গল্প। পরাগ।। মানস দত্ত

জীবন দৌড়াচ্ছে , সময় দৌড়াচ্ছে , বাস ছুটছে আর সবার মতো অনুপও ছুটছে জীবনের তাগিদে । চাহিদা বেড়েছে ক্রমাগত আর ঘামই তার চালিকা শক্তি । অফিস থেকে ফেরার পথে বাস স্টপ লাগোয়া একটা পার্কে একটু বসা তারপর বাস এলে বাসে চেপে ভিড় ঠেলে বাড়ি । কর্ম ব্যস্ততার মাঝে অনুপের নিজের সময় বলতে ঐ টুকুই । অনুপ প্রতিদিন একটা গাছের নীচে বসার জায়গায় বসে । কয়েক জন বয়স্ক লোক সেখানে হাঁটতে আসে , কয়েক জন যুবক যুবতী বিকেলে বেড়াতে আসে, কিছু বাবা মা তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে খেলাতে নিয়ে আসে এই পার্কে । যদিও সেখানে মায়েদের সংখ্যাই বেশী । কেউ কেউ আবার দাদুর সাথেও আসে । অনুপের সাথে কম বেশি কয়েক জনের আলাপও আছে । তারা কখনো কখনো অনুপের আড্ডার সঙ্গী হয়ে ওঠে । অনুপ যেখানে বসে ঠিক তার সামনে সবুজ ঘাসের বুকের মাঝে তাদের খেলার আসর বসে ।

অনুপ বসে আছে সেদিন হঠাৎ একটা বল তার পায়ের কাছে এসে পরলো । বাচ্চা দের নরম ফুটবল । একটি বাচ্চা মেয়ে ফুটবলটি নিতে অনুপের কাছে এলো,অনুপ তাকে বলটি দিলো । ভারি মিষ্টি দেখতে মেয়েটি । উজ্জল রং, ঝাঁকরা চুল, আর বাচ্চাটির নিষ্পাপ সরলতা যে কোনো মানুষকে তাকে ভালো বাসতে বাধ্য করবে। তার আলতো কথা বলার সুর বসন্তের কোকিলকেও হারমানায় ।

বাচ্চাটির সাথে অনুপের বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে । বাচ্চাটির দাদু মাঝে মাঝে অনুপের শব্দ সঙ্গী হয়ে ওঠে । ঐ বাচ্চাটিকে দেখলেই অনুপের সারা শরীরে যেন এক তড়িৎ প্রবাহ প্রবাহিত হয়।

অনুপ তারসাথে কিছু সময় কাটাতে চাইলেও উপায় নেই। দায়িত্ববোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে। বয়সের পাওনা তো সময়ের সাথে সাথে তাকে মিটিয়ে দিয়ে যেতেই হবে, সে যে বড় পাওনাদার । হিসেব পুরোদমে বুঝে নেবে । বাড়তি শোষিত রক্ত ঘামকে ব্যাঙ্কে গোচ্ছিত করাই যেন মূল কাজ হয়ে দাড়িয়েছে এই সময়ের মানুষদের । গোচ্ছিত রক্তঘাম জীবনের গতিপথকে বিবর্তিত করলো না বিবর্তনই মানুষকে মেসিনে পরিনত করে বিলুপ্তির রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে চললো । মাঝে মাঝে অনুপকে নাড়াদেয় এসব ভাবনা ।

এমনই একদিনে অনুপ বসে আছে গাছের নীচে । আজ বাস লেট । শহড় জুড়ে মিছিল,  ট্রাফিক জ্যাম ।তাই আজ একটু দেরী হচ্ছে বাস আসতে। অনুপ একটু হাঁটা হাঁটি করছে । হঠাৎ অচেনার ভীড়ে এক চেনা মুখ যেনো দারুন গরমে এক দমকা শীতল হাওয়া । অনুপের চোখ যেনো জ্বলে উঠলো মুখে এক অদ্ভুত খুশীর আনন্দ । আজ প্রায় দশ বছর পর অয়ন্তিকার সাথে দেখা ।

আমাদের চিন্তা চেতনা সময়ের সাথে সাথে আধুনিক হয়ে ওঠে , আর শরীর যত সময় যায় তত পুরোনো হয় ওঠে ।

অয়ন্তিকাও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয় । মাঝ বয়সের ছাপ তাকে স্পর্শ করলেও তার রং এর ছটা যেন তাকে সযত্নে আগলে রেখেছে । আজও আগের মতোই সুদীর্ঘ চুল পিঠ ছাড়িয়ে আলতো ভাবে ছুয়ে আছে তার নিতম্ব। বুকের ঢেউ আর কোমরের খাঁজ যেন দেবশিল্পির শিল্পকলা ফুটে উঠেছে তার শরীরে। তুমি কেমন আছো ? পাহাড়ের গায়ে সরু সরু মেঘেরা আশ্রয় নিলে যে রকম অপূর্ব লাগে সেইরকম অয়ন্তিকা তার সরু ঠোটে মেঘ বসানো মৃদু হাসি হেসে বললো ভালো আছি । ঐ ছোট্ট মেয়ে টির হাত ধরে গাড়িতে গিয়ে বসলো ।আজ তার দাদু আসেনি তারা আজ একটু শপিং করতে যাবে তাই । মেয়েটি মায়ের হাত ধরে গাড়িতে ওঠার আগে অনুপকে হাত নেড়ে টাটা করে গেলো আজ । অয়ন্তিকার মেঘ বসানো হাসি অনুপের সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে মুছে দিয়েছে । দশ বছর পর ঐ দুটি শব্দ ‘ ভালো আছি’ তার মাঝ বয়সি বুকেও কাঁপন ধরিয়েছে । অয়ন্তিকার শরীরের উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সবই অনুপের মুখস্থ,  তবুও সে বয়সে অনুপ এই শিহরণ অনুভব করেনি কখনো । আজ বছর দশ পর … ।

বাস এসেছে সবাই ঠেলে বাসে উঠছে অন্য দিনের থেকে আজ বাসে ভীর একটু বেশি , অনুপকে যেন ভিড়ই ঠেলে নিয়ে চলছে । মিছিল ভাঙ্গা ফিরতি লোকেরা রাস্তার দুধারে হাত নেড়ে গল্প করতে করতে চলেছে । অনুপের চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে । নানা কথার শব্দের সুরে অয়ন্তিকার চোখের ভাষা শ্লোগান তুলেছে অনুপের বুকে,আমি ভালো নেই , অনুপ আমি ভালো নেই ।

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page