গল্প।। অবিকল্প ।। অনুরাধা ভট্টাচার্য
প্রতিদিনের মতো সেদিনও দ্বিজেন বাবু সকাল সকাল পেপার পড়তে পড়তে বেশ আয়েশ করে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক টা দিয়েই, বিরক্ত হয়ে মুখের চা টা ফেলে দিয়ে , বেশ একটু চিৎকার করেই ” বাড়িতে কি চিনি ফুরিয়ে গেছে?” রান্না ঘরের ভেতর থেকে দ্বিজেন বাবুর স্ত্রী বেশ নরম সুরেই বললেন,
” চিনি ফুরাবে কেন? ডাক্তার তোমাকে চিনি খেতে বারণ করেছে তাই তোমার চায়ে সুগার ফ্রি বড়ি দিয়েছি ।ওতে ও তো চিনির মতোই মিষ্টি হয় শুনেছি।”
— আ হা , চিনির মতো মিষ্টি হয় ।নিজেও সুগার ফ্রি দিয়ে খাচ্ছ কি?
—– আমার কি সুগার হয়েছে , যে আমি সুগার ফ্রি দিয়ে চা খাব?
এইরকম ছোট খাটো ঝগড়া দিয়েই এই দুই বুড়ো বুড়ির দিন শুরু হয় ও সময় কাটে। কি করবে ! করার তো কিছুই নেই। তাই বলে বুড়ো বুড়ির মধ্যে ভাব ভালোবাসা নেই তা নয় ।একে অপরের প্রচন্ড খেয়াল ও রাখে ।
দ্বিজেন বাবু একজন প্রবাসি বাঙালী,বয়স সত্তর পার হয়ে গেছে। বহুবছর নাগপুরে বাস। নাগপুর সুরেন্দ্র নগরে নিজস্ব ছোট্ট একটা বাংলো টাইপ বাড়ী আছে । বতর্মানে সেখানে থাকার মধ্যে দ্বিজেন বাবু ও তাঁর স্ত্রী স্মিতা দেবী। এনাদের একমাত্র ছেলে চাকরী সুত্রে স্বপরিবারে মুম্বাই তে থাকে। নাগপুরে বহু পরিচিতি।একসময় খুব এদিক ওদিক , এর ওর বাড়ি যাতায়াত ছিল , কিন্তু এখন বয়স হয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যার পর আর কোথাও যাওয়ার ভরসা পান না। আর দিনের বেলায় সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে , তাই দিনের বেলাতেও কোথাও ঘুরতে বা আড্ডা দিতে যাওয়া সম্ভব হয়না। দৃষ্টি শক্তি ও যথেষ্ট কমে আসছে , ফলে গাড়ি চালানোর সাহস ও হয়না। তাই আজকাল কারো সাথেই বিশেষ যোগাযোগ হয়না বললেই চলে। দ্বিজেন বাবুর গাছ পালার খুব সখ । তাই সামনের ছোট্ট উঠোন মতো জায়গাটায় তিনি বেশ কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে ,তার ই পরিচর্যা নিয়ে সময় কাটান ।
গিন্নি স্মিতার সাথে চা নিয়ে ঝগড়া করলেও সেই সুগার ফ্রি চা ই তাকে শেষ মেশ খেতে হোল ।তারপর তিনি যথারীতি তাঁর বাগান পরিচর্যায় লেগে গেলেন। স্মিতা দেবীও তার রান্না ঘরে রান্না করতে করতে দ্বিজেন বাবুর সাথে কলকাতায় গিয়ে কোথায় উঠবেন , কার কার সাথে দেখা করবেন , কোথায় কোথায় বেড়াবেন ,সেই সব প্রোগ্রাম ঠিক করছিলেন । কারন এই মাসে তাদের ছেলে-বৌমা তাদের কলকতায় বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে রেখেছে । কলকাতায় বৌমার কোন আত্মীয় র বিয়ে আছে , তাই তারা কলকাতায় যাবে, সেই সাথে এনাদের ও নিয়ে যাবে ।বহু বছর দ্বিজেন বাবু ও স্মিতা দেবীর কলকাতায় যাওয়া হয়নি । তাই এই সুযোগ টা কেউই হাতছাড়া করতে চায়না।ছেলে ও বিশেষ ছুটি ছাটা পায়না , তাই সবাই একসাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ও হয়না।