মৃগতৃষ্ণা।। অনন্যা পাল

খ্রীঃ পূঃ তিনশ শতাব্দীর মৌর্যবংশীয় সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের ইতিহাসে কিংবদন্তী, তাঁর ধর্মাচরণের ব্যাপ্তি ঘটেছে সমগ্র প্রাচ্যে, যার সাক্ষী হয়ে আছে অসংখ্য শিলালিপি, স্তূপ ও বৌদ্ধ পঞ্জিকা। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয় তাঁর জীবনী ‘অশোক-অবদান’, যেটি চৈনিক ভাষায় অনুবাদ হয়; শ্রীলঙ্কার পালি ভাষার ‘মহাবংশ’ পুঁথিটিতেও অশোকের আখ্যান বর্ণিত হয়েছে এই গ্রন্থের ভিত্তিতে। অশোক-অবদানে সম্রাটের যে পরিচয় পাওয়া যায়, সে এক রক্তমাংসের মানবের, স্নেহ, প্রেম, ক্রোধ, ঈর্ষার ঊর্ধ্বে তিনি নন। জীবনের শেষ ভাগে তরুণী পত্নীর মোহ, পুত্রস্নেহ ও পূণ্যার্জনের উন্মাদনা রাজপরিবার তথা মগধ সাম্রাজ্যে বয়ে নিয়ে এসেছিল অনিশ্চয়তা, যার আগুনে দগ্ধ হয়েছেন তিনজনেই, অশোক, যুবরাজ কুনাল ও রানী তিষ্যরক্ষিতা।

***

মৌর্যকুলতিলক অশোকের রাজ্যাভিষেকের পরে কেটে গেছে প্রায় চৌত্রিশ বছর, বয়স সত্তর ছুঁয়েছে, কালের নিয়মে বৃদ্ধ হয়েছেন রাজাধিরাজ, তবু কর্মোদ্যম ও প্রজাপালনে এখনও তিনি সমান উজ্জীবিত। প্রধানাপত্নী অসন্ধিমিত্রা, প্রিয়ভার্যা কৌরবকি ও পদ্মাবতী একে একে চলে গেছেন সকলেই, বৃদ্ধবয়সের একাকীত্ম দূর করতে তিনি বিবাহ করেছেন সুন্দরী তিষ্যরক্ষিতাকে কয়েকমাস পূর্বে। তিষ্যরক্ষিতা স্বামীর একান্ত অনুগামিনী, এ বিবাহে সুখী হয়েছেন সম্রাট; সুযোগ্য পুত্র কুণালকে যুবরাজ ঘোষনা করেছেন তিনি, তাঁর অবর্তমানে সাম্রাজ্যরক্ষার  দুশ্চিন্তা নেই সেকারণে। এখন শুধুই ধর্মচিন্তা; সঙ্ঘাচরণের প্রচার, দান ও লোককল্যাণ, তথাগতের চরণ লাভের তীব্র আকাঙ্খা।

সম্রাটের আত্মকথনঃ

বড় ক্লান্ত লাগছে আজ উৎসব সমাপনের পশ্চাতে, শরীর অশক্ত হয়েছে অনুভব করি সেকথা; তবু আমি পরিতৃপ্ত। একপক্ষকাল ব্যাপী রাজোদ্যানে আয়োজিত বৌদ্ধ মহাসভা সফল হয়েছে দুই সহস্র অর্হৎ এর উপস্থিতিতে, স্বর্ণমূল্যে দানপেটিকা পাঠানো হয়েছে পাঁচহাজার সঙ্ঘে। ভগবন! ধর্মপথে অচল রেখো। ‘ওম মণিপদ্মে হুম!’ আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে দৃঢ়বদ্ধ করে যেতে চাই বুদ্ধের পথ, যা পৃথিবীর একমাত্র সত্য। দান, সত্য, ক্ষমা, পরম ধর্ম বলে মেনে এসেছি এই জীবনে; না ক্ষমা নয়, ক্ষমা নয়! ধর্মরক্ষা করতে, প্রায় বিশ সহস্র আজীবকের প্রাণনাশ করতে হয়েছে পুন্ড্রবর্ধনে, উদ্ধত নির্গ্রন্থ-উপাসকদেরও হত্যার আদেশ দিয়েছি অতীতে, কিন্তু সে তো রাজধর্ম। বৌদ্ধবিদ্বেষী দুর্বিনীত প্রজার শাসন ক্ষত্রীয় পুরুষের কর্তব্য।

সন্ধ্যার অস্তরাগে, শয়নকক্ষ বড় বেশী অন্ধকার লাগে কেন? তবে কি চোখের জ্যোতি কমে এলো, নাকি আলো দিতে অবহেলা অন্তঃপুরবাসিনীদের? মহাদেবীর প্রয়াণের পর থেকে দাসীদের সেবায় সে আন্তরিকতা কোথায়! নিজের কুশ্রীতার প্রতিফলন দেখেছি আমি তাদের প্রেমহীন আসঙ্গে, ঐশ্বর্য্য, ক্ষমতা সবই সেখানে মূল্যহীন।

চন্দনের গন্ধ পাই যেন, কঙ্কণের রিনিঝিনি? দীপ হাতে কে ও? তিষ্যরক্ষিতা, দেবী! আমার শুষ্ক জীবনের বসন্ত মলয়, পূর্ণ চন্দ্রকলা; এসো প্রিয়ে, কাছে এসো!

