কবিতার সংবেদী লাইন মুখে মুখে ফিরবে ।। মৃদুলকান্তি দে

‘আমি বাড়ি ফিরিনি’ কবিতার বইতে অন্তর্ভূক্ত তিপ্পান্ন কবিতার টানটান আধুনিক সজীবতার মধ্যে রাজাদিত্য ব্যানার্জি ক্রমশ আত্মবিস্তারের দিকে এগিয়ে যান। যেতে যেতে এই শহর (যে শহরের ‘ইঁদুরকলে আটকে পড়ল আর একজন কলকাতাবাসী’, ছাড়িয়ে এই দেশের অন্য ভূখন্ডে (বারো বছরের পরিযায়ী শ্রমিক জামলো মকদম হেঁটে চলেছে হাজার বছরের খিধের সঙ্গে), মহাদেশে (সেসব দেশ কেমন দেখতে? ছুরি ভরতি আমার শহরটার মতো?) তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

কবির আত্ম-উদ্ঘাটন পর্বে প্রকাশ্য হতে থাকে অন্তরাল এবং চেনা আবর্তনের মধ্যে নীরবতা, ‘প্রভুভক্ত দুঃসময়’, প্রতিবাদ, আশা-উদ্দীপিত অভিমুখ (‘হাহাকার বুকে নিয়ে কবিতা লেখা আমার জীবন ধর্ম নয়’)। শিষ্টাচার বা সভ্যতার উপর নির্বিচার আক্রমণে ক্ষুব্ধ কবিতার অনেক শব্দ পাঠকের অভিনিবেশ সরাসরি স্পর্শ    করবে, ঝাঁকিয়ে দেবে (‘সাহসগুলো সব কোথায় রেখেছেন?/ব্যাঙ্কের লকারে/আর প্রতিবাদ?/শ্মশানে?’)।

অকাল প্রয়াত দাদার (চেরাপুঞ্জির সন্নিকটে নিজের ছবির শুটিং চলাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন) মৃত্যু জনিত শোকভার কবির হৃদয়ে যে নিভৃত অনুভূতির অনুরনণ তোলে, তা ব্যক্তিগত সংকেতের ভাষ্য অতিক্রম করে গেছে বার বার। বেশ কিছু কবিতার স্নায়ুতন্ত্র মৃত্যু বেদনার কাঁপন। এই দুঃসহ আর্ত কাঁপন কী গভীরতর, শিকড় সন্ধানী পাঠক তার মর্মন্তুদ অবস্থান পেয়ে যান পাঁচটি কবিতার অবয়বে। দাদা বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায়কে পাঁচটি কবিতা উৎসর্গ।

তার কবিতায় ডানা মেলে নিরন্তর জিজ্ঞাসা। এই প্রশ্ন চিহ্ন সম্পৃক্ত সংলাপ কার সঙ্গে? সেই ‘কুয়াশা কেবিনে’ ‘নীল শাড়ি’ পরা মেয়েটির কথা ভাবা যেতে পারে। যেন সিনেমার মোটিফ-এর মতো এই নীল শাড়ি অন্তত দশটি কবিতায় ফিরে ফিরে আসে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কবি একজন নাট্য ও চলচ্চিত্র পরিচালক যার আন্তর্জাতিক আঙিনায় বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ও নাট্য-মঞ্চ মুখর শহরগুলোতে নিয়ত আসা-যাওয়া। আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে, ‘অস্পষ্ট কুয়াশার মাঝে’ বা ‘একলা ছাদের অন্ধকারে’ বা ‘কোয়েল নদীর আশেপাশে’ বা ‘মিথ্যে কথায় ভরা শহরে’ ‘যে ট্রেন দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে’ নীল শাড়ির অবয়ব কাছে বা দূরে। কবি লিখেছেন, ‘প্রবল হাওয়াতে তোমার চুল উড়ে পড়ছে তোমার মুখে’।

তারপর তার পংক্তি এরকমঃ

‘সেই ট্রেনটার কথা বলেছিলাম তোমার মনে পড়ে?                                কবে স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে

……                                                  তুমি আসোনি                                                 ঘরে ফিরিনি আমি’                                             (অচেনা শোক)

