উপন্যাস।। আবার এসো ফিরে।। রামেশ্বর দত্ত

  ‘আপনি জানেন নিশ্চয়ই রেবেকা, মানে আমার প্রথমা স্ত্রী আমাদের চারটে সন্তানকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। এবং বিবাহ বিচ্ছেদও করেছেএখন আমি হেনরিয়েটাকে নিয়ে সুখে আছিমাদ্রাজের কোর্টে মামলার দেশীয় ভাষার নথিপত্র ইংরাজিতে তর্জমা করার কাজ করছি তাতে যা পাই, তা দিয়ে সংসার চালিয়ে এই স্থানে কৃত কর্জ মেটানো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আপনাকে আর অধিক কী জানাব। আপনি তো সবই জানেন। এবং সময়ে সময়ে আমার চাহিদা মতো অর্থ পাঠিয়ে আমার জীবনকে সচল রেখেছেন। আমার পৈতৃক বাড়িটা বিক্রয় করে আশা রাখি, অধিক অর্থ পাব। তা দিয়ে আমার সমস্ত ধারদেনা মিটিয়ে দোব। এর পরে ইচ্ছা, বিলেত গিয়ে সেখান থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসে কলিকাতার উঁচু আদালতে ওকালতি করব। যদিবা এ সম্বন্ধে কলিকাতায় পৌছিয়ে আমি আপনার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবার ইচ্ছা রাখলাম।’

এরপর… 

  মাইকেলের চিঠি পেয়ে দুই কাজ এক করে খিদিরপুর এসেছিলেন।  প্রথম কাজ শেষ। এখন রাজনারায়ণ দত্তের রেখে যাওয়া সম্পত্তি পরিদর্শন করছেন তিনি।

বাড়ি বিশাল আকারের। বহু ঘর বিশিষ্ট দুতলা বাড়ি।  ইংরাজির ইউ ধরণের । বাড়ির দুটো প্রবেশ দ্বার।  জানলা,কপাটও বড় আকারের। কাঠের। খড়খড়ি দেওয়া জানালা। বাড়ির সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে  পুরো বাড়িটাকে নিরীক্ষণ করছিলেন। একজন এগিয়ে এলেন। পরিচয় জানতে চাইলেন । নিজের নামধাম জানালেন। বললেন, মধু আমার থেকে বছর চারেকের ছোট হলেও, আমরা দুজনে ভালো বন্ধু।

ভদ্রলোক ঈশ্বরচন্দ্রকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একথা সেকথার মাঝে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, এই বাড়ি মধু বিক্রি করতে চায়।

-মধু!

ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, সে তো কবেই ইহলোক ত্যাগ করেছে!

ঈশ্বরচন্দ্র গায়ের ফতুয়ার বুক পকেট থেকে মধুর চিঠিখানা বের করে ভদ্রলোককে দেখালেন। ভদ্রলোক বলে উঠলেন, এও আমায় বিশ্বাস করতে হবে?

-বিশ্বাস করুন আর না করুন, যা সত্য তাই আমি আপনাকে দেখালাম।

-মশায়, আপনার উদ্দেশ্যটা কি বলবেন?

-মধু এই বাড়ি বেচে দিতে চায়।

-অ্যাঁ…,

মুখে বিদখুটে আওয়াজ তুললেন ভদ্রলোক। তারপর বললেন, বিক্রি! কোন সাহসে সে এ কথা বলে? মধু কি জানে না, তার বাবা তাকে ত্যাজ্যপুত্র করে গেছে? ত্যাজ্যপুত্রের আবার অধিকার কিসের?

কথা শেষ করে মুখব্যাদন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে উঠলেন, মধু তা বিলক্ষণ জানে। বেশ কয়েক বছর আগে সে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার কারণে রাজনারায়ণ দত্ত মশায় তার একমাত্র জীবিত পুত্রকে ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাই বলে, পিতার গচ্ছিত সম্পত্তিতে তার অধিকার ষোল আনা থাকবে না, তা তো হতে পারে না।

-মধুর হয়ে এসব কথা শোনাবার আপনি কে, মশাই?

