এবং আব্বার গল্প ।। শুভায়ুর রহমান

তেঁতুল গাছের নীচের থামটার একদিকে ঠাঁই বসে। ভাঙাচোরা শরীরটা গত দশ দিন ধরে চলা মসিবতের মধ্যে আরও কাহিল। চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, দু,কয়েসে সমুদ্র সফেন ফেনা উঠেছে। ‘আল্লাহ আল্লাহ’ ডেকে মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস টা মুক্ত করছে। লাগাতার মানুষের আসাযাওয়ার ব্যস্ততা। ম্যাজিস্ট্রেট ভবন চত্বরের বাইরে পিচরাস্তার ওপারে হোটেল কর্মী খরিদ্দার টানছে, ‘ সবজি ভাত, ডিম ভাত, মাছ ভাত, খাসির মাংস।’ মুখে রুচি নাই। আর দু,মুঠো উঠলেও গলার নলি বেয়ে পেটে নামে না। পাছে ম্যাজিস্ট্রেটের লোক এসে খোঁজ করলে যদি দেখতে না পান, সেই আশঙ্কায় মৌলানা বিল্লাল হোসেন ফরাজিও শুকলালকে নিয়ে হোটেল মুখো হন না। গাছের মগডাল থেকে কয়েকটি কাক নেমে সাইকেল শেডে বসে কাগজ ঠোঙার এঁটো নিয়ে গোগ্রাস গেলার অভিপ্রায়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করেছে। সেদিনও এমনই কাক মাথার উপর লড়াই করছিল। কদভানুর ভাবনায় সত্য হল। একাবতের মা বলেছিল, ওগো একাবতের আব্বা দেখো, কাকে হুটোপুটি করছে। আমি ধমক দিয়ে কদভানুকে থামিয়ে দিয়েলাম।’ শুকলালের কথায় মৌলানা বিল্লাল জানান, ‘ সবই আল্লার কুদরত। তাঁর ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তোমার উপর দিয়ে পরীক্ষা করছেন। ‘ ঘাড় নেড়ে দু,হাঁটুর মধ্যে লুঙ্গির ভাঁজে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল শুকলাল। মিনিট দু,ই তিন পর খাঁকি পোষালে অল্পবয়সী এক যুবক এসে খোঁজ করেন,’ শুকলাল মালিত্যা কে আছেন? ‘ ধ্যান ভাঙলো শুকলালের।

দু,তলার কোনের ঘরে মার্বেল বসানো। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের ছবি বাঁধানো। ধবধবে সাদা শার্ট পরিহিত অফিসার। কাঁচ বসানো টেবিলের উপর ফাইল খুলে কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। বাইরে তপ্ত রোদে শরীটা যতটা ছ্যাঁকা খাচ্ছিলো, তার চেয়ে অধিক বেগে হিমেল হয়েছে। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বসতে বললেন। মৌলানা ও শুকলাল গদি আঁটা চেয়ারের হাতলটা টেনে বসলেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের দর্শনে বুকে বল ধরেছে। দিন রাত এক করেছে, মাথা পা ঠুকেছে বেচারা। এ ফোর কাগজে দরখাস্ত লিখে গ্রামের প্রধানকে দিয়ে সই করিয়ে বিডিওর কাছে আবেদন করে৷ সেই মোতাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস হতে খবর যায়। ভরা পৌষের রাত জাঁকিয়ে বসার মতো শুকলালের কাঁপন ধরেছে। ভয় ও টেনশনে আষ্টেপৃষ্টে দিনকে দিন নেতিয়ে যাচ্ছে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, নাম কি?