বইটির কবিতা সাজানো বা প্রোডাকশন ডিজাইন এমন, ‘আবছায়া     কথোপকথনের মতন’ নীল শাড়ি বিজড়িত চিত্রকল্পকে সাক্ষী রেখে ঝলসে উঠে কোমলতা-হারানো রুক্ষতা, ড্রাগ লর্ডদের ভয়ঙ্কর ছায়াপাত, মূল্যবোধহীনতা, প্রান্তিক মানুষদের অসহায়তা, দলবদ্ধ প্রতারণা, অন্ধকারে লন্ঠন ধরা কাগজকুড়ানি, পারমানবিক আকাশ, দালাল স্ট্রিট, রাষ্ট্র ক্ষমতার কক্ষ বা অলিন্দের বাইরের বিপজ্জনক রাজনীতি।

‘স্তব্ধতা দিয়ে তৈরি কৃষ্ণচূড়া                                    সব বোঝে                                               কিছু বলে না’                                             (নিরাপদ কবিতা)

‘বাড়ির পাশে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল।                          একজন সো-কল্ড এলিট ইতর গাছটিকে হত্যা করলেন’।                (শেষ অথবা শুরু)

‘খুন আর আত্মহত্যার মধ্যবিন্দুতে মরা গাছটাকে দেখে চমকে উঠলাম’।   (গণ্ডারদের বসন্ত পিকনিক)

‘মোমবাতি নয়                                           মিছিল নয়                                                আসলে আমি একটা শান্ত বটগাছ খুঁজেছিলাম’                       (শান্ত বটগাছ)

মগ্নতার ভিতর, বিদ্যমান থাকার ভিতর তার বলবার পরিধি প্রসারিত হতে থাকে  ক্রমে।

‘মেয়েটির লম্বা চুল কোমর অবধি নেমে এসেছিল                   বিকেলের মরা রোদ ছুটিতে চলে যেতে চাইছিল                     হয়তো তাই রাত নেমে এসেছিল তাড়াহুড়ো করে                      আমি হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ করলাম আকাশে অনেক তারা                 আমি আর সে ছাড়া এই মুহূর্তে মানুষের পৃথিবীতে কেউ নেই’             (শেষ অথবা শুরু)

এর পরেই প্রশ্নঃ ‘তুমি কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রে বেড়াতে গিয়েছ কোনোদিন’? ছোট পরিধি থেকে এই যে অতি বৃহৎ পরিধিতে আহরণ, সেটা কি অস্তিত্বের সামগ্রিকতা ছুঁয়ে দেখার অন্বেষণ! এই খুঁজে বেড়ানো তার কবিতাগুলোর শিরা উপশিরা।

‘সব কিছুই না কি আমরা হারিয়ে ফেলি?                        আমিও কি তোমাকে হারিয়েছি’?  (অচেনা শোক)

‘পাড়ার মায়েদের সঙ্গে স্কুল খুঁজে বেড়াচ্ছি,                         কোন সিলেবাসে নিষ্ঠুরতা শেখাচ্ছে আজকাল’?  (ইদানীং আমি)

‘এমন কোনো শহর আছে মানুষ তোমার ভাষায় কথা বলে না’?          (সমান্তরাল দুনিয়া)

‘সম্বৃতার বাড়িটা কোথায়?                                   ছুটি নিয়ে আমাকে দেখে যাবে না বাবা’?                            (টু অর থ্রি থিংস ইউ ডিড নট নো অ্যাবাউট মি)

সমকালের সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের মানচিত্রে অস্তিত্বের অস্থিরতার ভিতর এক অন্যরকম পৃথিবীর সন্ধানে ব্যাপৃত কবির ভাষা। যার নিরন্তর আসা-যাওয়া হেলসিঙ্কি-কলকাতা, শিল্প-মাধুর্য-সম্পন্ন দেশ-বিদেশের শহর, তিনি জানেন    ‘এক ব্রহ্মাণ্ড যন্ত্রণা’ যেমন আছে, ‘সুখের একটা চাদর’ আছে। কিন্তু সেটা কোথায়? কতগুলো ব্যর্থতা উপড়ে ফেলে দিলে, কতগুলো পরাজয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে, সুখ (সৃষ্টিসুখ!) পূর্ণ মাত্রায় আমাদের চাওয়া-পাওয়া মেটাবে! অনন্ত সময় জুড়ে এই বিস্ময়। তাই পাকা ঠিকানা লেখা পোস্টকার্ড স্বপ্নের ডাকবাক্সে পৌঁছয় না, স্রষ্টাবৃত্তির স্বাতন্ত্র্য এখানেই। বাড়ি ফেরাও হয় না।

প্রকাশক ধানসিড়ি খুব যত্ন নিয়ে বইটি ছেপেছেন।

 

আমি বাড়ি ফিরিনি

রাজাদিত্য ব্যানার্জি

প্রকাশকধা সি ড়ি, কলকাতা ৭০০০৫০

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page