-কালে তা জনতে পারবেন। এখন এইটুকু জানুন, মধু ভিন রাজ্যে থাকলেও, আমি তার পশ্চাতে আছি। আপনারা যদি  স্বমানে এই বাড়ি ছেড়ে না যান, মধু মামলা মোকদ্দমায় যাবে। তাকে আমিই এই পরামর্শ দোব। দেশে আইন বলে তো কিছু আছে।  আইনের সাহায্যে মধু তার সম্পত্তি উদ্ধার করবে। আর শুনে রাখুন, আমার নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর…

কথা অবশিষ্ট রেখেই ঈশ্বরচন্দ্র সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটা লাগালেন। বাড়ি ফিরে পরের দিন মধুসূদনকে তার করলেন, কাম সার্ফ। ইউ মে হ্যাব টু গো টু কোর্ট ফর ইওর প্রপার্টি।

দিন কয়েকের মধ্যে মধুসূদন কলিকাতায় এসে পৌঁছলেন। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জন্যে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে রেখেছেন। লোয়ার চিৎপুর রোডে। সেখানে গিয়ে উঠলেন। বন্ধু মাধ্যমে দৌত্য করার পরেও তাঁর আত্মীয়রা পৈতৃক বাড়ি খালি করল না। তাঁকে মোকদ্দমা করতে হবে। সময়ের ব্যাপার। যে কদিন থাকবেন কলিকাতায় তাঁকে একলাই থাকতে হবে। হেনরিয়েটা মিল্টন আর শর্মিষ্ঠা মাদ্রাজে রয়ে গেছে।

কেস ফাইল হল আলিপুর আদালতে। কেসে একটার পর একটা দিন পড়ছে। মাস দুমাস অন্তর। নানান কারণ দেখিয়ে আত্মীয়রা দিন নিচ্ছে। মধুসূদন বিরক্ত হচ্ছেন। অথচ কোনও উপায় নেই।  কলিকাতাতেই পড়ে রয়েছেন।  ওদিকে মাদ্রাজে বউ বাচ্ছা তাঁর ফেরার দিন গুনছে । কলিকাতা থেকে টাকা গেলে তবে তাঁদের সংসার চলে।

নিজের সঞ্চয়ের টাকা শেষ হল। হাত পাতলেন ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে। কিছু পেলেন। কয়েক দিন চলল। নিজের। খেয়াল থাকছে না ওদেশেও টাকা পাঠাতে হবে। বেচারি হেনরিয়েটা টাকার অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন কলিকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। দুই সন্তানকে নিয়ে। খবর দিয়েই এসেছে ।

নির্দিষ্ট দিনে মধুসূদন হাওড়া স্টেশনে ছুটল। গাড়ি এলো। মাদ্রাজ মেল। তা থেকে হেনরিয়েটা ছেলে মেয়েকে নিয়ে  স্টেশনে নামল। শুকনো মুখ। মাথার চুল অপরিপাটি। মিল্টন, শর্মিষ্ঠার অবস্থাও একই রকম। বাবাকে দেখে তারা ছুটে কাছে এলেও, হেনরিয়েটার কোনও উচ্ছ্বাস নেই। মুখ ভার। হনহনিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ভোলবার ব্যবস্থা করেছ আমাদের?

মধুসূদন ইতস্তত করছিল, কী বলবে ? তার আগেই হেনরিয়েটার আবার একচোট বাক্যবাণ, কোন আক্কেলে আমাদেরকে সেখানে একলা ফেলে রাখছ বলো তো? দুমাস ধরে কোনও টাকা পাঠালে না। আমরা কিনা খেয়ে মরব?

-চলো। বাড়ি চলো।

স্ত্রীকে শান্ত করবার ভঙ্গিতে হাত ধরল। হেনরিয়েটা আর কিছু বলল না। স্বামীকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলল। পথে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে আসতে আসতে মধু স্ত্রীকে বোঝাল, যত তাড়াতাড়ি হোক আদালতের মাধ্যমে কেস মিটিয়ে ওই বাড়ি বিক্রি করব।

-তারপর? তারপর কি মাদ্রাজ ফিরবে?

-অবশ্যই যাব। তবে বেশিদিন দেশে থাকব না। অর্থ উপার্জনে আমাকে নেমে পড়তে হবে।

-কোথায় যাবে?

-লন্ডন। সেখানে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ব। পাশ দিয়ে এ দেশে ফিরব। এটর্নি হব। অনেক অর্থ উপার্জন করতে হবে আমাকে।

-আমরা কোথায় থাকব ততদিন?

-চিন্তা কোর না হেনরিয়েটা। তোমাদের জন্যে বাড়ি বিক্রির টাকার ভালো অংশ রেখে যাব। কোনও কষ্ট হবে না তোমার। বাচ্ছাদের।

হেনরিয়েটা সন্তুষ্ট হল। বাড়ি এল।

পরিবার নিয়ে কলিকাতায় নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে লাগল মধুসূদন। ইতিমধ্যে তার লেখা কিছু বই মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাম দিয়ে বাজারে কাটছিল।  বাংলা ভাষায় তা যথেষ্ঠ সুখ্যাতি পেয়েছে। তারই টারসে মাদ্রাজের কোর্টের দোভাষীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিল মধুসূদন।

