বল্লভপুরের রূপকথা

বল্লভপুরের রূপকথা: এক অন্য রূপকথার জগতে প্রবেশ

লিখছেন শুভদীপ সাহা 

সেকেণ্ড ডে, ফার্স্ট শো। দেখতে যাওয়ার আগে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিল। একে তো বাদল সরকার, আমার অন্যতম প্রিয় একজন নাট্যকার। যদিও বল্লভপুরের রূপকথা তাঁর ‘ঘরানার’ প্রথম দশটা নাটকের মধ্যে আসবে না। যে ফর্মে আমরা বাদল সরকারকে চিনি, সেই ফর্ম্যাটে বল্লভপুরের রূপকথা পড়ে না। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ তাঁর প্রথম দিকের লেখা নাটক, বিদেশে বসে। তিনি তখনও পথ খুঁজছেন। বলা বাহুল্য, মঞ্চ নাটক, অর্থাৎ অঙ্গন মঞ্চের জন্য ভেবে এ লেখা নয়। এ হেন সময়ে, শুরুর দিকে, তিনি হাত দিলেন বল্লভপুরের রূপকথায় এবং সোনা ফলালেন। নির্মল হাস্যরসের এই নাটকের স্ক্রিপ্টই এক অনাবিল আনন্দ দিতে পারে। যেখানে জোর করে হাসানো নয়, অন্যকে ছোটো ক’রে – নেকনজরে এনে হাসানো নয়।

তবুও, ভয় তাহলে কোন জায়গায়? এক, এই নাটককে সিনেমা করতে হ’লে যদি ‘পাল্টাতে’ হয় এর রসহানি হতে বাধ্য। এমন সরল ছন্দে এর চলন আছে, সেখানে যদি ওস্তাদি মারা হয়, ডুবে যাবে পুরো ব্যাপারটা। দুই, কোর্টরুম ড্রামা। অর্থাৎ, পুরো ঘটনাটা ঘটছে একটা ঘরের মধ্যে, ফলে সিনেমার সেই পাল্টে পাল্টে যাওয়া দৃশ্য যা বোর হ’তে দেয় না, তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। বোরডোম আসতে বাধ্য।

তিন, স্বল্প চরিত্রের উপস্থিতি। মূল চরিত্র আটটি। এদিক সেদিক ক’রে পুরো সিনেমা জুড়ে বারো পনেরোটি চরিত্র। এর মধ্যেই গল্প। ফলে একঘেয়েমি আসার সমূহ সম্ভবনা। চার, অন্ধকারে ঢাকা পুরো সিনেমা। সেখানে অল্প আলো ফেলে চরিত্র দেখিয়ে বড্ড বোকা বোকা ব্যাপার করা (আগে যা হয়ে এসেছে)… পাঁচ, নাটকে একটা প্রচ্ছন্ন হু-ডান-ইট ব্যাপার আছে, কিন্তু অনেকটা বলেও বলছি না ব্যাপার। মানে বুঝিয়ে দেওয়ার সব উপকরণ আছে। কিন্তু আমি তোমায় বলিনি। তুমি বুঝে ফেললে আমার কিছু করার নেই। এবং আরও অনেক কিছু…

বলা বাহুল্য, অনির্বাণ এবং টিম, দুর্দান্ত ভাবে পুরো বিষয়টা সামলেছেন। পুরো নাটকের থীম/গল্প একটুও পাল্টাননি তাঁরা। মূল নাটক অবিকৃত রেখে, এসেন্সটাকে রেখে ক্ষেত্রবিশেষে এক্সটেণ্ড করেছেন, যা গল্পের সূত্রটাকে টেনে নিয়েছে। দুর্দান্তভাবে।

একটা ঘরের মধ্যে, মানে ‘দরবার হল-এ’ এমন সুন্দরভাবে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে এমনভাবে গোটা বিষয়টা দ্যাখানো হয়েছে যে কোর্টরুম ড্রামার বোরডোম আসতে দেননি এই টীম। একই সাথে স্বল্প চরিত্রর উপস্থিতি, কিন্তু প্রতিটা চরিত্রকে এমন যত্নে সাজানো হয়েছে, এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, চরিত্র নির্মাণ এতোটাই যথাযথ যে, একবারের জন্যও খাপছাড়া বা বিরক্তি আসেনি। সবচেয়ে চাপের ছিল এই প্রচ্ছন্ন হু-ডান-ইট ব্যাপারটা। এতো সুন্দরভাবে বলা হয়েছে এটা, ‘গল্প’ বলাটা এতো সুন্দর যে….

