উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

ঈশ্বরচন্দ্র আজকাল অন্য পালঙ্কে শোন। তিনি এসবের কিছু  বুঝতে পারছিলেন না। তবে হঠাৎ তাঁর কানে কান্নার শব্দ আসায় চোখ খুললেন। দেখেন, দীনময়ী খাটের ওপর বসে রয়েছে। মুখ নিচু। তবে কি সে-ই কাঁদছে?

  গায়ের চাদর সরিয়ে উঠে এলেন। দীনময়ীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। গায়ে হাত রাখতে দীনময়ীর চমক ভাঙল। ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্বামীর বুকে। হাউ হাউ শব্দে কান্না বেরিয়ে এলো তাঁর  ঈশ্বরচন্দ্র দীনময়ীর মাথায় হাত রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, এরকম ভেঙে পড়লে চলবে কেন, দীনময়ী? নিজেকে শক্ত করো। তুমি তো নারায়ণের ভালো চিন্তা করেই  দূরে পাঠাবার কথা বলেছ…

এরপর… 

-আপনি ওকে একলা সামলাতে পারবেন তো? আমার শুধু সেই চিন্তা হচ্ছে।

-খুব পারব। ছেলের জন্ম দিয়েছি, আর ছেলেকে মানুষ করতে পারব না? তাহলে কেমনতর বাবা হলাম আমি?

-আপনি তো কত ছেলেদের পড়ান। তারা সকলে মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠে। আপনার নিজের ছেলেকেও ঠিক সেভাবে দেখবেন তো?

দীনময়ীর মনের সংশয় যেন কিছুতেই মিটছে না। ঈশ্বরচন্দ্র তা বুঝেই বলে উঠলেন, মনে এত দ্বন্দ্ব না রেখে তুমিও চলো না আমার সঙ্গে।

কথাটা যে কতখানি মনভোলানোর, ঈশ্বরচন্দ্র তা বুঝেই বলেছেন। তাতে দীনময়ীর মতো সরলমনা নারীও  শত দুঃখের মাঝে হেসে উঠবেন, তাও তিনি জানেন। অথচ এ ছাড়া অন্য কোনও কথার ভরসায় ক্রন্দনরত স্ত্রীকে বাস্পরহিত করা যাবে না, তা বুঝতে পেরে এমন বাক্যটাই উচ্চারণ করলেন। আর তাতে কাজও হল। দীনময়ী কান্না থামিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন। বললেন, ভাল কথাই  বলেছেন।

পাশে শোয়া তিন মেয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, সব্বাইকে নিয়ে গিয়ে সেখানে রাখতে পারবেন তো?

-কেন, ওদেরকে ঠাকুমার কাছে রেখে দিয়ে তুমি আর নারায়ণ চলো আমার সঙ্গে…

-যান তো। আর মস্করা করতে হবে না।…মা হলে বুঝতেন…

-আচ্ছা পরের জন্মে না হয়, তাই হবখন। তবে আমি কিন্তু মা হলে, কঠোর মা হব…

-দূর, যত সব…, বলে দীনময়ী স্বামীর পেটে আঙুলের আলতো খোঁচা দিয়ে বললেন, যান শুয়ে পড়ুন। কাল দেখবেন, আমি কতখানি কঠোর হতে পারি। এক ফোঁটা কাঁদব না।

 

দিনময়ী সত্যিই পরের দিন নারায়ণের যাত্রাকালে হাসতে হাসতে তাকে বিদায় দিলেন। ছেলেকে নিজে কোলে করে এনে গোরুর গাড়িতে বসালেন। গাড়ির ছইয়ের তলায় ঢুকে যাবার আগে নারায়ণের গলা জড়িয়ে ধরলেন। দুগাল ভরে দিলেন চুমুতে চুমুতে। হাত নেড়ে হাসতে হাসতে টা টা করলেন। অথচ চোখে একফোঁটা জল নেই।

কাঁদলেন বরং ভগবতীদেবী, ঠাকুরদাস এবং বাড়ির অন্যন্যরা। মায় বাড়ির ঝি চাকর, দারোয়ান পর্যন্ত, সকলে। আর কাঁদল হেমলতা। তার তো বোঝার বয়স হয়েছে। সে জেনেছে, এখন থেকে সে আর তার দাদার আদর পাবে না। তাই তার চোখে জল। কুমুদিনী, বিনোদিনী শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল চলন্ত গরুর গাড়িটার দিকে। তাদের বোঝবার বয়স হয়নি এখনও।

