কোজাগরীতে সান্দাকফু অভিযান।। মালবিকা ব্যানার্জি

হেমন্তিকার এই শেষ বিকেলে কেভেন্টারের ছাদে বসে হট চকলেট আর ফ্রায়েড পর্ক সসেজের ধোঁয়া ওঠা প্ল্যাটার আবার আমায় একটু একটু করে ফিরিয়ে দিচ্ছে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য । কর্তা সেই থেকে তিনদিন চান না করা ‘ছিরকুটে আমি’ টার একটা ভাল ফটো তোলবার বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন।  কুসুম-কুসুম রোদ পোহাতে পোহাতে  পড়ন্ত উৎসব-বেলার  দার্জিলিং শহরটাকে যত দেখছি, মুগ্ধ হচ্ছি। হাজারো মানুষের ভিড়ে রঙিন হয়ে উঠেছে ম্যল-চত্ত্বর। চকচকে চুল আর গাঢ় লাল লিপস্টিকের পুতুল-পুতুল মেয়েগুলোর চুঁয়ে পড়া স্টাইল আর কেতা থেকে নিজের পুরুষটিকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছে সারাক্ষণ।

সে যাই হোক, যে জন্য ধান ভানতে শিবের গাজন—

এক হপ্তার ছুটি নিয়ে গেছিলাম পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের মধ্যের চারটিকে (মাউন্ট এভারেস্ট, কাঞ্চনজংঘা, লোৎসে এবং মাকালু) একসাথে দেখবো বলে। বেশিদূরে নয়, তার জন্য যেতে হয়েছিল ঘরের কাছেই সান্দাকফু৷ ক্লাস সিক্সের ভূগোল বইয়ে প্রথম পড়েছিলাম  “পশ্চিমবাংলার উচ্চতম শৃঙ্গ  সান্দাকফু”-এর কথা। আমি তো আবার বহুদিন পযন্ত উচ্চারণ করতাম ‘সান্দাকোফু’!!

সে যাই হোক, পূর্ণিমার রাতে এই শ্বেতশুভ্র চূড়াগুলো নাকি অলৌকিক রূপ ধারন করে। তাই, বহুদিন আগে থেকে রীতিমতো প্ল্যান করে কোজাগরী পূর্নিমা-রাতে সান্দাকফু আসা।

আগে কথা ছিল, পাঁচবন্ধুর দল মিলে ট্রেক করবো এই পথে৷ শেষমেশ,  তিনজনই নানান বাহানায় ছিটকে গেলে রইলাম পড়ে আমরা দুজন “দ্যাবা-দেবী”। আমার হাঁটুর জোর ওনার আবার ভালই জানা। তাই, রিস্ক না নিয়ে প্রোগ্রাম রিশিডিউল করে “খানিক ট্রেক-খানিক হাঁটা” পথে আমাদের দুজনের সান্দাকফু অভিযান।

 

রিশিডিউলের চক্করে ট্রেন জোটে নি ভাগ্যে। অগত্যা গ্রীনলাইনের বাসে শিলিগুড়ি।

তেঞ্জিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড থেকে মাথাপিছু ১৫০ টাকা দিয়ে শেয়ার জিপে ঘন্টা-দুয়েকের মধ্যেই চলে এলাম ঘুমে। সেখান থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সোয়া একঘন্টার পথ মানেভঞ্জন। এখান থেকেই শুরু সান্দাকফুর পথে যাত্রা। এপথে শুধুমাত্র ল্যান্ডরোভার সহায়। ল্যান্ডরোভারগুলির এক-একটির বয়স ৮০-১০০! এখনও অক্লেশে চলছে ঐরকম রাস্তায়। তবে তাদের সকলের যন্ত্র-পাতিই যে ‘অজ্জিনাল’ তা কিন্তু নয়; অনেক গাড়িতেই ‘হাঁসজারু’ করে মাহিন্দ্রার যন্ত্র-পাতি বসানো! এপথে মোট ৪৮ টি গাড়ি চলে। এরকমই একটি গাড়ি বুক করা হল তিনদিনের জন্য। দু’রাতের জন্য ভাড়া ৬০০০ টাকা। ড্রাইভার পেমাজী বয়স্ক আর ভীষণরকম ভালমানুষ (খেয়াল করে দেখলাম, অধিকাংশ পাহাড়ি বয়স্ক মানুষদের মতই এঁরও চশমা নেই)।১৯৮৯ সাল থেকে উনি এ’পথে গাড়ি চালাচ্ছেন। পথের হাল-হকিকত হাতের তালুর মত চেনা। ক্যামেরার জন্য ১০০,  গাড়ির জন্য ১০০ আর মাথাপিছু ১০০–মোট ৪০০ টাকা দিয়ে এন্ট্রি মিললো সিংগালিলা ন্যাশনাল পার্কে।

মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু ৩১ কিমি পথ। ঠিক হল টুমলিং অব্ধি প্রথম ১২ কিমি আমরা ট্রেক করবো। বাকিটুকু অর্থাৎ টুমলিং থেকে সান্দাকফু গাড়িতে যাবো৷ সেইমতো গাড়িকে মালপত্র-সমেত পাঠিয়ে দেওয়া হল টুমলিং। যদিও আমি শেষ আট বছরে খাই না-খাই, চুটিয়ে ঘুরেছি লাদাখ থেকে আন্দামান.. মায় থাইল্যান্ড থেকে সিংহল। কিন্তু এই এতো বছরে ট্রেকিং বলতে একবেলার হিলে থেকে বার্সের ৪.৫ কিমি সম্বল। তা কুঁজোরও তো ইচ্ছে হয় চিত হয়ে শুতে। আমাদেরও সেরকম হল।

যাই হোক, শুরু হল চড়াই ভেঙে খাড়াই পথে হাঁটা। মাত্র ১০ মিনিটও গেছি কি যাই নি, ধপাস্ করে বসে পড়লাম মাটিতে, মানে বসতে বাধ্য হলাম আর কী!

