ছোট উপন্যাস

ছোট উপন্যাস ।। গোপাল গোঁসাই ।। সৌপ্তিক চক্রবর্তী

এক

গোপাল খাটিয়ার ওপর নতুন কেনা তোষকে ঘাড়গুঁজে বসে সামনের খবরের কাগজে গাঁজা কুটতে কুটতে ভাবলঃ সত্যিই! লাস্ট তিন-সাড়ে তিন বছরে তার জীবনটা কেমন আমূল বদলে গেল!

দুপুর আড়াইটে হবে। মোড়ের মাথায় ‘তারা মা ভাতের হোটেল’ থেকে ডিম-ভাত খেয়ে বাড়ি ফিরে কলতলায় স্নান সেরে এই বসেছে। এবার এক ছিলিম সেজে খাবে। তারপর ঘুম দেবে একচোট। 

সেই ২০১৯-র গোড়ায় লোকসভা ভোটের কিছুটা আগ দিয়েই খুন হয়ে গেল তার বাবা। তোলাবাজ ছিল। পাড়া লাগোয়া ঝিলপাড়ের বাজারটা সেই দেখত। পালাবদলের পরপরই বুদ্ধি করে পাল্টি খেয়েছিল। ফলে ঝামেলাও ছিল না আবার সংসারে কোনো অভাব-অনটনও ছিল না। সেই তার বাবাই খুন হয়ে গেল গোষ্ঠীবাজিতে! যাক গে।

তার বাবার ডাকনাম নন্দ হওয়ায় এবং সেই নামেই অধিক পরিচিত থাকার কারণেই সম্ভবত সে ছেলের নাম রেখেছিল গোপাল। মায় আবার তার মা ঘটা করে জন্মাষ্টমী পালন করতেন ফি বছর। যাইহোক, ডাক ও ভাল মিলিয়ে এই একটাই নাম তার। 

পাশেই যতীন কলোনীতে একটা বাড়ির একতলায় দুটো ঘর-রান্নাঘর-বাথরুম নিয়ে ভাড়া থাকত তারা। তারা বলতে বাপে-মায়ে-ছেলেতে। ওই বাড়িতেই গোপালের জন্ম।

গাঁজাটা মিহি করে কুটে নিয়ে বিড়ির মশলা ঢেলে হাত দিয়ে ভাল করে মিশিয়ে নিল গোপাল। মেঝেতে রাখা জলের বোতলটা তুলে নিয়ে কালচে হয়ে যাওয়া লাল কাপড়ের সাফিটা ভিজিয়ে নিংড়ে নিল। তারপর ছোট্ট কালো ছিলিমে সাফি জড়িয়ে মালটা ভরে নিল। বাঁহাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের ফাঁকে ছিলিমটা ধরে ওস্তাদের মতো ঠোঁটের ওপর রাখল। সাফি আর ঠোঁটের মাঝে সামান্য গ্যাপ। 

মাঝারি হাইটে গাট্টাগোট্টা চেহারা গোপালের। বাঁহাতের বাইসেপটা তাই ফুলে উঠেছে। গাঢ় ও উজ্জ্বল শ্যামলা রং। নাক-মুখ-চোখ কাটাকাটা। দাড়ি-গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। কদমছাঁট চুল। 

ডানহাতে লাইটার জ্বেলে আলতো আলতো টানে ধরিয়ে ফেলল ছিলিমটা। তারপর একটা লম্বা টান মেরে একটু ধরে রেখে অনেখানি নীলচে ধোঁয়া ছেড়ে দিল।

বেলুড়ের একটা পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা করেছিল। সিভিলে। তারপর বছর দুয়েক আড্ডা মেরে, গেঁজিয়ে, ক্লাবে টিটি-ক্যারম খেলে, গাঁজা টেনে, প্রেম করে, ঘুরে বেরিয়ে শেষমেষ দুই বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপে ইট-বালি-চুন-সুরকি সাপ্লায়ের বিজনেস শুরু করেছিল। ইচ্ছে ছিল আস্তে আস্তে কন্সট্রাকশনে যাবে।