(২০)

কারোও দূরে চলে যাওয়া সংসার নামের গাড়িটাকে কখনই একেবারে থামিয়ে দিতে পারে না। সেখানে ভোরের পাখিরা ডাকে। দিন আসে। দিনের কাজকর্ম চলে যথারীতি। রান্না হয়। খাওয়া হয়। সেখানে শুধু একটা  থালা কম রাখা হয়।  একাকী সেই থালাখানা তাকের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, অন্যেরা তাদের কাজ কেমন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ সেখানে থেমে নেই। নারায়ণ নেই বলে বাড়ির গাইটা এক ছটাক দুধও কম দেয়নি। দাঁড়ের টিয়া পাখিটা একটাও দানা ছোলা কম খায়নি । হ্যাঁ, দুপুরে লাল একটা লঙ্কা খাওয়া তার অভ্যেস; যা কিনা, নারায়ণ নিজে হাতে করে এনে রোজ তাকে জোগান দিত, সেটা  দেওয়া হল না। তখনই পাখিটা ছটফটানি শুরু করল। যার যার অভ্যাসের কাজ। ট্যাঁ ট্যাঁ, করে টিয়া তার কম পড়া খোরাকের জানান দিতে দীনময়ীই দৌড়ে এসে লাল লঙ্কা তার ঠোঁটে ধরিয়ে দিলেন। আর তখনই আবার মনে পড়ে গেল নারায়ণের কথা। এ যেন, পাঁচালির বইখানা লক্ষ্মীর থানে পড়ে রয়েছে, কেউ তার কথা মনে করে না যতক্ষণ না গৃহের ঠাকুরকে জল বাতাসা দেওয়া হয়। আর সেটাতেই আজ দেরী হল।

ঠাকুরদাস ব্যাড়ুজ্জ্যের বাড়িতে নিয়ম করে ঠাকুরের সেবা হয়, বেলা নটার মধ্যে। আজ নটা বেজে গেল। দশটা বাজল। বেলা পড়তে চলল। তাও ঠাকুর ঘরের দিকে পা পড়ছে না কারোও। কাজটা করেন প্রধানতঃ দীনময়ী। তবে এখন তার ঠাকুরঘরে ঢোকা বারণ। সন্তানসম্ভবা তিনি। তাই তা সারেন বাড়ির সেজো বউ। মানে শম্ভুচন্দ্রের স্ত্রী। এ বাড়িতে সে এখনও নতুন। মেজো বউ, অর্থাৎ দীনবন্ধুর বউয়েরও ছ মাস চলছে। তারও বাচ্ছা হবে, তাই তার ঠাকুরঘরে প্রবেশে নিষেধ রয়েছে। আর কেউ না হলে, বাড়ির গিন্নী, মানে ভগবতীদেবী সেই শূন্য স্থান পূরণ করেন। ঠাকুরের জল বাতাসা না দেওয়ার ব্যাপারটা ঠাকুরদাসের নজর এড়ালো না।

ভোর হাবর আগেই ঠাকুরদাস ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে মুখে জল বাতাসা ছুঁইয়ে মাঠে চলে যান। বেলা ন’টা দশটায় বাড়ি ফিরে আসেন। চাষের মাঠে বাকি সময়ের কাজ মুনিষরা সারে। বাড়ি ফিরে প্রথমে স্নান সারেন। তারপর ঢোকেন ঠাকুর ঘরে। পূজো সারেন। ততক্ষণে বাড়ির পূজো সমাপ্ত হয়ে যায়। টাটকা ফুল চন্দন আর মাজা থালা গেলাসে ঠাকুরের জন্যে টাটকা জল বাতাসা দেওয়া হয়ে যায়। আজ সেখানেই ঘাটতি হয়েছে। টাটকা জল বাতাসা তো পড়েই নিই; মায় দশ ঠাকুরের গলায় বাসি ফুলের মালা ঝুলছে, লক্ষী নারায়ণের থান শুকনোপাকনা ফুলে ভরে রয়েছে। পড় তো পড় ঠাকুরদাসের নজরেই তা পড়ল। স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে উপবীতের জল খসাতে খসাতে ঠাকুরঘরে ঢুকেই দু পা পিছিয়ে এলেন। তারপর ছিটকে একেবারে চৌকাঠের বাইরে। গলা তুলে ডাকলেন নিজের স্ত্রীকে, শুনছ…।