উফ্, বুকের ভিতরটা হাঁপরের মত ওঠা-পড়া করছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে, ফুসফুস দুটোর এক্ষুনি বিস্ফোরণ হবে। আমি চিল-চিৎকার জুড়লাম, “ড্রাইভার কোথায়? ড্রাইভারকে ডাকো! আমি আর হেঁটে যেতে পারবো না!”

হায়! কাকস্য পরিবেদনা। ড্রাইভার সেই কখন মালপত্র নিয়ে ধাঁ! ফোন করে দাঁড়াতে যে বলা হবে কোথাও, মোবাইলে টাওয়ার অব্ধি নেই। অগত্যা, হাঁটা ছাড়া উপায় নেই আর কিছু। তিনি বাকিটা পথ শক্ত করে হাতটি ধরে কাঁচুমাঁচু স্বরে স্ত্রোত্রবাক্য শুনিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন বটে, “কষ্ট করে ওখানে একবার পৌঁছলেই হল, যা দেখবে না… জীবনেও ভুলতে পারবেনা! কাঞ্চনজংঘা, এভারেস্ট সব একদম চোখের সামনে ঝকমক করবে!” কিন্তু ওঁর কথাগুলো তখন অনেকটা নিজেদেরকে প্রবোধ দেবার মতই শোনাচ্ছিলো। কারন, চারিদিকটা তখন ঘন কুয়াশায় ধোঁয়া-ধোঁয়া। মেঘদের মিছিল আমাদেরকে ভিজিয়ে দিয়ে চলেছে। দুহাত দূরের জিনিসও অস্পষ্ট। আর, আমরা দুই পাগল কিংবা বোকা একে অন্যের হাত শক্ত করে ধরে রেখে হেঁটে চলেছি সেই সরের মত কুয়াশা ভেদ করে। কিসের টানে খোদায় মালুম!!

আমি আসলে জন্ম-ভেবলি। ঘোরার ডাকে আমার সব ভুল হয়ে যায়৷ তখন আমার খেয়াল থাকে না শরীরের জোর কিংবা পকেটের রেস্ত। শুধু মনের জোরে বেরিয়ে পড়ি। তারপর, নিজেকেই নিজে গাল পাড়ি।

সেবার আমি কাশ্মীরে। পথের ধারের এক সস্তা-ধাবা গোছের একটিতে খেয়ে দেয়ে বাইরে এসে দাঁত খুঁচোচ্ছি। হঠাৎই খেয়াল করলাম, একটা ময়লা জোব্বা পড়া লোক অদ্ভুতরকম ভাবে আমায় জরিপ করছে। আমি একটু গলা খাঁকরিয়ে, “কুছ বোলেংগে”? বলতেই সে আরও সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমায় জিজ্ঞেস করলো, ‘আপ টুরিস্ট হো’? জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে আমার মনে হচ্ছিল, ওর ‘টুরিস্ট’ আর ‘টেরোরিস্ট’ গুলিয়ে গেছে! অচিরেই বুঝলাম,  গুলিয়ে যাবার প্রভূত কারণ আছে৷ ভদ্রলোক দেশি টেনেছেন প্রচুর। অল্প-অল্প দুলছেন আর মাথা নাড়িয়ে জানতে চাইছেন। আমি ‘জী’ বলাতেই উনি হঠাৎ হাউমাউ করে বলতে শুরু করলেন, “খামোখা ঘুমনে কা চক্কর মে কিঊ ইতনা পয়সা বরবাদ কর দেতে হ্যায় আপ টুরিস্ট লোগোনে? ঘুমনেসে ক্যায়া ফায়দা?” আমার এত্ত বছরের জীবনে এমন একটা অমোঘ সত্য কেউ কোনওদিন এমনভাবে মনে করিয়ে দেয় নি। বিবেকের দংশন জাস্ট শুরু হবো হবো করছে, এমন সময়ে ফস্ করে আমার বেরসিক বর-ভদ্রলোকটি এসে হাজির। মহামানবটির দিকে বাজপাখির দৃষ্টি হেনে খেঁকিয়ে উঠলো, “ঘুমনেসে হামকো স্মৃতি আউর তজুর্বা মিলতে হ্যায়!” লোকটি বোকার মত চেয়ে রইলো। আবার, বাজখাঁই গলায়, “সমঝ মে আয়া কুছ?” লোকটি দুলে দুলেই ‘নহি’ বললো। বর গলাটা একটু নামিয়ে, “অউর আয়েগা ভি  নহি! ছোড় দিজিয়ে! আচ্ছা, ইধার কোই সুসু করনেকা জ্যগা মিলেগা?” বুঝুন তবে!

