টোকিও ডায়েরি।। প্রবীর বিকাশ সরকার

তৃতীয়পক্ষ ওয়েব- ফেসবুকে লিখিত আমার বিভিন্ন লেখায় লাইক বা মন্তব্য দেখা যায় খুবই কম। এর একাধিক কারণ হতে পারে, এক. আমি ফেসবুক তারকা নই। দুই. বিখ্যাত কোনো লেখক নই। তিন. বিতর্কিত বিষয় নিয়ে আমি লেখালেখি করি না, ইত্যাদি।

তবে, আমার লেখা যারাই পড়েন, পড়ে মন্তব্য করেন, মতামত জানান এবং ইনবক্সে সাড়া দেন (প্রকাশ্যে মন্তব্য বা মতামত জানাতে চান না) তারা যে মনোযোগসহকারে পড়েন তাতে সন্দেহ নেই। এবং আমি বরাবরই অল্পেতে খুশি। তবে তরুণকালের মতো এখনো সমান উচ্চাবিলাসী।

এই সিরিজের প্রথম পর্বে লিখেছিলাম যে, “১৯৯৫ সালে মানচিত্র ট্যাবলয়েড থেকে ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হয়”, সেটা ঠিকই আছে, কারণ তখন থেকে রেগুলার ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার আগে অন্ততপক্ষে ৩টি সংখ্যা মানচিত্র A-4 সাইজের ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশ করেছিলাম। এই তথ্যটি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম! গতকাল গত দুই পর্ব পাঠ করে আমার এক বন্ধু ফোন করে স্মরণ করিয়ে দিল যে, মানচিত্র ট্যাবলয়েড থাকাকালেই কমপক্ষে ৩টি সংখ্যা ম্যাগাজিন আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। তাজ্জব ব্যাপার! আমি সম্পাদক, ডিজাইনার অথচ আমার একদম স্মরণে নেই! স্মরণে আছে “মানচিত্র”র একনিষ্ঠ পাঠক আনিসুর রহমানের! যে ইয়ামানাশি-প্রিফেকচারে বসবাস করে বহু বছর ধরে।

আমি বললাম, “বন্ধু, অনেক সংখ্যাই আমার সংগ্রহে নেই। থাকলেও হারিয়ে গেছে কীভাবে জানি না। তোমার সংগ্রহে থাকলে সেগুলো আমাকে দাও, সংগ্রহে রাখি। কৃতজ্ঞ থাকব।” আনিস সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হল। জানালো দ্রুতই পাঠিয়ে দেবে। তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানালাম।

আজকে সকালবেলা কুরিয়ার মারফত হাতে পেলাম। ৩টি সংখ্যাই হাতে পেয়ে সত্যি আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি! এরকম ৩টি সংখ্যা তাহলে প্রকাশ করেছিলাম ! ৩টিই জাপানে ছাপা। যথাক্রমে ১৯৯২, ১৯৯৩ এবং ১৯৯৪ সালে। ১৯৯২ এর সংখ্যাটির কিছু পৃষ্ঠা তুলে দিলাম। ৩২ পৃষ্ঠা, সাদা পাতলা ম্যাট পেপারে ছাপা। প্রচ্ছদ থেকে ইনার সব আমারই ডিজাইন ও লেআউট করা। নিজে করলে যে তৃপ্তি পাওয়া যায় তা তুলনাহীন। সত্যি ভীষণ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। আজ থেকে ২৯ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স ৩৩। আমার উচ্চবিলাসী “স্বপ্নে”র প্রমাণ। বিদেশে বাঙালি আসে সাধারণত টাকা কামানোর জন্য, আমি এসেছি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য, বিভিন্ন চ্যালেন্জকে জয় করার জন্য। এই না হলে বাঙালি!

তবে অবাক লাগছে একটি বিষয়ে যে, প্রায় ৩০ বছর আগের বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক যে সমস্যা—সেগুলোর আজও সমাধান হয়নি! তাহলে আমরা কোন-কোন ক্ষেত্রে উন্নত হলাম? এই স্পর্শকাতর সমস্যা ও সঙ্কটগুলোর যদি যথার্থ সমাধান না হয়, তাহলে কি বর্তমান উন্নয়ন ভিত্তিহীন বা ভাসমান? উন্নয়নের ধারা চলমান থাকবে নাকি ভবিষ্যতে ধসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে?

০৪

বন্ধু আনিসুর রহমানের পাঠানো “মানচিত্র”র এই দুর্লভ সংখ্যাটি আমার স্মরণের মধ্যেই নেই! ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত এই সংখ্যাটি সম্ভবত একটি পরীক্ষামূলক সংখ্যা ছিল। ৩২ পৃষ্ঠার ম্যাগাজিনটি নিয়ে লেআউট, ছাপা ও কাগজ নিয়ে নতুন একটি মাত্রা দিতে চেয়েছিলাম মনে হচ্ছে। যেমন প্রচ্ছদ দুরঙা, ভেতরে নতুন রূপসজ্জা বাংলা ভাষার ম্যাগাজিনে তখন ছিল না বলাই বাহুল্য। আর ছাপা হয়েছিল অফসেট মেশিনে নয়, ডাইরেক্ট প্রিন্ট-এ। এই পদ্ধতিটি তখন খুব চলছিল। এতে ব্যয় কম এবং ছাপার সময় কম হয়। দ্রুত ছাপিয়ে ফেলা যায়।