দিনের পঞ্চ ব্যঞ্জনের আনাজপাতি ভাগে ভাগে সাজিয়ে ভগবতীদেবী তখন সবে কুটনো কুটতে বসবেন; বঁটি খুলেছেন। স্বামীর ডাক কানে যেতেই ধড়মরিয়ে উঠে চলে এলেন। ঠাকুরদাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এমনিতেই মানুষটার মেজাজ একটু তিরিক্ষি ধরণের। অল্পেতেই চেঁচামিচি করেন। সে তুফানের জোর এতই যে সমগ্র বাড়িটাই যেন উড়তে থাকে। আজো ঠিক তাই হল। চিৎকার করে উঠলেন, বলি, বাড়ির হলটা কী!

ভগবতীদেবীর তখনও মাথায় আসছে না, কোন পান থেকে চুনটা খসে পড়েছে? তিনিও সামান্য গলা তুলে বললেন, কী হল, সাত সকালে এত চেঁচাচ্ছ কেন?

-সাত সকাল? বলি কটা বাজে, তার খেয়াল আছে?   গলায় কথার তোড় আগের মতই।

-হ্যাঁ। তা হয়েছে তো কী? চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছ কেন?

-ঠাকুরের ঘরের এ অবস্থা কেন? এখনও কেন ঠাকুরের পূজো সারা হয়নি?

ভগবতীদেবীর যেন দিব্যচক্ষু খুলল। ঝুঁকি দিয়ে ঠাকুরঘরের ভিতরটা দেখতে গেলেন। আবার সেই ঝার।

-সেজ বউমা…ও সেজ বউমা…, ভগবতীদেবীর ডাক।

তাঁর ডাক উপেক্ষা করে ঠাকুরদাস বলে উঠলেন, বলি, বাড়ির গিন্নী কে? কার এসব দেখার কথা?

-আবার আমায় ঠাসছ? সবদিক কি আমাকেই নজরে রাখতে হবে?

ভগবতীদেবী চিরবিরিয়ে উঠলেন। ততক্ষণে সেখানে বাড়ির সেজ বউ এসে হাজির হয়েছে । শম্ভুচন্দ্রের বউ। খুবই অল্প বয়সের মেয়ে। সবে সতেরো পেরিয়ে আঠারোয় পা দিয়েছে। শাশুড়ির প্রতি শ্বশুরের এমন কথায় তার মাথার ঘোমটা খসে পড়ার অবস্থা। বউমাকে সামনে পেয়ে ভগবতীদেবী তাকে বলে ফেললেন, আর কবে শিখবে এসব?

ঠাকুরদাস নতুন বউমার ঢাল হয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। উল্টে নিজের স্ত্রীকেই কথা শোনাতে শুরু করলেন, ও… ওর কি বয়স হয়েছে যে ওকে কথা শোনাচ্ছ? আক্কেল তোমার বলিহারি। পরের ঘরের মেয়ে এসে কি এ বাড়ির সব আচারবিচার দুদিনে শিখে নেবে?

-হ্যাঁ…আরোও আস্কারা দিয়ে বউদের মাথায়  তোলো, আমাকে ময়দা ঠাসা করো। যাও আজ থেকে আমি আর এ সংসারের কোনও কিছুতে থাকব না…,

রাগ দেখিয়ে ভগবতীদেবী দপদপিয়ে সরে গেলেন সেখান থেকে। গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে খিল আঁটলেন। ও মা, ওমা, করে বউরা ডাক পাড়ছে। কারোও ডাকেই তা দরজা খুলছে না। এদিকে রসুই ঘরে বামুন হাত উঁচু করে বসে রয়েছে। কী তরকারী হবে? কতটা হবে? কিছুরই হদিস করতে পারছে না সে। সেখানে ততক্ষণে এসেছেন দীনময়ী, আর মেজবউ। শাশুড়ি মায়ের অনুমতি ছাড়া সবজীর পদ নির্বাচন করা, তাঁরা আর কবে করেছেন? ভগবতীদেবীই তো এ সাম্রাজ্যের একছত্র অধিকারিনী।  বউ, পাচক, ঝি, সব মিলে এ ওর মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। সেজ বউ সেই যে শ্বশুরের গলার আওয়াজ শুনে ঠাকুরঘরের চৌকাঠ থেকে ফিরে এসেছে, ভয়ে আর ওদিকই মাড়াচ্ছে না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে রসুই  ঘরের দরজা ধরে। সকলের মাঝে দীনময়ী বয়জ্যেষ্ঠা এবং পুরনো এ বাড়িতে। তাঁরও মাথা কাজ করছে না।  তিনি একবার শাশুড়ির ঘরের দরজায় গিয়ে, ও মা, দরজা খুলুন, ও মা…, করে নিষ্ফলা চেষ্টায় মুখ কাঁচুমাচু করে ফিরে আসছেন; আবার পরক্ষণেই দৌড়চ্ছেন শ্বশুরের কাছে।