অসাধারণ আলোর কাজ। চোখের আরাম দেয় তো বটেই, ভাবায়ও। অবাক করে শমীক হালদারের ক্যামেরার কাজ। একদম শুরুতেই নৌকায় বা একটু পরে রঘুদার চোখ দিয়ে ভূপতিকে প্রথম দেখার দৃশ্যে যে ক্যামেরার কাজ, অনেকদিন মনে থাকবে। এই কাজ টানা চলতে থাকে সিনেমার শেষ অবধি।

এই নাটকের/ গল্পের বড় সম্পদ এর হিউমার। কোণায় কোণায় লুকিয়ে থাকা হিউমার। আর এক সফল প্রত্নত্বাত্ত্বিকের মতোই অনির্বাণ এগুলো খুঁজে খুঁজে ব্যবহার করেছেন। কিছুক্ষণ পরে পরে থমকে থমকে নয়, হিউমারের এই চোরাস্রোত চলতে থাকে অন্তঃসলিলা নদীর মতো…

মিউজিকে নির্ভর করে, কখনও সংলাপে, কখনও অভিনয়ে। সংলাপে অনেকটাই কাজ করে দিয়েছেন বাদল সরকার। কিন্তু সেখানে সুবিধের থেকে অসুবিধে বেশী। যে জায়গাগুলো অনির্বাণ আর তাঁর টীম দায়িত্ব নিয়েছেন সংলাপ যোগ করার, সেই জায়গাগুলো একই লেভেলের এবং সবচেয়ে বড়ো কথা একই ধারার না হ’লে বেমানান হ’ত। একই মানসিকতায় ভর করে সেই দায়িত্ব সামলেছেন তাঁর টীম। অল্প কথায় অনেকটা বলে দেওয়া এবং একইসাথে চারিত্রিক গুণাবলী প্রকাশ করা। যেমন একদম শেষে, “তোমার আপত্তি নেই তো?” এর উত্তরে যে উত্তরটা দেন ভূপতি (সিনেমা এখনও চলছে হল-এ, দেখে নিন, ভালো লাগবে) তা বাদল সরকার লিখে যাননি। অথচ, সেই মননটাকে ধরছে।

এই সিনেমার বড় সম্পদ এর অভিনয়। সত্যম,সুরঙ্গমা,দেবরাজ তো অসাধারণ কিন্তু আমায় প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে শ্যামল চক্রবর্তীর অভিনয়। সিনেমায় এর আগে তাঁকে অভিনয় করতে দেখেছি, দেখেছি মঞ্চেও। কিন্তু তাঁকে এরকমভাবে ‘ব্যবহার’ করা হয়েছে কি? তাঁর এই লেভেলের অভিনয়… এই চরিত্রে আর কাউকে ভাবতে পারছি না। এমন সাবলীল অভিনয়। সবচেয়ে কঠিন বোধহয় ছিল তাঁর জায়গাটা। একচুল এদিক ওদিক সরলেই সেটা ভাঁড়ামো হয়ে যেত। শ্যামলবাবু যা করেছেন তা যারা দেখবেন তারাই জানেন। অভিনয় এবং মিউজিকে দেবরাজ অসাধারণ। দুর্দান্ত মাঝি এবং ওই তিনজন পাওনাদার…

এই সিনেমা বহুবার দেখা যায়। বারবার দেখা যায়। প্রতিটা ফ্রেম মুখস্থ হওয়ার পরও দেখা যায়। তার কারণ ভাবতে বসলে একটাই কথা মাথায় আসে।

