টোকিও ডায়েরি।। প্রবীর বিকাশ সরকার

তৃতীয়পক্ষ ওয়েব- ঢাকা থেকে মুদ্রিত “মানচিত্র”র এটা ছিল ৪র্থ সংখ্যা। ১৯৯৫ সালের মে সংখ্যা। এই সংখ্যা থেকে “মানচিত্রে” নতুন মুখও কয়েকজন এসেছে। সবাই তরুণ। অফুরন্ত প্রাণরসে ও উদ্দীপনায় বেগমান, টুইটুম্বুর। এখন তাদেরকে যথার্থভাবে কাজে লাগানোই সম্পাদক হিসেবে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল আমার।
তখন ছিল না মোবাইল, না ছিল ইন্টারনেট। একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ল্যান্ড ফোন এবং ফ্যাক্স। যা ছিল খুবই ব্যয়বহুল। অধিকাংশ লেখাই আসত ঢাকা থেকে, সংগ্রহের দায়িত্বে মঞ্জুরুল আজিম পলাশ ও সাইফুল্লাহ্ মাহমুদ দুলাল। তবে বেশি লেখা দুলালের মাধ্যমেই সংগৃহীত হত। ডাকযোগে তো আসতই, জরুরি লেখার আদানপ্রদান চলত ফ্যাক্সে।
টোকিওর জীবনযাপন এত ব্যস্ত যে কীভাবে সময় বয়ে যেত টেরই পাওয়া যেত না, এখনো তাই। ঢাকা থেকে “মানচিত্র” ছাপা হয়ে এলেও আমার ব্যস্ততা কমেনি। লেখাগুলো পড়া ও সম্পাদনা করার জন্যও সময় দরকার ছিল। ট্রেনের মধ্যে, কাজের ফাঁকে লেখা পড়তে হত। তাছাড়া, নিজেকেও কিছু না কিছু লেখা লিখতে তো হতই। সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক ডিজাইন, লেআউটের কাজও ছিল বাধ্যতামূলক।
টেলিফোনে নির্দেশনা দিতাম ঢাকার সহযোগীদেরকে। দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্পাদনার কাজ শেষ করতেই হত। তারপর প্রসেস, প্রিপ্রেস ও ছাপা মিলিয়ে ৭ দিন, জাপানে আসতে আসতে ৩-৪দিন। এভাবে মাসের শেষদিকে বা ডেড লাইন পার হওয়ার পর কাগজ আসত। লাগাতার হরতালের কারণেও বিমান মিস হয়েছে। টোকিওসহ অন্যান্য প্রদেশে ও বিদেশে পাঠাতেও সময় লাগত। মোদ্দাকথা, পুরো মাসই ব্যস্ততায় ব্যস্ততায় চলে যেত। সত্যিকথা বলতে কোনো অবসরই ছিল না।
তথাপি, কিছু না কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে যেত। কিন্তু সংখ্যাগুলো যে স্বকীয়তায় এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ লেখায় সাজানো ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাস্টার পজিটিভে ছাপা হওয়ার ফলে ছাপাও ছিল অনেকটাই ঝকঝকে, তখনকার বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মোটামুটি মনোগ্রাহী বলা চলে। তবুও আমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না নিখুঁত করার জন্য।
এই সংখ্যার বিষয়াদি বিদেশি তথ্যভিত্তিক ম্যাগাজিনের চেয়ে কম কিছু ছিল না। মূল্যবান ফিচার, প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার পাঠকের গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সহকর্মী সকলের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ছিল বলেই “মানচিত্র” ক্রমশ সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়েছিল। অনেক লেখকও তৈরি হয়েছিল এই কাগজ থেকেই। নতুন এক গতি পেয়েছিলাম আমি নিজেও।
“মানচিত্র”কে ঘিরে কঠোর পরিশ্রম আমার স্বপ্নকে কেবলি গভীর থেকে গভীর করে চলেছিল। বাংলাদেশকে নিয়ে আশা-প্রত্যাশা নতুন এক সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল আমার মধ্যে। ব্যাপক সাড়াও ফেলেছিল বাংলাদেশে কাগজটি। অনেক দুঃসাহসী ফিচার ও লেখাও তখন ছাপা হয়েছিল “মানচিত্রে” যা এখন সম্ভব হত বলে মনে হয় না।
সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিনকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে পরিবেশ, সহিষ্ণুতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে “মানচিত্র” ছিল এর প্রকৃত উদাহরণ, কারণ জাপানের কাগজ ছিল বলে। এজন্য জাপানকে জানাই অজস্র ধন্যবাদ ও কুর্ণিশ। বাংলাদেশে মুক্ত মতামতভিত্তিক সংবাদপত্র এবং স্বাধীন-সৃজনশীল ম্যাগাজিন প্রকাশ করা ক্রমশ দূরহ হয়ে পড়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
১০
১৯৯৫ সালের জুলাই সংখ্যা এটা। কিন্তু জুন সংখ্যাটি নেই! তাহলে প্রকাশিত হয়নি, নাকি সংগ্রহে নেই জানি না। ব্যস্ততার কারণে হয়ত বেরই করতে পারিনি।
যে যাক। এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ ছিল দুটি বিষয়। এক হচ্ছে, জাপানের ODA এবং টোকিওর দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন।