ঠাকুরদাস তখন ক্ষণিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে বেমালুম ভুলে গিয়ে পায়ে পা তুলে দিব্যি মেজাজে হুঁকোয় টান দিয়ে চলেছেন। তাও কিনা, বাড়ির বাইরে উঠোনে বসে। সেখানে মুনিষ, চাকরদের নিয়ে বৈঠক করছেন। ভুলেই গেছেন বাড়ির অন্দরমহলের কথা। তাই দেখে দীনময়ী ফিরে আসছেন মুখ গোঁজ করে।

অনেকক্ষণ পরে কী মনে পড়তে ঠাকুরদাস হঠাৎ বাড়ির ভিতরে এসে ঢুকলেন। দেখেন তিন বউ এক মাথা হয়ে বসে রয়েছে। রসুই ঘরে উঁকি দিলেন। সেখানের অবস্থাও তথৈবাচ। টনক নড়ল। কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে।

-বড় বউ, তোমার শাশুড়ি মা কোথায়? ঠাকুরদাসের গলার স্বর তখন একেবারেই মোলায়েম।

দীনময়ী উত্তর করলেন, মা সেই যে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটেছেন, কিছুতেই তা খুলছেন না। কত ডাকাডাকি করছি। সাড়াও দিচ্ছেন না।

তিনি হাসলেন। বললেন, এ মহিলা বড্ড নাটুকে। বুঝলে বউমা, এর ওষুধ আমি যতক্ষণ না পাড়ব, মহিলার রাগ পড়বে না। আচ্ছা, আমি আসছি…, বলতে বলতে, আবার বাইরের উঠোনে বেরিয়ে গেলেন। চাতাল পেরিয়ে সোজা রাস্তায়। সঙ্গে একজন মুনিষকে নিয়ে হনহয়নিয়ে চললেন।  বাড়ির লোকজন দেখল, বাবু বেরিয়ে চলে গেলেন।

ব্যাপারটা শুধু জানা আছে দীনময়ীর। তিনি জানেন, এ অবস্থায় ঠাকুরদাস কী কী করেন। কিন্তু তিনি মুখে কুলুপ এঁটেছেন। অন্য দুই বউ বড়দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তবু একটা টুঁ শব্দও বার করাতে পারল না। অগত্যা মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল বউঝিয়েরা। বাড়ির ছোটরা তখন খই-দই-মুড়ি-মুড়কি সহযোগে ফলাহার খাচ্ছে। এ সমাধান দীনময়ীর।

তিন বউ রসুই ঘর ছেড়ে যে যার ঘরে গিয়ে কাজে লেগে পড়ল। সময় কাটছিল নিজের মনে। কতটা সময় পরে, তা কেউ খেয়াল করল না, হঠাৎ বাড়ির ভিতরে আবার ঠাকুরদাসের গলার আওয়াজ, বড়বউমা…ও বড়বউমা…।

সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে রান্নাঘরের সামনে একটা কিছু পড়ার শব্দ।

দীনময়ী জানেন, ব্যাপারটা কী হল। এ কান্ড তো শুধু আজ দেখছেন না। এ বাড়িতে তাঁর বাইশটা বছর কাটানো হয়ে গেছে। কতবার হয়েছে এ জিনিষ।