কেস মামলা মিটল। দখল পেল পৈতৃক বাড়ির। সঙ্গে বাবার রেখে যাওয়া সুন্দরবনের জমি জায়গাও ফেরত পেয়ে গেল। বাড়ি বিক্রি করল না। বন্ধক করল। পেল সাত হাজার টাকা।   সুন্দবনের জমির বায়নামা হল। তবে টাকা নগদে পেল না। ওই টাকা ডাক যোগে মাসে মাসে মাদ্রাজে পৌছিয়ে যাবে;আশ্বাস পেল।  কলিকাতার বাস তুলে পরিবারকে নিয়ে মাদ্রাজে ফিরল।  পুরনো আস্তানা। মন উচাটনে। কতদিনে লন্ডন পারি দেবে।

কথায় বলে, ওঝার ঝাড়ে বিষ নিকেশ; নেশার ভারে মানুষ শেষ। তা মধুর হল সেই অবস্থা। ছোট থেকেই যার ধুতি শার্ট বাদ দিয়ে হ্যাট কোট পরিধান করা, আর সুরা পান করার অভ্যেস; তাঁকে  শোধরায় কোন ঈশ্বরে?

মধুসূদন লন্ডনে এসেছে। পড়াশোনার সাথে সাথে বিদেশি মদের সদব্যবহার মাত্রারিক্ত বেড়ে গেল। রাজার ধনও বসে খেলে একদিন নিঃশেষ হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পিতৃপুরুষের পাওয়া জায়গা-বাড়ি বন্ধকের টাকায় এভাবে আর কতদিন চলবে? তাও যার মাসিক টাকার ভরসায় মধুসূদন হেনরিয়েটাকে দুই সন্তান সহ দেশে রেখে এসেছে, সে বেচাল লোক টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল। পরিবারের না খেয়ে থাকার অবস্থা।

খবরটা লন্ডনে পৌছাল। হেনরিয়েটার কষ্টের কথায় চোখের জল ফেলল মধুসূদন। মনে কষ্ট। বেচারি। কত সুখের ঘর থেকে তার কাছে চলে এসেছে, আর আজ কিনা, না খেতে পেয়ে বাচ্ছাদের নিয়ে শুকিয়ে মরছে? অতএব দেরী করা নয়। তিনজনকে নিজের কাছে আনিয়ে নিল।

একে হয় না, তায় দোসরকে টানা।  ভীম ঘটোৎকচ হলে না হয় অস্ত্র শিক্ষা দিয়েও কিছু অর্থের জোগান হতে পারত, কিন্তু বিদেশে বসে বাংলার সরস্বতীর আরাধনায় কে তাকে অর্থ দেবে? ফল, ফের টাকায় টান। হাত পাতার শুরু। হাত পাতলে হাতে আশীর্বাদী ফুল দেবার তো একজনই রয়েছে। কলিকাতার আর সকলকে মধু  চিনে নিয়েছে। যাঁরা তাঁর আসবার সময়ে বড় বড় আশ্বাস দিয়ে  তাঁকে বিদেশে পাঠাল, তাঁরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সুসময়ের বন্ধু বটে; অসময়ে কেউ নেই। এঁদের মধ্যে কে নেই? রাজা, জমিদার, রায়বাহাদুর তকমাধারী, সকলেই? হাত উপুড় করার বেলায় তাঁরা পশ্চাদপদ হেঁটেছে। বাদ শুধু একজনই।

হেনরিয়েটার সঙ্গে আলোচনায় বসল মদুসূদন। প্রথমে তো তিরস্কৃত হল, তোমার মতো মানুষের পাল্লায় পড়ে আমার জীবন ওষ্ঠাগত। এবার মরলেই বাঁচি।

-এ কথা বোলো না। দেখো, আমি তো আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আসলে আমার কবি হবার নেশা আমাকে কোথা থেকে কোথায় এনে ফেলল। আই এ্যম সরি, হেনরিয়েটা। আমার জন্যেই তোমার এত কষ্ট।

-আমার যা হবার তা তো হল। আমাদের শর্মিষ্ঠা, মিল্টনের ভবিষ্যৎ কী হবে?

-চিন্তা কোর না। আপাতত আমি ঈশ্বরকে জানিয়ে কিছু অর্থ আনিয়ে নিচ্ছি…

কথার মাঝে হেনরিয়েটা বলে উঠল, হ্যাঁ…, পেয়েছ একজনকে। না সে ব্যক্তি রাজা-উজির; না সরকারী বেতনভোগী  রাজকর্মচারী। কতবার সাহায্য করবে তোমায়?