তিষ্যরক্ষিতার মনের কথাঃ

শুক্লপক্ষের চৈতালী সন্ধ্যা, প্রসাধন, কেশসজ্জা সেরে আজ পরিধান করেছি রক্তবর্ণ অন্তরীয় ও সুক্ষ চীনাংশুকের স্বর্ণালী উত্তরীয়; সর্বাঙ্গে স্বর্ণ আভরণ, সিঁথিতে একটি সিংহলী পদ্মরাগ; অলকাতিলক চর্চিত মুখখানি তুলে ধরে সখী পিঙ্গলা হেসে বলেছিল দেবভোগ্যা রূপ। অস্তরাগের নরম আলোয় শয়নমন্দির কেমন যেন স্বপ্নময়, মৃদু পায়ে প্রবেশ করতে গিয়ে থেমে যাই নিজের অজান্তে। দীপ হাতে তবে কি অভিসারে চলেছি আমি, সেই কাঙ্খিত পুরুষটির জন্যে?

‘এসো প্রিয়ে, কাছে এসো!’ বৃদ্ধের উৎসুক কন্ঠস্বরে মোহভঙ্গ ঘটে; আধো অন্ধকারে কর্কশ কুরূপ মূর্তি যেন জান্তব মনে হয়, বিবিমিষা জাগে সমস্ত শরীরে। হাসিমুখে তবু এগিয়ে যাই, দীপখানি তুলে ধরি সমুখে প্রেমঘন দৃষ্টিতে; স্বামীর জরা কবলিত মুখশ্রীতে মুগ্ধতা ও আগ্রহের আতিশয্য। এমনি করেই কেটে যায় আরও একটি দাম্পত্যের রাত্রি; চীনাংশুক  রত্নআভুষণে ঢাকা পড়ে যায় ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস।

কিন্তু আমি কি এমনটাই চাইনি? বিলাস ব্যাসন, রাজমহিষীর পদমর্যাদা, বৃদ্ধ সম্রাটের একনিষ্ঠতা; এরই আশায় নিজেকে প্রস্তুত করেছি তিলে তিলে দীর্ঘ চার বছর কাল। মহাদেবীর দাসী থেকে আজ মগধ সম্রাজ্ঞী, পথ মসৃণ ছিল না; জিবৎকালে অসন্ধিমিত্রার অবজ্ঞা, অপমান, আজ ধূসর স্মৃতি মাত্র। ‘ছলাকলাময়ী, কুটিলা, উচ্চাকাঙ্খী’, মহাদেবী শেষের দিনগুলিতে এরকমই বাক্য প্রয়োগ করতেন, আমার প্রতি সম্রাটের আগ্রহ দেখে; দাসীরাও একই কথা বলে আড়ালে, আমি জানি।

কিছুদিন আগেও নিজের সৌভাগ্যে আশ্চর্য্য হয়েছি আমি নিজেই। সম্রাটের মনযোগ পেতে প্রাণ পণ করতেও প্রস্তুত ছিলাম একসময়। মনে পড়ে, বিবাহের পর প্রথম বুদ্ধ পূর্ণিমা, উৎসবমুখর সমগ্র নগরী। দানে, উপহারে মহাব্যস্ততা রাজপুরীতে, বিশেষ উপাসনা চলছে অহোঃরাত্র সামবোধি মন্দিরে। এত আয়োজনের মাঝেও সম্রাট স্বর্ণালঙ্কারের বিশেষ উপঢৌকন পাঠাতে ভোলেননি কোনও এক নারীকে, বোধি তার নাম। ঈর্ষার অনলে জ্বলে উঠেছিলাম সেদিন, সম্রাট আমার, শুধু আমার, অন্য কারো নয়! গোপনে ডেকে পাঠিয়েছিলাম এক কৃত্যাকে, উৎকোচ দিয়েছিলাম কমলহীরার কর্ণকুন্ডল; যাদুবিদ্যায় বিনষ্ট করবে সে বোধির রূপ যৌবন। রাজ-অন্তঃপুরের প্রাচীরেরও কান আছে, সম্রাটের কাছে পৌঁছেছিল সংবাদ অচিরেই; ছুটে এসেছিলেন সেদিন মহারাজধিরাজ অসহায় শিশুর মত। ‘নিরস্ত হও প্রিয়ে, বোধিকে বিনষ্ট কোর না! সে নারী নয়, সামবোধির মহাবোধিবৃক্ষ!’  মগধ সম্রাট নতজানু আমার কাছে, বলপ্রয়োগে নয়, কাতর অনুনয়ে জিতে নিতে চান আনুকুল্য। তাঁর বিবশ চোখের দৃষ্টিতে প্রথম অনুভব করেছিলাম, আমি সত্যই সম্রাজ্ঞী, মগধের রাজদণ্ড আমারই পদতলে, আমি মগধেশ্বরী!