ডাক আর ধপাস শব্দ শুনেও দীনময়ী কোলের মেয়েকে ঘুম পাড়ানোয় ব্যস্তই রয়ে গেলেন। নট নড়নচড়ন। এখন ওখানে গেলেই ব্যাপারটার রসভঙ্গ হবে। অন্য দুই বউ কে কী করল, তা আর তখন দেখাবর তাঁর ফুরসত কৈ? কোলে তো মেয়েকে শুইয়ে রেখেছেন। তাছাড়াও মনে মনে হাসছেন তিনি। অনেক বছর পর  এই ঘটনা আবার ঘটছে। বাড়ির নবাগত সদস্যারা তা দেখে জানুক, তাদের শ্বশুর- শাউড়ির এ প্রেমের খেলা।

একদিকে ধপাস শব্দ। আরদিকে খুটুস। ধপাস শব্দ বিরাট আকারের একটা আস্ত কাতল মাছের মাটিতে পড়ার। আর খুটুস? ভগবতীদেবীর ঘরের বন্ধ দরজা খোলার শব্দ। দুই-ই প্রায় একই সঙ্গে ঘটল। মেজবউ সেজবউ সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা দেখছে, তাদের শাশুড়ি কাপড় কোমর গাছা করে বেঁধে মাছ কাটার বিশাল বঁটিখানা নিয়ে বসতে যাচ্ছেন। আর শ্বশুর শাউড়িকে বলছেন, খবরদার, মাছে হাত দিও না বলছি।

শাশুড়ি তখন ভয়ডর হীন। মাছ তিনিই কুটবেন। ওটা যে তাঁর অতি সখের কাজ। ওটিতে কারোও হাত বাটাবার উপায় নেই। মুখে সলজ্জ হাসি। ঠাকুরদাসের চোখের কোণে চিকচিকে জলের রেখার সঙ্গে মুখে মৃদু হাসির তরঙ্গ। মান অভিমানের পালা অন্তে আবার দুজনায় পাশাপাশি বসে হিসেব হচ্ছে, মাছের ক’ টুকরো হবে, পিঠের মাছ কার কার পাতে পড়বে। মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট করবে তো?

ঠাকুরদাস আর ভগবতীর মিল হয়ে গেল। দুজনে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত।

(২১)

 

নারায়ণকে কলিকাতায় এনে ইশকুলে ভর্তি করে দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। সে পড়াশোনা করে তবে বাবার মতো তার মাথা নয়। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে নারায়ণের পড়া দেখেন। শেখান অনেক কিছু। অনেক কিছু মনে রাখতে পারে না। বাড়ির জন্যে তার মন খারাপ করে। পড়ায় মন বসাতে পারে না। ঈশ্বরচন্দ্র বেশ মুশকিলে পড়েছেন। অথচ কোনও উপায় নেই। এখনই তাকে ইশকুল ছাড়িয়ে গ্রামে ফেরত পাঠাতে তিনি নারাজ। বকাঝকার মধ্যে নারায়ণের দিন কাটছে। তার মধ্যে যেটুকু হচ্ছে, তাতেই ঈশ্বরচন্দ্রকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। মাঝে মাঝেই ছেলেকে নিয়ে কলিকাতার এখানে ওখানে ঘুরিয়ে আনেন। তার মন ভালো করবার জন্যে।

সেদিনও বেরলেন। বাড়ি থেকে বেরবার একটু পরেই আকাশ মেঘ করে এলো। বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা রয়েছে। ঈশ্বরচন্দ্রের একটা কাজও ছিল। ভেবেছিলেন, নারায়ণকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নিজের কাজটা সেরে আসবেন। নারায়ণেরও কিছুটা ঘোরা হবে। তবে বৃষ্টির পূর্বাভাস পেয়ে ফিরে এসে তাকে রেখে নিজেই বেরলেন। কাজটা জরুরী। আজকেই সারতে হবে।

চলেছেন চিৎপুরের পথ ধরে। বৃষ্টি নামল। দাঁড়িয়ে পড়লেন। আশ্রয় নিলেন এক গলির মুখে। একটা বাড়ির কার্নিশের নীচে।  স্থানটা চিৎপুরের পতিতালয় বলে খ্যাত। সেখানে গৃহস্থ বাড়ির পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট বাড়ি রয়েছে পতিতাদের জন্যে।

ঈশ্বরচন্দ্রের নজরে এল একটি মেয়ে। মেয়েটি অল্প বয়সী । বয়স আন্দাজ বছর কুড়ি। শরীর স্বাস্থ্য ক্ষীণ। পরণের শাড়ির খুঁট মাথায় তুলে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে অকাতরে ভিজে চলেছে। গা দিয়ে টুসটুস করে জল ঝরছে।  রাস্তায় কোনও জন মনিষ্যির দেখা নেই। এ অবস্থায় মেয়েটি অবশ্যই খরিদ্দার ধরবার আশায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে অপেক্ষা করছে, ঈশ্বরচন্দ্র বুঝলেন।

