স্বপ্ন… স্বপ্ন… স্বপ্ন দ্যাখে মন

ঘুমিয়ে পড়লেই আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। কখনো আনন্দের, কখনো বা সেটা ভয়ের। তার মধ্যে কিছু স্বপ্ন বিক্ষিপ্ত, কিছু অর্থহীন। কোনোটা আবার আগে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার অংশবিশেষ। আমরা স্বপ্ন কেন দেখি,স্বপ্নের মানেই বা কী? প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে আসছে। মস্তিষ্ক ও মনের উপর, মানুষের আত্মা যে যে বিষয়গুলো অধিকার করে তা হচ্ছে- সুখ, দুঃখ, আবেগ-অনুভূতি, উদ্বেগ আর ভয়। এসবের সাথে মন ও আত্মার মিতালি হলেই স্বপ্নের সৃষ্টি হয়। মানুষ ঘুমের মধ্যেই স্বপ্ন দেখেন। অবশ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আবদুল কালাম কিন্তু বলেছেন অন্য কথা। তিনি বলেছেন- জেগে থেকেও স্বপ্ন দেখা যায়। তাঁর মতে, মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন এবং অন্যদের মতে, ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন দু’টোই মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।

স্বপ্নের উৎপত্তি, ব্যাখা, গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক তত্ত্ব ও ধারণা প্রচলিত। এদের মধ্যে সবার প্রথমে যে তত্ত্বের কথা মাথায় আসে,সেটি হল ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড স্বপ্নের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি তত্ত্ব প্রদান করেন। তার তত্ত্ব অনুযায়ী স্বপ্ন হল মানুষের অবচেতন মনের প্রতিফলন, অবচেতন মনের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থেকেই স্বপ্নের উৎপত্তি। কিন্তু সুইডিশ মনোবিজ্ঞানী কার্ল জাং, যাকে বিশ্লেষণমূলক মনোবিজ্ঞানের জনক বলা হয়, ফ্রয়েডের তত্ত্বের অনেক অংশই সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মতে স্বপ্ন মানুষের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা, যা আমাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা সারাদিনে যা কিছু দেখি, যেসব ঘটনার মুখোমুখি হই, সেগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখায় বা স্বপ্ন তৈরীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তৈরি করে।

জার্মান মনোবিদ ফ্রিটজ পার্লস এর মতে, স্বপ্ন হল আমাদের অবদমিত সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ। সচেতন অবস্থায় আমাদের যেসব চিন্তা অবদমিত থাকে, সেগুলোই স্বপ্নে প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৭৬ সালে জে. এলান হবসন এবং রবার্ট ম্যাককার্লি সম্পূর্ণ নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন, যা স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার মোড় অনেকটাই ঘুরিয়ে দেয়। মানুষ বেশিরভাগ স্বপ্নই দেখে ঘুমের REM (Rapid Eye Movement) স্তরে। অন্যান্য স্তরে স্বপ্ন দেখলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই স্বপ্ন গুলো মানুষ ভুলে যায়। REM স্তরে দেখা স্বপ্ন গুলোই দীর্ঘসময় মনে থাকে। হবসনের মতে, মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের যে অংশগুলো আবেগ, অনুভূতি ও স্মৃতি গঠনের সাথে জড়িত (যেমন এমিগডালা, হিপোক্যাম্পাস), REM স্তরে সেগুলো যখন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এক ধরনের সংকেত সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক তখন এই সংকেত গুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে,যার ফল হিসেবে আমরা স্বপ্ন দেখি।

হবসনের মতে, মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগ থেকে স্বপ্নের উৎপত্তি। কিন্তু ইউনিভার্সিটি অফ কেপটাউন -এর প্রফেসর ও নিউরোসার্জন মার্ক সলমস দীর্ঘদিন জোহানেসবার্গের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করে অসংখ্য রোগীকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে আবিষ্কার করেন, মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্বপ্ন দেখাও বাধাগ্রস্ত হয়। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মস্তিষ্কের পশ্চাৎ ভাগ নয়, বরং সম্মুখভাগ থেকেই স্বপ্নের উদ্ভব হয়।
পরবর্তীতে হবসনের তত্ত্ব এবং মার্কের পর্যবেক্ষণ এর ফলাফল সমন্বিত করে ‘জি ঝাং ‘ স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, স্বপ্ন হল ঘুমন্ত অবস্থায় চলমান একটি প্রক্রিয়া, যা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, সাজানো এবং তথ্য প্রবাহের সাথে জড়িত। তার মতে, স্বপ্ন দেখার সময় মূলত মস্তিষ্কে তথ্য প্রবাহিত হয় যা স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। কেন আমরা এক স্বপ্ন থেকে অন্য স্বপ্নে ঢুকে যাই, এর ব্যাখাও জি ঝাং এর তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়।