দিনটি ছিল মাঘী পুরোন্মাসী, বসন্তের আগমন বার্তা বাতাসে, উদ্যানের তরুশাখে, শুকশারীর অবিশ্রান্ত কুজনে। স্নানান্তে জলপূর্ণ ঘট হাতে পূজার্চনায় চলেছি রাজবাটিকার প্রাচীন বোধিবৃক্ষের উদ্দেশ্যে, পবিত্র পার্বণে স্বামী সংসারের মঙ্গল কামনায় এই শুভাচার। কমলদীঘির পাড় বেয়ে পথ চলেছি, পিছনে উপাচার হাতে অনুগামিনীর দল; দীঘিতে ফুটে আছে নীলপদ্ম, মরালের ঝাঁক খেলা করে তার জলে। দীঘির একপাশে অশোক তরু ফুলে ফুলে আবিররঙা, পাথরে বাঁধানো বেদীমূল কুসুমাস্তির্ণ, ফুলের ভারে বুঝিবা নুয়ে পড়েছে তরুশাখ, মধুমাসে এ যেন নববধূর সজ্জা। পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই অচল হয়ে পড়ে চরণ, বেদিকায় বসে কে এই নবীনকান্তি পুরুষ? নীমিলিত আঁখি, ভাবসমাহিত অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী, স্বয়ং কন্দর্প নেমে এসেছেন কি ঋতুরাজের সম্বর্ধনায়?মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকি আমি না জানি কতক্ষণ। আচমকা চোখ মেলে চান যুবক, কি অপূর্ব তাঁর দুটি আঁখি, যেন আকাশের সবটুকু নীলিমা ধরা দিয়েছে ওই গভীর দৃষ্টিতে। কিছুটা বিস্ময় ফুটে ওঠে যুবকের অভিব্যক্তিতে, আমিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি নিজের বিহ্বলতায়। ‘মার্জনা করবেন আর্য, সাধনায় ব্যাঘাত ঘটালাম আপনার’, বলে উঠি আমি। ‘এ আমার সৌভাগ্য দেবি, আমি সম্মানিত’। ‘এই নির্জনে একাকী, কি আপনার পরিচয় দেব, জানতে আগ্রহ হয়’, কন্ঠ কেঁপে ওঠে আমার নিবিড় লজ্জায়, এক অপূর্ব সুখানুভূতি গ্রাস করে সমস্ত অন্তর, এই কি তবে প্রেম? জীবনে প্রথমবার নিজেকে বড় দুর্বল মনে হয়, যেন যুবকের চরণে আত্মসমর্পণেই আমার সকল প্রাপ্তি। ‘আমি কুনাল, সম্রাটপত্নীকে আমার নমন’, ওই সুগভীর কন্ঠের অভিবাদন বজ্রপাতসম পলকে ছিন্ন করে দেয় মায়াজাল, যুবরাজ কুনাল, আমার সপত্নীপুত্র! তপ্তশলাকা কর্ণকুহর ভেদ করে দগ্ধ করে দেয় হৃদপিণ্ড, বিনা সম্ভাষনে স্থান ত্যাগ করি আমি ত্রস্ত্য পায়ে।

কুণালের চিন্তনঃ

মাঘী পুরোন্মাসীর পূণ্যদিবসে, প্রতিদিনের মতই ধ্যানে বসেছিলাম অশোক তরুমূলে, তথাগতের জ্ঞানের আলোকজ্যোতিতে নিজেকে অন্বেষন করে ফিরি আমি, বড় শান্তি এই নিভৃত উপাসনায়। হঠাতই কোনও আলতো শব্দে মনযোগ ভঙ্গ হোল, চোখ মেলে দেখি এক নারীমূর্তি; যৌবনবতী, অগ্নিশিখাসম  উদগ্র রূপ তার, স্বর্গচ্যূতা অপ্সরা যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে বনপথে আমারই পানে চেয়ে নিঃসঙ্কোচ কৌতুহলে। অপরূপ তার দেহভঙ্গিমা, মুখশ্রীর সলজ্জ আগ্রহ, যেন আমারই পায়ে ঢেলে দিতে চায় অন্তরের সবটুকু মাধুর্য, হৃদয় বিবশ হয়েছিল আমার পৌরুষের অহঙ্কারে। বিভ্রম দূর হতে সময় লাগেনি, রাজোদ্যানের নির্জন পথে সহচরী পরিবৃতা, সালঙ্কারা রূপসীর পরিচয় বুঝে নিয়েছিলাম সহজেই; রাণী তিষ্যরক্ষিতা, পিতার ধর্মপত্নী তিনি! কিন্তু পরপুরুষের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়, এ কেমন ঘরণী? না না, কয়েক মূহূর্তের জন্য আমিও তো ভুলেছিলাম প্রিয়া কাঞ্চনমালার মুখ; পরস্ত্রীর সমালোচনা আমাকে সাজে না। শান্তি! শান্তি! ভগবন, পথ দেখাও!

পিতার কাছে অপরাধী আমি আজ, নিজের অজান্তেই প্রলুব্ধ করেছি তাঁর সহধর্মিণীকে, এও তো বিশ্বাসঘাতকতা। মগধ সম্রাট, ধর্ম সঞ্চারক, লোক হিতৈশী, বিশাল পুরুষ, তবু আমার প্রতি তিনি শুধুই স্নেহময় পিতা। তাঁর স্নেহের ঝর্ণাধারা জন্মলগ্ন থেকে নেমে এসেছে আমার শিরে নিঃশর্তে, আজ আমারই কারণে ঘটে গেলো একি অঘটন! ধিক্কার নিজেকে!