-সে লোক দয়ার সাগর, হেনরিয়েটা।…তবে, এইবার একটা কাজ করব, অর্থ এলে আমরা  লন্ডন ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যাব।  এখানে থাকার খরচ অনেক। তার থেকে ফ্রান্সে গিয়ে থাকলে খরচ কম। শুনেছি, সেখানের ভারসেলিস  নগরে কম দামের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। ঘর ভাড়া নোবো। থাকব। কষ্টেশিষ্টে দিন চলিয়ে ব্যারিস্টারি পড়াশোনা চালিয়ে যাব। ব্যারিস্টার আমাকে হতেই হবে। তারপর দেশে ফিরব। অর্থকষ্ট আর থাকবে না।

অর্থকষ্ট হচ্ছে বাঁধ ভাঙা জলের তোড়ের মতো। মদুসুদন ঈশ্বরচন্দ্রকে চিঠি লিখেছে। টাকা পাঠিয়েছেন তিনি। কিন্তু তা আসতে দেরী হচ্ছে। কলিকাতার বাড়ি বন্ধকের বাকি টাকা, তাও আসল না। হেনরিয়েটা সেদিন কান্নাকাটি করা দুটো বাচ্ছার আবদার রাখতে পারছে না। বাড়ির সামনে মেলা বসেছে। মিল্টন, শর্মিষ্ঠা মাকে ধরেছে, মেলায় নিয়ে যাবার জন্যে। অথচ হাতে রয়েছে মাত্র তিন ফ্রাঙ্ক। বাচ্ছাদের একদিনের দুধের খরচও জোগাড় হয়ে উঠবে না। কেঁদে পড়ল স্বামীর কাছে। বলল, এভাবে আর কতদিন? আমি তো আর সহ্য করতে পারছি না।

মধুর মন খারপ হল। তারই মধ্যে স্ত্রীকে আশ্বাস দিল, চিন্তা কোর না হেনরিয়েটা, দেখো আজকেই টাকা এসে পড়বে।

এতটাই ভরসা মধুর ঈশ্বরচন্দ্রের ওপর। টাকা চেয়ে তাঁকে চিঠি দিয়েছেন একমাস আগে। দেখা গেল, ঠিক এগোরাটায়   তাঁর হাতে এসে গেল পনেরো’শ টাকা। বিদ্যাসাগর পাঠিয়েছেন।

ঘটনা ঘটল সেপ্টেম্বর মাসে। মাঝে সুস্থিতিতে অক্টোবর, নভেম্বর মাস কাটল। তারপর? ডিসেম্বরের মাঝ দিয়ে আবার টাকা এলো। দুহাজার চার শত নব্বুই ফ্রাঙ্ক। এবারেও ত্রাতা সেই ঈশ্বরচন্দ্র। কর্জ করেও তিনি মধুকে টাকা পাঠাচ্ছেন। যাতে মধু সেখানে নিজের পড়াশোনা শেষ করে ভারতে ফিরে আসে।  তার জন্যে হাইকোর্টে জায়গাও করে রেখেছেন। কলিকাতায় পা রেখেই মধু কাজ শুরু করতে পারবে।

মধুসূদন ব্যারিস্টারি পাশ করলেন। হ্যাট কোট পরে বিলিতি সাহেব সেজে জাহাজে করে দেশে ফিরছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের আনন্দ ধরে না। আগে থাকতেই মধুর জন্যে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেটাকে সাজিয়েগুছিয়ে রাখলেন। মধু এখন ব্যারিস্টার। তার কি আর যেখানে সেখানে থাকা চলে? তাই এত আয়োজন।

কিন্তু হা ঈশ্বর! তাঁর সব আশায় জল ঢেলে মধু কলিকাতা পৌঁছিয়ে সোজা স্পেন্স হোটেলে গিয়ে উঠল। বিলিতি হোটেলে।

ভীষণ দুঃখ পেলেন ঈশ্বরচন্দ্র।  কষ্ট মনে ধরেই মধুকে হাইকোর্টে প্র্যাকটিসের কাজে লাগিয়ে দিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের ধারণা, মধু এসে তাঁকে ঋণভার থেকে মুক্ত করবে। এ ঋণ তো তাঁর মধুর জন্যেই করা। কিন্তু সেখানেও তিনি হেরে গেলেন। মধু দুঃখের সঙ্গে জানান দিল, সম্পত্তি বিক্রয়ের পুরো টাকা এখনও পায়নি। কেমন করে ঋণ শোধ করবে?

এদিকে যাদের কাছ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র টাকা ধার নিয়েছিলেন, তারা ছোটবড় কথা দিয়ে তাঁকে অপমান করছে। বলছে, মূর্খ, আহাম্মক, বিদ্যারসাগর হয়েছে। এবার  দয়ারসাগর নাম কেনবার জন্যে এক অকৃতজ্ঞ ফিরিঙ্গি সাহেবকে টাকা জুগিয়ে গেছে…

কুণ্ঠায় মরে যাচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র। স্থির করলেন, নিজের সংস্কৃত যন্ত্র  ডিপোজিটারীর দুই তৃতীয়াংশ বিক্রি করবেন। সেই অর্থ দিয়ে ঋণমুক্ত হবেন। বুক ভরা  দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তাই করলেন। তবু ভাঙলেন না।

