বসন্তের স্মৃতি।। দ্বৈপায়ন মজুমদার
সকাল থেকেই ঠিক করা থাকে প্ল্যান । আবির, রঙবেলুন ছাড়াও বসন্তের দিনে আরও একটা জিনিসের রুটম্যাপ তৈরি থাকে মফস্বলে । রঙ মাখার সঙ্গে বিভিন্ন বাড়ি থেকে দেওয়া মিষ্টি, নিমকি ইত্যাদিকে পাকস্থলীর পোস্টবক্সে পাঠিয়ে দেওয়া একটা রীতি । স্যারদের বাড়িতে সকাল থেকেই তাই ছাত্রদের আনাগোনা । হারুর ইনিংস শুরু করত সকালেই ।
একদম প্রথম সারির টার্গেট সমর স্যারের বাড়ি । সাধারণত স্যারদের বাড়িতে সহপাঠীদের সঙ্গে দল বেঁধে যাওয়া নিয়ম । কিন্তু হারু এত অপেক্ষা করতে রাজি না । বলা তো যায় না কখন কোন বাড়িতে মিষ্টির ভাঁড়ার শেষ হয়ে যায় । তাছাড়া সমর স্যারের বাড়ি যেতে বন্ধুর দলের প্রয়োজন নেই। স্যারের ছেলে মিন্টু ওরই সহপাঠী । তাই চেনা বামুনের পৈত্যে লাগে না । তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল । স্যারের পাড়ার দোকানের গরম রসগোল্লা বিখ্যাত । সকাল সকাল স্যার কিনে রাখতেন । সঙ্গে উপরি বাড়িতে তৈরি ঘুগনি । ইনিংস শুরুতো এমন ভাবেই হওয়া উচিত ।
সবকিছুই ঠিক চলছিল । প্রথমে স্যারের পায়ে আবির, তারপর স্যারের হাতের আবির নিজের কপালে, আর তারপর সেই ইঙ্গিত । মিন্টুকে ঘরের ভিতর থেকে প্লেট আনার ইশারা । মিন্টু খুব ভালো করে চেনে হারুর খিদে । ক্লাসের সবাই মজা করে বলে হারুর পাকস্থলীতে নাকি ইডেনের পুরো মাঠ ঢুকে যেতে পারে । একটা গোটা খাসি হারুর পেটের ভিতর খুব সহজে হাডুডু খেলতে পারে । সব জেনেও প্লেটে ছিল মাত্র দু’টো রসগোল্লা । ওটা শেষ করতে হারুর কয়েক সেকেন্ড লাগে । কিন্তু মিন্টুর হাতে নেই ঘুগনি । কী হলো কেসটা ? মিন্টু হারুর হাতে জলের গ্লাস ধরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল । অসহায় হারু ঢকঢক করে জল পেটে ঢেলে মিন্টুর যাত্রাপথের দিকে চেয়ে থাকে । নাহ, এবার মনে হয় ঘুগনি নেই ।
দেরি করা ঠিক না, আরও অনেক স্টেশন বাকি । অন্য বন্ধুরাও আসবে, সাইকেলের প্যাডেলে পা রাখে হারু । একের পর এক বন্ধুর সঙ্গে রঙ বিনিময় আর বিভিন্ন স্যারের বাড়িতে নিমকি, সন্দেশ, কালোজাম খেতে খেতে দুপুর । এখন আর ওদেরকে চেনা যাচ্ছে না । রঙে সবাইকে প্রায় এক দেখাচ্ছে । একদম শেষে যোগ দিল রাজা । রাজা পড়াশোনা করা ছেলে, প্রতিবার শেষে বেরোয় । বেশিরভাগ স্যারের বাড়ি একা একা যায়, স্যারদের খুব পছন্দের । যদিও হারু মনে করে এগুলো বেশি নম্বর পাওয়ার ছক । দু’টো রসগোল্লা দিলে রাজা ন্যাকামো করে একটা খায় । সমর স্যারের প্রিয় ছাত্র । হারু জিজ্ঞেস করে, “সমর স্যারের বাড়িতে এবার ঘুগনি দিল না কেন রে?” সকালের ঘুগনির কষ্ট এখনও ভোলেনি হারু ।
“কে বলল করেনি? আমি তো এক প্লেট খাওয়ার পর স্যার জেঠিমাকে আরও দিতে বললেন । আমি অবশ্য না বললাম”, উত্তর দেয় রাজা । এতক্ষণের রঙ খেলা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে রসগোল্লা, সন্দেশ, নিমকি সব কিছুকেই অর্থহীন মনে হয় হারুর । এত বড় মিস, এটা নিশ্চয় মিন্টুর কারসাজি । স্কুলের ফুটবল মাঠে ল্যাঙ মেরেছিল, তার বদলা নিল আজ ।
হারুদের দলে তখনও কয়েকজনের সমর স্যারের বাড়ি যাওয়া বাকি । তারা স্যারের বাড়ির দিকে বেরোতেই হারু সেই দলে ঢুকে গেল । সবাই মানা করল, দু’বার যাওয়া ঠিক না । ঘুগনির টানে সেসব হারুর মাথায় ঢোকে না । বলে যা রঙ মেখেছি চিনতেই পারা যাবে না আমাদের ।
ঠিক তাই, সমর স্যারের গায়েও তখন আবিরের হরেক রঙ । স্যারের বন্ধুরা লাগিয়েছে হয়ত । দুপুর হয়ে গেছে, তাই জলদি আবির দেওয়া নেওয়া সেরে স্যার মিন্টুর হাত দিয়ে মিষ্টি আর ঘুগনি পাঠালেন । সেই মিন্টু, একটু টেনশন হয় হারুর । কিন্তু মিন্টু সবার হাতেই ঘুগনি আর মিষ্টি ধরালো । সবার খাওয়া প্রায় শেষ, প্লেটগুলো নামিয়ে রাখতেই মিন্টুর মুখোমুখি হারু । মিন্টু হারুর দিকে তাকিয়েই কিছু বলতে গেল ।
জলের গ্লাস হাতে না তুলেই সাইকেলের প্যাডেলে পা দিল হারু । মিন্টু কিছু একটা বলল, শুনতে পেল না । প্রায় হাওয়ার গতিতে সাইকেল চালিয়ে যখন বসাকদের মাঠে পৌঁছল তখনও মনে হচ্ছে মিন্টু পিছনে ডাকছে । অনেক শিক্ষা হয়েছে, এরপর ফুটবল মাঠে কাউকে পায়ে পায়ে জড়িয়ে ফেলবে না । ভর দুপুরে শপথ নেয় ঘুগনি প্রেমী হারু । পরের বসন্তে ঘুগনি নিশ্চিত করতে এই স্যাক্রিফাইস করতেই হবে ।