তা, সত্যি বলতে কি, চারিদিকে কুজ্জ্বটিকার অস্পষ্টতার মাঝে হাঁটতে হাঁটতে আমার সেই দিনের সেই লোকটির কথাই বারে বারে মনে হচ্ছিল! আহা রে, ভাল বুদ্ধি দিতেই এসেছিলো সে। কানে তুলিনি। এখন বোঝো মজা! কেন যে আমরা এসব পাগলামি করতে বেরোই?

যাইহোক, খানিকটা পরে পথ অনেকটাই হন্টন-যোগ্য হয়ে এল। বেশ সমতল একটি জায়গা, সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া, ঠান্ডা শীতল বাতাস, বড় আরামদায়ক। ছবির মত দু-একটি বাড়ি-ঘর।  সবুজ মাঠে চমরী গাই চরে বেড়াচ্ছে। গলায় ঘন্টি বাঁধা—টুংটাং। আহা, সেই কত্তবছর  আগের ডি.ডি.এল.জে. মনে পড়িয়ে দিল। জায়গাটার নাম নাকি চিত্রে! তা চিত্রর মতোই সুন্দর সে’গ্রাম।

এর’ম সুন্দর জায়গায় এলেই আমার বরের সাধারণত খুব চিপাসা পায়। এবারও দেখলাম ব্যতিক্রম হল না। সামনেই একটা চায়ের দোকান, কতিপয় টুরিস্ট। এক ইয়ং কাপল— দেখে মনে হল হনিমুনে এসেছে।

হনিমুনে ট্রেকিং!! এরা আমাদের থেকেও দু-কাঠি উপরে, মানে পাগলামির ফোর্থ স্টেজে! সারবার বিশেষ আশা নেই!

আরেকটি ফ্যামিলিও রয়েছে এই দোকানে। ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা আর একটি বাচ্চা ছেলে। এঁরা ল্যান্ডরোভারে এসেছেন। ভদ্রমহিলা পৃথুলা, তায় মনে হলো শখ করে বরের জিন্স পড়েছেন। মাথায় ছেলেদের টুপি, চোখে মেয়েদের গগলস্ আর ঠোঁটে পুরু গোলাপি লিপস্টিক। এই তবে, খাঁটি ‘বাবুসোনার মা’ যাঁরা নিঝুম বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে  তুমুল হাজিরা দেন আর উচ্চৈঃস্বরে, “বাবুসোনা, লেজ খাবে,  কুড়কুড়ে?” জিজ্ঞেস করে আশপাশ মাথায় করেন!!

তা আমি যখন এসব আবোল-তাবোল ভাবতেই ব্যস্ত, আমার বরটি তখন একটি ভয়ানক বুদ্ধির কাজ করে ফেললো। ‘বাবুসোনার মা’ – দের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো যে, সে আমাদের ড্রাইভার পেমা ওরফে ‘ভাইয়া’জী কে চেনে কিনা? ‘বিলকুল, স্যার’ শোনামাত্রই  অনুরোধ করলো,  ড্রাইভারকে পথে দেখতে পেলে যেন বলে দেয় টুমলিং না গিয়ে পথেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে। ড্রাইভার মাথা নাড়িয়ে ‘জী, স্যার’ বলে চলে গেল। ও বেশ নিশ্চিন্ত ভংগিতে বললো, “খবর দেওয়া হয়ে গেছে। গাড়িতে উঠে পড়লেই আর কষ্ট নেই!” কিন্তু আমার সন্দিগ্ধ মন সে আশ্বাসে বিশেষ আমল দিল না। আমাদের ড্রাইভার কখন বেরিয়ে গেছে! তাকে রাস্তায় পাওয়া এত সোজা নাকি?

যত্তসব ছেলেভুলানো কথা!!

যাইহোক, চায়ের দাম মিটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।

এই ফাঁকে বলে রাখি, বিগিনার্স ট্রেকাররা অনেকসময়ই প্রথম রাতটা চিত্রে কিংবা মেঘমাতে থেকে যান। চিত্রে থেকে মেঘমার দূরত্ব ৬ কিমি। পথ আর শুরুর মত সাংঘাতিক খাড়াই নয়। পথে পড়ে লামাধুরা। মায়াবী এপথের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। মেঘমা সত্যিই সার্থকনামা। সারাটাবেলা জুড়ে সেখানে মেঘেদের খেলা। আলো-ছায়ার কারিকুরি। চিরহরিৎ গাছগুলো যেন দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে আসে। সুতরাং, বরকে আর বেশি গ্যাস- ফ্যাস খাওয়াতে হল না, পথের সৌন্দর্যে সব ব্যথার উপশম হল আপনা থেকেই।

পথমধ্যে দুটি রেড পান্ডা দেখলাম—দ্রুত পার হয়ে গেল রাস্তার এদিক থেকে ওদিকে— একের পিছু আরেকটি। মেঘমাতে ঢুকতেই দারুন সুন্দর একটা মনাস্ট্রি রয়েছে। এখানে বুদ্ধের ১০৮ রূপ দেখতে পাওয়া যায়।

মেঘমাতে পৌঁছতেই দেখি আরিব্বাস! আমাদের ড্রাইভারজী যে গাড়ি নিয়ে আমাদের জন্যেই অপেক্ষারত। তার মানে সংবাদ ঠিকমত পৌঁছে গেছে। পরে জেনেছিলাম, পথে ড্রাইভারজীর বোনের বাড়ি পড়তে উনি সেখানে কিছুসময় দেখা করে বেরোন এবং যার ফলে আমাদের বার্তাবহর সাথে ওঁর মোলাকাত হয়ে যায়।

