গল্প।। ঘরবদল।। শ্যামাপ্রসাদ সরকার

আজ আর একটু পর  মা কে আনতে যাব। দীর্ঘ কুড়িবছর পর এক মানসিকসেবাকেন্দ্র থেকে মা ছাড়া পাচ্ছে। বয়স নয় নয় করে আটষট্টি তো হবেই এখন। কুড়িটা বছর তো আর কম দিন নয়। মজার কথা এই যে মা এর আগেকার স্মৃতি বলতে ব্রেনে খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার এক বিরলতম রোগে মা এর জীবন থেকে প্রায় নব্বই শতাংশ স্মৃতি উধাও। মা ইদানীং কথাও কম বলে। যদিও সেইরকম ভায়োলেন্টও আর হবে না বলেই আশ্বস্ত করেছেন ডাক্তার রায়। ওঁর বক্তব্য বাড়ির পরিবেশে এবার মা কে রাখাই যায়। যে বাড়ীটা থেকে মা ওই হাসপাতালটায় গেছিল সেই বাড়িটা এখন ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত। বাবাও আর নেই পাঁচ বছর প্রায়। আসলে কোনও কিছুই আর নেই যা মা কে পুরনো স্মৃতি ফেরাতে সাহায্য করার মত। এমনকি আমিও এখন বছর চল্লিশের একজন পুরুষমানুষ। গঙ্গাফড়িং এর মত রোগা যে ছেলেকে মা সমু বলে চিনতো, এতদিনে ওইটুকু স্মৃতিই কি তার আজও রয়ে গেছে নেহাতই? আজকের আমি হয়তো  এলিয়েন মা’র কাছে বোধহয়।
* **
সেবাকেন্দ্রে অবশ্য এতবছর নিয়ম করে পনেরদিনে একবার যেতাম। মা কথা বলতো কম দু একবার হুঁ হাঁ করেই শূন্য উদাস দৃষ্টিতে রেলিংএর বাইরে করবীগাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকতো। কেবল উঠে আসার সময় মাথা আর গায়ে হাত বুলিয়ে দিত। পাতাঝরার মরসুমে যেভাবে শুকনো পাতারা বৃক্ষশাখাকে হাওয়ার আদর দিয়ে ছুঁয়ে যায়।
পারমিতা সবসময়ের জন্য একজন আয়া রাখার কথা বলছিল আমায়। আমি রাজী নই! এই ব্যাপারটা নিয়ে আমার একটা কুৎসিত স্মৃতি আছে। তখন ক্লাস নাইন হবে। মা এর মাথার গোলমালটা বেশ চড়া সুরেই। এই ভালো তো এই জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে। কখনো বা অবসন্ন হয়ে মূর্ছা যাচ্ছে। আমার পড়াশোনা আর অফিস সামলাতে বাবা হিমসিম খাচ্ছে। বাবা মানুষটা চিরদিনই দূরের দূরের একটু আমার থেকে। অবশ্য কর্তব্যে কখনো অবহেলা করতে দেখিনি। একজন মাঝবয়সী মহিলাকে রাখা হল মা কে দেখাশোনার জন্য। অতসীদি বলে তাকে ডাকা হতো। মা ও বেশ পোষ মেনে গেছিল ওর কাছে। ওই মাকে স্নান করিয়ে, চুল বেঁধে এমনকি ঘুমও পাড়িয়ে দিত । মোটামুটি কয়েকমাস ভালোই কাটল। একদিন দুপুরে পড়তে পড়তে একবার উঠে বাথরুম যেতে গিয়ে হঠাৎ দেখি অতসীদি আর বাবাকে খুব অপ্রস্তুত অবস্হায়। পাশের ঘরে আমার পাগলী মা তখন গভীর ঘুমে। মনটা বিষিয়ে গেছিল খুব। বাবাও সেটা বুঝতে পেরেছিল। মা কে তারপর থেকেই সেবাকেন্দ্রে রেখে আসা হল। অতসীদিও আর রইল না। তবুও কামনাতাড়িত দুটো মানুষের উন্মুক্তমিলনের দৃশ্য আমার মনে পড়লে শরীরটা কেমন কেমন করত। এমনকি বিয়ের পর প্রথম প্রথম পারমিতার কাছে যেতে গিয়েও অনেকবার শিথিল হয়ে গেছি সেটা হঠাৎ মনে পড়ায়। এখন অবশ্য সে সব অতীত। বাবার বয়সটাতে এসে ওই ঘটনার জন্য বরং আজকাল বাবার ওপর করুণাই হয়।