সম্রাটঃ

চতুরশীতিসহস্র ধর্মরাজীকা নির্মাণ করব তথাগতের স্মরণে, এই ছিল আমার জীবনের আকাংক্ষা; পথ সহজ ছিল না, দীর্ঘদিনের অভিপ্রায়ে সমাধা হয়েছিল এ কার্য যে পূণ্যদিনে, কুণাল জন্ম নিয়েছিল সেদিন। পুত্রলাভের আনন্দ শতগুণ হয়েছিল ধর্ম সংকল্প পূরণের সন্তুষ্টিতে; ধন্য ধন্য করেছিল সমস্ত অমাত্যসভা, ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ উপগুপ্ত নিজে উপস্থিত থেকে আশীষ জানিয়েছিলেন নবজাতকের উদ্দেশ্যে। পদ্মাবতী বলেছিল লাজনম্র স্বরে, ‘মহারাজ পুত্রের মুখদর্শন করুন, সার্থক হোক আমার জীবন’। মুখপানে চেয়ে বিস্ময় জেগেছিল, এই দেবশিশু, অনিন্দ্যকান্তি, এ আমার সন্তান? ধন্য ভাগ্য। মস্তকে করস্পর্শ করতেই চোখ মেলে চেয়েছিল সে; কি অপূর্ব তার দুটি চোখ, যেন দুটি নীলপদ্ম ফুটে আছে তথাগতের চরণে! তাকে উপাধি দিয়েছিলাম, ধর্ম বিভর্দন; ধর্মের জয়যাত্রার কান্ডারী হবে সে আমার অবর্তমানে, এই ছিল আশা। অমাত্য যশশ ‘কুণাল’ নামটি প্রস্তাব করেছিল, কুনাল পক্ষীর চক্ষুও নাকি এমনই সুন্দর। নিজচক্ষে সে পক্ষী দেখে সন্তুষ্ট হয়ে নামকরণ করেছিলাম পুত্রের, আমার উত্তরসুরী, বিদ্বান, ধীমান, ন্যায়পরায়ণ যুবরাজ কুণাল!

তক্ষশীলায় বিদ্রোহ জেগেছে, দৃঢ়হস্তে শাসনের প্রয়োজন অবিলম্বে, এই অশক্ত শরীরে দীর্ঘপথযাত্রা সহজ নয়, তবু যেতে হবে; সাম্রাজ্যপালনে দুর্বলতার স্থান নেই। যাত্রার প্রারম্ভে কুণাল জানালো সে যাবে তক্ষশীলায় আমার পরিবর্তে; হৃদয়ের ধন সে, বিপদের মুখে পাঠাই কিরূপে? কিন্তু, নিজ সিদ্ধান্তে অচল সে, কোনও বারণ শুনতে চায়না, অমাত্যসভাও তাকেই সমর্থন করেছে, আমার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত সকলেই। ‘আমার প্রতি আস্থা রাখুন পিতা’, কুণালের এই বাক্যের পরে রাজী হতেই হোল শেষে; তথাগত মঙ্গল করুন তার, শুভমস্তু।

তিষ্যরক্ষিতাঃ

তিনি চলে গেলেন আজ, না জানি কতদিনের তরে। আমারই কারণে পাটলিপুত্র থেকে দূরে সরে গেলেন কি যুবরাজ? জানি, ঘৃণা করেন আমায় সেদিনের পর থেকে, তাঁর সংযত সম্বোধনে প্রকাশ পেয়েছিল বিরাগপূর্ণ প্রত্যাখ্যান, সে যে কি ভীষণ লজ্জার!

সম্রাট বড়বেশী মোহাচ্ছন্ন পুত্রের প্রতি, মাঝে মাঝে ভয় হয় বুঝিবা আমাকেও ত্যাগ করতে দ্বিধা করবেননা তিনি, কুণালের এতটুকু প্ররোচনায়। যুদ্ধগামী পুত্রকে নিজরথে পাশে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন পাটলিপুত্রের সীমানা অবধি, এমনই বিবশ তিনি অপত্য স্নেহের কাছে। এহেন যুবরাজের বিরাগভাজন হয়ে অস্তিত্বসংকট হবে না তো আমার? আশঙ্কায় বুক কাঁপে আজকাল।

আজ মাসাধিককাল হোল সম্রাট অসুস্থ, তাঁর শরীরের চর্ম থেকে নিঃসৃত হচ্ছে পুতিগন্ধময় নির্যাস; দাসীরা সেবায় বিমুখ হয়েছে, কক্ষের বাতাস দুর্বিসহ, অমাত্যেরাও কক্ষের বাইরে থেকে দেখে যাচ্ছেন তাঁদের প্রভুকে। নিঃসঙ্গ সম্রাটের শয্যাপার্শ্বে এখন শুধু আমি, তৃষ্ণার্ত চাতকিনীর মত অহোঃরাত্র চেয়ে থাকি তাঁর মুখপানে; ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে চলেছে নিঃশ্বাস, কান পেতে থাকি সশঙ্কচিত্তে। আমার অস্তিত্ব নির্ভর করে আছে ওই দুর্বল বক্ষের ক্ষীণ স্পন্দনে, সম্রাট তোমাকে মরতে দেবো না আমি, কিছুতেই না!