এই বার এই কলকাতা যাওয়ার প্রোগ্রামে সকলেই খুব খুশি। বিশেষ করে নাতি-নাতনিকে সাথে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দে দুই বুড়ো বুড়ির মন যেন মেতে উঠেছে।নাতি নাতনি কে নিয়ে চিড়িয়াখানা , মিউজিয়াম,বেলুরমঠ,আরো কোথায় কোথায় বেড়াবেন সেই আলোচনায় মত্ত, ঠিক তখনই ঘরের ভেতর ফোনটা বেজে উঠলো।ছেলের ফোন এসেছে মনে করে স্মিতা দেবী রান্না ফেলে তাড়াতাড়ি গিয়ে ফোনটা ধরেন । হ্যাঁ, ছেলের ই ফোন। — ” হ্যালো , রজত , হ্যাঁ আমরা ভালো আছি। —- তোরা কবে আসছিস? —- কি ???? তোদের আসা হবে না? কলকাতায় বিয়েতে যাবিনা! ——- এখানে ও আসবি না? ——আচ্ছা—- ভালো থাকিস ।দাদুভাই আর দিদিভাইকে আমাদের আদর দিস ।তোরা সাবধানে থাকিস ।” —— ফোনটা রাখতেই দ্বিজেন বাবুর প্রশ্নের ঝড় শুরু হয়ে গেল।কি বলল, সবাই ঠিক আছে তো ? কি বলছিলে তুমি — আসবে না , না কি যেন একটা শুনলাম। কি হয়েছে?
স্মিতা দেবী নিজেকে একটু সামলে নিয়ে , —-” খোকারা কলকাতায় যাবে না, এখানেও আসতে পারবেনা।খোকা ইউ এস এ তে একটা ভালো অফার পেয়েছে।ওকে এমাসেই জয়েন করতে হবে।আর এখন একবারে সকলকে নিয়েই চলে যাবে । যাওয়ার আগে পাসপোর্ট ভিসা এবং অনেক প্রস্তুতির ব্যাপার আছে । সেই নিয়েই খুব ব্যস্ত। তাই যাওয়ার আগে এখানে আসার ও সময় পাবেনা।”
এরপর দুই বুড়ো বুড়ি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকল । কারুর মুখে কোন কথা নেই।একটু পরে দ্বিজেন বাবু —” কি কলকাতা ঘুরলে ? কোথায় কোথায় বেড়ালে ? নাতি নাতনি নিয়ে খুব আনন্দ করলে তো ?”
—-একা আমি ই স্বপ্ন দেখেছিলাম, তুমি দেখনি?
—- না। তুমি তো আবার এই এক যুগ বাদে তোমার সেই স্কুল কলেজের বন্ধু দের সাথে দেখা করার প্রোগ্রাম ও মনে মনে তৈরি করেছিলে !আমার তো আর অত বন্ধু নেই । তাই দেখা করার প্রত্যাশাও নেই।যাই হোক সাধ মিটেছে তো ?
এইভাবেই একাকীত্বের মধ্যে তাদের দিন কাটতে থাকে। দ্বিজেন বাবু মুখে কিছু বলেননা তবে ছেলের প্রতি খুবই অসন্তুষ্ট। ছেলের নাম মুখে পর্যন্ত আনেন না।
এইরকম ই একদিন সকালে দ্বিজেন বাবু যথারীতি তাঁর বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত আর স্মিতা দেবী রান্না ঘরে , সেই সময় বাইরের গেটে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের একটা ছেলে —“নমস্তে জী ,” দ্বিজেন বাবু মুখ তুলে তাকিয়ে –” বোলিয়ে”
ইঁহা কোই কিরায়া পে মকান মিলেগা ক্যা?
কথার টোনেই দ্বিজেন বাবু বুঝে যান যে ছেলেটি বাঙালী। তাই , “আপনি বাঙালী? আসুন ভেতরে আসুন।”– বলে ছেলেটি কে ভেতরে ডেকে নেয়। অন্যদিকে বাংলায় কথা শুনে ছেলেটি যেন ধরে প্রাণ ফিরে পায়।বাড়ির ভেতরে ঢুকে — ” আপনি বাঙালী , ওফ্, কি শান্তি ।মনে হচ্ছে যেন কয়েক যুগ বাদে বাংলা কথা শুনতে পাচ্ছি।”
—বসো , ওই চেয়ারটায় বসো । তুমি কি এখানে নতুন? কি নাম তোমার ?
