মূল ঘটনার জন্য যদি আলো বরাদ্দ থাকে সেই আলোর ব্যাপ্তিতেই তাঁরা থাকুন। তাঁরা থাকুন, মূল ঘটনার তিনদিকে (ডাইনে-বাঁয়ে এবং সামনে), তাহলে সুবিধে যা হবে মূল ঘটনার অনেকটা কাছাকাছি তাঁরা থাকবেন, শুধু একদিকে (সামনে) জায়গা বরাদ্দ হলে একদম পিছনে যে দর্শক থাকবেন, অনেকসময় মূল ঘটনাক্ষেত্র থেকে অনেকটাই দূরে তিনি অবস্থান করবেন।
আমাদের এইটুকু আলোচনার ক্ষেত্রে এসে আমরা দেখতে পারি, আমাদের তথাকথিত ভাবনার যে ‘থিয়েটার’, যে সম্পর্কে আমরা শুরুতে আলোচনা করেছিলাম, গঠনগত দিক থেকে বাদল সরকার এখন অনেকটাই দূরে সরে এসেছেন। এই যে ফর্ম্যাটের কথা বাদলবাবু বললেন, সেটির জন্য আলাদা কোনো ঘরের প্রয়োজন নেই (যেখানে মঞ্চ আর প্রেক্ষাগৃহ থাকবে), প্রকৃতির সাহচর্যে, পর্যাপ্ত খোলা জায়গায় ‘থিয়েটার’ সম্ভব। অঙ্গন তার ক্ষেত্র, অঙ্গনমঞ্চ।বেশ। একটা দিক ভাঙা গেল। ইলিউশন ভাঙছি আমরা দর্শকের দিক থেকে। কিন্তু অভিনয় পরিসরে? খোলা মাঠের মধ্যে যদি ঘটনার ‘প্রয়োজনেই’ একটা জঙ্গল বা ঘরের অন্দরমহল-এর প্রয়োজন হয়, এবং আমরা সেটাকে ‘তৈরী’ করি, তাহলে কি সেটা আমাদের প্রাথমিক সেই ইলিউশানের জায়গাতেই নিয়ে যাচ্ছে না? অতএব, সেই ইলিউশান ‘ভাঙতে’ এখানে আমাদের নির্ভর করতে হবে দর্শকের কল্পনাশক্তির ওপর। ধরে নিই এখানে একটা জঙ্গল আছে, বা নদী বা ঘর। কোনো পর্দায় সেটি মোটামুটি এঁকে সেটাকে টাঙিয়ে রাখলাম সেই অংশটুকু বোঝাতে। লক্ষণীয়, এখানে দর্শক কিন্তু তাঁর কল্পনাশক্তির মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অবচেতনেই সরাসরি ‘যোগদান’ করছেন এই অঙ্গনমঞ্চে।
অর্থাৎ প্রাথমিক বাধা-নিয়ম কাটিয়ে অঙ্গনমঞ্চ অনেকাংশে ‘মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। নানারকম নিয়মের ক্ষেত্র থেকে বের হয়ে এসে সে নিজেই নিজের একটা নিয়ম তৈরি করছে। ‘মুক্ত’ কথাটা অবশ্য দু’রকম ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। বাদল সরকার বলছেন, “ইংরেজি ‘ফ্রী‘ কথাটার মানে মুক্ত। আবার বেচা–কেনার ভিত্তিতে গঠিত আমাদের এই সমাজব্যবস্থায় ‘ফ্রী‘ কথাটার আর একটা মানে তৈরী হয়েছে, প্রচলিত ভাষায় যাকে বলে ‘মাগনা‘, অর্থাৎ যা পেতে গেলে বিনিময়ে কিছু দিতে হয় না। বর্তমান ব্যবস্থায় এমন বস্তু বেশি বাকি নেই। বাতাস, সূর্যের আলো, বৃষ্টির জল এরকম কিছু বস্তু এখনো ফ্রী আছে, কতদিন থাকবে জানি না।”