-স্যার, শুকলাল মালিত্যা, লোকে কয় শুকলাল মালিত্যা বায়োস্কোপওয়ালা।
-ছেলের নাম কি?
-একাবত মালিত্যা।
-কাজকর্ম কি করেন?
-স্যার, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করি। দখিন খাটি মানে বর্ধমানে ধানের সিজিনে খাটতি যাই। আবার গ্রামে পরের ভুঁইয়েও গতর খাটাই। যখন মুনিশ বন্ধ থাকে এগাঁ সেগাঁ বায়োস্কোপ দেখাই।

শুকলালের উত্তরে কৌতুহলী হলেন। সপ্রতিভ ভঙ্গিতে জানতে চাইলেন, এখন বায়োস্কোপ চলে?
-স্যার চলে না বলিই তো এত কিছু করি, যখন যা পাই। আমার বাপ দাদোর এ কাজ। ছাড়তে চাইলে মনটাতে বান ডাকে। বড্ড কষ্ট হয়। তাই মাঝেসাজে ঝাড়পুছ করে বাক্সটারে মাথায় তুলি! কাঁপা গলায় উত্তর দিলো সে। শুকলালের উত্তর পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট খুশি হয়েছে, তা স্যারের চোখমুখ দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না মৌলানার। এবার কাতর অনুনয়ে মৌলানা ঘটনার বিশদ বর্ণনা দিলেন, স্যার আমি শুকলালের বাড়ির পাশের মসজিদে ইমামতি করি। বেচারার খাদে গাড়ি পড়েছে, এ মসিবত থেকে উদ্ধার করতে আপনিই পারেন। হতভাগার আপনিই শেষ ভরসা।’
ভোলাডাঙা গ্রামের নারীপুরুষ, ছোট বড় সকলেই মৌলানাকে মানেন। পনেরো বছর আগে মুর্শিদাবাদ থেকে ভোলাডাঙা গ্রামে আসেন। তখন থেকে টানা ইমামতি করছেন। আর পাঁচটা গ্রামের মানুষের মতোই তিনিও এ গ্রামের মানুষের বিপদে আপদে সঙ্গে থাকেন, একপ্রকার মায়ায় আচ্ছন্ন। আলখাল্লা পোষাক, মুখভর্তি দাড়ি, মাথায় ফেজটুপি, গলায় গামছা প্রিন্টের লালসাদা ওড়নায় শ্যামলা দোহারা গড়ন। ওয়াজ মাহফিলে বক্তৃতায় জাদু মাখিয়ে লোক ধরে রাখেন।
শুকলালের হৃৎপিণ্ডে ধুকপুকানি বেড়েছে। ভিতরটা খুবলে খুবলে হাড় মাংস ফিনকি যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে। চোখের কোণে বিভীষিকাময় মরুভূমির চিকচিক দশা! ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি ঘরটাতে হাতড়াচ্ছে, তার বেশি কিছু বলা হয় না। শুকলালের না বলা মনের খেদ প্রকাশ করেন মৌলানা বিল্লাল হোসেন। ম্যাজিস্ট্রেটের মুখের আদলের পরিবর্তন ঘটে, তিনি আশ্বস্ত করেন, কাগজপত্র আগেই চলেগেছে বিদেশ দফতরে। আজই ফাইনাল রিপোর্ট মেইল করছি, আশা রাখি কয়েক দিনের মধ্যেই কিছু একটা হবে।

সে এক নিদারুণ ব্যাথা, শিরা উপশিরায় প্রবাহিত হতে থাকে। নাইলনের ব্যাগে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড রেখে অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। রাস্তায় চলছে বহু মানুষের মুখ বিচরণ, এত মুখের মধ্যে আপন মুখ খুঁজছে শুকলাল কিন্তু এ সাদৃশ্য তো ঘটার না। চলার পরিধিতে ছন্দ পতন হলে মগজের কার্ণিশ বেয়ে নেমে আসে আদিকালের বুভুক্ষু সময়, যা শান্তি তো দেয় না। উলটে কেড়ে নেয় সুখ, অস্থিরতার আঁতুড়ঘরই কেবল জোটে!