অবশেষে সেরে উঠছেন স্বামী, ধীরে, অতি ধীরে; কাল থেকে সজ্ঞানে রয়েছেন, অস্বচ্ছ দৃষ্টি ভেদ করে চিনতে পেরেছেন আমায়; সে মূহূর্তে তাঁর মুখভাবে ফুটে উঠেছিল সে কি অপরিসীম বিশ্বাস ও নিশ্চিন্ততা। জানিনা, এই আরোগ্যলাভের নেপথ্য কাহিনী জানলে ঠিক এতটাই খুশী হতেন কিনা প্রজাপালক সম্রাট। রাজবৈদ্য যখন হার মেনেছেন রোগের কারণ নির্ণয়ে, চারিদিকে গোপনে চর পাঠিয়েছিলাম আমি, আরও কেউ তো থাকবে এই সুবিশাল সাম্রাজ্যে, যে একই রোগে আক্রান্ত; আমি চেয়েছিলাম সেরকমই কারুকে। অবশেষে পেয়েছিলাম এক শবরকে, একই রোগে জর্জরিত দরিদ্র ব্যাধ রোগমুক্তির আশ্বাস পেয়ে এসেছিল রাজপুরীর গুপ্তকক্ষে। না রোগমুক্তি ঘটেনি তার, মুক্তি মিলেছিল এ জীবন থেকে চিরতরে। আমার অনুগত চন্ডাল, আসুরিক বিদ্যায় পারদর্শী, শবরকে হত্যা করে, তার শব ব্যবচ্ছেদ করে সে কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে। শবরের উদরে সন্ধান মেলে এক বৃহৎ কীটের, রোগের কারণ এই কীট সন্দেহ থাকেনা। পলাণ্ডু নির্যাস প্রয়োগে নাশ হয় সেই দুষ্ট কীট, আর সেইদিন থেকে সম্রাটকে গোপনে পলাণ্ডু নির্যাস সেবন করাতে থাকি আমি; তিনি ক্ষত্রিয় শ্রেষ্ট, সজ্ঞানে এই অপবিত্র বস্তু সেবন করতেন না কখনোই জানতাম সেকথা। ক্ষত্রিয়ের অভিমান, ব্যাধপত্নীর হাহাকার, সবই তুচ্ছ আজ আমার কাছে; আমি দেবি তিষ্যরক্ষিতা, এ আমার অস্তিত্ব সঙ্কট!

সম্রাটঃ

গহীন অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি আমি ধীরে ধীরে, চারিধার অস্পষ্ট, কেউ কোথাও নেই, বড় নিস্তব্ধতা। না, আছে! একটি আবছায়া মূর্তি নিরন্তর জেগে আছে শিয়রে, পরিচিত মুখ, তবু চিনতে পারিনা, সব শূণ্য; তবু ওই শীতল করস্পর্শে বড় শান্তি, সময় হয়েছে কি তবে অনন্ত যাত্রার?

হ্যাঁ চিনেছি তাকে, তিষ্যরক্ষিতা, প্রিয়া আমার! না জানি কত রাত্রি জাগরণ, কত না দুশ্চিন্তা, বিবর্ণ হয়েছে তার মুখশ্রী, বড় কৃশ দেখায় যেন, অঙ্গের অলংকার শিথিল হয়েছে গাত্রে। অসহায়া নারী, তায় নবীন বয়স, তথাগতের নামজপ ছাড়া আর কি বা করতে পারে সে, তবু তার একনিষ্ঠ সেবা আর সতীত্ববলে জীবন ফিরে পেলাম আবার। আমি ধন্য!

পূর্বের থেকে আমি এখন অনেক সুস্থ, তবু বল পাইনা শরীরে, জানিনা কতদিন সচল থাকবে এই জরাগ্রস্ত হৃৎপিণ্ড। কিছু আগে সংবাদ পেলাম মহামাত্য রাধাগুপ্তের কাছে, কুণাল সফল হয়েছে তক্ষশিলায় মৈত্রী স্থাপনে; তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে শীঘ্র রাজধানীতে। সময় এসেছে রাজদণ্ড যোগ্য হাতে তুলে দিয়ে অবসর নেবার।

কুণালঃ

তক্ষশীলার জনতার আন্তরিকতায় আমি আপ্লুত, বিদ্রোহ দমনে এসেছিলাম রাজপ্রতিভূ রূপে; কিন্তু অস্ত্র ধারণের প্রয়োজন হোলনা, মৈত্রী প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আবেগে উপহারে আমাকে বরণ করেছেন রাজন্যবর্গ তথা বিদ্রোহী প্রজাকুল। চতুর্দিকে আমরই নামের জয়ধ্বনি, ধন্য আমি আজ, সার্থক আমার জীবন। ভগবন শক্তি দাও, যেন ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে, অন্তরের অমৃতলোকের সন্ধান পেতে পারি এ জীবনে।

পাটলিপুত্রে শুভ সংবাদ পাঠিয়েছি, পুত্রের এই জয়ে সম্রাটের গর্বিত মুখচ্ছ্ববি কল্পনা করেছি মনে মনে না জানি কতবার, বিগত কয়েকদিনে। আজ জনশ্রুতি শুনলাম পিতা অসুস্থ, জানিনা কোনও সত্যতা আছে কিনা এই সংবাদের, হয়তো বা বশীভূত প্রজাদের পুনরায় উজ্জিবীত করার কূট পরিকল্পনা এটি। রাজধানী থেকে সংবাদ লাভের আশায় উন্মুখ হয়ে আছি, দীর্ঘজীবি হোন পিতা, চিরস্মরণীয় হোন দেবনাম-প্রিয় চক্রবর্তী সম্রাট অশোক।