বাঙালীর সন্তান, মধুসূদন দত্ত, কবি হবার উচ্চাশা নিয়ে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মাইকেল হলেন, ঈশ্বরচন্দ্র দেখে মনে কষ্ট পেলেন; কিন্তু তাতে মধুর কবি স্বত্বাকে এতটুকুও ছোট ভাবলেন না,  স্নেহের আগলে জড়িয়ে রইলেন মধুর সঙ্গে।

মধুর দুর্দিনে হাত ভরে তাঁকে সাহায্য করে প্রতিদান আশা করলেন না, মধু ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে তাঁর ঋণ শোধ করল না, তাও সামলে নিলেন, নিজে ভাঙলেন না। তবে অকালে তার মতো এক প্রতিভাকে ঝরে যেতে দেখে সেদিন তিনি এক অতি গুণী বড় বন্ধুবিয়োগের ব্যাথায় কাতর হলেন। মধুর বয়স মাত্র একান্ন বছর। এটাই কি মধুর চলে যাবার সময়? ঈশ্বরচন্দ্রের কোমল হৃদয় সেদিন বাঁধ ভাঙা কান্নায় উদ্বেল হল। ভাবলেন, মধু বেহিসেবী ছিল বটে; তবে আপামার কৃতঘ্ননায় মোড়া মধু নিজে চলে যাবার আগে তাঁকে অমর করে রেখে গেল নিজের রচনার মধ্যে দিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র মধুর লেখা পড়ছেন আর হু হু করে কাঁদছেন-

বিদ্যার সাগর তুমি বিখ্যাত ভারতে।

করুণার সিন্ধু তুমি সেই জানে মনে,

দীন যে, দীনের বন্ধু! –উজ্জ্বল জগতে

হেমাদ্রির হেম-কান্তি অম্লান কিরণে।…

দীর্ঘ এ কবিতা তাঁকেও যে অমর করে দিয়ে গেছে সে কথা ভেবে ঈশ্বরচন্দ্রের অশ্রু আর বাঁধ মানছে না।

ভাঙা মনের সান্ত্বনা খুঁজতে সব কথা জনিয়ে তিনি দীর্ঘ পত্র লিখলেন বাবাকে। মধুর লেখা কবিতা সহ। পত্র পড়ে গর্বে ঠাকুরদাসের বুক ভরে উঠল। পড়ে শোনালেন ভগবতীদেবীকে। চকচক করে উঠল ভগবতীদেবীর দুচোখ। আনন্দের অশ্রু বইল দুজনের চোখে। শেষে ঠাকুরদাস গেলেন পুত্রবধূর কাছে। দীনময়ীর হাতে পত্রখানা তুলে দিলেন। দীনময়ী পাঠ করলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস নিলেন। কোথা থেকে যেন ফুলের সুবাস বয়ে এলো তাঁর নাসিকারন্ধ্রে ।  পত্রের ঘ্রাণ নিলেন। এ তাঁর পতিদেবতার পত্রের সুবাস। ছুটে গেলেন ঠাকুরদাসের কাছে। ভিক্ষা চাইলেন পত্রখানা। সারাজীবনের আমানত করে রাখবেন।

ঠাকুরদাস সস্নেহে দীনময়ীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ জানিয়ে বললেন, মা, ঈশ্বর আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছে। ও চিঠি বরং গৃহ দেবতার পায়ে অর্পণ করো।

দীনময়ী তাই করলেন।

(২২)

 

কয়েক মাস কেটে গেল। এখন প্রখর গ্রীষ্মের সময়। ঈশ্বরচন্দ্র আবার গ্রামে এসে পৌঁছেছেন।

কলিকাতায় বসে তিনি খবর পেয়েছিলেন, দেশ গ্রামে দুর্ভিক্ষের অবস্থা চলছে। উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি বীরসিংহে এসে পড়েছেন। দূরাবস্থার সামাল দিতে দেশের ইংরেজ সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। তা অবশ্য শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। সেখানে গ্রাম ছেড়ে কাতারে কাতারে মানুষ আসছে দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্যে। মানুষের আসা থামানো যাচ্ছে না। ঈশ্বরচন্দ্র নিজে ওপর মহলে লেখালিখি করেছেন। ব্যবস্থাকে আরও ত্বরান্বিত ও বিস্তারিত করবার অনুরোধ জানিয়ে, পরে নিজের গ্রামে এসে  দেখেন, সেখানের অবস্থা আরও ভয়াভয়।