এই উদ্দাম দুনিয়ায় নীলনকশা অনবরত ঘটতেই থাকে। কারও নাগালে থাকে জীবনভর উল্লাসের সমাহার, কারও হাতে যুগের বিন্যাস খোদিত নিয়তির দুর্বল ইস্তাহার! সেই সকল মানুষের ভাগ্যে শ্মশানের ধোঁয়া ও কবরের নিস্তব্ধতা বাঁশপাতায় ঢেকে যাওয়া অন্ধকারের সীমারেখা পার্থিব জগতেই বিচরণ করে। কিন্তু বাঁচার মানে খুঁজে পান না। এমনকি বেঁচে আছেন কিনা তার টের পান না। একদিন বারমাস্যায় এমন বাড়তি ঢেউ ওঠে, সেই ঢেউয়ের তীব্রতা সামলানো অসম্ভব হয়, অবসন্ন মন্ত্র কানেকানে ফিসফাস কথা কয়। শুকলাল ছেলেবেলা থেকে আজ অবধি যতক্ষণ অতিবাহিত করেছে, এইরকম বিপর্যয়ের বিপরীতে প্রথম দাঁড়িয়েছে। পিছোতে পিছোতে দাঁড়াবার জায়গার পরিবর্তে ভাঙনের তীরে পৌঁছেছে! তার বাড়িতে দিন রাত পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। কাঠের বেঞ্চিতে বসে হাজি আবুতালেব চাচা। শুকলালের গায়ে মাথায় হাত বুলোয়। শুকলালকে বুঝ দেন, শুকলাল দুনিয়াদারি করতেই এসেছি, কিন্তু ঠুনকো পুতুলের মতো, সুতো ধরে আজরাইল টান দিলেই নাচ বন্ধ হয়ে যাবে। যিনি দিয়েছেন, তিনি নিয়েছেন। আল্লাহতালা আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, তাঁর নেক বান্দাদের পরীক্ষাতেও ফেলেন। জানমালের উপর পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষায় সকলকেই বসতে হবে বাপ। সবর করো, ধৈর্য ধরো দোয়া দরুদ পড়ো, সওয়াব পাওয়া যাবে। আখেরাতে লাভ হবে।’ আবুতালেব চাচার কথা ফ্যালনা নয়, তিনি আকলিমা চাচিকে নিয়ে দু,বছর আগে হজ্ব জিয়ারত করেছেন। এখন দ্বীনের কাজ করেন। কোরান হাদিস পড়েন। এ পাড়া সে পাড়া এমনকি আশপাশ গাঁ থেকেও ডাক আসে। নসীহত ওয়াজ মাহফিলে ইবাদত বন্দেগীর কাজে মেতে থাকেন। আবুতালেব চাচার কথা শুকলালের মনে ধরে।

বাড়ি থেকে সবাই চলে গেলে, উঠোন থেকে পিঁড়িতে উঠে কদভানুর পাশে বসে। কদভানুর চোখ স্থির হয়ে রয়েছে, লাল শাঁসের উপর তরমুজের বীজ, চোখের পলক ফেলার হেলদোল নেয়। পা দুটো ছড়িয়ে। শুকলাল হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে বুকে টেনে নিল। রোগা শরীরটা কঙ্কালসার রূপ পেয়েছে, হাড়ে মাংস লেপ্টে। কদভানুর মধ্যে চাপা কাঁপুনি অনুভব করলো শুকলাল। কদভানুকে কাঁদতে নিষেধ করে জানায়, নসীবে ছিল এসব। আমরা কি ভেবেছিলাম, ভাবতে পারিনি। কদভানু সবই কপাল। শুললালের বুকে আরও গভীরভাবে মুখ গুঁজে চরম অভিমানই ব্যক্ত করলো, কপাল! ঝাঁটা মারো কপালে’ বলে গলাটা ধরে এলো। চাপা গরম নিঃশ্বাস ছাড়লো শুকলালের বুকে, সেই শুকনো শ্বাস তো আর শ্বাস নয় ইঁটভাঁটার কয়লা আগুন। বুকটাকে পুড়িয়ে দিল, বুকের ছাদে দাউদাউ জ্বলে উঠলো, আগুনে সিদ্ধ হচ্ছে শুকলাল মালিত্যা। ধোঁয়ায় ঝাপসা হচ্ছে চোখ, আরও ঘন চুলের মতো কালো অন্ধকারে শুকলাল হারিয়ে যাচ্ছে ।