‘মুক্ত’ শব্দের প্রকাশ যখন এলই, তখন এই ফাঁকে ব’লে নেওয়া যাক, বাদল সরকারের নাট্যদর্শনের ভিত্তিতেই এই থার্ড থিয়েটার দু’রকমভাবে প্রকাশ পেল। এক, অঙ্গনমঞ্চ। যার সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে আলোচনা করেছি – করছি। দ্বিতীয়, মুক্তমঞ্চ। এ নিয়ে বিবিধ মতান্তর থাকলেও, বাদল সরকার এই বিষয়টা স্পষ্ট করেছিলেন। ধরা যাক, এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে আমরা স্থান নির্বাচন করছি (কোনো মাঠ), সেখানে আমরা বিষয় নির্বাচন করছি (কোন নাটক/নাটকের ভাবনা), সেই খোলা মাঠের কাছাকাছি যারা আছেন তাঁরা কেউ কেউ উপস্থিত হচ্ছেন, কেউ আগ্রহে, কেউ কৌতূহলে, কেউ বা নিছক মজা দেখার জন্য। কিন্তু, ঠিক যে কারণে, প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চ ছেড়ে অঙ্গনমঞ্চে প্রবেশ, সেই ক্ষেত্রও তো তাহলে অনেকসময় ফলপ্রসূ হচ্ছে না। একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমাদের মঞ্চ-প্রেক্ষাগৃহে এমন নাটকের অভাব নেই যেখানে অর্থনৈতিকভাবে নীচু শ্রেণীর ওপর অত্যাচারের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। বিবৃত হয়েছে অত্যাচারী মানুষদের কথা। অথচ, তাৎপর্যপূর্ণভাবে, নীচু শ্রেণির মানুষদের ওপর এই অত্যাচার দেখানো হয়েছে যে প্রেক্ষাগৃহে, সেখানে প্রবেশের জন্য নির্ধারিত কাঞ্চনমূল্য দেবার ক্ষমতা, সেই শ্রেণীর মানুষটির নেই। ফলে অত্যাচারী শ্রেনীর মানুষই দেখছেন তাঁদের অত্যাচারের কাহিনী। প্রহসন ! একেই তো ব’লে সভ্যতা!
‘থার্ড থিয়েটার’ যখন মাঠে ঘাটে নিয়ে এলো সেই কাহিনী, সেখানেও কি মানুষ পৌঁছোতে পারছেন তাঁদের কাছে? নির্দিষ্ট দিনগুজরানের খুঁদকুড়ো জুটিয়ে, ‘থিয়েটার’ বাতুলতা তাঁদের কাছে। বিনোদন তাঁদের কাছে। বাদল সরকার বললেন, মানুষ যদি থিয়েটারের কাছে পৌঁছোতে না পারে, থিয়েটারকেই পৌঁছোতে হবে মানুষের কাছে। ফলে, সেই জনবসতি অঞ্চলে, হয়তো আগাম ঠিক করে দেওয়া নেই, রাস্তার ধারে জায়গা পেয়ে, মুহূর্তের ইশারাটুকুকে সঞ্চয় ক’রে, হঠাৎ শুরু করে দেওয়া। ক্রমশ নিতান্ত কৌতূহলে মানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত ভিড়।
মুক্তমঞ্চ।
আমাদের মনে করিয়ে দেয় দেশজ ভানুমতীর খেল।
অর্থাৎ দেখা গেল, থিয়েটারের গঠনগত দিক থেকে আমরা যাত্রা বা আমাদের দেশজ নানা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সাযুজ্য পাচ্ছি। তাহলে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতেই পারে, আমাদের আদি ‘যাত্রা’ বা লোকনাট্য কী দোষ করল যে সেই প্রেক্ষিত থেকে সরে এসে নতুনধারার থিয়েটার করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল !
এর মূল কারণ বিষয়বস্তু।
লোকনাট্য বা যাত্রার ক্ষেত্রে প্রথমত বিষয়বস্তু ‘সমকালীন’ নয়। পুরোনো পালাগান এবং সেই ফর্ম্যাটই সেখানে সম্বল। দ্বিতীয়ত, সেখানে অভিনয় এবং বিষয় নির্বাচন ‘চড়া দাগের’ বা ‘অতিনাটকীয়’, বাস্তব থেকে অকারণেই তার দূরত্ব। বিষয়ের সাথে দর্শকের সহজেই মিলে যাওয়ার পক্ষে যা ছিল এক অন্তরায়। এখানে আমরা পাচ্ছি নাট্যকার বাদল সরকারকে, যিনি খুব সচেতনভাবেই ‘হাসির নাটক’কে লঘুভাবে দেখেননি। সিরিয়াস নাটকের মতোই হাসির নাটককে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর লেখা নাটকে হিউমারের খোঁজ আমরা পাচ্ছি, তিনি জানেন শুধুমাত্র বিষয় দিয়ে এক মুক্ত ক্ষেত্রে, যেখানে মনোযোগ সরে যাওয়ার হাজারো উপাদান মজুত আছে, সেখানে ‘কৌতূহলী, মজা দেখতে আসা’ মানুষকে থিয়েটারের দিকে মনোযোগী করে রাখা অসম্ভব। সেখানে নাটককার বাদল সরকারের এক অন্য সত্ত্বাকে আমরা পাচ্ছি। ‘ডায়লগ’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে উৎকর্ষতা, এক অন্য পথের সূচনা করছে। ডায়লগের দিক থেকে যদি দেখি (পাঠ হিসেবে), খুব ছোটো ছোটো মুভমেন্টের মাধ্যমে বাদলবাবু তাঁর বক্তব্য পেশ করছেন। এবং পুরো সময়টা জুড়ে এক প্রয়োজনীয় অস্বস্তিতে রাখছেন দর্শক/পাঠককে। বলা বাহুল্য, এই অস্বস্তি নাটকের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরাসরি বক্তব্য পেশের মাধ্যমে যে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক (যে ক্ষেত্র যাত্রায় অনেকাংশেই প্রতীয়মান), নাটককার বাদল সরকার তুলে আনছেন এই নতুন এক ক্ষেত্র। উদাহরণস্বরূপ তুলে আনছি বাকি ইতিহাসের একটি অংশ।
…………………………….
শরদিন্দু : তুমি আত্মহত্যা করলে কেন সীতানাথ?
সীতানাথ : তুমি আত্মহত্যা করোনি কেন শরদিন্দু?
শরদিন্দু : (স্তম্ভিত) আমি? আমি আত্মহত্যা কেন করবো?
সীতানাথ : কেন করবে না? যুক্তি দাও।
শরদিন্দু : যুক্তি? এ তো সহজ যুক্তি। বাঁচতে চাই বলে।
সীতানাথ : কেন বাঁচতে চাও?
শরদিন্দু : কেন বাঁচতে চাই? বাঁচতে কে না চায়?
সীতানাথ : অনেকেই চায় না।
শরদিন্দু : কে বললো চায় না?
সীতানাথ : কে বললো চায়?
শরদিন্দু : যদি না চায় তো বেঁচে আছে কেন? আত্মহত্যা করছে না কেন—তোমার মতো?
সীতানাথ : বেঁচে নেই। আত্মহত্যা করছে। হয়তো আমার মতো নয়।
শরদিন্দু : তার মানে?
সীতানাথ : তার মানে তারা গলায় ফাঁসি দিয়ে ঝুলছে না। কাপড়ে কেরোসিন ঢেলে জ্বলছে না। কোমরে পাথর বেঁধে ডুবছে না। তারা নিঃশব্দে নীরবে বাঁচা বন্ধ করে বসে আছে।
শরদিন্দু : এ কথার কোনো অর্থ হয় না।
সীতানাথ : কোন্ কথার অর্থ হয় – বলো, শুনি।
শরদিন্দু : মানুষ হয় বাঁচবে, না হয় মরবে!
সীতানাথ : অর্থপূর্ণ কথা বলেছো। খাঁটি কথা বলেছো। সেইজন্যেই আমি মরেছি।
শরদিন্দু : সেইজন্যে মরেছো?
সীতানাথ : সেইজন্যে মরেছি। মানুষ হয় বাঁচবে, না হয় মরবে। কথাটা অর্থপূর্ণ, যেহেতু যুক্তিসঙ্গত। এই যুক্তির সিদ্ধান্ত কী?
