বই-কথা ‘তপোভাগ’ ।। শানু চৌধুরী

সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আখ্যান “তপোভাগ” শেষ করলাম। যে আখ্যান আমাকে লিখিয়ে নিল,কিছু কথা। এই আখ্যানের প্রথম উল্লাস শুরুই হচ্ছে মানুষের জীবনের প্রাথমিক চাহিদা ও বিলাস ব্যসনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ আকাঙ্ক্ষাকে নসাৎ করার ঘটনা দিয়ে, যার মধ্যে কখনো ঢুকে যাচ্ছে পরম প্রেমগীতি বা গভীর লীলারস। যে লীলারস ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নির্দেশ করে, এবং ঘটনার শেকড়ে ছড়িয়ে দেয় রূপানুরাগ স্বরুপ কলহান্তরিতা বা বিরহের মতো মুখ্য রসগুলি,এ কি সত্যিই বিদ্যাপতির ধর্মমতের আধুনিকায়ন? আবার কখনো শরীর বর্ণনাকালে চরিত্রকে আড়াল করে সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে ধরছেন, সময়ের বহমানতা। যেখানে নিটোলভাবে চরিত্রে মায়া,অকৃত্রিম, ঐকান্তিক ও প্রাণময় ভক্তিনিষ্ঠা কাজ করছে, ডিকশনের পরতে পরতে। যা ভাষাকে করে তুলছে রাজকীয়। যে কারণেই,আমি প্রথম উল্লাস পাঠ করে ঘোষণা করি, তপোভাগ এক উদাসীন লেখকের,রাজকীয় ভাষা। আসলে এই উল্লাস,এই প্রাচীন পথরেখার যে যাত্রা আখ্যানের প্রথমভাগে তা আর কিছু নয়,লেখকের নিষ্ঠা বা পদাবলি সাহিত্যের প্রতি এক যুক্তিনিষ্ঠটার প্রকাশ। এই নিষ্ঠাই আখ্যানের যাত্রা পথকে করে তুলেছে নবীন নবস্ফূট। সুপ্রিয়র আত্মা বোধহয় পরমতসহিষ্ণু পঞ্চোপাসক। নাহলে, এই অনুভূতি প্রকাশ পেতে পারে না। নাগরিক জীবনে থেকে বনের মায়ার ছোঁয়া লাগতে পারে না। পৌরাণিক কাহিনির আঙ্গিকের নবধারায় এক অবক্ষয়, মানুষের মত ও পথের বিভেদ, সময়ের জড়ত্বকে যেমন আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে তা রচনার প্রেক্ষাপটকে সুগম করে তুলেছে। আসলে এ আখ্যানের প্রথম উল্লাস আমার মতে, অতন্দ্র নিষ্ঠার ফল। নইলে এ নবধারার রচনা সৃষ্টি করা যায় না।

এবার আসি দ্বিতীয় উল্লাসে। এই উল্লাসে উঠে আসছে ভরত মহাদেশ, ভারত নয়। বিন্ধ্য পর্বতের যে তিন কোণা অঞ্চল, সেই অঞ্চলে আর্যাবর্তের যে সীমানা , সেই সীমানার ঐতিহাসিক উপাদানকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে এই আখ্যানের দ্বিতীয় উল্লাস। সেই সময়কার ভারতে ,যে প্রাচীন জনপদ তার যে প্রাকৃতিক মানচিত্র তা, আর্যদের বিভিন্ন নামকে কেন্দ্র করে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রাচীন বৈদিক যুগের নরপতি বা নৃপতির ধারণাটি যেভাবে এসেছে তা কখনই ইতিহাস বই টুকে লেখা নয় বরং ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে চলার লেখা। আখ্যানের এই ভাগে এসেছে আদিম সমাজ থেকে বিবর্তিত হয়ে সভ্যতা যখন সদ্য দানা বাঁধছে সেই সময়ের জনপদ গড়ে ওঠার যে ইতিহাস এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের যে ইতিহাস তাকে কেন্দ্র করে। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে মগধের কথা এবং সুপ্রিয় এখানে মগধের শক্তির কথা তুলে ধরেনি। তার পরিবর্তে এঁকেছেন শক্তির পরিহাসের কথা। আর অসম্ভব দক্ষতায় বর্ণনা করেছেন, সেই সময়ের কারিগরি শিল্পের ছবিগুলিকে। তবে আমার একটা প্রশ্ন রয়েছে লেখকের কাছে। এখানে যে যাদব বংশের পরিণতি দেখানো হয়েছে তা, কি যাদবদের অহং আর দম্ভ? নাকি বিনষ্ট হওয়ার পিছনে রয়েছে নাগবংশীয়দের বসতি কেড়ে নেওয়ার ফল ? আবার নাগ গ্রামে যে মড়কের চিত্র তুলে ধরেছ, তা পুরো ঘটনায় এক গোলকধাঁধা। পৃথা, আত্রেয়,দ্রুপদ প্রভৃতি চরিত্ররা থেকেও যেন নেই, তা কেন? আসলে এই আখ্যান চরিত্রের কথা বলে না। বলে সময়ের চিত্রের। বলে সময়ের লহমার কথা। এই আখ্যানকে তাই আমি বলবো, পৌরাণিক কাহিনির এক যুগোপযোগী নবীকরণ। এখানে আছে গিরিরাজের নাটকীয়তা, রয়েছে মনোদুঃখের আগমনী সংকেত যা মায়াবদ্ধ জীবের বিবিধ রঙ্গকে প্রশ্ন করে। এই আখ্যান কখনো গীতিকাব্য, কখনো শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনকে পুনর্নির্মাণ করে লেখা। এ আখ্যান ডিসাইফার করা সম্ভব নয়, যদি না ইতিহাস সচেতন হওয়া যায়। শেষবারের মতো বলি, এই আখ্যানে যে ভাষার ব্যবহার সেই ভাষা রাজকীয় কারণ এই ভাষা এক শুদ্ধ মুদ্রার প্রতীক। ঠিক যেমন প্রয়োজন ছিল এই রচনার ক্ষেত্রে।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page