এষার আজানে বদনার ওজু পানিতে ভেসে উঠছে, চকচকে মুখ, ঝকঝকে দাঁতে চওড়া হাসি। কত কিছুই মনে আসে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যায় অসময়ের বন্ধু হয়ে, অপেক্ষায় থাকে মা বাপ আত্মীয়স্বজন বাড়ি কড়ি পাটাতন, উঠোন, ঘরের মেঝেতে হামাগুড়ি ছাপ।
রাত নামে। আবার বায়োস্কোপ নিয়ে বের হয় শুকলাল৷ সারাদিন নাংনা, চ্যাঙা, পাটিকাবাড়ি গ্রামের ছেলে মেয়েরা পিছন পিছন ছোটে। বায়োস্কোপের খুপরিতে চোখ রাখে, ক্ষুদিরামের ফাঁসি, পলাশির যুদ্ধ, ভিক্টোরিয়া,, চিড়িয়াখানা, তাজমহল চেখের তারারন্ধে জ্বলজ্বল করে। ঘাম মুছে ছায়ায় কিছুক্ষণ আরাম নিয়ে, দুপুরের পর বার্ণিয়াতে সাপ্তাহিক হাটে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে বায়োস্কোপের বাক্সটা নামায়। পুকুরের পূর্বদিকে খোলা মাঠে সবজি আনাজপাতি, মাছ বিক্রি চলছে। পশ্চিমে পুরনো পোষাকের বাজার তার গা ঘেঁষেই সাজানো পোড়ামাটির থালা, কলসি, হাঁড়ি, সরাই, তাওয়া, পুতুল, ঘোড়া। পুকুরে নিজস্ব স্টাইলেই ডুব দিচ্ছে পানকৌড়ি। রাজহাঁস পালকের রূপকথন মিশছে স্নিগ্ধ কাঁচ পানির বৃত্তাকার তরঙ্গে। বাবলা ডালে বক বসে দখলদারি চালাচ্ছে। কড়ি গাছের ডালে রোদ লেগে ধান রঙা জৌলুস ছড়াচ্ছে। শুকলাল ডান হাতে খঞ্জনি বাজিয়ে বাম হাতে হ্যান্ডেল ঘোরাচ্ছে। মুখে অনর্গল ধারাবিবরণী। তার গায়ে লাল নীল সাদা সবুজ হলুদ রঙের পাটা সিটের জামা, মাথায় লাল টুপি। বাক্সে লেখা, মালিত্যা বায়োস্কোপ। চলছে, পলাশির যুদ্ধ। আসছে, নানির গাঁয়ে মাটির কথা। ‘চলে এসেছে চলে এসেছি। শুরু হবে বাক্সের ভিতর আজব দুনিয়া’। হেঁকে হেঁকে দর্শক টানছে। হাটের মানুষজন ঘিরে ধরেছে। খুপরিতে চারজন চোখে রেখেছে। ধারাবিবরণী দিচ্ছে- চারদিকে সবুজ মাঠ/ তার মাঝে রঙিন হাট/কলাই জমির পর নানির ভিটে/ নলেন গুড়ে পৌষ পিঠে/ উঠোনে চরছে মুরগী দল/ ইঁদুর ধরতে জাঁতিকল/মাটির ঘরে পায়রার বাসা/ ঘরে ফিরছে যত চাষা/রাত নামলো ঘরে ঘরে/ আলো ফিরলো হ্যারিকেনে/ ঘুমপাড়ানি গানে নানির আদর/ গায়ে চড়িয়ে গরম চাদর/ সাঙ্গ হল বাক্স কথা/ এবার আমার ঘরে ফেরা।