***
ট্যাক্সিটা ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াল। আমি, পারমিতা আর টুপুর তিনজনেই মা কে আনতে গেছিলাম। পারমিতা মা কে ধরে ধরে ঘরে আনল। ঠাম্মাকে পেয়ে স্বভাবতই টুপুর খুব খুশী। যাকে নিয়ে এত উত্তেজনা, এত সংশয় সেই মা নির্বিকার শুধু। সারা রাস্তা একটাও কথা বলেনি। আমরাও জোর করিনি অবশ্য। যতটা স্বাভাবিক পরিবেশ রাখা যায় আর কি।
টুপুর মা এর কাছে এসে দাঁড়ায়। ওর গড়নটা মা এর মতো রোগা লম্বা। ঠাম্মার চেয়ে যে এখন ও লম্বা এই ব্যাপারটাই ওকে আনন্দ দিচ্ছে। সারাটা রাস্তা থেকে বাড়ি অবধি মা নির্নিমেষ উদাস শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল শুধু। দেখে অবাক হলাম মা বাবাকে তো খুঁজলো না একবারও। বাবা যে আর নেই সেটা মা কে বলিনি আজও।
*****
নির্বাক উদাস দৃষ্টির সামনে তাকিয়ে থাকাটা কষ্টকর খুব। মানুষটা বেঁচে আছে,কিন্তু সে জানেই না তার চারপাশটা কতটা বদলে গেছে!
দুদিন কেটে গেছে, বাড়িতে এসে মা এর কোনও অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। চুপচাপই থাকে। খেতে দিলে খেয়ে নেয়। এখন বাথরুমটাও মা নিজেই যেতে পারে।
আজ মহালয়া, ভোরবেলা উঠেই রেডিও চালিয়ে দিয়েছি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ শারদমুহূর্ত রচনা করছেন চিরকালীন তন্ময়তায়, মা দেখি হঠাৎ  ঘর থেকে বেরোল। একখানা পলকা দড়ি যেন মা এখন। ছোটবেলায় বাবা তর্পণ করতে গঙ্গার ঘাটে যেত। কখনো কখনো আমিও জিলিপির লোভে সঙ্গে যেতাম। এই বাড়িতে এসে এতদিনে প্রথমবার ঠাকুরঘরে ঢুকলো মা । ইতিউতি চেয়ে তাক থেকে দেখি বাবার ফটোখানা নামিয়ে এনে বুকে চেপে ধরে আছে। শুকনো হয়ে যাওয়া গাছের গায়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির মত চোখের জল মা’র চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে।
বিস্মৃতির অতলস্পর্শ থেকে মা কিন্তু তার অতিচেনা মানুষটিকে  ঠিক খুঁজে নিয়েছে ! যে মানুষটার উপস্থিতি তার কুমারীবেলার পদবী, ঠিকানা আর পরিচয় সবই একদা বদলে দিয়েছিল। আজকে চারপাশের এতকিছুর বদলের মধ‍্যেও মা’এর ক্ষীণতম স্মৃতির কোণায় যে এই ব্যাপারটা এতদিন অক্ষত হয়ে রয়ে গেছে, সেটা কম আশ্চর্যের নয়!
শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page