যাইহোক, বাবার বাৎসরিক কাটিয়ে দীর্ঘদিনের প্রেমিকা চন্দনাকে বিয়ে করেছিল গোপাল। তখন সে সদ্য পঁচিশে পড়েছে। আর চন্দনা একুশে। অনেকদিনের প্রেম। আর ফেলে রাখতে চায়নি বিয়েটা।

কিছুদিন আনন্দে কাটানোর পরই আবার শোক। করোনায় মারা গেল তার মা। ২০২০-র মাঝামাঝি। সে ও তার বউ দুজনেই ভুগল।

বড় বড় টানে ছিলিম টানতে থাকল গোপাল। কিছুক্ষণ পর ছিলিম শেষ হলে একটা মাঝারি সাইজের ভাঁড়ে, যেটাকে ছাইদান বানিয়েছে, ঢেলে দিল ছাইটুকু। ছিলিমটা তেলোতে জোরে ঠুকে গিট্টিটা বার করে আনল। নখ দিয়ে গিট্টি ও একটা ঝাঁটার কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে ছিলিমটা পরিষ্কার করল। তারপর গিট্টিটা আবার ভরে দিল। আঙুল ঢুকিয়ে চেপে টাইট করে দিল একটু। 

খাটিয়ার ওপরেই ছিল আলুমিনিয়ামের ছোট্ট বাক্সটা। যেমনটা ছেলেবেলায় স্কুলে নিয়ে যেত। ওটার ডালা খুলে সাফি মোড়ানো ছিলিম-কাঠি ভরে রাখল। শুধু ছিলিম-কাঠি নয় ওই বাক্সে থাকেঃ

গাঁজার প্যাকেট

একটা বাবুল টুথপেস্টের ছোট টিউব 

সস্তার টুথব্রাশ

স্বচ্ছ প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়ানো লাক্স সাবান

গার্ডার মারা ছোট টাইড ডিটারজেন্টের পাউচ

কালো রঙের একটা পকেট চিরুনি

একটা প্যারসুট নারকেল তেলের মাঝারি বোতল

সেলো ব্র্যান্ডের একটা দশ টাকার বলপেন 

মাঝারি সাইজের নেইল কাটার 

এইরকম টুকিটাকি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিশ।

এরপর আরও বড় দুর্বিপাক তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। ২০২১-র গোড়ায় বন্ধুরা, বন্ধু না বলে পার্টনার বলাই ভাল, চিট করল। শধু চিট করেই ক্ষান্ত হল না। মিথ্যে চুরির দায়ে জেলেও পুরল তাকে। রক্ষে যে তারা তখনও বাচ্চা-কাচ্চার কাথা ভাবেনি!

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় জামা-কাপড়ের সাথে সেলফোন আর ওয়ালেটটা ফেরত পেয়েছিল। এসবিআই-এর ডেবিট কার্ড, প্যান কার্ড আর ভোটার কার্ডটা ওয়ালেটেই ছিল। এখনও ওখানেই রাখে। ফাইলটা তার মামার কাছে রেখেছে।

একটু জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে গোপাল একটা বিড়ি ধরাল। বিড়ি টানতে টানতে আবার নানান ভাবনা ও স্মৃতিতে ডুবে গেল…

বিড়িটা শেষ করে ভাঁড়ে গুঁজে দিয়ে আর একটু জল খেয়ে খাটিয়ায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল গোপাল। মাথার বালিশটাও নতুন। পায়ের কাছে মুড়ে রাখা মশারিটাও। 

বৃষ্টি-বাদলা হয়ে ওয়েদারটা একটু ঠান্ডা এই যা বাঁচোয়া। একটু হ্যাল খেতে খেতে ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে এল তার।

 

দুই

একবছর জেল খেটে এই মাস দেড়েক হল ফিরেছে। জেল এক দুর্বিসহ ব্যাপার। সে যে কদিনেরই হোক। গোপাল তো মনে মনে ভাবে আর যাই হোক না কেন আর কখনও যেন জেল না হয় তার। 