একজন দর্শকের সাহায্যে মাথায় তুললো বাক্সটি। সন্ধ্যেই বার্নিয়া বাজারে সরকারি ল্যাম্পপোস্ট জ্বলতে শুরু করেছে। আলোর চারপাশে পোকাদের ঘোরাঘুরি চলছে বস্তুত। নিউ রকমারি স্টোর্সের কাউন্টার থেকে বেরোচ্ছে তাজের আলির মেয়ে শরিফা। তার হাত ধরে আছে একাবত। বলা নেই, কওয়া নেই কোথা থেকে তাজের আলির ভাই ছাবেদ আলি এসে একাবতের গলার টুঁটি চেপে ধরেছে। বাক্স ফেলে একাবতের নাম ধরে চেঁচাতে থাকে। শুকলালের চিৎকারে কদভানু ও তার বোন মেরজান বিবি হাঁউমাঁউ করে উঠে গেছে। থরথর কাঁপছে শুকলাল। সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। উপোষে নিকানো ঠোঁটে অস্ফুট বাক্য বের করলো, জানো বার্নিয়া বাজারে শরিফার সঙ্গে বাপজানরে দেখলাম! ছাবেদ আলি বাপজানের টুঁটি চেপে ধরেছে।’ মেরজান আলো জ্বাললো। আঁচলটা মাথায় টেনে বিড়বিড় করে বললো, ‘রাব্বান্না আফরেগ আ লাইনা সাবরাও ওয়া তাওয়াফফানা মোসলেমীন’। হে মালিক আমাদের সবর করার শক্তি দান করো।’ মেরজান জানে এ আগুন নেভানোর নয়, ঘরে লাগলে পানি ঢেলে নেভানো যায়। কিন্তু মনে আগুন হল তুষের আগুন, ধীক ধীক জ্বলে পুড়ে, অবশিষ্ট থাকে ছাই। শুকলালের মাথায় কদভানুর হাত স্পর্শ করলো। আমি জেগে রয়েছি, তুমি ঘুমাও। কদভানুর কথাশুনে ডানহাতে মাথা রেখে কাত হলো। এ ঘোর অমাবস্যা। রাতের পর যে সকাল আসে সেখানেও রাতের চেয়ে ঘন অন্ধকার। দিন রাত দুইই সমান। স্মৃতি উসকে কাঁটাফোটে জানে লাগে।

দাঁতনটা মুখে নিয়ে পূর্ব দিকে লাল আভায় প্রকৃতির নিষ্ঠুরতাকে খোঁজে শুকলাল। স্বামীর পাশে চুপচাপ কদভানুও এসে দাঁড়ায়। বিলক্ষণ টের পায় স্বামীর মনপুরার গন্ধ কতটা ঝাঁঝালো। অবিকল দেখতে পাচ্ছে। চোখের সামনে খাঁখা খরা মাঠ, অন্তর খাতে আস্ত মরুভূমি! ছেলেটাকে যদি না পাঠানো যেতো। আদিকালের ক্ষয়িষ্ণু প্রতীক্ষায় দিন গুনছে তারা!

ড্রেসিং আয়নায় শরিফা নিজের অবয়ব দেখছে। আঙ্কলেট বিলাসী নেলপালিশে সেজে উঠেছে। নতুন সংসারে পা বাড়াবে। চলছে তোড়জোড়। বাথরুমে টিপটাপ পানি ঝরছে, হেনা মাখানো চুল এখনো ভিজে। মেকাপ সেট, কাজল, আই লাইনারে তামাম সৌন্দর্য কুড়িয়ে অঙ্গে নিচ্ছে। সেই আগের দিনের মতো একাবতের মুখটা মনে আনে না খুব একটা। একাবতকে মনেপ্রাণে আপন করতে চাইলেও বাবা তাজের আলির কথাতে রা কাড়তে পারেনি। উঁচু পদে চাকরি করে ছেলে। এমন পাত্র সহজে জোটে না। তাজের আলির কথায় সম্মতি দিয়ে শরিফা জানিয়েছিল, বাবা আমার মতামত কেন? তুমি যেটা ভালো বুঝবে। প্রথম দিনগুলোর মতো আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে থাকলো। হারিয়ে গেল সব ইচ্ছা।
দুজনের জীবন উদ্যানে ভালোবাসার ফুল বিকশিত হয়। পৃথিবীর শেষ স্টেশনে প্রেমের ট্রেনকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে আবদ্ধ হয় দুজনে। একাবতের হাত ধরে চোখে চোখ রেখে ছিল নুরাই খাঁর আমবাগানের সবুজ গালিচায়। ভুলে থাকতে নয় একসাথে টিকে থাকতে ভালোবাসার ঘুড়ি শূন্যে উড়িয়ে, সম্পর্কের সলতে পাকায় একে অপরকে ছুঁইয়ে। অথচ কোন এক ঝড়ে আলগা হয় বাঁধন। একাবত বলেছিল, সব কিছু ঠিকঠাক না থাকলে, হয়তো মৃত্যুর বাড়িতে দেখা হবে। তখন নিথর দেহ ছাড়া কিছুই পাবে না।’
উচ্চমাধ্যমিকে ফেল করলো একাবত। রোজগারে স্বপ্ন দেখতে থাকলো। জোর জবরদস্তি করে বিদেশ যাওয়ার বায়না ধরলো। বাপের শেষ সম্বল দশ কাঠা জমি বেচে সৌদি আরবে আল মন্টিক কোম্পানির কাজে চলে গেল। মনে ব্যামো ধরলো কাজ ছেড়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করলে ম্যানেজারের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়। পুলিশকে ধরিয়ে দেওয়া হলে ঠাঁই হল জেলে। কিন্তু জেলে যাওয়ার দিন আটেক পরই দুঃসংবাদটা ফোনে জানায় পাঁচখেলার আমোদ সেখের ছেলে ফুরকান সেখ। গ্রামে হইচই শুরু হল। দুঃখে কাতর হয়ে কানাকানি হতে থাকলো। তাহলে কি? শরিফার জন্য? কিন্তু সবই অস্পষ্ট থাকলো।