—- আমার নাম শ্যামল তরফদার। হ্যাঁ , গত সপ্তাহে এসেছি।আপাতত দিন পনেরো থাকার ব্যবস্থা অফিস থেকে ই দিয়েছে।তার মধ্যে সাত দিন তো পার হয়ে গেল।বাকি দিন সাতেকের মধ্যে একটা বাড়ি না পেলেই নয় । আপনাদের এখানে একটা ঘর হবে?
বাংলা কথা শুনে স্মিতা দেবী রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। — “তুমি তো একাই থাকবে , এখানে কোন হোস্টেলে খোঁজ করে দেখ , একজনের ব্যবস্থা নিশ্চই হয়ে যাবে ।”
বেশ একটু লজ্জা পেয়েই বলল, না মানে , মাস ছয়েক হোল আমার বিয়ে হয়েছে। তাই ,আমি ঠিক একা থাকবো না । আসলে নতুন জায়গা , প্রথম আসছি , এখানে কিছু চিনিনা জানিনা তাই প্রথমে একাই এসেছি ।বাড়ি পেয়ে গেলে ,আগামী মাসে একসাথে দিন তিনেকের একটা ছুটি আছে , ভাবছিলাম তখন বৌ কে নিয়ে আসব। তাই , ওয়ান বেডরুমের একটা ফ্ল্যাট বা বাড়ি যদি —
দ্বিজেন বাবু বললেন, সে তো ভালো কথা ।
পেপারে অনেক এড আসে , সেখান থেকে খোঁজ কর , পেয়ে যাবে ।
— আপনাদের বাড়িতে একটা ঘর —
না বাবা, আমাদের তো একস্ট্রা ঘর নেই , তাছাড়া আলাদা রান্না ঘর , আলাদা বাথরুম, এসব কোন ব্যবস্থা ই আমার এখানে নেই। তোমার ফোন নাম্বার টা দিয়ে যাও , আমি পরিচিতি দের সাথে কথা বলে দেখব।যদি পেয়ে যাই তোমায় ফোন করে দেব।
বেশ মনোক্ষুন্ন হয়ে শ্যামল চলে যেতে নিলে স্মিতা দেবী বলে , একটু চা ,জল খেয়ে যাও প্রথমদিন এলে ।
আজ নয় , পরে আবার যেদিন আসব সেদিনের জন্য তোলা রইল ।আজ দেখি একটু ঘুরে যদি কোথাও বাড়ির সন্ধান পাই ।
দ্বিজেন বাবু বললেন , হ্যাঁ বাবা আবার এস । আমি ও সন্ধান পেলে তোমায় জানাব ।
ছেলেটি নিজের একটা কার্ড দ্বিজেন বাবুর হাতে দিয়ে —এতে আমার ফোন নাম্বার আছে, বলে নমস্কার করে , আসি বলে চলে যায় । শ্যামল চলে যাবার পর থেকে, স্মিতা দেবী র মনে ঘর ভাড়া দেবার সখ জেগে উঠল ।সে প্রায়ই দ্বিজেন বাবু কে বলে ঘর দোর মেরামত করে একটা এক্সট্রা ঘর তুলে ভাড়া দিলে মন্দ হয়না । কিন্তু দ্বিজেন বাবুর প্রস্তাব টা পছন্দ হয় না। একদিন রেগে গিয়ে বলে , আমি আর এই বাড়ি মেইনটেন করতে পারছিনা। অনেক পুরনো বাড়ি ।চারদিক থেকে ভেঙে পড়ছে ।ভাবছি প্রোমোটার কে দিয়ে দেব । সেদিন একটা প্রোমোটার বলছিল , এখানে খুব সুন্দর একটা বিল্ডিং হতে পারে । আমি রাজি থাকলে ওরা আমায় একটা ফ্ল্যাট, সাথে বেশ কিছু টাকা দেবে ।যা দিয়ে আমাদের আগামী দিনগুলো স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে । তোমার ছেলের টাকার আমাদের কোন প্রয়োজন পড়বে না ।
ও – ও – ও,ছেলে এখন আমার একার হয়ে গেল বুঝি? তবে যাই বল তোমার ঐ ফ্ল্যাটে থাকায় আমার একটু ও মত নেই ।আর খোকা রাজি হবে ?