হৈ হৈ করে গাড়িতে উঠলাম। এবার সিধা টংলু হয়ে টুমলিং। রাস্তা বাঁধানো ঝকঝকে।

টুমলিং এ আমাদের থাকার জায়গা আগে  থেকে বুক করা ছিল। আমরা পৌছতেই ঘর মিলে গেল ঝটপট। সাথে গরম খাবার—ভাত, পাতলা মুসুরডাল, কুড়মুড়ে আলুভাজা আর আলুর মধ্যে বাঁধাকপি-ছিটে দিয়ে তরকারি একটা। খিদে আর ঠান্ডায় সেটাই তখন অমৃতভোগ।

এখানে থাকার ব্যবস্থা খুবই সাধারণ। কাঠের ঘরগুলোতে ঠান্ডাও মানায় না তেমন। এখানে সন্ধ্যে বলে কিছু নেই, বিশেষ করে এইসময়টায়। দীননাথ খানিক মলিন হওয়ার পরই ঝুপ্পুস করে যেটা নেমে আসে, তাকে রাতই বলে। আর, সাথে সাথেই আসে কনকনে তীক্ষ্ণ হাওয়া। অমন বিভীষিকাময় ঠান্ডা আমি অক্টোবরের পহেলগাঁও কিংবা লাদাখেও পাইনি। পাইনের বনের মধ্য দিয়ে আসা বাতাসের সোঁ সোঁ আওয়াজ চমকে উঠতে বাধ্য করায়। চারপাশ যেদিকে তাকাই, সবটাই ধোঁয়ায় যেন আরও রহস্যময়। এর মধ্যে নাকি এভারেষ্ট না ছাই  দেখা যাবে!

ঠান্ডায় আমার হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে লেপের মধ্যে। নড়াচড়া করতে ইচ্ছে হয় না। পাশ ফিরলেই মনে হয়, কেউ ষড় করে বিছানায় জল ঢেলে রেখেছে। এবার আমার আর রাগ নয়, কান্না পাচ্ছে একটু একটু। কেন মরতে এলাম এই ঠান্ডায়? দুনিয়ায় আর জায়গা ছিলনা? মানুষে আসে এখানে? আমার চেঁচামেচির মাঝে বর মিনমিন করে আবার কী একটা বলতে শুরু করেছিল বটে, তবে এবার আর জুত করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ক্যামেরা নিয়ে বাইরে চলে গেল। খানিক পরেই দরজায় দুমদাম— ” বাইরে এসো, শিগগির বাইরে এসো।”

কি রে বাবা? ডাকাত পড়লো, নাকি তুষারচিতা? শেষমেশ বিদেশে এসে সাধের প্রাণটুকু খোয়াবার যোগাড় হল নাকি!!

#৩

ধড়মড় করে বাইরে বেরিয়ে এসে সে’রাতে যা দেখেছিলাম, তা ভোলা কঠিন হবে। হয়তো, ভুলবই না কোনওদিন।

আমাদের ঘরটি থেকে বেরিয়ে সোজা তাকালেই উত্তুঙ্গ কাঞ্চনজংঘা।

পূর্ণিমার গোল থালার মত চাঁদ তখন প্রায় মাথার উপর। আর, তার আলো ঠিকরে পড়ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার ঠিক চূড়ায়। কুম্ভকর্ণ, কাবরু, পান্ডিম নিয়ে সপার্ষদ শৈলরাজি ঠিক যেন একটি হীরকখন্ড। চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে ক্ষীরের মত নরম আলোয়।

হঠাৎ এ কী ম্যাজিক হলো? এই খানিক আগেই তো দেখে গেলাম মেঘের চাদরে ঢেকে গেছে চারপাশ।

অথচ…

এখন সে মেঘের ছিঁটেফোটাও নেই। খানিকটা মেঘ শুধু বাঁদিকের এভারেস্ট -মাকালু রেঞ্জের কোল জুড়ে রয়েছে তখনও।

দূর্গম পার্বত্য প্রদেশে সহসা মনটা হু হু করে উঠলো। মনে হত লাগলো, প্রকৃতির কাছে কত নগন্য এই মনুষ্যজীবন। প্রকৃতি রোজই এমন কত শত অপার্থিব, অলৌকিক দৃশ্য রচনা করছে। অথচ, মানুষের তাতে কোনোই নিয়ন্ত্রন নেই; অনুভবটুকুতেই কেবল সীমিত সমস্ত প্রয়োগ।

ইতি-উতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমাদের আজ রাতের প্রতিবেশীরাও। কেউ কেউ টেলিজুম লেন্স বাগিয়ে ছবি তুলছেন খচাৎ খচ্—একবার চাঁদের দিকে তো একবার পাহাড় চূড়ায়।

আমরা হাঁটতে লাগলাম…এলোমেলো।

দূরে রান্নাঘরে গোল হয়ে বসে কাদের কাঁই-কিচির… চুল্লির ধোঁয়ার কুন্ডলি… উনুনের কাছে গুঁটুলি পাকিয়ে একটা বেড়াল।

আমার হঠাৎ বড্ড শীত করতে লাগলো৷

হঠাৎ খুব ভাল কিছু দেখলে আমার  মনের কোণে আচম্বিতে বেয়াড়া বিষাদ এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় বরাবরই।

এই যে আমি…এমন একটা অলৌকিক দৃশ্যের সাক্ষী থাকছি… অথচ আমার মা কিংবা আমার আরও কিছু আপনজন সেগুলো দেখতে পেলই না,  হয়তো বা আর কোনওদিন পাবেও না… ভেবে মন খারাপ হয়ে যায় ভারি।

কিংবা আমার বাবা…সারাজীবন যিনি শুধু খেটেই  গেলেন আর একদিন কাউকে কিছু না বলে পট্ করে মরে গেলেন…তাঁরও তো কোনওদিন এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ হলই না!