দুপুরে বাড়ির রোয়াকে শুকলাল মালিত্যা বসে আছে। তাকে ঘিরে রয়েছে মৌলানা বিল্লাল হোসেন সহ বেশ কিছু জন। কদভানু মেরজান ও শুকলালের বোন ফিরোজাকে ঘিরে মহিলারা। একাবতের বহু গল্প মুখে মুখে উঠে আসছে। কষ্টের সংসারের তিন শতক বসত ভিটে ও দশ কাঠা জমিই ছিল ভরসা। একাবত এক রাতে বলেছিল, সৌদি আরবে কাজে যাবো। তিন বছর থাকবো। দেশে ফেরার আগে ওমরাহ হজটা সেরে আসা হবে।’ বিভিন্ন কথা আলোচনা হতে হতে বাড়ির সামনে একটি স্করপিও এসে দাঁড়ালো। ফাইল, ডায়েরি হাতে একজন অফিসার সঙ্গে আরও দুজন ব্যাক্তি। তাদের মধ্যে একজন এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। বিদেশ দফতর থেকে মেইল এসেছে জেলা কালেক্টর অফিসে। সেখান থেকে ব্লক অফিসে। কালই ছেলের দেহ ফিরবে। গাড়ি আসাতে মানুষে গিজগিজ করছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে অফিসার শুনলেন ছেলের বিদেশ যাত্রার কথা। শুকলাল এখন শুকলালে নেই, শোকে পাথর। চোখের পানি শুকিয়ে ছেঁচা খটখটে বিল। ভীষণরকম মগ্নতায় বিধ্বস্ত। অনাহত মুহুর্তে সাদাকালো জীবনটা ভেবে ভেবে ছারখার। মগজের মোড়ে হরেক চিন্তার ট্রাফিক জ্যাম। হাতের তীর একবার ফসকে গেলে ফিরে আসে না। শুকলালের মধ্যে আরেক মানুষ ভর করে খাতাপত্র খুলে বসেছে। কোনভাবেই সহজ মানুষের দিনযাপনে জটিল পাটিগণিত ভিড় করে উত্তর অধরা থাকে। ‘ঘুপচি ঘরেই আজরাইল হাত বাড়িয়ে জোয়ান ছেলেটার জান কবুজ করলো’ কত কি যে বলাবলি চলছে তার হদিস নেই।
আজ পাড়ার লোকজন কাজকর্ম ফেলে ছুটেছে শুকলালের বাড়িতে। মুকছেদ মাষ্টার, একাবতের বন্ধু মসিউর ও হকসাহেব মোট তিনজন ম্যাটাডোর ভাড়া করে দমদম বিমনাবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। ঘরের বাতা ধরে মহিলারা ‘আহ’ শব্দ বলে কষ্ট প্রকাশ করছেন। গিয়াসউদ্দিন, ফজলু, আক্কেল মালিত্যা কবর খুঁড়তে গেছে। কেউ বাঁশ কাটতে ব্যস্ত। ছামাই সেখের বউ তোতা বিবি প্লাস্টিক জগে পানি নিয়ে কদভানুর চোখে মুখে মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, আর কাঁদিস নে, আর কাঁদিস নে। গলা ভেঙে গিয়েচে, দু সপ্তা ধরি কাদচিস। দুয়া কর। মাগফেরাতের জন্য দুয়া কর। বল আল্লাহ আমার ছেলিকে তুমি ভালো রাখো। হাসরের ময়দানে ইজ্জতের সঙ্গে উতরিয়ে দিয়ো। ছেলিকে নেক বান্দা মনে করে বেহেশতের ফুল বাগিচায় জায়গা দিয়ো। ‘
-‘আর পারছি নে। কত সহ্য করব। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন এমন করলো।’
পাশ থেকে মুসুব্বারের মা রাবেয়া শরবতের গ্লাস ধরে খেতে বললো। কোন মতেই রাজি হল না কদভানু।
-‘ অন্তত এক ঢোক নে কদভানু। গলাটা ভিজিয়ি নে মা। আমার কথা শোন মা।’ কদভানুর ভ্রুক্ষেপ নেই।