কি যায় আসে তোমার খোকার রাজি হওয়া না হওয়ায়? বাড়ি আমার, আমি বাড়ি কি করবো সে আমি বুঝবো।আর জেনে রাখ , তোমার খোকা এবাড়িতে আর কোনদিনই ফিরছে না । যে একবার দেশের বাইরে যায় সে আর দেশে ফেরে না। ফিরতে চায় না।
এরপর এই বাড়ি প্রোমোটার কে দেওয়া নিয়ে প্রায়ই দুজনের মধ্যে বাক- বিতন্ডা, মনো মালিন্য চলতেই থাকে । স্মিতা দেবীর অপছন্দ কে অগ্ৰাহ্য করে দ্বিজেন বাবুর এক প্রোমোটারের সাথে কথা বার্তা সবে শুরু হয়েছে , এমন সময় একদিন সন্ধ্যাবেলা সেই বাঙালী ছেলেটি , শ্যামল ,বউ কে কলকাতা থেকে নিয়ে এসে হাজির।সাথে একটা সুটকেস ছাড়া অন্য কোন লাগেজ না থাকায় দ্বিজেন বাবু ও স্মিতা দেবী প্রথম টা বুঝতে পারেনি , ভেবেছেন বউ নিয়ে দেখা করতে এসেছে । তাই খুব যত্ন করে ঘরে নিয়ে বসায় । জিজ্ঞ্যেস করে ” বউকে কবে নিয়ে এলে? বাড়ি পেয়েছ? কোথায় , কেমন বাড়ি পেলে? ” কোন উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে স্মিতা দেবী একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন ।এবার স্মিতা দেবীর প্রশ্ন শেষ হলে শ্যামল বলল , —” আমরা এখন ট্রেন থেকে নেমে সোজা এখানে এসে উঠেছি। আমাদের এখানেই একটু থাকার জায়গা দিন ।আমি এখনও কোন ঘর পাইনি। “
দ্বিজেন বাবু খুব ক্ষেপে গিয়ে –“ঘর পাওনি তো বউকে নিয়ে এলে কেন? আমার এখানে তোমাদের থাকার মত কোন জায়গা নেই।”
দ্বিজেন বাবুর এই ব্যবহারে স্মিতা দেবী খুব অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন। তাই তাঁকে শান্ত করতে –” আহা, এখন এই সন্ধ্যা বেলায় ছেলেটা বউ কে নিয়ে কোথায় যাবে ? ও তো এখানে কিছুই চেনে না ।আজকের রাত টা অন্তত ওরা খোকার ঘরেই—-“
এবার শ্যামলের বৌ সাথী, দ্বিজেন ও স্মিতা দুজনকে প্রনাম করে ” আপনাদের ঘরে আমাদের জন্য জায়গা না থাকলে এখানে এই বারান্দায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেব । আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। বলে স্মিতা দেবীর কাছে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ” তোমাদের কাছে আমাদের একটু জায়গা হবে না, আমি তো তোমাদের কাছে , তোমাদের সাথে থাকব বলেই এসেছি।”
সাথীর কথায় এমন কিছু ছিল যে স্মিতা কেন দ্বিজেন বাবু ও আর মানা করতে পারলেন না। স্মিতা দেবী তো সাথীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, সত্যিই আমাদের সাথে থাকবে? তা বেশ তো , থাকবে । সাথে সাথে দ্বিজেন বাবু —” কি করে থাকবে? আমার এ বাড়ি তো ভাঙা পড়বে ।আমি প্রমোটারকে বাড়ি দিয়ে দিচ্ছি।সাথী মিষ্টি হেসে , এখন ও তো দেওয়া হয়নি । যতক্ষন বাড়ি ভাঙা না হচ্ছে ততক্ষণ তো কোন অসুবিধা নেই? ততক্ষণ তো আমরা থাকতে পারি?এবার দ্বিজেন বাবু বেশ নরম আওয়াজে , ” কিন্তু মা , এখানে যে থাকবে তোমাদের তো একটা আলাদা রান্না ঘর, বাথরুম লাগবে । আমার এখানে তো তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।