ঈশ্বরচন্দ্রের মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলেন, অসময়ের বৃষ্টিতে  ভিজলে  মেয়েটা সর্দিজ্বরে পড়বে। তিনি করলেন কী, কার্নিশের তল ধরে তার কাছে এগিয়ে গেলেন। দয়া পরবশে তাকে সাহয্যের জন্যে মন কেমন করল। পকেটে একটা আধুলি ছিল। বার করলেন।  তার হাতে দিলেন। বললেন, এটা নিয়ে আজকের মতো ঘরে ফিরে যা। এভাবে জলে ভিজিস  না।

মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে গেল। গোল্লা গোল্লা চোখ করে তাকিয়ে রইল দাতার দিকে। চোখ দিয়ে জল নামল। চোখের জল বৃষ্টির জলের সঙ্গে এক হয়ে গেল। বলল, আপনে আমার সারাদিনের রোজগার একলাই দিয়ে গেলেন। ঘরে  আইসেন।

-এটা তোর বাড়ি নয়। রোজগারের ঘর। এখানে আমাকে দেখলে, লোকে ছি ছি করবে। তোর বাড়িতে যেয়ে বসবখন । কোথায় থাকিস? বাড়িতে কে কে আছে?

-বাড়ি খিদিরপুরে। সেখেনে আম্মা আব্বু আর আমার একটা পোলা র‍্যইয়েছে।

-আর তোর মিয়াঁ?

নিজেও ওই ভাষা ব্যবহার করলেন।   সে উত্তর করল, মিয়াঁ অন্য বিবিরে নে থাকে। আমারে দ্যাখে না।

-পোলা কত বড়?

-সবে তিন বচ্ছরে পা দেছ্যে।

-ঠিক আছে। একদিন তোদের বাড়ি যাব। যাওয়ার পথ বল।

মেয়েটি হাত মুখ নাচিয়ে তার বাড়ির পথ নির্দেশ দিয়ে বলল, খিদিরপুরে মোছমান মহল্লায় থাকি। আপনে সত্যি ব্যলছেন, আইসবেন?

-যাব। তোর পোলাকে দেখে আসব।…আচ্ছা, চলি। তুইও বাড়ি ফিরে যা। বৃষ্টি ধরলে তবে যাস।

বৃষ্টি ধরে আসতে ঈশ্বরচন্দ্র পথে নামলেন। মেয়েটিও রাস্তা থেকে সরে গলির ভিতরে একটা বাড়িতে প্রবেশ করল।

এরপর ঈশ্বরচন্দ্র সত্যি সত্যিই একদিন খিদিরপুরে গিয়ে পৌঁছলেন।

তিনি যাচ্ছেন অন্য কাজে। খিদিরপুরে মাইকেলের পৈতৃক বাড়ি। মাইকেল মধুসূদস দত্ত। আদি নাম মধুসূদন। গোঁড়া হিন্দু । ধনী ঘরের সন্তান। তবে সে খৃষ্টান ধর্ম নিয়েছে। নামের সঙ্গে সংযোজন হয়েছে মাইকেল। মাইলেক মধুসূদন। ঈশ্বরচন্দ্রের থেকে বছর চারের ছোট। দুজনের মাঝে বন্ধুত্ব। ইংরেজি ভাষায় কবিতা লেখায় কৃতিত্ব অর্জন করেছে। বাংলা লেখালিখিতেও বিশেষ নাম করেছে। জীবনে নামকরা কবি হবার উচ্চাশা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এখান থেকে সেখানে। এ রাজ্য থেকে সে রাজ্যে। ধর্ম পরিবর্তনের কারণে সে এখন তার বাবার তাজ্য পুত্র। ধনী ব্যক্তির সন্তান হয়েও তাকে নিরন্নে দিন কাটাতে হচ্ছে প্রায়শই। ঈশ্বরচন্দ্রকে পাকড়াও করে রেখেছে, আপদে বিপদে উদ্ধারের জন্যে। মাইকেল এখন থাকছে মাদ্রাজ রাজ্যে। সেখান থেকে সে ঈশ্বরচন্দ্রকে চিঠি লিখেছিল, তার পৈতৃক বাড়িটায় একবার ঘুরে আসতে। বাবা, রাজনারায়ণ দত্তের মৃত্যুর পর আত্মীয়রা ওই বাড়ি দখল করে বসে রয়েছে।  দেশের বাড়ি জায়গা বিক্রি করে মধু চাইছে, টাকা পয়সা নিয়ে আবার ও দেশে ফিরে যাবে। সেখানের অর্থ কষ্ট দূর করবে।