অসম্ভব যত্ন নিয়ে এই সিনেমা বানানো হয়েছে। প্রতিটা ফ্রেমে এর যত্নের ছাপ স্পষ্ট। অগোছালোটাও যত্নে সাজানো। দর্শককে অনেকেই বোকা ভাবেন। ভাবেন, যা খুশি করে একটা দিয়ে দিলেই লোকে ঠিক দেখবে, চলে যাবে। আর তারপর যখন চলে না, তখন পাশে দাঁড়ান, হাত ধরুন স্লোগান ওঠে। অথচ, বাংলা ছবিতে এমন যত্নের ছাপ শেষ কবে দেখেছি আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সিনেমায় ইদানীং সিনেমার অংশ কেটে কেটে বানানো ট্রেলার এবং সেখানে মূল উপাদান ঠেসে দেওয়া, তার পুরো উল্টো পথে গেছেন অনির্বাণ। মূল উপাদান অনেক লুকিয়ে রেখেছেন। জানেন, লোকে আসবেই হল-এ।

এখন তো ট্রোল ইণ্ডাস্ট্রি খুব পপুলার। সেই করে নাম করে যায় অনেকে। তাদেরকে দিয়ে সিনেমার প্রচারও করা হয়। গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, ট্রোলাররা এই সিনেমা ছুঁতেও পারবে না। এই সিনেমার প্রতিটা ক্ষেত্রে শিক্ষা এবং রুচির ছাপ স্পষ্ট। বুদ্ধিদীপ্তভাবে এই হাস্যরসের উপস্থাপন এই মুহূর্তে বোধহয় একমাত্র অনির্বাণের ক্ষেত্রেই সম্ভব।

মিউজিক এই ছবির এক বড় সম্পদ। শুরুর এবং শেষের গানদুটো বাদ দিলে, পুরো সিনেমা জুড়ে একটাই গান। সাহানার কণ্ঠে ‘সাজো, সাজাও…’।

দেখতে চাই গো হৃদয় ঘেঁটে… ক’দিন আগে, অনির্বাণের জন্মদিনের দিন, সাহানার গাওয়া ‘সাজো..সাজাও এমন ক’রে’ গানটা প্রথমবার শোনার সুযোগ হয়। কিছু কিছু নির্মাণ আছে, প্রবল অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এই গানটা ঠিক তেমনই একটা গান.. আমার কাছে। অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম এই গানের নির্মাণ। এক স্পষ্ট পল্লীগীতির ছোঁয়া যেমন আছে, তেমনই প্রচ্ছন্ন নগরগীতির উপস্থিতি প্রাঞ্জল। (প্রসঙ্গত, পল্লীগীতি বোঝাতে অনেকে ‘লোকগীতি’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেন। এটা ভুল শব্দ। লোকে গাইলেই লোকগীতি, সে শহর লোক, নগর হোক, গ্রাম হোক, পল্লী হোক..)।

যেভাবে আমাদের চিরাচরিত শোনা পল্লীগীতির মধ্যে এক মেঠো টানা সুর আছে, সেই টানটাকে ভাঙা হচ্ছে (শুনলেই বোঝা যায় ইচ্ছে করে ,Intentionally এই ভাঙাটা)। আমরা যারা বাদল সরকারের ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ স্ক্রিপ্টটা পড়েছি, তারা জানি, পুরো নাটকটা জুড়ে কোথাও থিতু হতে দেয় না… একটা restless অবস্থার মধ্যে দিয়ে চালিত ক’রে নিয়ে যায়, সিনেমাতেও সেই ধারা মেনেই চলেছে। গানের মধ্যে দিয়েও এই ব্যাপারটা আছে। যে মুহূর্তে আপনি ভাবছেন এখানে এসে ঝোঁকটা ফেলবে, তার ঠিক আগে আগেই নিয়ে নিচ্ছে – হিসেব মিলছে না।

গানটাও তেমনই। একটা টপ্পার ঝোঁক আছে। একটা ঝিমুনি ভাব আছে…. যে ঝিমুনি আনার জন্য প্রচুর এনার্জি লাগে।