এই তো শুনতে পেলাম, কে যেন বলছেন, “আহা, পুণ্যিমার রাত্তিরে এমন দৃশ্য…ভাগ্য সুপ্রসন্ন না থাকলে সম্ভবই না!”

অজান্তেই গাল বেয়ে নেমে এল নোনতা জল। হয়তো অকারণেই, তবুও…।

পূর্নিমার রাতে পাহাড় সাক্ষী রেখে ঘুরেছি আগেও।

মনে পড়ে, কিন্নর উপত্যকায় রকছামের মত এক স্বর্গে কাটিয়েছিলাম এমনি এক পূর্ণিমার রাত। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা এক উপত্যকার বুক চিরে বয়ে চলেছিল বসপা।

চাঁদের আলোতে রুপালি ফিতের মত

কুল-কুল ধ্বনিতে। তার ঝিম ধরানো একটানা বয়ে চলা আমরা অনেক রাত অব্ধি বারান্দায় বসে শুনেছিলাম।

কিংবা, পহেলগাঁওতে এক শিরশিরে ঠান্ডা রাতে বাকিরা যখন ইয়াকনি আর বাখরখানি খেতে মশগুল, আমরা দুজনে কিছুটা নিভৃত সময় কাটিয়েছিলাম লিডারের পাড়ে। মাথার পেছনে পূর্ণ শশী, নদীর জলে আর পাহাড়ের গায়ে তার অস্থির প্রতিবিম্ব। চুপ করে শুনছিলাম নদীর নিক্কণ…একটানা…ঘোর লাগানো!

তবুও সেখানে অনুপস্থিত ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার এই রূপ, এই আভিজাত্য!

তাই, এই রাতটি অতুলনীয় হয়ে থেকে যাবে মনিকোঠায়।

এইসব আবোলতাবোল ভেবেই হয়তো সারাটা রাত কেটে যেত, যদি না পাহাড়ি ছেলেটি আমাদের ডাক দিয়ে যেত, “খানা লাগা দিয়া, সাব”।

এই হাড়-হিম শীতে ছেলেগুলো খাবার সাজাচ্ছে, রিজার্ভারের বরফ-ঠান্ডা জলে বাসন ধুয়ে আনছে, আমরা খেয়ে উঠলে তবে ওদের আজকের মত ছুটি।

রাতের খাবার বলতে গরম গরম ভাত-রুটি, আলুভাজি আর আন্ডা-কারি। সাথে ঘরে বানানো ঘি—অপূর্ব তার গন্ধ আর স্বাদ। ফেরার পথে কিনে এনেছিলাম একটু।

পরদিন সকালে ঠান্ডাটা একটু কম লাগলেও হাওয়াটা ছিল মারাত্মক। এদিন আমাদের গন্তব্য সান্দাকফু। ড্রাইভারজী আগেই জানিয়ে দিলেন গৈরিবাসের পর থেকে রাস্তা ‘বহুত খারাব’। নাস্তা সেরে, ছবি-টবি তুলে গাড়িতে উঠে বসলাম।

আকাশ আজ ঝকঝকে। কাঁচা-মিঠে রোদ ভারি আরামদায়ক। বাতাসে ভেসে আসছে একটানা দ্রিম-দ্রিম সুর। ড্রাইভারজী জানালেন কাছেই আছে একটি মনাস্ট্রি। এই শব্দ সেখান থেকেই আসছে। পাকা-বাঁধানো রাস্তা চলে গেছে গৈরিবাস অব্ধি। সেখানে দু-চার ঘর বসতি, একটি মিলিটারী আস্তানা আর কী কী সব।

গৈরিবাসের পর থেকে যেটিকে রাস্তা  বলা হচ্ছিল, তাকে খন্দ বলাই ভাল৷ পিচ-টিচ উঠে গেছে কবেই, বড় বড় বোল্ডারের উপর দিয়ে গাড়ি চলেছে ধাঁই-ধপাধপ্।

উল্টোদিক থেকে গাড়ি এলেই চিত্তির। একটা চাকা তখন প্রায় খাদে নেমে যায় যায়।

আর, ব্যাক গিয়ার দিতে হলে তো সোনায় সোহাগা।

তা, এইসব করেই পৌঁছলাম কালিপোখরি। লেকটি স্থানীয়দের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। লেকের চারপাশে রং-বেরংয়ের পতাকা। ছোট্ট লেকটির জলের রঙ এক্কেবারে কালো।

কালিপোখরির একটু পরে বিখেভঞ্জন আর তার কিছু পরেই সান্দাকপুর বা সান্দাকফু।

শেষের ২-৩ কিমি পথ ভয়ংকরতম।

পুরো ৬০° খাড়াই বেয়ে যখন গাড়ি উঠছিল, কোমরের হাড়গুলো অব্ধি জানান দিচ্ছিল সে কষ্ট। পথও একসময় ফুরালো আর আমরাও পৌঁছলাম গন্তব্যে।