ঈশ্বরচন্দ্র ভেবে বেরিয়েছেন, এক কাজে দুকাজ সারবেন। প্রথমে যাবেন মুসলমান মহল্লায়, মেয়েটির বাড়ি। পরে যাবেন মধুর পৈতৃক বাড়ি দেখতে।

জায়গাটা আসলে কিডারপুর। ঈশ্বরচন্দ্র জানেন, রবার্ট কিডের ছেলে জেমস কিড এখানে একটা ডক প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেটা ছিল ১৮০৭ সাল। তাঁর জন্মের অনেক আগে। ভদ্রলোক আদি কলিকাতায় অনেক কিছুই বানিয়েছেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনেরও স্রস্টা ।  দিনে দিনে ইংরেজ সাহেবের আবিষ্কৃত কিডারপুর  বাঙালির উচ্চারণে এসে দাঁড়িয়েছে খিদিরপুরে। গঙ্গা থেকে একটা ফালি এসে ঢুকেছে খিদিরপুরের ডকে। মূল নদী থেকে জাহাজ এসে নোঙ্গর করে সেখানে। জলপথ বেয়ে জাহাজ ঢোকে। চওড়া খালের এক পাশে কলিকাতা। অপরদিকে খিদিরপুর। দু অঞ্চলের যোগাযোগের মাধ্যম সেতু। অস্থায়ী সেতু কাঠের । ভাঁজ হয়। জাহাজ আসলে তা খুলে যায়। পেরিয়ে গেলে আবার যোগ করা হয়। মানুষ চলাচল করে। পাল্কি, ঘোড়ার গাড়ি, টমটমও চলে সেতুর উপর দিয়ে।

ঈশ্বরচন্দ্র সেতু পেরলেন। পায়ে হেঁটে। জলপথের ধার দিয়ে দিয়ে চলেছেন। সামনে পেলেন একজোড়া মন্দির। খালের ধার ঘেঁসে মন্দিরের অবস্থান। হিন্দুদের মন্দির। নাম ভূকৈলাস শিব মন্দির।

পায়ে পায়ে অনেকটা ফাঁকা পথ পেরলেন। এলো মেটিয়াবুরুজ। মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা। স্থানীয় দৃশ্যটাই কেমন হঠাৎ পাল্টিয়ে গেল। তিনি দেখছেন, পথের ওপরে হেথা সেথা শূয়রের পাল। মুখে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে ঘুরছে। পথের ধারে ত্যাগ করা মানুষের বিষ্ঠা চাটছে। অপরিষ্কৃত জায়গা । সেসব কাটিয়ে  খুঁজে বার করলেন মেয়েটির আস্তানা।

নাম তার মেহেরুন্নিসা। বারবনিতারা গ্রাহকদের আসল নাম বলে না। তবে মেয়েটি সেদিন তার আসল নামটাই বলেছিল। ওই নামেই তাকে এখানে খুঁজে পেলেন । মেহেরুন্নিসা ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখে অবাক। ভাবতেই পারেনি, এমন লোক সত্যি সত্যিই তাদের বাড়িতে আসবে। আসেন আসেন , করে আপ্যায়ন করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। কাঠের টুল টেনে ঘরে বসাল।

ঢোকার মুখে ঈশ্বরচন্দ্র মেহেরুন্নিসাদের কুঁড়েঘরটা দেখছিলেন।  মাটির দেওয়াল। মাথায় তালপাতার ছাউনি। বাড়ির আশেপাশে শূকর দলের আড্ডা। আসল, এটাই এদের জাত ব্যবসা। শূকর পোষে, বড় হলে বাজারে বিক্রি করে । সাহেবদের বাজারে। কলিকাতায়  হগ সাহেবের নামে মার্কেট আছে। সেখানে  শুকর কেটে তার মাংস বিক্রি হয়। সাহেবদের কাছে লোভনীয় খাদ্য।  আর এরা নিজেরা গরুর মাংস খায়।