তিষ্যরক্ষিতাঃ

তক্ষশীলা থেকে সংবাদ এসেছে, বিনা রক্তক্ষয়ে শান্তি ফিরিয়েছেন সেখানে যুবরাজ নিজ স্বভাব গুণে; ধন্য ধন্য পড়ে গেছে পাটলিপুত্রে। শয্যাশায়ী সম্রাটের রোগাতুর মুখশ্রী পুত্রগর্বে উজ্জ্বল, সারাদিনে শুধু তারই নাম উচ্চারণ করে চলেছেন ঘুরে ফিরে। যেন সেই সব তাঁর জীবনে, আর সকলেই তুচ্ছ।

দ্বারের নেপথ্য থেকে আলোচনা শুনলাম আজ, কুণালকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে চান মগধেশ্বর, রাজ্যচালনায় বৈরাগ্য এসেছে। রোগশয্যায় শুয়ে মতিভ্রম ঘটেছে বৃদ্ধের! কিন্তু, সত্যিই যদি কুণাল রাজা হন, কি হবে আমার? ঘৃণা করেন তিনি আমায়, জানি সে কথা; শেষে কি মগধেশ্বরী থেকে হতে হবে পথের কুক্কুরী?হয়তো ভ্রষ্টা নারীর অপবাদে প্রাণদণ্ড দেবেন আমার, পিতার মৃত্যুতে। না, প্রতিকার চাই এর, এত সহজে হারব না আমি, কিছুতেই না!

আজ বহুদিন পরে, নববধূসাজে নতুন করে বাসরসজ্জা পেতেছি সম্রাটের শয়নমন্দিরে, ঘৃতদীপের মায়াবী আলোয় মাথা রেখেছি  স্বামীর বক্ষে, বাইরে একাদশীর চাঁদ, জাতিপুষ্পের সুরভী ভেসে আসে বাতাসে। দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে চোখের কোল বেয়ে গভীর অভিমানে, হায়রে বিবশ নারী, নিজেকে পণ্য করে আর কত পশরা সাজাবি! বৃদ্ধ বিচলিত হন অশ্রু দেখে, মহার্ঘ বস্ত্র, অলঙ্কার, কি চাই আমার, জানতে চান পরম আদরে। বেদনার অশ্রু, তারও মূল্যায়ন অর্থের নিরিখে; মহাজ্ঞানী সম্রাট এত কিছু জানো, তবু নারীর হৃদয় বুঝতে শেখোনি আজও। নিজের পৌরুষে মদমত্ত তুমি, কত সহজে বিশ্বাস করে নিলে নারীশ্রেষ্ঠার নিঃশর্ত প্রেম জিতেছ এই বৃদ্ধ বয়সে। ‘না, উপঢৌকন নয়, চাই সাতটি দিনের জন্য রাজ্যচালনার অধিকার’, সলজ্জ মুখে জানিয়েছিলাম তাঁকে। কৌতুক বোধ করেছিলেন স্বামী এই অভিনব আব্দারে, হয়তো ভেবেছিলেন, নিঃসঙ্গ নারীর এ এক পুতুলখেলা। প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতে মত দিয়েছিলেন সহজেই, রাজ্যচালনার আর কিই বা করতে পারি আমি, আসল ক্ষমতা তো অমাত্যমন্ডলীর।

ভুল! দুঃসাহসী নারীর ক্ষমতার কথা কিছুই জানোনা তুমি সম্রাট! এক আদেশ পত্র তৈরী করিয়েছি আমি সম্রাটের নামে, পত্র লেখা হয়েছে তক্ষশীলার নগরপালের উদ্দেশ্যে। কুণাল দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, অবিলম্বে যেন তাঁর চক্ষু উৎপাটিত করা হয়, সম্রাটের আদেশক্রমে; এই মর্মে রচিত হয়েছে লিপি। এখন শুধু অপেক্ষা গভীররাত্রির, নিঃশব্দে সম্রাটের কক্ষ থেকে তাঁর রাজ-অঙ্গুরীয় চুরি করে লিপিখানি মুদ্রাঙ্কিত করতে হবে অতি সাবধানে। বৃদ্ধ এখনও শয্যাশায়ী, গুপ্তচর হস্তে প্রেরিত এই আদেশের কথা জানতেও পারবেননা তিনি।

লিপি পাঠিয়েছি অর্ধপক্ষকাল আগে, সপ্তাহকাল পুরণের আগেই রাজ্যশাসন থেকে মুক্তি নিয়েছি; আমাকে রাজকর্মে নিরুৎসাহী দেখে মনে মনে হেসেছেন সম্রাট, ‘সাধ মিটেছে তো’ জানতে চেয়েছিলেন পরিহাসচ্ছলে। শুধু লিপি প্রেরণের পরবর্তী রাত্রিতে দারুণ দুঃসপ্ন দেখে নিদ্রাভঙ্গ ঘটেছিল তাঁর; এক আগুনের পাখি সিংহাসন পানে ধেয়ে আসছে প্রবল শক্তিতে, এরকমই ছিল স্বপ্নের বিষয়। স্বপ্ন বিচার করাব বিশেষজ্ঞ ডেকে, আস্বস্ত করেছিলাম তাঁকে। উৎকোচ লোভে আমারই ইঙ্গিতে পণ্ডিত বিধান দেন, অতি শুভ এই স্বপ্নের সঙ্কেত, চিন্তার কিছু নেই।

ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন সম্রাট, রাজসভায় তাঁর উপস্থিতি নিয়মিত হয়েছে। কুণাল নিরুদ্দেশ তক্ষশীলা থেকে, পত্নী কাঞ্চনমালা সহ; হয়তো সন্ন্যাস নিয়েছেন, রাজকর্মে আগ্রহ ছিলনা তাঁর কোনোকালেই, ধীরে ধীরে বুঝিয়েছি সম্রাটকে।

কুণাল

এ কি সত্য? বিশ্বাস হতে চায় না! তক্ষশীলার নগরপাল অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখা করতে এসেছিলেন কিছু আগে, হাতে একখানি লিপি, সম্রাটের নামাঙ্কিত। আমার দুটি চোখ উপড়ে নিতে হবে, এমনই নির্দেশ আছে সে লিপিতে। বুঝতে পারছি না কিছু, এমন নিষ্ঠুর দণ্ড কোন অপরাধে? প্রাণাধিক পুত্র, যার চক্ষুতে বিশ্বের সৌন্দর্য্য খুঁজে পেয়েছিলেন স্নেহময় পিতা, সেই চক্ষু ধ্বংস করতে চান তিনি? তবে তাই হোক, মগধের প্রতি আনুগত্য শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে পালন করব আমি।

‘নির্দেশ পালন করুন আর্য’, অনুরোধ করেছিলাম নগরপালকে; তিনি অস্বীকৃত হলে বোঝাই তাঁকে, ‘নির্দেশ অমান্য করে বিদ্রোহী হবেন কেন নগরাধীশ? আপনি কার্য সমাধা না করলে আমাকেই নিজ হাতে নেভাতে হবে দুচোখের আলো, তাই কি চান দেব?’

সংবাদ পেয়ে অন্তঃপুর থেকে ছুটে এসেছিল কাঞ্চনমালা, হাহাকার করে উঠেছিল সে বুকভাঙ্গা বেদনায়। ‘দুঃখ কিসের প্রিয়ে, বাইরের আলো মুছে গেলে, অন্তরের আলো আরও উজ্জ্বল হবে; হয়তো এই তথাগতের ইচ্ছা’, বোঝাই তাকে আমি।

কি অসীম অন্ধকার! প্রচণ্ড যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করতে করতে কখন যেন এই অন্ধকারকেই সঙ্গী করেছি আমি, তক্ষশীলায় আর নয়। সামান্য অন্ধ ভিক্ষুক আমি এখন, কাঞ্চনমালার হাত ধরে এগিয়ে চলেছি পূবপানে, পথে পথে গান গাই, ভীক্ষালব্ধ তণ্ডুলে দিনপাত করি। আমার লক্ষ্য সামবোধি মন্দির, সেখানেই কাটাবো বাকী জীবন ধর্মচিন্তা করে, এমনটাই বাসনা।

সম্রাটঃ

শরীরের ব্যাধি বৈদ্য দূর করে, মনব্যাধি দূর করে কে? ধর্মচিন্তা, লোককল্যানে সাময়িক শান্তি, কিন্তু বেদনা ঘোচে কই? প্রিয়পুত্র, নয়ণের মণি, শেষ বয়সের যষ্ঠি, এমন করে হারাতে হবে তাকে ভাবিনি কখনও। হাঃ ঈশ্বর!

আজ মধুপূর্ণিমা, এই দিনে ভগবান তথাগত অরণ্যগামী হয়েছিলেন শিষ্যদের মধ্যে বিভেদ দূর করতে, বড় পবিত্র এই তিথি। বহূদিন পরে রাজ উদ্যানে পদচারণা করছি, সঙ্গী হয়েছেন মহামাত্য রাধাগুপ্ত ও যশশ, তবে কোনও রাজকর্ম নয় আজ, শুধুই ধর্মকথা। বাইরে সুমিষ্ট কন্ঠের নামগান শুনতে পাই যেন, বড় পরিচিত কন্ঠস্বর! কে ও?

আমার নির্দেশে লোক ছুটে যায় উদ্যান সংলগ্ন পথে; অবশেষে আস্তাবল থেকে ধরে নিয়ে আসে এক ধুলি ধুসরিত অন্ধভিক্ষুক ও তার স্ত্রীকে আমার সমুখে। ‘কে তুমি? জানতে চাই স্বভাবসিদ্ধ গম্ভীর স্বরে, তবু বক্ষ কেঁপে ওঠে কোনও অজানা আশঙ্কায়। ‘আমি ভিক্ষু, চলেছি উরুবেলা গ্রামে, সামবোধি মন্দির আমার গন্তব্যস্থল’। সেই কন্ঠস্বর, আর সন্দেহ থাকে না মনে, ‘কুণাল! কুণাল, পুত্র মোর!’ উদ্যানের তৃণশয্যায় জ্ঞান হারাই আমি।

তিষ্যরক্ষিতা, কুলটা, দাসী, এতবড় স্পর্ধা তার! অনুসন্ধান করে জেনেছি সকল কথা। নিস্তার নেই আজ পাপিষ্ঠার, যে যন্ত্রণা দিয়েছে সে আমার পুত্রকে, শতগুণে ফিরাব তা। ভরা সভায়, শৃংখল পরিয়ে তাকে টেনে এনেছে রক্ষীদল আমারই আদেশে, আগ্রহে উৎসুক অমাত্যবর্গ বিচারবাণী শোনার আশায়; এককোণে বসে আছে কুণাল নতমস্তকে, যেন অপরাধী সে নিজে। কুলটার চোখের তীব্র দৃষ্টিতে অকুন্ঠ ঘৃণা, যেন মর্মভেদ করে বিদ্ধ করতে চায় অন্তর।