সান্দাকফুতে আমরা ছিলাম হোটেল সানরাইজে। যে ঘরে আমাদের বুকিং ছিল, দেরিতে পৌঁছবার কারণে সেটি ততক্ষনে অন্যদের হস্তগত। আমাদের তার থেকে কম ভাড়ার একটা ঘর দেওয়া হল। ওজর-আপত্তি করেও বিশেষ লাভ হল না। প্রচুর ট্যুরিস্ট। সমস্ত ঘর বুকড্। অনেকেই থাকতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন। আমাদের যেহেতু অ্যাডভান্স করা ছিল, তাই কোনওরকম একটি ঘর জুটেছে।

হোটেল মালিক রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন এত লোক সামলাতে। তার সদ্যবিবাহিতা হিমাচলি পত্নীটিও ছুটে বেরাচ্ছেন সর্বক্ষন। ঘরে ঢুকে দেখি, বাথরুমে জলের অবস্থা শোচনীয়। বাইরে একটি জায়গায় জল ধরে রাখা, সেখান থেকেই ছোট বালতিতে করে বরফ-ঠান্ডা জল আনতে হবে।

অবেলা হয়ে যাওয়ায় লাঞ্চে শুধু একটু গরম স্যুপ আর ম্যাগি খেলাম। তার দাম পড়লো প্রায় ২০০ টাকা। খাবার-দাবারের দাম এ জায়গায় সংগত কারণেই খুব বেশি৷

হোটেলের সামনে ৩৬০° খোলা ভিউ, যদিও এখন সবই আবার ঝাপসা। বামদিকে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা চলে গিয়েছে আরও দূরে ফালুটে। রাস্তার দুপাশে রডোডেনড্রন আর পাইন গাছের সারি। পাইন গাছগুলোতে বেগুনী রঙের ফল ধরেছে। এরকম রঙ আগে দেখিনি।

রাস্তা ধরে একটু হেঁটে আসতে ইচ্ছে হল আশপাশ।পাইন বনের ভুলভুলাইয়াতে পথ হারায় বাতাস— ‘সর্-সর্’ সেই আর্তনাদ ভ্রম হয় নদীর গর্জন বলে। মেঘেরা দলবেঁধে চলেছে আমাদের সঙ্গে।

সন্ধ্যে নামছে পাহাড়ের খাঁজে। ঠান্ডাটা আরও জাঁকিয়ে বসছে। পাহাড়ি জায়গায় সাঁঝ নামতেই চারিদিক কেমন শান্তটি হয়ে গেল।

চাপ-চাপ অন্ধকার, একটি-দুটি গাড়ির আলো কিংবা ‘হুইম-ঘ্যাঁচ’ আওয়াজ, কাদের মৃদু ফিসফাস কিংবা হই-হই আড্ডা। কোথায় যেন একটি বাচ্চা কঁকিয়ে উঠল; একটি কুকুর ডেকে উঠলো…ভৌ ভৌ।

আমরা দুটিতে…

ফেরার পথ ধরলাম।

 

#৪

সন্ধ্যে একটু ঘন হতেই যথারীতি মালুম পাওয়া গেল ঠান্ডার কিড়মিড়-কামড়। আসার আগে টেম্পারেচার প্রেডিকশন দেখিয়েছিল দিনে পনেরো আর রাতে নয়। তখন ভেবেছিলাম, এ আর কী এমন ঠান্ডা! কিন্তু, আসল সময়ে প্রেডিকশন -ফ্রেডিকশন সব ঘেঁটে গিয়ে যে দিনে দশ আর রাতে জিরো হয়ে যাবে, সে আর কে ভেবেছিলো! তার সাথে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা রয়েছে ঐ শনশনে মারাত্মক ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা। সঙ্গের জামা-কাপড়ও ঐ ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ভেবে নিয়ে আসা। গ্লাভস অব্ধি নিয়ে আসিনি। আর, এখন জিন্সের পকেট থেকে হাত বের করলে মনে হচ্ছে ফ্রষ্ট বাইট হয়ে যেতে পারে।

উনি একবার মৃদু স্বরে বললেন, “বলছিলাম কী এখানে দারুন একটা ড্রিংক পাওয়া যায়। রডোড্রেনড্রনের ফুল থেকে বানায়, নাম—রক্সি। খেলে বেশ গা গরম হয়ে যায়। একটু খেলে হত না?” আমি কটমট করে তাকাতেই গলার স্বর আরো নামিয়ে, “নাহ্, থাক তবে!  মানে… ঠান্ডার জন্যই বলছিলাম আর কি।”

আমি এবার গনগনে স্বরে বললাম,  “সেটা আগে বলতে কি হচ্ছিল? ঠান্ডায় আইস্ক্রিম হয়ে যাবার যোগাড় হচ্ছে আর এখন ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোচ্ছে?”