সাথী বলল কিচ্ছু লাগবে না। আপনার ছেলে, ছেলের বৌ থাকলে তাদের কি এসব আলাদা ব্যবস্থা লাগতো? আমরা আপনাদের সাথে একসাথে থাকব।
কিন্তু মা তোমাদের জন্য একটা ঘর তো চাই ।
—মেশোমশাই, আপনার ছেলের ঘরটা তো খালি ই পড়ে আছে ।আমরা ওদের বিছানা টা ছাড়া আর কোন জিনিস ব্যবহার করব না । কথা দিচ্ছি । কটাদিন তো একসাথে থাকি , তারপর আপনার আমাদের কে ভালো না লাগলে নাহয় তখন চলে যাব।
সাথী র জোরাজুরি তে দ্বিজেন বাবু আপত্তি সত্ত্বেও না বলতে পারলেন না। সেই রাত থেকেই শুরু হোল এদের নতুন জীবন। সাথী তার মিষ্টি ব্যাবহারে দুই বুড়ো বুড়ি ও তাদের সংসার টাকে নিজের করে নিল।
প্রতিদিন সকালে উঠে চা করা থেকে শুরু করে , স্মিতাকে রান্নাঘরে রান্না র কাজে সাহায্য করা, দ্বিজেন বাবুকে সময় মতো ওসুধ খাওয়ানো র দ্বায়িত্ব , সব নিজের হাতে তুলে নেয়। সাথী তার সদ্য বাবা-মা কে হারানোর দুঃখটাও যেন এদের স্নেহ ছায়ায় প্রায় ভুলেই গিয়েছে। শ্যামল মনের সুখে চাকরী করছে, প্রবাসে বৌ কে সারাদিন একা একা থাকতে হয় না ।এটা তার বিরাট নিশ্চিন্তি।আর দ্বিজেন বাবু ও স্মিতা দেবী ও শ্যামল ও সাথীর সংস্পর্শে নিজেদের একাকীত্ব ভুলে আনন্দে আত্মহারা। ইতিমধ্যে দ্বিজেনবাবু প্রমোটারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আর শ্যামল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙা চোরা বাড়িটা মেরামত করিয়ে, সুন্দর করে রং ও করিয়ে দিয়েছে । এইভাবে আনন্দে কোথা দিয়ে দুটো বছর পার হয়ে গেছে কেউ টের ই পায়নি।
এমন ই সুখের সংসারে হঠাৎ যেন এক বাজ পড়ল , সেদিন যখন শ্যামল অফিস থেকে ফিরে বলল ,ওদের নাগপুরে থাকার মেয়াদ শেষ ।সবাই চমকে উঠল ।”কেন কি হ’ল”? শ্যামল বলল সে পুনাতে খুব ভালো একটা অফার পেয়েছে। সামনের মাসে জয়েনিং। অফিস থেকেই থাকার জন্য ফ্ল্যাট দিচ্ছে।ফলে বাড়ি খোঁজার ঝন্ঝাট নেই।আর স্যালারি এখনকার থেকে দুগুন ।ফলে আর কিছু ভাবার কোন অবসর নেই।
প্রথম টা সবাই চুপ হয়ে গেল।তারপর দ্বিজেন বাবু রাগে ফেটে পড়লেন ।” কি ভেবেছ টা কি তোমরা ? যে যার নিজের স্বার্থ নিয়েই আছ ? আমরা কি শুধু তোমাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বসে আছি? খুশি হোল এলে , খুশি হোল চলে যাবে — ।এই জন্যই আমি প্রথম থেকে মানা করে ছিলাম ওদের এখানে থাকতে দিতে।”। সাথী তাড়াতাড়ি দ্বিজেন বাবু কে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। বলে , মেশোমশাই আপনি উত্তেজিত হবেন না , আপনার শরীর খারাপ হব । প্রেসার বেড়ে যাবে।
—-“থামো , অনেক হয়েছে ।আর দরদ দেখাবার দরকার নেই।যাও যাও যার যেখানে যাবার এখন ই চলে যাও । ভুল তো আমাদের ই । নিজের ছেলেই আপন হোল না , আমাদের কথা কোনদিন ভাবলো না ।মুলুক ছেড়েই চলে গেল নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে। এদের ই বা দোষ দেব কি দিয়ে? ” এবার সাথী মুখ খুলল। আপনার ছেলে আর ছেলের বৌ আপনাদের কথা ভাবে না, এটা আপনার ভুল ধারণা।ওরা আপনাদের কথা না ভাবলে আমরা এখানে এলাম কি করে?