তাঁর গ্রামে আসার খবর ছড়িয়ে পড়ল বীরসিংহ ছাড়িয়ে আশপাশের অন্যান্য গ্রামেও। কাতারে কাতারে লোক আসতে শুরু করল। দিনে এক’শ দু’শো । তারা চায় দয়ার সাগরের দান। অন্নসত্র নিয়ে বাঁচতে। কেউ আসছে রঙচটা কলাইয়ের থালা সম্বল করে, কেউ তাও আনতে পারছে না।  প্রখর খরায় ঝরে পড়া শুকনো কলাপাতা, শালপাতা হাতে আসছে তারা। পুরুষ-মহিলা, বাচ্চাকাচ্চার দল। মেয়েদের শরীরে ছিন্ন মলিন বস্ত্র। তা দিয়ে কোনও রকমে লজ্জানিবারণ হচ্ছে। মাথার চুল রুক্ষ । কতদিন তেল-জল পড়েনি তাতে। ক্ষুধায় পাগলপারা অবস্থা মানুষগুলোর। গ্রামের মানুষের এমন দুরাবস্থা দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের মন ভেঙে যাচ্ছে। এ অবস্থার মোকাবিলা তাকে করতেই হবে।

তিনি কাজে নেমে পড়েছেন। সঙ্গে রেখেছেন শম্ভুচন্দ্রকে। সে তাঁর বড়দাদার অনুগত সৈনিক। দাদার আদেশে পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে সত্বর কাজ শুরু করে দিয়েছে। এখান সেখান থেকে বিশাল বিশাল হাঁড়ি কড়াই জোগাড় করে এনেছে। দুজন পাচক, চারজন সহকারী কর্মী ভাড়ায় নিয়োগ করেছে।  দিনরাত এক করে রান্না করা খাবার পরিবেশন করছে মানুষগুলোকে। ক্ষুধার্ত, অন্নক্লিষ্ট মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ  দুমুঠো অন্ন পেয়ে আবার বাঁচবার আশা করছে। রোজ তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে। কবে কখন মেঘ জমে আকাশে। বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়ে জমা মেঘের কোল বেয়ে। কিন্তু হায়! বৃষ্টি কোথায়?

দেশজুড়ে এখন অনাবৃষ্টি চলছে। তাতে আবার বাংলায় তার প্রখরতা রয়েছে অত্যন্ত বেশি। বৈশাখ চলে গিয়েছিল। কালবৈশাখীর দেখা মেলেনি।  বৃষ্টি নেই-ই। জ্যৈষ্ঠেও একই অবস্থা। প্রকৃতি আরও কঠিন হয়েছে। আষাঢ় শ্রাবণ, বৃষ্টির মাস। তাও শুকনো গেছে। মাঠ ফুটিফাটার মতো চৌচির। কোথাও ফসলের দানা মাত্র উৎপাদন হয়নি। হাহাকার পড়ে গিয়েছিল চতুর্দিকে। তাতেই মানুষের এই দুরাবস্থা।

তারপর এক সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। মাটি ভিজল। রোষ কাটল প্রকৃতির। অসময় হলেও মানুষ চাষবাসে নামল। কিছু কিছু করে অন্নের সংস্থান হওয়া শুরু হল। তৃষার জল পেল। ঘর বাড়িতে ফিরতে শুরু করল।

প্রকৃতি বুঝি এভাবেই কালে কালে মানুষকে নাড়া দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। না হলে, মানুষ নিজ গর্বে বলীয়ান হয়ে ঈশ্বরকে ভুলতে বসে।

ঈশ্বরচন্দ্রও এবার বীরসিংহ গ্রাম ছাড়লেন। কলিকাতায় ফিরলেন। কাজে যোগ দিলেন।

কিন্তু একি! প্রকৃতির রোষ সামলে উঠলেন যিনি, তাঁকে পড়তে হল নিজ বিপদে! যে বিপদের কথা কল্পনাতেও আনা যায় না!

দুর্ঘটনার কালো হাত তাঁকে স্পর্শ করল। অবধারিত মৃত্যু। তবে জগতকর্তা ঈশ্বরের করুণায় তাঁর প্রাণ রক্ষা হল। রক্ষাকর্তা এল মানুষের বেশে। দুজন ইংরেজ পুরুষ এবং একজন ইংরেজ মহিলা। মিঃ এ্যটকিসন, মিঃ উড্রে এবং মিস মেরী কারপেন্টার। পুরুষ দুজন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারী। পদ, ডাইরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন, এবং স্কুল ইন্সপেক্টর। মেরী কারপেন্টার আসছেন ইংল্যান্ডের দক্ষিণপশ্চিমের শহর ব্রিষ্টল থেকে। ধর্মযাজক পিতার সন্তান তিনি। বাড়িতে দেখেছেন নানান জনের আনাগোনা। এদেশ ওদেশের মানুষদের। ছোটবেলায় দেখেছেন ভারতের রাজা রামমোহন রায়কে। তাঁর সাহচর্য পেয়েছেন । রামমোহন তাঁর বাবার বন্ধু। বাবা ধর্মযাজক। রামমোহন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে ইংল্যান্ডে এসে কারপেন্টার পরিবারের অতিথি হয়েছিলেন। মারাও যান সেখানে। মেরীর মনে দাগ কাটে সে ঘটনা। পরে উপযুক্ত বয়সে এসে কেশবচন্দ্র সেনের সংস্পর্শেও এসেছেন।  ভারতের দুই সমাজ সংস্কারকের সংস্পর্শ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতে আসতে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটাতে তাঁর আসা।