বকা খেয়ে না কি অপ্রত্যাশিত আনন্দে বুঝলাম না, ভদ্রলোক খানিক হতভম্ব হয়ে রইলেন। তারপর দুই পা হেঁটে আর চার পা লাফিয়ে রান্নাঘরমুখো হলেন।

দু-চার মিনিট বাইরে কাটাবার পর আর থাকতে না পেরে আমিও অগত্যা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

রান্নাঘরে একটা বিশাল অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে জল ফুটছে টগবগিয়ে। কালচে রঙা ধোঁয়া বেঁকেচুরে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে। উনুনের কাঁপতে থাকা নীলচে আলোর দিকে একটানা চেয়ে থাকলে চোখে জল এসে যায়।

উনুনের পাশেই কুন্ডুলি পাকিয়ে একটা বেড়াল, গায়ে ইয়া বড় বড় লোম। চুক চুক করে ডাকতেই সোজা কাছে এসে সামনের দু-পা তুলে দিয়ে গায়ে ওঠবার চেষ্টা! মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতেই আরামের ঘরঘর আওয়াজ।

ওদিকে মারাত্মক ঠান্ডাতেও সুন্দরী হোটেল মালকিনের গায়ে একটা পাতলা গোলাপি কার্ডিগান আর গলায় একটা সিল্কের স্কার্ফ। একঝলক বরের দিকে তাকিয়ে নিলাম। নাহ্, তিনি মালিকের সাথে পানীয়ের বিষয়টি নিয়েই ব্যস্ত। এসব দিকে ভ্রূক্ষেপও নেই!

তা, হোটেল মালিকই জানালেন রক্সি আমার জন্যে একটু ‘স্ট্রংগ’ হয়ে যাবে। রাইস থেকে বানানো আরেকটা পানীয় আছে ওর কাছে, সেটা নেওয়াই আমাদের পক্ষে ভাল হবে। আর আমি গাধারাম এইমাত্র বুঝলাম যে সব কটি পানীয়তে উত্তাল ইথাইল অ্যালকোহল রয়েছে। এতক্ষনে ওর সেই কাঁচুমাচু প্রস্তাবের কারণ আমার মাথায় ঢুকলো। এদিকে ঠান্ডাতে প্রায় মারা পড়বারই জোগাড়। অতএব, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ প্রবাদটি মনে করে, কান-মাথা পেঁচিয়ে, দুজনে দুটো কাঁচের গ্লাসে পানীয় নিয়ে বাইরে এলাম।

বাইরে দুটো ফাইবারের চেয়ার পাতা, একটা লাল টেবিলও। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় চারিদিকে একটা মায়াবী আলো। যদিও পর্বতচূড়াগুলো মেঘের আড়ালে সব। রাইস ওয়াইনে একচুমুক দিতে ঠান্ডা ভাবটা সত্যিই কাটলো। তবে, বিচ্ছিরি একটা পচাটে গন্ধ।

এখন, মাথার উপরে তারাভরা আকাশ; যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারা যাবে। কালপুরুষ, ধ্রুবতারা সব সুষ্পষ্ট। অনেক ছোট্টবেলায় গরমের রাতে লোডশেডিং হয়ে গেলে আমায় ছাদে নিয়ে যেত বাপী। তখন তো আর এমন ঘরে ঘরে জেনেরেটর চলত না। তাই লোডশেডিং মানে নিকষ কালো আঁধার যেন গিলে খেতে আসত। অন্ধকার পল্লীতে আমরা বাবা-মেয়েতে তারা চিনতাম আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে। ছাদের পাশে সুপুরি গাছের  মাথাগুলো ভূতুড়ে দৃষ্টিতে যেন তাকিয়ে থাকত আমাদের দিকে। ভয়ে সেদিকে ভালো করে চাইতে অবধি পারতাম না। রাতের খাবার খাওয়া হতো হ্যারিকেনের আলোতে৷ মা নিয়মমাফিক আগের রাতের পুড়ে যাওয়া সলতে কেটে বাদ দিয়ে হ্যারিকেনে কেরাসিন ভরে রাখত সেই সাঁঝবিকেলেই। দেওয়ালে হ্যারিকেনের আলোর দপদপানি আর রহস্যময় নকশা। বড় বড় খয়েরি রঙের মথ ফড়ফড়িয়ে উড়ে এসে বসতো হ্যারিকেনের গরম কাচে। খাওয়া শেষ হলে হাত ধুতে যেত হত কলপাড়ে গা ছমছমে অন্ধকারে। ঠাকুমার গা ঘেঁষে পেছন পেছন যেতাম। ঠাকুমা নিজের সকড়ি মুখ-হাত ধুয়ে কুলকুচি করতো জোরে জোরে। কলপাড়ে হঠাৎ শব্দ হত ঠাস্ করে৷ আমি চমকে উঠে দেখতাম নারকেল গাছ থেকে একটা ছোট্ট কু্ঁড়ি-নারকেল বাঁধানো মেঝেতে পড়ে  দু-ফাঁক হয়ে গেল!  ঠাকুমা আমার মুখ ধুইয়ে দিতেই আমি একছুটে ঘরের ভেতরে। পেছনে ঠাকুমা চিল্লাতো— “দ্যাখো মেয়ের কান্ডখান্! সকড়ি হাতখান্ ভাল কইর‍্যা না ধুইয়াই দৌড় লাগাইলো গিয়া।”

ঠাকুমাকে কতবছর হয়ে গেল দেখিনি!  বাপিকেই তো আজ প্রায় ১৪ বছর…!

কোনওদিন এদের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনাটুকুও আর নেই।

ভুল বললাম বোধহয়!  শুনেছি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে নাকি সমস্ত পূর্বপুরুষের হাজির হন পরপারে স্বাগত জানাতে। একথা সত্যি হলে অন্তত আরেকটিবার দেখা হবে সকলের সাথে!