শরদিন্দু : কী?
সীতানাথ : সিদ্ধান্ত—যদি বাঁচা না যায়, তবে মরো।
শরদিন্দু : বাঁচা যাবে না কেন?
সীতানাথ : কেন, তুমি বলো?
শরদিন্দু : আমি কী বলবো? আমি তো বেঁচে আছি।
[ সীতানাথ শুধু হাসিমুখে চেয়ে রইলো। যেন মজার কথা বলেছে শরদিন্দু।
(অধৈর্য স্বরে) আমি তো বেঁচে আছি!
সীতানাথ : (স্নিগ্ধকণ্ঠে) তুমি আত্মহত্যা করোনি কেন শরদিন্দু?
শরদিন্দু : (প্রবল প্রতিবাদে) কেন করবো?
সীতানাথ : কেন করবে না শরদিন্দু?
শরদিন্দু : আমি—আমার স্ত্রী আছে!
সীতানাথ : আমারও স্ত্রী ছিল!
শরদিন্দু : বন্ধুবান্ধব আছে!
সীতানাথ : আমারও ছিল।
শরদিন্দু: আমার চাকরি আছে! কাজ আছে!
সীতানাথ : আমারও চাকরি ছিল। কাজ ছিল।
শরদিন্দু : (চিৎকার করে) কিন্তু তুমি আত্মহত্যা করেছো!
সীতানাথ : (স্নিগ্ধকণ্ঠে) আর তুমি আত্মহত্যা করোনি। কেন করোনি শরদিন্দু?
শরদিন্দু : (ক্রুদ্ধ অস্বীকারে) আমার বাঁচতে ভালো লাগে, তাই করিনি!
[সীতানাথের মুখের হাসি আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। চোখের দৃষ্টিতে, ওষ্ঠাধরের বক্রতায় একটা গভীর অশ্রদ্ধা ফুটে উঠলো ক্রমে।] (দুর্বল স্বরে) আমার বাঁচতে ভালো লাগে :
সীতানাথ : (চূড়ান্ত অশ্রদ্ধায়) মিথ্যেবাদী। প্রবঞ্চক। কাপুরুষ।
শরদিন্দু : আমি— কাপুরুষ?
সীতানাথ : (রূঢ় তর্জনে) চুপ করো।
…………………………….
যারা পড়েছেন ‘বাকি ইতিহাস’ আর যারা পড়েননি, সবার জন্য আমার একটা কৌতূহলী প্রশ্ন। আমি যে অংশটা তুলে দিয়েছি, খেয়াল ক’রে দেখবেন, এটা নাটকের মাঝের একটা অংশ। শুরুর অনেক পরের। শেষের অনেক আগের। নতুন যারা পড়ছেন, ঠিক এই মুহূর্তে তাঁরা জানেন না শরদিন্দু বা সীতানাথকে, তাঁদের ইতিহাস বা চরিত্র কিছুই জানেন না। কিন্তু, পড়তে কোথাও অস্বস্তি হ’ল কি? নিজেদের অনেক ক্ষেত্রের দৈনন্দিনতার সাথে মিলে যাচ্ছে না কি? বাদল সরকার তাঁর থার্ড থিয়েটার তৈরী করছেন এভাবেই। যেভাবে এইটুকু অংশই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ, পথের ধারে চলতি অভিনয়ের মাঝে, মাঝপথে স্রেফ ঢুঁ মারতে আসা এক দর্শকও বেমানান নন ওই ভিড়ে। এখানেই থার্ড থিয়েটারের, বাদলবাবুর দর্শনের সার্থকতা।
নাটকের বিষয়বস্তুকে মুখ্য করে শুধু সেই বিষয়ে আবদ্ধ না থেকে এক দর্শন তুলে আনছেন বাদলবাবু, একইসাথে সেটিকে প্রচলিত পদ্ধতি থেকে মুক্ত করে। আর আমরা একইসাথে তাঁর লেখায় অ্যাবসার্ড নাটকের পাশাপাশি পাচ্ছি হাসির নাটকও। যে ক্ষেত্রটিকে তিনি লঘু করে তো দেখছেনই না, বরং বলছেন, ‘কবিকাহিনী’র ভূমিকায়, হাসির নাটকের জাত নীচু ব’লে আমি মনে করি না। তিনি বলছেন, মানুষ চরম দুঃখে হাসতে পারে, চূড়ান্ত ট্র্যাজেডিও হাসি দিয়ে ফোটাতে পারে।