এদেশে এসে বিদ্যালয় বিদ্যালয়ে ঘুরছেন। বিশেষ করে বালিকা বিদ্যালয়গুলোতে। নারীশিক্ষার বিস্তারের লক্ষ্যে তাঁর কাজ। স্বেচ্ছা শ্রম দান করছেন। দেশের অন্যান্য শহর ঘুরে মেরী সদ্য পা রাখলেন কলিকাতায়। নিজের দেশে বসেই  ঈশ্বরচন্দ্রের নাম শুনেছিলেন। বিশেষ উৎসাহী হলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করবার। ইচ্ছে প্রকাশ করলেন মিঃ এ্যটকিনসননের কাছে।

এ্যটিকিনসন চিঠি দিলেন ঈশ্বরচন্দ্রকে,

প্রিয় পণ্ডিত,                                               ২৭ শে নভেম্বর ১৮৬৬

আশা করি, মিস কারপেন্টার নামের সঙ্গে আপনি পরিচিত আছেন। যিনি কিনা, আপানার সঙ্গেও পরিচিত হতে উৎসাহী এবং দেশে নারীশিক্ষার বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক। এজন্যে আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি কি আগামী বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটায় বেথুন ইশকুলে আসতে  পারবেন? আমি সেই সময় মিস কারপেন্টারকে সেখানে নিয়ে যাব এবং এই সাক্ষাৎ নিতান্তই সৌজন্যেমূলক হবে। আমার মনে হয় পরবর্তী কোনও এক সময়ে স্কুল কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসতে তিনি বিশেষ আনন্দিত হবেন। ওই সাক্ষাৎ মিঃ কারের কলিকাতায় ফিরে আসা পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

আপনার গুণগ্রাহী

ডবলু এস এ্যাটকিনসন

ঈশ্বরচন্দ্র  এলেন বেথুন কলেজে। মিস কারপেনটারকেও এ্যটকিনসন এনে হাজির করলেন। দুজনের সাক্ষাৎ হল। প্রথম সাক্ষাতেই একই পথের পথিক দুজনে দুজনের মন জয় করে নিলেন।

তিনি প্রস্তাব রাখলেন, কলিকাতার বিভিন্ন মহিলা ইশকুল পরিদর্শন করতে চান। সঙ্গে থাকবেন এ্যটকিনসন এবং উড্রে । ঈশ্বরচন্দ্রকেও তিনি বাদ রাখলেন না। ইংরেজ মহিলার এই এক বিশেষ গুণ,-গুণী কৃতকর্মাকে সঙ্গে রাখা। যেখানে যাচ্ছেন, তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন।

সেদিন গেলেন উত্তরপাড়া। হুগলী জেলার বর্ধিষ্ণু নগর। সেখানে বাবু বিজয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় স্থাপনা করেছেন এক মহিলা বিদ্যালয়। নামকরণ করেছেন, উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয়। উত্তরপাড়া রাজবাড়ির অনতিদূরে; গঙ্গার ধারে। মনোরম জায়গা। পড়াশোনার অনুকূল স্থান।  যথারীতি চারজনের পুরো দলই চলল ইশকুল পরিদর্শনে । বাহন ফিটন গাড়ি। পৌঁছলেন। ফিটন থেকে নেমে বড় গেট পেরিয়ে ইশকুলে প্রবেশ করলেন।

ইশকুলের অবস্থান একটি তিনতলা বাড়িতে। সেখানে সতেরোখানা ঘর রয়েছে। ছোটবড় মিলিয়ে। বড় ঘরগুলো সব ক্লাসরুম। কয়েক সারি বেঞ্চ পাতা। প্রতি বেঞ্চে তিনজন করে মেয়ে বসে। সব অল্প বয়সী মেয়ে। ক্লাসে মোট আঠারজন পড়ুয়া।

তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাস। মিস কারপেন্টর রুমে গিয়ে ঢুকলেন। অন্য তিনজন তাঁকে অনুসরণ করছেন। পরিদর্শক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন মেয়েদের। গরীব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা। তাদের পোশাক আষাকই তা বলে দিচ্ছে। তবে জামা কাপড় বেশ পরিষ্কার। মাথার চুলে চিরুনি বোলানো।