ঈশ্বরচন্দ্র ঘরে বসেছেন। দেখছেন, বাইরের পরিবেশ নোংরা হলেও ঘরদোর পয় পরিষ্কার। মায় খাবার থালা বাসন চকচকে করে মাজা ধোয়া।

কথা হল কিছুটা। তারপর মেহেরুন্নিসা উঠে ভিতরের ঘরে গেল। একটু পরে থালা ভরে খাবার এনে হাজির করল। সেঁয়ইভাজা । বলল, খেয়ে নিন বাবু। ঘরে বানানো।  খাবারটা মিঠে। ঈশ্বরচন্দ্র তৃপ্তি করে খেলেন। জল দিল। জল পান করলেন।

ঘরে একটা ছোট ছেলে ঘোরাঘুরি করছিল। রোগা প্যাংলা চেহারা। খালি গাঁ। পরণে সূতির ইজের। তাকে কাছে ডাকলেন। সে এলো। কোলে তুলে নিলেন। আদর করলেন। একজোড়া জামা কিনে এনেছিলেন। তার হাতে  দিলেন। ঠোঙা ভরে লজেঞ্চুস এনেছিলেন, তা দিলেন। মেহেরুন্নিসার জন্যে একটা শাড়ি এনেছিলেন, তাও দিলেন। মেয়েটার বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করলেন। বেরিয়ে পড়লেন সেখান থেকে।  তার আগে মেহেরুন্নিসাকে বললেন, মাসে মাসে দুটো করে টাকা বরাদ্দ করা রইল, প্রতি মাসে এসে টাকাটা নিয়ে যাস। নিজের বাড়ির ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়ে এলেন।

সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি চললেন মাইকেল মধুসূদনের বাড়ি। মাদ্রাজে বসে মাইকেল ঈশ্বরচন্দ্রকে লিখেছিল,-

‘আমার বাবা, মা, ভাই কেউই আর এখন জীবিত নেই। ওই বাড়িতে আমি আর কোনও দিনও গিয়ে থাকতে পারব না। অথচ ফাঁকা বাড়ি পেয়ে আমার জ্ঞাতিভাইরা সেখানে রাজ করচ্ছে। এমনকি বন্ধু  গৌড়দাসের (গৌড়দাস বসাক) লেখা চিঠিতে জানতে পারলাম, ওরা আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করতেও দ্বিধা করেনি। তাই ওই বাড়ি আমাকে বেচা করতেই হবে। প্রয়োজনে মামলা মোকদ্দমা করে ওদের ওই বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে।

‘পরদেশে এসে অবধি আপনাকেই আমার সব থেকে বড় সুহৃদ বলে মেনেছি। তাই আপনি যদি আপনার নিত্যকার কাজ থেকে কিছুটা সময় বের করে ওই বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং আমাকে সবিস্তারে জানান দেন তো আমি কলিকাতা গিয়ে বসব। হেনরিয়েটাকে আপাতত এখানেই রেখে আমি পারি দেব।

‘আপনি জানেন নিশ্চয়ই রেবেকা, মানে আমার প্রথমা স্ত্রী আমাদের চারটে সন্তানকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এবং বিবাহ বিচ্ছেদও করেছে। এখন আমি হেনরিয়েটাকে নিয়ে সুখে আছি। মাদ্রাজের কোর্টে মামলার দেশীয় ভাষার নথিপত্র ইংরাজিতে তর্জমা করার কাজ করছি।  তাতে যা পাই, তা দিয়ে সংসার চালিয়ে এই স্থানে কৃত কর্জ মেটানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আপনাকে আর অধিক কী জানাব। আপনি তো সবই জানেন। এবং সময়ে সময়ে আমার চাহিদা মতো অর্থ পাঠিয়ে আমার জীবনকে সচল রেখেছেন। আমার পৈতৃক বাড়িটা বিক্রয় করে আশা রাখি, অধিক অর্থ পাব। তা দিয়ে আমার সমস্ত ধারদেনা মিটিয়ে দোব। এর পরে ইচ্ছা, বিলেত গিয়ে সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে কলিকাতার উঁচু আদালতে ওকালতি করব। যদিবা এ সম্বন্ধে কলিকাতায় পৌছিয়ে আমি আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবার ইচ্ছা রাখলাম।’

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page