‘একটি একটি করে অঙ্গচ্ছেদ করবে অপরাধিনীর, সাবধান, যেন মৃত্যু না ঘটে! একটু একটু করে তিলে তিলে যন্ত্রণা পেয়ে মরবে পিশাচিনী এই আমার আজ্ঞা!’ ঘাতকদের নির্দেশ দিতে কন্ঠস্বরে কাঁপে না আমার।

কুণালঃ

ক্ষমা, পিতা ক্ষমা করুন অর্বাচিনাকে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এতবড় শাস্তি দেবেননা দেব! আর্তনাদ করে উঠি আমি। শান্তির সন্ধানে চলেছি মহাযাত্রায়, এই ক্রোধ, এই হিংসা পিচ্ছিল করবে আমার পথ, এক নারীর মৃত্যুর দায় মাথায় নিয়ে কিভাবে খুঁজে পাব চিরসত্যকে?

পিতাকে অনুনয় করি, তিষ্যরক্ষিতার প্রাণভিক্ষা চেয়ে; তিনি ক্রোধান্ধ, মানতে চাননা কোনো কথা।

‘হে দেবি, তুমি আমার দৃষ্টি হরণ করেছ, তাইতো অন্তরের দৃষ্টি উন্মুক্ত হয়েছে আজ, তোমাকে নমন। আমি সমস্ত হৃদয় দিয়ে ক্ষমা করলাম তোমায়, আমার প্রতি সকল পাপের থেকে মুক্ত হলে তুমি’। আমার উদ্দাত্ত স্বর শুনে থমকে যান সম্রাট, সভাস্থলে নেমে আসে নিস্তব্ধতা; শুধু এক ক্ষীণ হাসির শব্দ কানে এসে বাজে। তিষ্যরক্ষিতা, বড় বেশী সাহসিনী তুমি, ঔদ্ধত্য দিয়ে অভিমান ঢাকো!

সম্রাটঃ

কুণালের বাক্য শেষমূহূর্তে দুর্বল করে দিল আমায়, থাক বধ্যভূমিতে নয়, জ্বলন্ত লাক্ষাগৃহে পুড়ে মরুক হতভাগিনী! আদেশ দিয়ে সভাগৃহ ত্যাগ করি টলমল পায়ে, যেতে যেতে কানে আসে রাক্ষসীর চিৎকার; বুঝিবা অভিসম্পাতে বিদ্ধ করছে আমাকে সে। কি বা আর করতে পারে তার মত দুষ্টা নারী!

তিষ্যরক্ষিতাঃ

চক্রবর্তী সম্রাট, দেবনাম-প্রিয়, ধর্মাশোক, কত সহজে ধর্মচ্যূত হলে আজ এই কুলটার কারনে। ‘ক্ষমা পরম ধর্মঃ’ পুত্রস্নেহে ভুলেছ সেকথা। পাপিষ্ঠাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে নিজে দণ্ডিত হলে মহারাজ! দরিদ্রকুলে জন্ম, দাসীবৃতিতে কেটেছে কৈশোর; স্বল্পশিক্ষিত, অজ্ঞান নারী, নিজেকে বাঁচাতে যে পাপ করেছি আমি, তুমিও একই পাপে পঙ্কিল হলে আজ, মগধেশ্বর!

***

তিষ্যরক্ষিতা পুড়ে মরেছিল জ্বলন্ত লাক্ষাগৃহে, এরপর বেশীদিন জীবিত থাকেননি সম্রাট অশোক। কুণাল তাঁর বাকীজীবন বুদ্ধের চরণে উৎসর্গ করেন। মৃত্যুর পূর্বে অশোক কুণালের শিশুপুত্র সম্পাতিকে উত্তরাধিকারী চিহ্নিত করে যান, যদিও তার নাবালকত্বের কারণে সম্রাটের আর এক পৌত্র দশরথ সিংহাসনে বসেন।

সপ্তম শতাব্দীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এক সাং তাঁর ভারতবর্ষ ভ্রমণ বিবরণীতে তক্ষশীলা নগরীর দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে একটি স্তূপের উল্লেখ করেন, যেখানে কুণালের চক্ষুদ্বয় সংরক্ষিত হয়েছিল। সেকালের স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস ছিল, কোনও অন্ধব্যক্তি পবিত্র মনে এই স্তূপে প্রার্থনা জানালে, চক্ষু ফিরে পাবে।

***  ***

দুরূহ শব্দের অর্থঃ অর্হৎ – বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, আজীবক – নাস্তিক, নির্গন্ত্র – জৈন সন্ন্যাসী, পদ্মরাগ – চূণি, চতুরশীতি সহস্র – চুরাশিহাজার, ধর্মরাজিকা – বৌদ্ধস্তূপ, কৃত্যা – ডাকিনী বিদ্যায় পারদর্শী, পলাণ্ডু – পেঁয়াজ, সামবোধি – বুদ্ধ গয়া

তথ্য সূত্রঃ

  1. The Legend of King Ashoka, by John S. Strong (A translation of Ashoka Avadana)
  2. Ashoka’s Wives and the Ambiguity of Buddhist Kingship, by John S. Strong
  3. Emperor Ashoka: Did he suffer from von Recklinghausen’s diseases? By N.N.Whig and Sheetal Sharma
শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page