জাপানের অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিসটেন্স যাকে ODA বলা হয়ে থাকে সংক্ষেপে তার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। সেই বছর ৪০ বছর পূর্তি ছিল। জাপানে অর্থসাহায্য ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা পেয়ে আজকের চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার, ফিলিপিন্স, নেপাল এবং আজকের বাংলাদেশে কী পরিমাণ সমৃদ্ধ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু এশিয়াতেই নয়, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ জাপানের লাগাতার অর্থসাহায্য পেয়ে আসছে এখনো।
জানা যায় যে, বিতর্কিত টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান দ্বারা যেসকল দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষতিপূরণস্বরূপ একটি শর্ত ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। জার্মানিকেও অনুরূপ শর্ত দেয়া হয়েছিল, কিন্তু জাপান যেভাবে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ছাড়াও অনেক দরিদ্র, উন্নয়নকামী দেশকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে, জার্মানি তার প্রতীজ্ঞা রক্ষা করেনি বলে কথিত আছে।
এই যে এত সাহায্য জাপান দিয়েছে সামান্য ধন্যবাদও কি কোনো দেশ দিয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে, আমাদের জানা নেই। যাহোক, ODA এর ওপর একটি তথ্যবহুল প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম, লিখেছিলেন সেইসময়কার বিশিষ্ট অর্থনীতি বিষয়ক লেখক ও গবেষক বিরূপাক্ষ পাল।
জিয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন অভিযুক্ত দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে পরিচিত মেজর (অবঃ) মঈন। কানাডা থেকে কবি, লেখক ইকবাল হাসান সাক্ষাৎকারটি পাঠিয়েছিলেন। বেশ আলোড়ন তুলেছিল এটা পাঠকমহলে।
অর্থনীতি নিয়ে লিখেছিলেন মূল্যবান নিবন্ধ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড.আতিয়ার রহমান।
গুরুত্বপূর্ণ সুদীর্ঘ (৪ পৃষ্ঠা) একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী স্যারের। তাতে অনেক অমূল্য তথ্য বিধৃত আছে।
ধারাবাহিক গবেষণাপ্রবন্ধ “বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি” “মানচিত্র” কাগজের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিল সন্দেহাতীতভাবে। ধন্যবাদ জানাই আনোয়ার স্যারকে।
পরিবেশ নিয়ে ছিল দুটি বিশেষ ফিচার। রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও শিশুসাহিত্যিক মোস্তফা হোসাইন।
শিল্প-সংস্কৃতি বিভাগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী নানা সমস্যা নিয়ে খোলামেলা মতামত রেখেছেন। এটা একটা অমূল্য সম্পদ সমকালীন সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আকর বলে মনে করি।
নিয়মিত বিভাগগুলোর মধ্যে টোকিও তথা জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশির জীবন ও কর্মকাণ্ড চলমান ইতিহাসেরই অংশ বলে আজ বিবেচিত। স্মৃতিকাতর করে তুলবে অনেককেই।
সম্ভবত, এটাই ছিল জাপানে প্রথম আন্তর্জাতিক সাহিত্য বিনিময় সমাবেশের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ। উদ্যোগী ছিলেন জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক এবং বাংলার ভাষার পণ্ডিত অধ্যাপক কাজুও আজুমা। আজুমা স্যারের অনুরোধে “মানচিত্র”র পক্ষ থেকে আমরা কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা রেখেছিলাম। সম্মেলনের সংবাদ ও আগত অতিথি সাহিত্যিকদের পঠিত মূল প্রবন্ধগুলো “মানচিত্র” কাগজে প্রকাশ করতে পেরে ধন্য মনে করছি। ইতিহাস হয়ে রইল।
কিংবদন্তিতুল্য কবি সাবদার সিদ্দিকীর নাম নাম আমরা তরুণকালে বহুবার শুনেছি। এখন তিনি বিস্মৃতই বলা চলে। তাঁর মৃত্যু নিয়ে একটি মর্মস্পর্শী ফিচার লিখেছিল কবি ও অনুবাদক খায়রুল আলম লিটু।
নব্বই এর দিকে হঠাৎ করেই জেগে উঠছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত ভিয়েতনাম। কীভাবে জেগে উঠল ধ্বংসস্তুপ থেকে তারই তথ্যবহূল নিবন্ধ লিখেছিল লিটু।
ওয়ার ক্রাইমস ফাইল নিয়ে একটি অমূল্য গবেষণামূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন ছাত্রনেতা কামাল পাশা চৌধুরী। যা “মানচিত্র”কে আলাদা মাত্রা দিয়েছে।
এই সংখ্যায় সাহিত্য বিষয়ক প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার থাকার কারণে গল্প ছিল না, তবে কবিতা ছিল। আরও ছিল জাপানি ভাষায় নিবন্ধ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপানি অনুবাদ।
শেয়ার করতে:

You cannot copy content of this page