গল্প।। রোহিণী ও সাবমেরিন।। বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়
চিলের বিকট চিৎকার শুনে অবিনাশ ওরফে নন্দবাবু দোতলার জানলা দিয়ে নীচের দিকে তাকালেন।
বারান্দা জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে– পায়ে চটি গলিয়ে নিচে নামতে নামতেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এলো।
একতলায় বারান্দা পেরুলেই গ্রিলের গেট, গেটের বাইরে ছোট বাগান, তারপর একটা পুকুর। পুকুরে মাছের চাষ হয়।জেলেরা মাঝে মাঝে ভোরবেলা জাল ফেলে মাছ ধরে।
বর্ষাকালে জল বাড়লে ছোট ডিঙি নৌকা চালিয়ে এপার ওপার করে বলরাম মাঝি। দুপুরে বিড়ি মুখে ছিপ ফেলে কৈলাশ, পেশায় একজন কলের মিস্ত্রি।আর সারাদিন পুকুরে দাপিয়ে বেড়ায় ওপারের দুষ্টু ছেলের দল। তখন তাদের গা থেকে বুনো শাপলা ফুলের গন্ধ বের হয়।
এই পুকুরটা ভুজো বোসের নাতি কাতলা বোসের থেকে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছে স্যাকরা বাড়ির মেজ ছেলে নীরদ। খুবই করিত্কর্মা ছেলে,থুড়ি লোক।সোনা রুপো গয়নার দোকান চালায় বড় রাস্তার মোড়ে।বেশ চালু দোকান। এদিকে পুকুরটা জেলেদের দিয়ে ভাড়া খাটায়। পুকুরে ছেড়ে দিয়েছে কয়েকটি পোষা পাতিহাঁস। সকাল সন্ধে তাদের ঝগড়া আর প্যা৺ক প্যা৺ক শব্দে চাপা পড়ে যায় স্যাকরা বাড়ির সন্ধ্যারতির
ঘন্টাধ্বনি। অন্ততঃ অবিনাশের তো সেরকম ই মনে হয়।
অবিনাশ ৫ ফুট ৭”, ফর্সা,মাথায় সামান্য টাক আছে। অবসরপ্রাপ্ত ইস্কুলমাস্টার।
গলায় পৈতে রাখেন।কাশ্যপ গোত্র, চট্টোপাধ্যায় বংশোদ্ভূত অবিনাশের প্রপিতামহ ছিলেন টোলের পণ্ডিত।
অবিনাশ নিজেও ভোরে উঠে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করেন। স্তব পাঠ করেন।
সরস্বতী পুজোর সময় তাঁর ডাক পড়ে,
পাড়ার লোকেরা খুশি মনে চাল কলা ও দক্ষিণা দিয়ে যায়। সকলেই জানে তিনি একজন ধর্মভীরু সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণসন্তান।
কিন্তু আজ অবিনাশের মন বড়ো চঞ্চল। খুব অস্থির লাগছে।
হঠাৎ চারপাশ ঝাপসা ও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে যেন। কেন?
ঐ চিলের চিৎকার! বৃদ্ধ পুরুষ চিল টা
একবার চেঁচিয়ে উঠে চুপ করে গেল।কেন?
আর সে কি অপার্থিব হাড়হিম করা চিৎকার! যেন কাউকে সাবধান করতে চাইছে।
অবিনাশের চোখ চলে গেল পুকুরের দিকে। আবছা অন্ধকারে কী যেন টলমল করছে জলে। ওটা কী?
মাঝপুকুরে ভেসে উঠেছে একটা গাছের গুঁড়ি। কোত্থেকে এলো?