অনির্বাণের গান লেখার ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত। ‘ও তো এরকম ভালো লিখবেই’ ব’লে খাটো ক’রে দেওয়াটা ঠিক হবে না ; বরং, অনির্বাণ, আপনি আরও লিখুন, বেশী ক’রে লিখুন, এই দাবী রাখা যায়। গানের অ্যারেঞ্জমেন্ট দারুণ। সবশেষে মূল কথায় আসি। গানটি গেয়েছেন সাহানা – যার মূল পরিচয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে ; আমরা দাগিয়ে দিয়েছি। একটা ফ্রেমবন্দী না করলে মুশকিল। যেভাবে সুকুমার রায় শিশুসাহিত্যিক, শিশুদের জন্যই লেখেন শুধু… যাই হোক। আমার দূরতম ভাবনাতেও আসছে না, এই মুহূর্তে আর কোন শিল্পী আছেন যিনি এভাবে এই গানটা ‘পারফর্ম’ করতে পারবেন ! আমার ধারণা, সাহানার বেড়ে ওঠা, বীরভূমের পল্লীর সুর, বাউলদের আখড়ার ওই বোহেমিয়ানাকে মন থেকে না ছুঁলে এই গানটা ‘পারফর্ম’ করা সম্ভব হ’ত না (আমি খুব ভেবেচিন্তেই গান শুধুমাত্র ‘গেয়েছেন’ না ব’লে ‘পারফর্ম’ করেছেন শব্দটা ব্যবহার করছি)। শান্তিনিকেতনের পরিবেশে বেড়ে উঠে, বীরভূমের বাউলসঙ্গে যে নিয়ন্ত্রিত বোহেমিয়ানাকে রপ্ত করেছেন সাহানা, এই গানে তা ফুটে উঠেছে… সাহানার গলায় যে আলাদা বিশেষত্ব আছে, তা ফুটিয়ে তুলেছে এই গানটাকে.. ধন্যবাদ সাহানা এই গানটা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।

গানটা এতো সুন্দরভাবে মিশে গেছে, যে গানটাও একটা চরিত্র। কিছু কিছু জায়গা বেশ ভালো লাগার। যেমন সিগারেট স্মোকিং ইনজুরিয়াস টু হেলথ – বলার জায়গাটা বা কিছু সংলাপে প্রবাদের ভিন্ন ব্যবহার। খারাপ বা অস্বস্তির জায়গা একটা। অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কেন উনি ‘ক্লাইম্যাক্স’ কথাটা ব্যবহার করলেন। বলার দরকার ছিল না তো। বেশ গল্প চলছিল, এবারে যেন ঘন্টা বাজিয়ে জানান দেওয়া, যাও সবে নিজ নিজ কাজে…। কোথাও যেন আমার মনে হচ্ছিল, ওনার খটকা লাগছে যে সিনেমাটা ‘বড়’ হয়ে যাচ্ছে ভেবে জানিয়ে দেওয়া – তিষ্ঠ ক্ষণকাল ! এটা যদিও খুবই সামান্য, কিছুই না, কিন্তু এইটে না থাকলে আরও ভালো হ’ত।

অনির্বাণ, আপনাকে অনেক কাজ করতে হবে। অভিনয়ের জগতের যেমন আপনাকে দরকার, তেমনই পরিচালক অনির্বাণকেও আমাদের দরকার। আর একটা অনুরোধ, এমনই যত্ন নিয়েই সিনেমা বানাবেন। হিট করে গেলেও, এই যত্নের অভ্যেসে জল দেবেন। ভালোবাসা নেবেন। আমি আপনার ভক্ত নই, কাজের গুণমুগ্ধ।

আর একটা জিনিস শেখার। অনেকেই কিন্তু গেছেন অনির্বাণকে দেখতে। ‘অনির্বাণের সিনেমা’ জেনেই। একদম শেষে অনির্বাণ বাকি টীমের সাথে আসছেন। একটুও বাড়াবাড়ি নেই, লোকদ্যাখানো নেই। অহেতুক কনফিডেন্স নেই। এই যে সংযম, পরিচালকের সংযম, এইটে শেখাটা দরকার। একটুও অপ্রয়োজনীয়তা নেই, বাড়াবাড়ি নেই। ভালোবাসা।

যারা যারা দ্যাখেননি এখনও, সপরিবারে, হ্যাঁ, সপরিবারে দেখে আসুন। একটাই মুশকিল অবশ্য, একবার দেখলে, বারবার দেখার ইচ্ছে হবে।

কারণ এক গল্প বারবার বললে, সে আর এক গল্প থাকে না…

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page