বাদলবাবুর দেখানো পথ, এই থার্ড থিয়েটার, তাঁর ভাবনা কতটা ‘আধুনিক’ সে বিচার করার ক্ষমতা আমার নেই। নাটক এক অভিঘাত তৈরী করে – তৈরী করার ক্ষমতা রাখে, প্রত্যাশা থিয়েটারের কাছে। এই অভিঘাতের প্রেক্ষিত কোনো একটি ঘটনার মোড়কে মূল বিষয়ে পৌঁছোনোর প্রত্যাশী। প্রতিদিন নিত্যনতুন ঘটনার আবহে খবর তৈরী হয়। অনেক খবরের ভিড়ে মোড়ক পালটে যায় দ্রুত। ‘রাঙতায় মোড়া আমাদের যুগের অসুখ’ ! একজন শিল্পীর কাজ সাংবাদিকের মতো, সময়টাকে কামড়ে ধরা। শিল্পের নানা ক্ষেত্রে, এই সময়, কামড়ে ধরার কাজ দ্রুত করতে হয়, সময়ের তাগিদেই। আজ যে ক্ষত টাটকা, সময় তাতে প্রলেপ দেবেই। শিল্পীকে সেই সময়ের মধ্যে ধরতে হবে সেই ক্ষতকে – কার্য-কারণ বিশ্লেষণের তাগিদে। কবিতা বা গান যত সহজে দ্রুততায় তৈরী হ’তে পারে, নাটক বা থিয়েটারের ক্ষেত্রে সেই দ্রুততা অসম্ভব, গঠনগত কারণেই। আর গঠনগত অংশ যত জটিল হবে, সময় থেকে তত দূরে সরে যাওয়া।
থার্ড থিয়েটার আমাদের সেই জায়গাটা দেয়, খুব কম উপকরণে, সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করার। যেহেতু এখানে বিশাল পরিমাণ টাকা যুক্ত নয়, তাই নানারকম এক্সপেরিমেন্ট / এক্সপ্লোরেশন সহজেই ভাবা যায়। মঞ্চ থিয়েটারের ক্ষেত্রে যেহেতু দর্শক আসছেন (বলা ভালো নিয়ে আসা হচ্ছে) টাকার বিনিময়ে, সেখানে দর্শকের ‘মনোরঞ্জন’ করা এক মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
থার্ড থিয়েটারে টাকার দাপট নেই বলেই, ‘finest’ বা ‘perfect’ শো দেখানোর ‘চাপ’ থাকে না। মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই নানা ক্ষেত্রের কাজ নির্দিষ্ট থাকে। তিনি তাঁর সেই কাজে প্রফেশনাল। যিনি নাটক লিখছেন বা যিনি নির্দেশক বা যিনি অভিনয় করছেন বা যিনি আলো দিচ্ছেন, প্রত্যেকেই। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পুরো নাটকটা গড়ে উঠছে নির্দেশকের ‘মাথায়’। তিনিই ব’লে দিচ্ছেন, কী করতে হবে। সেইমতো হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে অভিনেতা সেই বিষয়ে একাত্ম না হয়েও অভিনয় করে চলেছেন। থার্ড থিয়েটারে অনেকটা ক্ষেত্র থাকে অভিনেতার নিজের ‘ইনপুট’ দেওয়ার।
সামান্য এক দর্শকের ভূমিকা থেকে বলতে পারি, কিছু ঘটনার কথা। লকডাউন পর্বর দ্বিতীয় ভাগ কেটেছে তখন, তখনও তৃতীয়বারের লকডাউনের ইঙ্গিত পেলেও তা সুস্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে চেনা আধুলি, তাঁদের অঙ্গনমঞ্চে নিয়ে এলেন ‘জামলো মকদম’। লকডাউনে হাঁটতে থাকা এক কিশোরীর ঘটনা, যে বাড়ি ফিরতে চায় আর বাড়ির কাছে এসে ‘স্বাভাবিকভাবেই’….. ‘মারা যায়’। এই ঘটনা আমাদের কারোর কারোর কাছে এক যন্ত্রণার অভিঘাত তৈরী ক’রে, অভিঘাত তৈরী ক’রে খামখেয়ালী ক্ষমতার নিষ্ঠুরতার প্রতি। থার্ড থিয়েটার সেই অভিঘাত প্রবল ক’রে তোলে।