এই পদ্ধতিতে মেটার তৈরি করতে হয় ভিন্নভাবে। পেইজ মেকারে লেখা সাজিয়ে সেটা আউট লাইন প্রিন্টারের সাহায্যে প্রিন্ট আউট নিয়ে ডিজাইন শিটে আঠা দিয়ে সেঁটে দেয়া হত শুধু ছবি ও গ্রাফস এর জায়গা খালি রেখে। তারপর ছবি ও গ্রাফসগুলোর ফটো তুলে সাইজ অনুযায়ী বিশেষ ফটোগ্রাফিক কাগজে প্রিন্ট করে কেটে নির্দেশিত জায়গায় সেঁটে দিতে হত। এরপর A-4 দুটি পৃষ্ঠা বা পাতা পাশাপাশি রেখে জেরেক্স কপিয়ার মেশিনের মতো একটি বিশেষ প্রিন্টারের মাধ্যমে হালকা বেগুনি রঙের মোটা “পেপার প্লেইট” তৈরি কেরে নিতে হত। সেই পেপার প্লেইটটি A-3 সাইজের প্রিন্টিং মেশিনের রোলারে পেঁচিয়ে রং নিয়ন্ত্রণ করে ছাপা হত। তবে বড় অক্ষরগুলো অনেকটা স্পষ্ট হলেও ছোট অক্ষরগুলোর লাইন বা রেখা চিকন হত না।

ডাইরেক্ট প্রিন্ট পদ্ধতিতে বাইকালারও করা যেত। প্রচ্ছদটাই এর প্রমাণ। অর্থাৎ, অফসেট সিস্টেমের মতো দুটি প্লেইট করতে হত। মুদ্রণ কারিগররা এত দক্ষ ছিল যে, রং মেলানো বা রেজিস্ট্রেশন মেলানো কোনো ব্যাপারই ছিল না! সামনে থেকে ছাপা দেখেছিলাম যতখানি মনে পড়ে। ছাপাখানাটি ছিল তাবাতা শহরে, যেখানে “মিয়াজাকি সেইহোন” বা “মিয়াজাকি বুক বাইনডিং কোম্পানি” নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যার প্রায় সব কর্মচারীই ছিলেন বাংলাদেশি তরুণ। বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান এবং “মানচিত্র” কাগজের একটি আড্ডাস্থল ছিল এই প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েক বছরের জন্য।

“মানচিত্র” ছিল আমার একটি ব্যয়বহুল প্রকল্প। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পকে কেন্দ্র করে একটি বিলাসী স্বপ্ন। প্রায় ১২ বছর কাগজটি প্রকাশ করলেও নানা কারণে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি, যদিও তিনটি সন্তুষ্টি আমার রয়েছে, ১. আধুনিক প্রকাশনায় “মানচিত্র” ইতিহাস সৃৃষ্টি করতে পেরেছে, ২. বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পেরেছে, এবং ৩. বাংলাদেশের তৎকালীন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গবেষকদের প্রচুর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এটাই বা কম কীসে?

প্রথম থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল, “মানচিত্র”কে বাংলাদেশের প্রচলিত পত্রপত্রিকার কপি-পেস্ট জাতীয় কাগজ না করা। সব তথ্য, সংবাদ, ফিচার, সাহিত্য রচনা, সাক্ষাৎকার, আলোচনা ও অভিমত সবই নিজস্ব হতে হবে, অর্থাৎ, স্বকীয়তা থাকতে হবে। তখন অন্যান্য দেশেও বেশ কিছু সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ও ম্যাগাজিন প্রকাশিত হত যার অধিকাংশ ছিল বাংলাদেশের পত্রিকার সংবাদ ও লেখা কপি-পেস্ট করে ছাপানো কাগজ।

তবে জাপানি এবং আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিন থেকে ভালো ফিচার ও সাক্ষাৎকার “মানচিত্রে” বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে তাও কদাচিৎ। বরং “মানচিত্র” থেকে একাধিক সংবাদ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। আর স্বকীয়তার জন্যই প্রচুর সম্মানী প্রদান করা হত ।

 

আরেকটি ইচ্ছে ছিল, বাংলাদেশকে স্বল্প পরিসরে হলেও জাপানিদের কাছে তুলে ধরা। বাংলাদেশের তখন এত বাজে ভাবমূর্তি জাপানে যা লজ্জায়, ক্ষোভে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মাথা নত করে থাকতে হত। এই ইমেজ ভাঙার জন্য ছিল না সরকারের কোনো চেষ্টা, না ছিল দূতাবাসের কোনো পরিকল্পনা! আজ পুরনো “মানচিত্র”র সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু জাতীয় সমস্যা ও সঙ্কটগুলো এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। যা পীড়াদায়ক। তবে বাংলাদেশ আশাব্যন্জক হয়ে উঠেছে এটাও সত্য।

 

শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page