সতীত্ব ও বেহুলা উপাখ্যান।। শম্পা রাউৎ
যে ‘পিতৃতন্ত্র ‘সতী’ শব্দ তৈরি করল তার কোনো পুংলিঙ্গাত্মক কোন শব্দ তৈরি করা থেকে খুব সতর্কভাবে বিরত থেকেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের উন্নত জীবনাচরণ সমৃদ্ধ মহাকাব্যগুলিতে ক্রমেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল অনার্য স্বাধীন জীবন। একে ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দেওয়া যায়। সে যুগে রঙিন মনোরঞ্জক সতীত্বের সংঘাত নিয়ে সতী নারীর চমকপ্রদ গল্প তৈরি হচ্ছিল দৃষ্টান্ত হিসেবে। এই বিপর্যয় মধ্যযুগের বাঙালির সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। নারীকে শিক্ষাহীন করে রাখায় গার্গী, মৈত্রেয়ী, অপালার কথা সাধারণ মানুষ জানতেও পারলেন না। জনমদুখিনী সীতাদেবী এবং বেহুলা বা সাবিত্রী হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হতে শুরু করলেন তাঁরা। তাঁরা শাস্ত্রের উপদেশ শুনতেন—- ‘নারীর জন্য বিবাহই উপনয়ন,পতিসেবা বেদঅধ্যয়ন আর পতিগৃহে বাস হলো গুরুগৃহে বাস।’
মধ্যযুগে এবং এই যুগেও মনসামঙ্গলের কাহিনী সমান জনপ্রিয়। কাব্যগুলিতে নারীকে শিশুকাল থেকে পতিব্রতা হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বেহুলাকে আমরা সবাই একজন শ্রেষ্ঠ সতী নারী হিসেবে চিনি। চাঁদ সওদাগরকে আমরা চিনি দুঃখবিজয়ী, বীর, পুরুষাকারের প্রতিমূর্তি হিসেবে। এক্ষেত্রে চিনি মানে চেনানো হয়েছে।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আলোর অভিমুখ বদলে গেল। হতে পারে যে, তার প্রমাণ মাইকেল মধুসূদন দিয়ে গেছেন। মনসামঙ্গল কাব্যের দুটি প্রধান সমুদ্রযাত্রার গল্প আছে। এক, চাঁদ সওদাগরের। সে পূর্ণ হাতে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসে। দুই, বেহুলার। সে শূন্যহাতে গিয়ে পূর্ণ হাতে ফিরে আসে। বিরাট সমুদ্রযাত্রার মুখোমুখি যে দুটি মানুষকে হতে হলো তাদের মূল্যায়নের এর এই দ্বিমুখিতা আসলে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই একপেশে ধর্মশাস্ত্রের প্রভাবের কাছে, যার থেকে এই পাঁচশো বছরেও আমরা বোধহয় মুক্ত হতে পারিনি। জলযাত্রার মধ্যে উত্তাল ঢেউয়ের মোকাবিলা চাঁদ করলেন সাহস দিয়ে। হিংস্র জলজন্তুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন বুদ্ধি দিয়ে। আর এসবের হাত থেকে বেহুলা বাঁচলো কেবল সতীত্ব দিয়ে? এই সতীত্ব বা যৌন শুচিতার কতকগুলি মাপকাঠি পিতৃতন্ত্র করেছিল। অনাহারে থাকা চাঁদ সওদাগরের প্রতি আমাদের করুণা বর্ষিত হয় অথচ বারো বছরের বেহুলার কথা আমরা তেমন করে ভাবিইনি। পচা গলা লখিন্দরের শরীরের রসে যখন মাছি ভনভন করে, তখনও বেহুলাকে প্রেম দেখাতে হয়। এই বেহুলাকেই আবার এক চরিত্রহীন জুয়াড়িকে পাঁচটি বিবাহ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়।
সাহিত্যের পাঠ বদলে যেতেই পারে। যে বেহুলাকে অসহায়, সতী বলে তার ওপর করুণা করা হয়েছে, সেই বেহুলাই ঘর ছেড়ে বেরোতে পারা, একাকী সমুদ্রযাত্রা করা আধুনিক এক নারী হিসেবে আমাদের আদর্শ হয়ে উঠতেই পারতেন।