না গুঁড়ি নয়। ওটা একটা ভেসে ওঠা সাবমেরিনের ভগ্নাংশ।আর তার মধ্যে এ কি? বসে আছেন রোহিণী,খোলা চুল,দূর থেকেও চেনা যাচ্ছে।অবিকল তিনি। রোহিণী মানে পাড়ার স্বপন কাকুর ন পিসিমা। তিনি যেন হাত নেড়ে অবিনাশ কে ডাকছেন।
পায়ে পায়ে জলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন অবিনাশ।গেড়ি গুগলি মাড়িয়ে হেঁটে চলেছেন অল্প জল থেকে ক্রমশঃ গভীর জলের দিকে।ঐ হাতছানি অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। তাঁর ডান পায়ের হাঁটুর ওপর ঠোক্কর মারল একটা ছোকরা টাইপের সাহসী তেলাপিয়া মাছ, সতর্ক চিহ্নের মতো সামনে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেল একটা নিরীহ জলঢোড়া সাপ– এক কোমর জলের মধ্যে ভেসে উঠল তাঁর ধবধবে সাদা পৈতে, টাক সমেত ভারী শরীরের উর্ধাংশ ।
দূর থেকে নন্দ বাবু ডেকে উঠলেন: ফিরে এস অবিনাশ। কথাটা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল–স্যাকরা বাড়ির নতুন রঙ করা সবুজ দেয়াল থেকে আওয়াজ এল, ফি রে এ সো ও ও।
হঠাৎ যেমন এসেছিল, তেমনই ভুসস্ করে সাবমেরিন জলে ডুবে গেল।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর চারপাশে আলো জ্বলে উঠল।আমগাছ থেকে একটা লক্ষ্মীপ্যা৺চা জোরসে ডেকে উঠল।
চিৎকার শুনে ডিনামাইট ক্লাবের ছেলেরা হই হই করে ছুটে এল। তারপর টর্চ মারল পুকুরে।এ কী!
বিধু,তড়িৎ,খোকন,ঝন্টু পুকুরের ওপার থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে মাঝপুকুর থেকে অবিনাশ ওরফে নন্দবাবু র জ্যান্ত বডি ডাঙায় এনে তুলল।
তারপর নিয়ে এল ক্লাব ঘরে।
খুব জোর বেঁচে গেলেন কাকু।
ভর সন্ধ্যায় জলে নেমে কী করছিলেন?
আর এটা কি স্নান করার সময়?
আচ্ছা মানুষ তো আপনি!
যান, একবার ডাঃ চ্যাটার্জি কে দেখিয়ে নিন। আজকেই।
পারলে মাথাটাও দেখিয়ে নেবেন, ওঁর মেয়েকে দিয়ে।
হতভম্ব অবিনাশ কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর ঘোর এখনও কাটেনি।
অবিনাশ কে ছেড়ে ছেলেগুলো বসে পড়েছে টিভি র সামনে।ভারত বনাম ইংল্যান্ড ওয়ানডে সিরিজ। ভারত ব্যাট করছে।ধবন আউট। রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলি। রোহিত একটা পুল করল। ছক্কা। হাততালির বন্যা।
ক্লাবঘরের উল্টোদিকে লাহিড়ি বাড়ির রাধা ঠাকুমা ৯০ বছর বয়সেও খুব টনকো মহিলা।সব লক্ষ্য রাখেন। বলে উঠলেন,জয় রাধে। বৌমা শাখ বাজাও।
লক্ষ্মী প্যাচা ডেকেছে মানে বিপদ কেটে গেছে। তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন,কী কাণ্ড দেখো।এত লোক থাকতে নন্দকেই কিনা নিশি ডাকল।
লরেটো হাউসে পড়া,বছর কুড়ির নিশা মোবাইল ফোনে গান শুনছিল।
ইয়ার প্লাগ খুলে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল,হু’জ নিশি, ঠাম্মা?
রাধা ঠাকুমা বললেন,তোরা তো বিশ্বাস করবি নি।নিশি নয়,ও হল গে শ্যামভিলার স্বপনের ন পিসি।ভাল নাম রোহিণী।স্বভাব চরিত্তির কোনো কালেই ভাল না…
অল্পবয়সী ছোঁড়াদের ডাকাডাকি করত আর ফুরসৎ পেলে ফষ্টিনষ্টি করত।ওর বর, মানে স্বপনের পিশে কতো মারতো, কিন্তু ওই যে বলে না ,স্বভাব যায় না ম’লে, কিছুতেই শুধরোলো না। আর এই নন্দর ঠাকুর্দাকে ও.. যাক গে। ছেড়ে দে এসব পুরনো কাসুন্দি।
নিশা বলল,ও ঠাম্মা, এই অবিনাশ না নন্দর ঠাকুর্দা না কি খুব হ্যান্ডসাম ছিল, তুমিই বলেছিলে একদিন। সত্যি?
হাঁ রে। খুব।
তোমার ক্রাশ ছিল, বোঝাই যায়।
তা একটু ছিল বৈ কি!
থাকবে না?
কেন,তোর নেই?