ওফঃ বাবা! সেই হুব্বা কাঁসাই, বুড়ো থলথলে মাল, যার স্বভাব ছিল, হয়ত এখনও তাই আছে, নতুন কোনো কয়েদি এলে সুযোগ বুঝে দলবল সমেত চড়াও হয়ে যুত করে তার পেছনমারা। 

ভাগ্যিস! ‘বাসুদেবনদা’ ছিল। সেই বাঁচিয়ে নিয়েছিল গোপালকে। ফলপট্টিতে জোড়াখুনের দায়ে যাবজ্জীবন। দক্ষিণের লোক কিন্তু জন্মকম্মো এখানেই। চমৎকার বাংলা বলে। জেলে বসেও অপারেট করত বলে অন্য কয়েদিরা সবাই তাকে সমঝে চলত। হুব্বা কাঁসাইয়ের বান্টু থেকে নিজের পেছন বাঁচাতে আমেয়াদ জেলে বাসুদেবনের পোঁদেপোঁদে ঘুরত গোপাল। 

জেল থেকে ফিরে দেখে সব শেষ। নিজের পাড়ায় ঢুকে তাদের ভাড়া বাড়ির কাছে এসে দেখে কোথায় বাড়ি? কনস্ট্রাকশন হচ্ছে! দুটো তলা গাঁথাও হয়ে গেছে! এদিকে তার কনস্ট্রাকশন তোলার স্বপ্ন প্রায় চুরমার তখন।

নিচেই একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন ঘরে তার সেই দুই বন্ধু বা পার্টনার বসে ছিল। সাথে কয়েকটা লেবার। গোপালকে দেখেই একজন ‘কি রে, বাঞ্চোত আবার চুরি করতে এসেছিস!’ অন্যজন ‘মেরে তাড়া, বোকচোদকে’ বলেই লাফ মেরে বেরিয়ে তেড়ে এল। 

সাথে লেবারগুলোও। 

‘ভাগ এখান থেকে শালা, আর কোনোদিন যেন পাড়ায় না দেখি।’ 

তাকে গালে-ঘাড়ে চড় তো মারলই আরও মারতে যাচ্ছিল। সে কোনোমতে হাত দিয়ে আটকাতে আটকাতে জিজ্ঞেস করল ও বললঃ চন্দনা কোথায়? ওকে নিয়েই আমি চলে যাব, ভাই। মারিস না।

‘ওসব চন্দনা-ফন্দনা কোথায় আমরা জানি না। তুই বেরো পাড়া থেকে। শালা চোর।’ বলে উঠল এক পার্টনার। 

আর একজন ধাক্কা মারল বুকে। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তার ওপর পড়ে গেল গোপাল। 

বাড়ি ভাড়ার এগ্রিমেন্টও ছিল না। তার বাবা বেঁচে থাকতে দরকারই পড়েনি কখনও। আর গোপালও করায়নি। এতদিনের চেনা বাড়িওয়ালা। মাস গেলে ভাড়া বাবদ একটা দিয়ে দিত। অগত্যা গোপাল পাড়া ছাড়তে বাধ্য হল। 

লেখাপড়ায় তেমন মন না থাকলেও রবি ঠাকুরের লেখা বলেই হয়ত তার ওই দুই লাইন মনে পড়েছিলঃ তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে! 

রাস্তা থেকে উঠে গায়ের ধুলো ঝেড়ে মুখ ঘুরিয়ে এগোতে থাকল মোড়ের দিকে। 

হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকল কে চোর! তাকে বিজনেসে চিট করে দিল! মিথ্যে মামলায় তাকে ফাঁসাল! তারা এতদিন ভাড়া ছিল এই বাড়িতে তখন প্রোমোটিং করল না! এখন যেই তারা একে একে মরেছে বা সরেছে অমনি প্রোমোটিং করে দিল! ভাগের ন্যায্য ফ্ল্যাটটাও দিল না! বউটাকে কে কী বুঝিয়েছে কে জানে! কোথায় গেল তাই বা কে জানে!

চলবে… 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page