আসরবাদ ম্যাটাডোরে কফিন বন্দী দেহ ফিরল। ভিড় ঠেলে কফিনের উপর হামলে পড়লো কদভানু, শুকলাল মেরজান। বাক্সে মাথা ঠুকে কাঁদতে থাকলো ওরা। ‘বাপ ওঠ বাপ, ওরে আব্বা কথা বল। তোকে কতবার নিষেধ করলাম সৌদি যাসনি। তুই বাপ কেন গলায় দড়ি দিলি। কোন দুঃখে এ কাজ করলি? তাকিয়ে দেখ কত মানুষ। সবাই আজ আমাদের বাড়িতে তোর আব্বার বায়োস্কোপ দেখতে এসেছে।’ কথাগুলি বলে চললো শুকলাল। কদভানু কাঁদছে, আল্লাহ গতর দিয়েলো, গাঁয়ে খেটে খেলি না কেন? তোর কিসের এত তাড়া ছিল? একবার কারণটা বললি না আব্বাজান, আমাদের মুখ মনে পড়লো না তোর? কেন তুই জেলে গেলি?’ একাবতের আব্বা মায়ের কাঁদনে গাছের পাতাও কাঁদছে। বাতাসে কান্নার প্রতিধ্বনি। শোকের আবহে ঢেকে গেছে মৃত্যু বাড়ি। নিথর দেহের মাথার গোড়ায় খেলে যাচ্ছে আয়াতের লাইন। ধূপ ধোঁয়া মিলিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যে। মসজিদ থেকে খাট এসেছে। মুর্দার গোসল করানো হল। প্রথম দিন পৃথিবীতে আসার লগ্নে যেমন অতি সন্তপর্ণে যত্ন নেওয়া হয়, তেমনি সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে সাদা তিন কাপড় কাফন পরিধান করিয়ে খাটে শোয়ানো হল। মুর্দার চোখে সুরমা, সুগন্ধী ছড়ানো হল৷ কেউ একজন হাত তুলে গোলাপ জল ছড়ালো।

গ্রামের শেষে ডাঙা মাঠে গোরস্থানের গেটে নামানো হল মুর্দার খাট। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে শুকলাল ঘোষণা দিল, আসসালামু আলাইকুম বিদেশে যে নিয়ত নিয়ে গিয়েছিল আমার আব্বাজান। মনের আশা পূরণ হলনা। পরম করুনাময় উঠিয়ে লিয়েছে। অজান্তে কারও যদি ক্ষতি করে থাকে তাহলে নিজগুণে ঘরের ছেলি মনে করে ক্ষমা করে দেবেন। তাছাড়া কোন প্রাপ্য যদি পান আমারে বলবেন শোধ দিয়ে দবো। সে যাতে জান্নাতবাসী হয় তার জন্যি দোয়া করবেন।’। মৌলানা বিল্লাল হাত ধরে শুকলালকে সামনের কাতারে দাঁড় করে দিলেন। জানাযা মোনাজাতে সকলেই হাত তুললেন। মৌলানা জানাযায় দোয়া করলেন, হে পরম দিগার তুমি সবই জানো।, তুমিই বুঝতে পারো আমাদের ভাষা, আমাদের কষ্ট দুঃখ। ভালো থাকা না থাকা, পাওয়া না পাওয়া, সকল হিসেবের মালিক তুমি। আমরা পাপী তাপি বান্দা, অতি নগণ্য, তোমার কাছে হাত উঠিয়েছি। আমাদের শুকলাল ভাইয়ের একমাত্র সন্তান তোমার কাছে ফিরে গিয়েছে, তার গুনাহের খাতা মাপ করে নেকির খাতা পূর্ণ করে দিও। যতদূর গিয়ে পড়ে চোখেরও নজর, প্রশস্ত করে দিও ছেলের কবর। তুমি ছাড়া মাবুদ নাই। কেয়ামতের ময়দানে বিনা কৈফিয়তে বেহেশতবাসী বানিয়ে দিও।

