টোকিও ডায়েরি।। প্রবীর বিকাশ সরকার ।।

সংবাদপত্র, সাময়িকী, গ্রন্থ, ছবির অ্যালবাম এইসব প্রকাশনা চলমান সময়ের আয়না। প্রকাশমান অবস্থায় চলমান সময়ের প্রতিচ্ছবি তাতে হরফ ও রঙের সমন্বয়ে মুদ্রিত হয়ে থাকে। যা ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে প্রতিভাত হয়। সমকালীন ইতিহাস রচনায় অসামান্য ভূমিকা রাখে।

১৯৯১-২০০২ সাল পর্যন্ত মাসিক “মানচিত্র” কাগজে (প্রচ্ছদসহ ৫২ পৃষ্ঠা) বিস্তর তথ্য, ছবি, প্রবন্ধ-নিবন্ধ এবং বিশিষ্ট জনের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এমন একটি কাগজ আর কেউ প্রকাশ করতে পারল না কেন, সেটাও একটা প্রশ্ন হয়ে আছে আমার মনে।

দুই বাংলায় এখন মুদ্রিত তথ্যভিত্তিক সাময়িকী বা ম্যাগাজিন গুটি কয় ছাড়া নেই। একসময় কম ছিল না। বাংলাদেশে সাপ্তাহিক সন্ধানী, সাপ্তাহিক স্বদেশ, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক ২০০০, সাপ্তাহিক খবরের কাগজ বন্ধ হয় গেছে। সাপ্তাহিক সাপ্তাহিক এখনো প্রকাশিত হয় কিনা জানি না। সাপ্তাহিক রোববার, পাক্ষিক অন্যদিন, পাক্ষিক অর্থকাগজ প্রকাশিত হচ্ছে। টিমটিম করে জ্বলছে ম্যাগাজিন সংস্কৃতি বাংলাদেশে। ক্রমেই সরু হয়ে আসছে তার শিখা। অন্ততপক্ষে সর্ববিষয়ক তথ্যভিত্তিক বৈচিত্র্যময় দু-তিনটি মাসিক ম্যাগাজিন থাকা জরুরি।

এখন প্রচুর অনলাইন নিউজ পোর্টাল, সাহিত্য ম্যাগ প্রকাশিত হচ্ছে কিন্ত অধিকাংশই দুর্বল। নিজস্বতা বা স্বকীয়তা নেই বললেই চলে। দেশি-বিদেশি পত্রিকাগুলোর সংবাদ ও ফিচার কাট পেস্ট এবং অস্বচ্ছ অনুবাদ করে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত একটিও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। মূল সমস্যাটা কোথায়? লেখা তথা বিষয়বস্তুর সুতীব্র সঙ্কট? অনুসন্ধানী ফিচার? প্রতিবেদন রচনায় আলস্য, অনাগ্রহ?

প্রকৃতপক্ষে, উপলক্ষ টাকা রোজগারের ধান্ধা। বিজ্ঞাপনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। চেনা বামুনের যেমন পৈতা লাগে না, তেমনি ভালো কাগজের বিজ্ঞাপনের অভাব হয় না। সমস্যা হচ্ছে কনটেন্টস।

পুরনো “মানচিত্র” কাগজের ফাইল ঘেঁটে কিছু ছবি তুলে ধরার লক্ষ্যে শুরু করলাম ধারাবাহিক “মানচিত্র”র স্মৃতি। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানে না এই কাগজটির ইতিহাস।

দৃশ্যমান প্রচ্ছদের ছবিতে জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণদের দেখা যাচ্ছে টোকিও য়োয়োগি উদ্যানে বিক্ষোভরত অবস্থায়। তাদের বয়স এখন ৫০ থেকে ৬৫ বয়সের মধ্যে। তাদের চোখে বর্তমান বাংলাদেশ কী রূপে ধরা দিচ্ছে জানার বড় আগ্রহ! একদিন সবাই চলে যাবে অন্যলোকে, কিন্তু থেকে যাবে এই লোকের কোনো না কোনো গ্রন্থাগারে ম্যাগাজিনটি।

সম্পাদক হিসেবে, প্রকাশক হিসেবে আমার শ্রমের সার্থকতা এখানেই।

প্রায় ১২ বছর “মানচিত্র” কাগজ প্রকাশ করেছি কোনোদিন কারো কাছে বিজ্ঞাপন চাইনি। ১৯৯১ সালে যখন প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করি তখন জাপান প্রবাসী সৈয়দ দুলাল, যিনি এখন বাংলাদেশের নাট্যজগতের প্রতিথযশা শিল্পী, নিজ থেকেই বলেছিলেন, “রয়াল বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে”র একটি বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দেবেন। দিয়েছিলেন।

আর সেইসময় জাপানস্থ বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমান এর জিএসএ ছিলেন শরীফ চৌধুরী, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি নিজ থেকেই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এই দুটি বিজ্ঞাপন নিয়েই চালু করেছিলাম কাগজটি। যদিও পরবর্তীকালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসার বিজ্ঞাপন আমি বিনামূল্যেই প্রকাশ করেছি যাতে করে তাদের কিছুটা হলেও লাভ হয়।

১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে হঠাৎ করেই একটি সুযোগ আসে, তৎকালীন জাপান রেলওয়ে ও টয়োটা কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নতুন কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম জাপান (ITJ) এর টোকিও শাখার সেলসম্যান মি.নিশিমাৎসু সরাসরি ফোন করেন আমাকে। জানান তারা “মানচিত্র” কাগজের খবর জাপানি জাতীয় গণমাধ্যমে জেনে যোগাযোগ করছেন, বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী।

বুঝতে পারলাম, চেনা বামুনের পৈতা লাগে না। ভালো জিনিসের কদর সবসময়ই থাকে। গেলাম একদিন মি.নিশিমাৎসুর সঙ্গে দেখা করতে। অভিনব প্রস্তাব দিলেন! আমি তো অবাক! প্রস্তাবে রাজি হলাম। আর তাতেই, আজি প্রাতের সূর্য দেখা সফল হল।

ওই বছরের এপিল মাসে “মানচিত্র” ট্যাবলয়েড থেকে ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হল। সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশ থেকেই ছাপিয়ে আনতে হবে, যদিও আমি ডিজাইন ও লে আউট করব। তাতে করে বাংলাদেশের স্টাফ ও প্রেস টাকা পাবে। প্রতি সংখ্যার বাজেট ছিল ১লাখ ২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। ঢাকায় গেলাম। দাঁড়িয়ে থেকে ছাপার কাজ শেষ করে জাপানে ফিরলাম, পরে বিমানযোগে “মানচিত্র” জাপানে এসে পৌঁছালো। নতুন যুগের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই শুভযাত্রার প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এটা।

প্রচ্ছদের ছবি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন বিশিষ্ট কবি, গল্পকার ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ আহমাদ তারেক। এই সংখ্যাতে বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখকদের লেখা প্রকাশের সোনালি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, রাজনীতিক “মানচিত্রে” লিখেছেন। সম্মানীও প্রদান করা হয়েছে ঢাকার যে-কোনো পত্রিকার চেয়ে দু-তিনগুণ বেশি। তখন টাকা ছিল প্রচুর হাতে।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page