দ্বিজেন বাবু ও স্মিতা দেবী প্রায় একসাথে ই –“মানে ?”
মানে , আপনাদের ছেলের বৌ আর আমি খুব ছোট্ট বেলার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ।ওরা যখন ইউ এস এ তে চলে যায় , সেই সময় ই শ্যামলের নাগপুরের চাকরী টা হয়েছে । এখানে শ্যামল ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছে শুনে ওরাই আমাকে বলেছে এখানে এসে আপনাদের সাথে থাকার জন্য।মেশোমশাই রাজি হবেন না সেটাও ওরা জানতো । আমি বলেছিলাম , আমি ঠিক রাজি করিয়ে নেব ।আর সুমি , মানে সুমিতার , আপনাদের বৌ এর ও আমার উপর ভরসা ছিল । আমরা এখানে আপনাদের সাথে থাকায় ওরা ও নিশ্চিন্তে আছে ।আর মেশোমশাই , আপনি ছেলের ওপর রাগ করে ওর ফোন তোলেন না , ওদের সাথে কথা বলেন না, এতে কি ওদের কষ্ট হয় না ? আমাদের কাছ থেকে প্রতিদিন ওরা আপনাদের খবরা খবর নেয় ।তবু মাসিমা কথা বলে এটাতে একটু ওদের মন শান্ত থাকে । কিন্তু আপনি ওদের খুব কষ্ট দেন ।
—- বেশ করি । কি লাভ সবার কথা ভেবে ? আমাদের কথা কে ভাবে ? তোরা ভাবছিস?
এবার শ্যামল বলে , আপনিই বলুন , এত ভালো অফার টা আমি কি করে ছেড়ে দিই? তবে এখানে আমার এক বাঙালী কলিগ আছে , যে পরিবার নিয়ে এখানে মানে নাগপুরেই থাকে ।সে বলেছে আপনাদের খোঁজ খবর রাখবে । আপনাদের সাথে রেগুলার যোগাযোগ রাখবে ।ওরা খুব মিশুকে । আপনাদের ও ওদের কে খুব ভালো লাগবে ।
এতক্ষন পরে স্মিতা দেবী কথা বললেন , —-“শ্যামল , তোমার যাওয়া টা কবে ? “
— মাসিমা , আমার নয়, আমাদের , মানে আমি আর সাথী দুজনেই যাব । সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে।
— না বাবা , আপাতত তুমি একাই যাবে । সাথীর এখন যাওয়া হবেনা ।
— মানে? সাথীর যাওয়া হবেনা মানে?
—মানে সাথী এখন তোমার সাথে যাবেনা।
—-কিন্তু মাসিমা, সাথী অস্হির হয়ে বলে ,আমি ওর সাথে না গেলে ওর অনেক অসুবিধা হবে। তুমি তো জানো ও বাইরের খাবার খেতে পারে না।আর নিজে বানিয়ে খাবে তাও তো পারবে না ।ওর দেখাশোনার জন্য আমার যাওয়া খুবই প্রয়োজন।
—–কিন্তু এই মূহুর্তে তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন তোর দেখাশোনা করা , যেটা শ্যামলের পক্ষে সম্ভব নয়।ও তো সারাদিন অফিসে থাকবে ।তারপর ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে নিজে বিশ্রাম করবে না তোর দেখাশোনা করবে?
মাসিমার কথার কোন অর্থ না বুঝে শ্যামল অবাক হয়ে বলল ” আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন , আমি কিছু ই বুঝলাম না।”
— সাথী এখন একা নয় । তোমার সংসারে নতুন অতিথি আসছে ।তাকে স্বাগত জানাতে এই সময় সাথীর খুব যত্নের প্রয়োজন।এখন তো আগত সন্তানের জন্য তোমাকে এটুকু কষ্ট সহ্য করতেই হবে বাবা।
মাসিমার কথায় শ্যামল অবাক হয়ে সাথীর দিকে তাকায়। দ্বিজেন বাবু খুশি তে আটখানা হয়ে —” আরে এতো দারুন খবর শোনালে গিন্নি। এই খুশিতে চল আজ পার্টি হয়ে যাক।” সাথী লজ্জায় মাসিমার বুকে মুখ লুকায় ।
illustration-google, various artist