story

গোরস্তানের পশ্চিমে মহানিম, খেজুর, টেঁপাকুল, যগডুমুর উলুখড়,বাঁশ দখল নিয়েছে। মাকাল ফল ঝুলছে যগডুমুর ডালে। পুরনো কবর ধসে ঘুন লাগা বাঁশ দেখা যায়, ইয়া বড় বড় শিয়ালের গর্ত, কোনও কবর ইঁটের গাঁথনি দিয়ে চিহ্নিত করা। নতুন কবরের উপর কাঁটালটে, তেলাকুচা গজিয়েছে। পাঁচিলের গায়ে বাঁশ পাতার ছায়ায় শায়িত থাকলো একাবত। ঘুম আসে ঘুম ভাঙে পূর্ণিমাও রাত জাগে। এভাবেই অনাহারী দিন কাটে রাত কাটে। সপ্তাহ কাটে, কাটে পক্ষকাল। আবুতালেব চাচা, মৌলানা, সামসুল, ইসলামরা সঙ্গ দেয়, শক্ত হতে সাহস জোগায়, এ হল দুনিয়ার নিয়ম। পেট আছে দু, মুঠো মুখে দিতে হবে। আমরা এই আছি এই নেই। আমরা বেঁচে আছি এটা আশ্চর্যের, শ্বাসবায়ু না নেওয়াটা আশ্চর্যের নয়”, এখন বেঁচে আছি এটাই রক্তগোলাপ! তোমার ক্ষত কোন জাদু মলমে সারবে না। তবুও তো রক্ত মাংসে গড়া, বাঁচতে হবে জানান মৌলানা বিল্লাল হোসেন। আবুতালেব চাচাও উপদেশ দেন, কদভানুকে বোঝাবি। ও তো মা, ওর ব্যাথাটা আরও গভীর। তুই গ্রামেই খেটেখুটে খা। দরকারে নতুন করে পালা বাঁধ।’
কদভানুর সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন শহরে গিয়ে ছবি এঁকে রিল বানিয়ে আনলো। এবার নতুন পালা রচনা করলো,- অভাগা বাপ মার এক ব্যাটা ছিল/ বড়লোকের বেটির সাথে পিরীতি হইল/ পড়াশোনায় ছেদ দিয়ে সে বিদেশেতে গেল/ বড়লোকের বেটি তখন ধনী বর পেল/ লাশ হয়ে ব্যাটা ঘরে ফিরিল/ বাপ মার চোখে নদী নামিল/ সেই বাপে এবার নতুন পালা বাঁধিল!
বায়োস্কোপ মাথায় শুকলাল হাঁটছে। গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে অন্যগ্রামে হাঁকাবে। ডাঙা মাঠের কাছে এসে থামলো। গোরস্তানের কড়কড়ে বাঁশ হাওয়ায় হেলেদুলে মসমস শব্দে ঘুঙুর বাজিয়ে নাচছে। আবার হাঁটা শুরু করে শুকলাল। পিছন ফিরে আবার তাকায়। গোরস্তানের পাঁচিল টপকে একাবত লাফ দিয়ে এপারে। রাস্তা ধরে শুকলাল এগিয়ে চলেছে, আব্বার বায়োস্কোপ দেখার অছিলায় পিছন পিছন যেন ছেলেও হাঁটছে।

ইলাস্ট্রেশন- গুগল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page