২০০১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বপ্ন মূলত আমাদের স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। সজাগ অবস্থায় আমরা যেসব সূক্ষ্ম জিনিস এড়িয়ে যাই, সেসব আমাদের অবচেতন মনে জমা থাকে। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক এই সূক্ষ্ম বিষয় গুলো বিশ্লেষণ করে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

স্বপ্নের সাথে মন ও আত্মার সম্পর্ক যেমন, ঠিক তেমনি পরিবেশ-পরিস্থিতি, বয়স, কর্মভেদের সাথেও স্বপ্নের সম্পর্ক আছে। ছোট্ট শিশুরা যেমন স্বপ্ন দেখে, প্রবীণরা তেমন দেখেন না। আবার যুবকরা যে স্বপ্ন দেখে, যুবতীরা একই রকম দেখেন না। স্বপ্ন দেখার নির্ধারিত সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ সম্ভবত কল্পনার থেকেও বেশি স্বপ্ন দেখেন। তাই এ নিয়ে বিজ্ঞানেও সৃষ্টি হয়েছে একটি শাখা। যার নাম ‘স্বপ্নবিজ্ঞান’, ইংরেজিতে বলা হয় ‘Oneirology’।

মজার বিষয় হচ্ছে শুধু মানুষ নয়, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীই স্বপ্ন দেখে। এদের মধ্যে ডলফিনের REM স্তরের ব্যাপ্তি সবচেয়ে কম, মানুষের ক্ষেত্রে যা আরেকটু বেশি। আর আর্মাডিলো, অপোসাম প্রজাতির জন্য এ ব্যাপ্তি সবচেয়ে বেশি।

গ্রীক এবং রোমান যুগে মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, স্বপ্নগুলি এক বা একাধিক দেবতার কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বার্তা অথবা মৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আসা বার্তা যা প্রধানত ভবিষ্যত বাণী হিসেবে পরিগণিত। গ্রীকরা আবার বিশ্বাস করতেন যে, ঘুমের সময় আত্মা দেহত্যাগ করে। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বিশ্বাস করতেন যে, স্বপ্ন হলো শারীরিক কার্যকলাপ। তিনি মনে করতেন যে, স্বপ্ন রোগের বিশ্লেষণ এবং কোন ধরনের রোগ হতে পারে তার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আধুনিক যুগে স্বপ্নকে অবচেতন মনের একটি সংযোগ হিসেবে দেখা হয়। প্রাণবন্ত ও সুখময় স্বপ্নগুলোকে আর্শীবাদ এবং দুঃখময় ও খারাপ স্বপ্নগুলোকে অভিশাপ হিসেবে ধরে নেয়া হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ এবং তারও আগে মনে করা হত, স্বপ্নের দু’টি দিক আছে। প্রথমটি হচ্ছে- মানুষের মনের ভেতরের ইচ্ছার নিছক অভিব্যক্তি এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ঘুমের সময় আত্মা দেহত্যাগ করে এবং জেগে উঠার আগ পর্যন্ত ঐটি দ্বারা দেহ পরিচালিত হয়। অর্থাৎ দেহত্যাগকারী আত্মা যেখানে যেখানে যেমনভাবে ঘুরে বেড়ায় তাই মনে প্রতিফলিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্র্যাটিসের দেয়া তত্ত্ব ছিল এরকম: ‘দিনের বেলা মানুষের আত্মা স্বপ্ন সংক্রান্ত চিত্র গ্রহণ করে এবং রাতের বেলা পূর্ণাঙ্গ একটি ছবিতে রূপদান করে।’

স্বপ্ন নিয়ে গবেষণার ফলে দেখা গেছে মজার সব তথ্য। মানবমস্তিষ্কের এই রহস্য উন্মোচন করতে মনোবিদগণ গবেষণা চালিয়েই যাচ্ছেন।স্বপ্ন আমাদের কাজে অনুপ্রেরণা জোগায়- এমন তথ্যও বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। আশা যে তাদের গবেষণার ফলাফল স্বপ্ন সম্বন্ধে আমাদের সব কৌতূহল মেটাতে সক্ষম হবেন। স্বপ্ন না দেখলে মানুষ বাঁচতেই পারেন না, জীবন গড়তেও তাই স্বপ্ন দেখা চাই।

বৈশাখী নার্গিস 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page