সামনের বেঞ্চে বইয়ের ব্যাগ রেখে বসে রয়েছে মেয়েরা। মিস কারপেনন্টর ঘরে ঢুকতে একদফা নমস্কার জানিয়েছে তারা। দুহাত জোড় করে বুকের কাছে এনে তা করেছে। খুশি হয়েছেন পরিদর্শকেরা।

এক এক করে নাম জিজ্ঞেস করলেন। নাম বলল সকলে। এবার পড়ার বিশয়ে দুচার কথা জিজ্ঞেস করবেন। পূর্বেই একজনের কাছ থেকে ইংরেজি আর অঙ্কের পাঠ্যবই চেয়ে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। মিস কারপেন্টর তাঁকেই অনুমতি করলেন, কয়েকটা প্রশ্ন করবার জন্যে। তিনি করলেন। মেয়েরা উত্তর দিল। সকলে অবশ্য সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তাতে কিছু নয়। তবে মেয়েরা সপ্রতিভ। সঠিক উত্তর দেবার চেষ্টা করেছে।

ক্লাসরুম ছেড়ে বেরিয়ে অন্যান্য রুমে ঢুকেও একই কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করে ছাত্রীদের পড়ার প্রস্তুতি সম্বন্ধে সম্যক একটা ধরনা নিয়ে নিলেন।

ইশকুলের পরিবেশ, শিক্ষাদানের পদ্ধতি সম্বন্ধে ধারণা হল। যা কিনা সন্তুষ্টি দিল সকলকে। এভাবেই ইশকুল পরিদর্শন শেষ হল।

এবার ফেরবার পালা। একই গাড়িতে সকলে উঠতে যাচ্ছেন। হঠাৎ এক সহৃদয় ব্যক্তি ঈশ্বরচন্দ্রকে অনুরোধ করল, বিদ্যাসাগর মশাই, আপনি বরং আমার গাড়িতে আসুন।

বগী গাড়ি। এক ঘোড়ায় টানা। ভদ্রলোক একলা। চালক নিজেই।

ঈশ্বরচন্দ্র ইতস্তত করছেন। দাঁড়িয়ে পড়েছেন। ভদ্রলোক জোরাজুরি করতে শুরু করল। বলল, আপনার মতো কীর্তিমান ব্যক্তি আমার গাড়িতে চাপলে গাড়ি আমার ধন্য হবে।

ঈষৎ হাসলেন ঈশ্বরচন্দ্র। রাজি হয়ে গেলেন। তবে গাড়িতে চড়বার সময় বললেন, বাপু, আমি কখনও বগী গাড়ি চড়িনি । জোরে গাড়ি হাঁকিও না। একটু সাবধানে চালাবে।

-অবশ্যই । আপনি নিশ্চিত থাকুন। ঘোড়া আমার কথা শোনে।

-হা, হা। ঘোড়াও কথা শোনে…

ঈশ্বরচন্দ্র হাসতে হাসতে গাড়িতে উঠলেন। চালকের পাশে বসলেন। ভদ্রলোক লাগামে টান মারল। ঘোড়া নড়েচড়ে উঠল। গাড়ি চলতে শুরু করল। সাহেবদের ফিটন গাড়ি আগে আগে । পিছনে বগী গাড়ি। টগবগ টগবগ ঘোড়া দৌড়চ্ছে। গাড়িও হেলতে দুলতে ছুটছে। পথের দুদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছেন ঈশ্বরচন্দ্র। গঙ্গার ধার দিয়ে পথ। উঁচু উঁচু  গাছের সারি। গঙ্গার হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। খোশ মেজাজেই রয়েছেন দুজনে।

উত্তরপাড়ার সীমানা শেষ হল। এল বালি । গঙ্গা তখন কিছুটা দূরে সরে গেছে। গাড়ি পথ অতিক্রম করছে। সামনেই পথ বাঁক নিয়েছে । ফিটন গতি কমিয়ে পথের বাঁক পেরোলো। কিন্তু বগী গাড়ি চলল তার পূর্ব গতিতে।

আর যায় কোথায়? বাঁকে বগিগাড়ি নিজের ভারসাম্য হারিয়ে আরোহী শুদ্ধু উল্টিয়ে পড়ল। ঘোড়াও পড়ল মুখ থুবড়ে। ঈশ্বরচন্দ্র আর চালক ছিটকে গিয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। তাদের প্রায় মাথার সামনে শায়িত ঘোড়ার অবস্থান। মাটিতে পড়ে সে বেচারা পিছনের পা দুটো ভীষণ ভাবে ছিটকচ্ছে; মাটি ছেড়ে ওঠাবার জন্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।  যে কোনও মুহূর্তে লোহার নালশুদ্ধু ঘোড়ার লাথি ঈশ্বরচন্দ্রের মাথায় আঘাত হানতে প্রস্তুত ।

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page