কতটা ‘ইনভলভ’ হন দর্শক? কতটা মজে থাকেন একটা ‘আপাত তৈরি করা নকল ঘটনায়’? ২০২১-এর ২৯শে মে মাটিয়ারিতে গঙ্গার পাড়ে জামলো মকদমের শো চলছিল। অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক, লোডশেডিং ! দর্শকদের হাতে হাতে উঠে আসে মোবাইল। মোবাইলের টর্চের আলো তাঁরা ফেলেন অভিনেতাদের দিকে। দর্শকদের আলো-মাধুকরীতে জামলোর সেদিনের পথ চলা শেষ হয়।
শিল্পর প্রতিটি ক্ষেত্রই এক্সপেরিমেন্টের জায়গা। বাদলবাবু শুধু একজন নাট্যকার নন, নাট্যকর্মী দল সংগঠক, অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যতাত্ত্বিকও বটে। লক্ষণীয়, হাতে গোনা কয়েকটি নাটক বাদ দিলে তাঁর অধিকাংশ নাটকই যেমন প্রেক্ষাগৃহে করা সম্ভব, তেমনই মুক্তমঞ্চে করা সম্ভব। বাদলবাবুর নানা ক্ষেত্রের বিচরণ যদি আমরা দেখতে দেখতে যাই, সেখানে দেখতে পাবো এক ক্রমাগত exploration… অণ্বেষণ, খোঁজ। বাদলবাবু তাঁর নানা কাজের মধ্যে দিয়ে আদতে পথ তৈরী করছেন ‘থার্ড থিয়েটারে’রই। এমনকি, যে ঘটনা প্রায় প্রবাদ হয়ে আছে, শুধুমাত্র এই অণ্বেষণের পথে গিয়েই, ‘The Badal Sircar’, তাঁর জীবনের সায়াহ্নে এসে রীতিমতো পরীক্ষা দিয়ে ‘ভর্তি’ হচ্ছেন ট্র্যাডিশনাল ইন্সটিট্যুটে, পড়ছেন তাঁর ‘হাঁটুর বয়সী’ শিক্ষার্থীদের সাথে, যেখানে পাঠ্য হিসেবে আছে বাদল সরকারের লেখা নাটক।
বাদলবাবুর নাট্যদর্শন চলতি হাওয়ার পন্থী নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি যদি খুব ভালোভাবে লক্ষ করা যায়, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আঁটোসাঁটো ক’রে রাখেননি তাঁর গানগুলোকে, অনেকটা ‘ফ্রি স্পেস’ দিয়ে রেখেছেন, যে, যাও বাবা, যদি এক্সপ্লোর করার প্রয়োজন মনে হয়, করো। (খেয়াল করবেন মাননীয় বন্ধুরা, আমি এক্সপ্লোর শব্দটা ব্যবহার করছি, যথেচ্ছাচার নয়)। আমার মনে হয়, বাদল সরকারের থার্ড থিয়েটার সুধীন দত্তের কবিতার মতো, রবীন্দ্রনাথের সুরের মতো বহমান। বাদলবাবু পথ দেখিয়েছেন, চলতি হাওয়ার পন্থী না হয়ে, সেই জায়গাটা রেখে গেছেন। তাই, বাদলবাবু চলে গেলেও, তাঁর তৈরি পথে আমাদের নিত্য যাওয়া আসা…. তাঁর চিরন্তন ভাবনার মধ্যে দিয়ে জন্ম যে থার্ড থিয়েটারের, সেই পথে পথ চলা, সেই অন্বেষণ, যে কোনো থিয়েটার পিপাসু মনকে আলো জুগিয়ে যাবে।