না, নেই।
তারপর বলো। কী হলো রোহিণী র?
সে এক ঘটনা। একদিন ভোররাতে খবর পেলুম, একটা জাহাজী ছেলে, শিশির, ছুটি কাটাতে এসেছিল,তার সঙ্গে ভেগে গেছে।
ভেগে গেছে মানে? ইলোপ করেছে?
ন পিসি?দ্যাটস রিয়েলি ইন্টারেস্টিং!
না রে ভাই। তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল। একদিন খবর এলো সে নাকি জলে ডুবে মরে গেছে। সত্যি কিনা কে জানে।
নিশা বলল, ঠাম্মা আমি এই ন পিসি কে নিয়ে একটা স্টোরি লিখব, আমার ব্লগে।
বেশ, লিখিস। শোন না, লোকে বলে এখনও নাকি মেয়েছেলেটা এদিক ওদিক গভীর জলে ঘাই মারে।
জলজাহাজে চেপে চুল খুলে ঘুরে বেড়ায়।এসব শোনা কথা অবশ্য।
মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ,ডিয়ার ঠাম্মা। ওভাবে বলতে নেই। কোনো মহিলাকে এভাবে বলা যায়না। জানি,ইউ ডিডনট্ মিন ইট।স্টিল।
রাধা ঠাকুমা বললেন,জানিস তো,ঐ রোহিণী নামটাই গোলমেলে।
বঙ্কিমবাবু ঠিক টের পেয়েছিলেন। মানে ঐ বঙ্কিম চাটুজ্জে ,পড়েছিস তোরা?
সেই রোহিণীও ফ্লার্ট করত পরপুরুষের সঙ্গে।তাই ওকে চরম শাস্তি দিলেন।
বাহ্। সেই গোবেচারা গোবিন্দ না কি যেন? সে বুঝি ধোয়া তুলসি পাতা?
আর বোলো না ঠাম্মি, মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।
নিশা আর রাধা ঠাকুমা এখন কফি খাচ্ছে।
নিশা বলল,শোনো ঠাম্মা, রোহিণী নামটাই এখন হিট। একজন অভিনেত্রী ও সমাজবিজ্ঞানী আছে ঐ নামে। এই শহরে একজন গায়িকা আছে। ভালো গায়। তোমাকে শোনাতে পারি ইউটিউবে। ও আবার তোমাদের আমলের বিখ্যাত বটুক দা, মানে জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রর আপন নাতনি।
এবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলি। বিরাট ঔপন্যাসিক। কিন্তু রোহিণীকেই মরতে হলো কেন? লোকটা তো শাস্তি পেলনা।তার দায় ছিল না?
এই কাহিনি নিয়ে সিনেমা, সিরিয়াল সব হয়েছে। স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় করেছিল রোহিণীর রোল। আমার ভালো লাগে নি।
আমিও দেখেছি রে টিভি তে। সন্তুর মেয়ে কিন্তু ভালো পার্ট করে, যাই বলিস।
আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই।
স্টোরি লেখার সময় মনে রাখবি।
স্বপনের ন পিশে এখন চিল হয়ে পুকুর পাহারা দেয়। পুরনো লোকেরা বলে।
কে জানে । সত্যি না গপ্পো।
নিজের বৌকে তো হাড়ে হাড়ে চেনে। তাই আশেপাশে দেখতে পেলে চিল চিৎকারে ছেলে ছোকরাদের সাবধান করে দেয়।আজো মনে হয় ওর ডাক শুনেছি। কিছুক্ষণ আগে।
তুমি না, নিশা হাসতে থাকে।
কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছেন অবিনাশ।না অবিনাশ নয়। নন্দ বাবু।
আজ থেকে শুধু নন্দ বাবু।
ফিডার রোডের বাড়ি, গায়ত্রী মন্ত্র, ঠাকুর্দার মন্ত্রপূত পৈতে,বেলগাছ এবং পোষা বেড়াল মিমি কে ছেড়ে অবিনাশ চলেছেন সাত সমুদ্দুরের পথে, সাবমেরিনে চেপে।
তার ডানপাশে চালকের আসনে বসে আছে রোহিণী, চুল খোলা,নগ্ন বাহুতে অবিনাশের প্রপিতামহ নবকুমারের নাম ট্যাটু করে আঁকা আছে।
ছবি সৌজন্য- গুগল