আনমনে এসব আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে খেয়াল করিনি মেঘ কেটে গিয়ে কখন সামনের রেঞ্জটা পুরো ক্লিয়ার হয়ে গেছে। গতদিনের মতই সপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ভাসিত চোখের সামনে এবং টুমলিংয়ের চেয়ে যেন আরও কাছে, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবো তাঁর বরফঠান্ডা শরীর। অনিমেষ নয়নে কতক্ষণ চেয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎই ঠান্ডাটা অাবার জাঁকিয়ে ধরতে সম্বিত ফিরে এল। নাহ্, আর পারা যাচ্ছে না! এবার ঘরে ঢুকতেই হবে। হঠাৎ নজরে এল  সামনের টেবিলে কী যেন সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো।

ওমা! এতো একটু আগের পড়ে থাকা জল জমে বরফকুচি হয়ে গেছে।

একটু দূরে একটা ঘড়ি লাগানো, তাতে এই মুহূর্তে টেম্পারেচার দেখাচ্ছে -১’ আর সময় রাত দশটা।

রাত হয়ে গেছে।  তাই, দেরি না করে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নিলাম। হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে সেই রাত্তিরে খাওয়া গরম গরম খিচুড়ি, আলুভাজা আর চাটনির অমৃতস্বাদ এখনো মুখে লেগে রয়েছে।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে মাথা আর কান ঢেকে হু-হু করতে করতে সান্দাকফু টপে উঠলাম। অনেকেই এসে গেছেন ততক্ষণে।  সামনে দিগন্তরেখায় আবছা স্নো-পিক। খানিক পরে, সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়লো কাঞ্চনজঙ্ঘার উপর। আহা, সে কী অনূভুতি! রক্তিমাভায় গলিত সোনার রঙ ধারণ করেছে শৃঙ্গ। অপার বিস্ময়ে সক্কলে চুপ,  চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, শুধু শাটারের ক্লিক-ক্লিক শব্দ। কাঞ্চনজঙ্ঘায় রঙের খেলা শেষ হলে পরে মাকালু আর এভারেস্টের উপর দিনমনির প্রথম কিরণ এসে পড়লো। অসাধারণ কিছু ফ্রেম ধরে রাখা হল ক্যামেরায় আর মুঠোফোনে। যাক, আমাদের এত কষ্ট তাহলে সার্থক।

বেলা বাড়ছে। আজই ধরতে হবে ফেরার পথ। ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম ল্যান্ডরোভারে। একটা অদ্ভুত মন খারাপের অনুভূতি আমাদের দুজনকেই ঘিরে ধরেছে।

গাড়িতে দুজনে বসে ছিলাম চুপচাপই। এই কিছুদিন আগে পুজো শেষ হলেও সান্দাকফু-যাত্রার কথা ভেবে মনখারাপ হয়নি তখন। অথচ, এখন খুব কান্না পাচ্ছে। গাড়ির জানালায় ভেজা ভেজা মনকেমন।

বর গম্ভীর মুখে আড়চোখে একবার দেখে নিলে; তারপর, বাইরের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলো,  “এখনো তো আমাদের জার্নির অনেকটা বাকি। এই ত্তো, এখান থেকে নেমে যাবো মানেভঞ্জন।  তারপর বিকেলের আগেই পৌঁছে যাবো দার্জিলিং। এরপর তিনচুলেও আছে। আর তিনচুলেতে গিয়ে তো বড় একটা কাজ রয়েছে। আমাদের পরের ট্যুরের প্ল্যানিংটাও তো সেরে ফেলতে হবে!”

এত মনখারাপের মাঝেও হেসে ফেললাম ফিক্ করে।

ছোট্ট একফালি ঝিকমিকে রোদ তক্ষুনি যেন আড়মোড়া ভেঙে নেমে এল পাহাড়ের ঢালে। আর, পথের পাশের ভেজা ভেজা ফার্নও তাদের সবুজ পাতা নাড়িয়ে আমাদের বিদায় জানালো।

 

প্রয়োজনীয় টুকিটাকি—

থাকা

১. চিত্রে: ঈগলস নেস্ট, ফোন:09733081184

২. টংলু: জিটিএ ট্রেকারস হাট (ভাড়া নামমাত্র), ফোন: 9088030683

৩. টুমলিং:

ক. সিদ্ধার্থ লজ

যোগাযোগ:  তিলক গুরুং,

ফোন: 95933 20408, 97350 00615

খ. শিখর লজ

যোগাযোগ:  কেশব গুরুং,

ফোন:9232695120, 9564797551

ভাড়া: ডাবল বেড রুমের চার্জ মোটামুটিভাবে ১২০০-১৫০০।

৪. সান্দাকফু:

ক. হোটেল সানরাইজ

ফোন: (+91) 9741450002

ভাড়া: ডাবল বেড রুমের চার্জ মোটামুটিভাবে ১৮০০-২৫০০। নতুন বিল্ডিংএর ঘরগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল এবং দামি।

খ. শেরপা চ্যালেট

ফোন: 9332599261, 9933488159

ভাড়া: ডাবল বেড রুমের চার্জ মোটামুটিভাবে ১৫০০-৩০০০।

গ. এছাড়াও, জি.টি.এ বা পি. ডব্লিউ. ডি. র থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

যোগাযোগ করুন এদের কলকাতা অফিসে…

লেখিকা- মালবিকা ব্যানার্জি

অনুজীববিদ্যা গবেষক ও ভ্রমণপিপাসু

ছবি: সুপ্রতিম মন্ডল

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page